ঋগ্বেদ ০৯।০৮৬

ঋগ্বেদ ০৯।০৮৬
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ৯ম মণ্ডল সূক্ত ৮৬
পবমান সোম দেবতা। প্রথম ১০ ঋক আকৃষ্ট ও মাষ নামে ঋষিগণ; দ্বিতীয় ১০ ঋক সিকতা ও ষনীবাবরী নামক ঋষিগণ; তৃতীয় ১০ ঋক পৃস্নি ও ইতিজ নামক ঋষিগণ; চতুর্থ ১০ ঋক আকৃষ্ট ও মাষ নামক ঋষিগণ; তদনন্তর ৫ ঋক অত্রি ঋষি; তদনন্তর ৩ ঋক গৃৎসমদ ঋষি।

১। হে ক্ষরণশীল সোম! তোমার রসগুলি বিস্তার হইতেছে, ইহারা মানসবেগে অগ্রসর হইতেছে, ইহারা আনন্দকর, ইহারা শীঘ্রগামিনী ঘোটকী শাবকের ন্যায় অবলীলাক্রমে ধাবিত হইতেছে। ইহারা পক্ষীর ন্যায় আকাশ হইতে পতিত হইতেছে। মধুর রসশালী অতি চমৎকার মাদকাশক্তিসম্পন্ন এই সোমরসগুলি কলসটাকে পরিপূর্ণ করিয়া উপবেশন করিতেছে।

২। মাদকাশক্তি মধুরতাসম্পন্ন তোমার রসগুলি রথবাহ ঘোটকদিগের ন্যায় পৃথক পৃথক প্রস্তুত হইতেছে। মধুপূর্ণ ও পূর্ণপ্রবাহে প্রবহমান এই সকল সোমরস বজ্রধারী ইন্দ্রকে সেইরূপ আপ্যায়িত করিতেছে, যেরূপ গাভীআপন বৎসকে আপ্যায়িত করে।

৩। ঘোটককে চালাইয়া দিলে সে যেরূপ যুদ্ধ অভিমুখে ধাবিত হয়, হে সোম! তদ্রূপ দ্রুত বেগে তুমি আইস। তুমি স্বর্গীয় বস্তু তুল্য, তুমি প্রস্তর নির্মিত কলসে আকাশ হইতে প্রবেশ কর। উচ্চস্থানস্থিত মেষলোমময়পবিত্রের উপর এই সোম ইন্দ্রের পানের জন্য ক্ষরিত হইতেছে(১)।

৪। হে সোম! চতুর্দিগব্যাপিনী তোমার ধারাগুলি মানসবেগে শূন্য পথ দিয়া কলসের মধ্যে যাইয়া দুগ্ধের সহিত মিশ্রিত হইতেছে। যে সমস্ত ঋষি তোমাকে প্রস্তুত ও শোধন করেন, তাহারা তোমার ধারাগুলি কলসের মধ্যে প্রবিষ্ট করাইয়া দিতেছেন, যেহেতু ঋষিগণের সেবর্নীয় বস্তু।

৫। হে সোম! তুমি সর্বদ্রষ্টা। তুমি প্রভু। তোমার চমৎকার কিরণপুঞ্জ সৰ্বস্থানে গতিবিধি করে। তুমি বিশ্বজগতের পতি, সর্বস্থানব্যাপী, সর্ববস্তুর অবলম্বনস্বরূপ। এইরূপে তুমি ক্ষরিত হও।

৬। যখন সোম নিষ্পীড়িত হয়েন, তখন তিনি নিজে একস্থানবর্তী, সুস্থির, কিন্তু তাহার কিরণপুঞ্জ চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। যখন তিনি হরিতবর্ণ ধারণ পূর্বক মেষলোমময় পবিত্রে শোধিত হয়েন, তখন তিনিও উপবেশনকর্তা হইয়া নিজ বাসস্থান কলসের মধ্যে উপবেশন করেন।

৭। সোমরস যজ্ঞের ধ্বজাস্বরূপ, তিনি যজ্ঞের শোভাবিধাতা; তিনি দেবতাদিগের গৃহে গমন করেন। তিনি সহস্রধারারূপে কলসের মধ্যে যাইয়া থাকেন, তিনি রস সেচন করিতে করিতে সশব্দে মেষলোমময় পবিত্র অতিক্রম করেন।

৮। তিনি রাজা, নদী হইতে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইতেছেন। তিনি নদী মধ্যে ছিলেন জলের তরঙ্গে মিলিত হইতেছেন (২)। তিনি ক্ষরণকালে উচ্চস্থানস্থিত মেষলোমময় পবিত্রে আরোহণ করিতেছেন। তিনি পৃথিবীর ধারণকর্তা নাভিস্বরূপ, তিনি আকাশের আলোকস্বরূপ।

৯। সোম এরূপ শব্দ করিলেন, যে গগনের উর্ধভাগ প্রতিধ্বনিত হইল। তাহার অবলম্বনে লোক ও ভূলোক সুস্থির আছে। তিনি ইন্দ্রের বন্ধুত্বের অনুরোধে ক্ষরিত হইতেছেন। তিনি ক্ষরিত হইয়া কলসের মধ্যে গিয়াবসিতেছেন।

১০। এই সোম যজ্ঞের ঔজ্জল্যসম্পাদক আলোকস্বরূপ, ইনি সুমিষ্ট মধুর ন্যায় ক্ষরিত হইতেছেন। ইনি দেবতাদিগের জন্মদাতা পিতা, ধনের অধিপতি। ইনি বিবিধ অপ্রত্যক্ষ রত্ন দ্যুলোক ও ভূলোকে বিতরণ করেন। ইনি ইন্দ্রের পানোপযোগী অতি চমৎকার রস,ইহার মাদকতাশক্তি নিরুপম।

১১। ইনি সবেগে, সশব্দে কলসে যাইতেছেন। ইনি দ্যুলোকের অধিপতি, সর্বদ্রষ্টা; ইহার ধারা শতসংখ্যক। ইনি হরিতবর্ণ ধারণ করিয়া যজ্ঞের স্থানে স্থানে বসিতেছেন, ইনি পবিত্রের ছিদ্র পথে ক্ষরিত হইয়া রস বর্ষণ করিতেছেন।

১২। ইনি ক্ষরণকালে নদীর অগ্রে ধাবিত হয়েন, সেইরূপ বাক্যের অগ্রে এবং গাভীগণের অগ্রে ধাবিত হয়েন, এতাদৃশ ইহার বেগ। ইনি উত্তম অস্ত্র শস্ত্র ধারণ পূর্বক যুদ্ধের সম্মুখভাগে প্রচুর ধন জয় করেন। সেই রস সেচনকারী সোমকে নিষ্পীড়ন কর্তারা নিষ্পীড়ন করিতেছে।

১৩। স্তোত্র শ্রবণে প্রীত হইয়া এই সোম চালিত অশ্বের ন্যায় যাইয়া মেষলোমের পবিত্রে তরঙ্গরূপে(প্রচুর পরিমাণে) যাইতেছে। হে ইন্দ্র! হে কবি! দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যে তোমার যজ্ঞ হইলেই এই নিৰ্ম্মল সোম স্তোত্র শুনিতে শুনিতে ক্ষরিত হয়।

১৪। এই সোম এরূপ এক আলোকময় কবচে আচ্ছাদিত, যাহার কিরণ আকাশকে স্পর্শ ও পূর্ণ করিতেছে। যজ্ঞের সময় জলের সহিত মিশ্রিত হইয়া ইনি শূন্যপথে গতি করেন। ইনি স্বর্গের প্রাচীন পিতা ইন্দ্রকে সেবা করেন(৩)।

১৫। এই সোম সর্বাগ্রে ইন্দ্রের তেজঃ বাড়াইয়া ছিলেন, সেই ইন্দ্রের আগমনের জয় ইনি ইন্দ্রকে পরম সুখী করিতেছেন। সেই সর্বোচ্চস্থানে যথায়, ইন্দ্রের ধাম, তথা হইতে তিনি সোম পানের প্রভাবে সকল যুদ্ধে গমন করেন।

১৬। সোম ইন্দ্রের উদরে প্রবেশ করেন, কারণ ইন্দ্র তাহার বন্ধু। তিনি ইন্দ্রের উদরের কোন অনিষ্ট করেন না। মানব যেমন যুবতীদিগের সহিত মিলিত হয়, তদ্রূপ ইনি শতচ্ছিদ্র পথ দিয়া নির্গত হইয়া জলের সহিত মিশ্রিতহইতেছেন।

১৭। হে সোম! তোমার সেবকেরা মধুর সুরে তোমার স্তব করিবার অভিলাষে যজ্ঞগৃহ মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে । বুদ্ধিমানেরা স্তোত্রসহকারে সোমের আবাহন করিতেছেন। গাভী ইহার উপর দুগ্ধ ঢালিয়া দিতেছে।

১৮। হে সোম! যে যুদ্ধ তিন দিন অবিরত প্ৰবৰ্ত্তমান হইয়া আমাদিগের জন্য প্রচুর ইক্ষু, অন্ন, মধু ও লোকজন আনিয়া দিয়াছে(৪), সেই অক্ষয় অন্ন বর্ধনকারী যুদ্ধের অভিমুখে তুমি ক্ষরিত হও।

১৯। স্তোত্র বর্ষণকারী বিচক্ষণ সোম ক্ষরিত হইতেছেন, ইনি দিন ও প্রাতঃকাল ও সূর্যের সৃষ্টিকর্তা। ইনি ধারার আকারে কলসে প্রবেশ করিতেছেন। ইনি বুদ্ধিমানদিগের স্তোত্রের ভাগী হইয়া ইন্দ্রের হৃদয়ঙ্গম হইতেছেন।

২০। এই প্রাচীন কবি সোম বুদ্ধিমান্ লোকদিগের দ্বারা প্রস্তুত হইয়া ক্ষরিত হইতেছেন। ইনি কলসের মধ্যে সশব্দে যাইতেছেন। ইনি যেন ত্রিতের নাম উচ্চারণ করিতেছেন। ইনি ইন্দ্র ও বায়ুর সহিত বন্ধুত্ব করিবার জন্য মধু ঢালিয়া দিতেছেন।

২১। এই সোম শোধিত হইয়া প্রাতঃকালকে আলোকময় করেন, ইনি নদী অর্থাৎ ধারা হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন, ইনি সংসারের সৃষ্টিকর্তা। ইনি একবিংশতি গাভী হইতে আপনার অনুপানস্বরূপ দুগ্ধ দোহন করিতেছেন। এই আনন্দকর সোম হৃদয়ের মধ্যে যাইবার জন্য রমণীয়ভাবে ক্ষরিত হইতেছেন।

২২। হে সোম! তুমি শোধিত হইয়াছ। দিব্য ধামের দিকে ক্ষরিত হও। তুমি পবিত্রের পথ দিয়া কলসে যাও। শব্দ করিতে করিতে ইন্দ্রের উদরে প্রবেশ কর। মনুষ্যেরা তোমাকে প্রস্তুত করিয়াছে। তুমি সূর্যকে আকাশে স্থাপন করিয়াছ।

২৩। প্রস্তরের দ্বারা নিষ্পীড়িত হইয়া তুমি পবিত্রে ক্ষরিত হও। হে সোম! তুমি ইন্দ্রের উদরে প্রবেশ কর। তুমি বিচক্ষণ, তুমি মানুষ চেন। তুমি অঙ্গিরার সন্তানদিগকে গাভীসমূহ দেখাইয়া দিয়াছিলে।

২৪। হে পবিত্র সোম! সৎকর্মানুষ্ঠানকারী বিদ্বান ব্যক্তিগণ তোমার আশ্রয় কামনা করিয়া তোমার গুণ গান করিয়া থাকে। পক্ষী তোমাকে দ্যুলোক হইতে মর্ত্যে আনয়ন করিয়াছে। যাবতীয় স্তুতিবাক্য তোমার শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে।

২৫। যখন সোমরস তরঙ্গবেগে মেষলোমময় পবিত্রের চতুঃপার্শ্ব দিয়া ক্ষরিত হইতে থাকেন, তখন সাতটা গাভী তাহার নিকটে যাইয়া থাকে। ঋতের যজ্ঞস্থানে প্রকান্ড দেহধারী আয়ুগণ (কতকগুলি ব্যক্তির নাম) জলের আধারের দিকে সেই কর্মকুশল সোমকে প্রেরণ করিতেছে।

২৬। সোমরস ক্ষরণপূর্বক তাবৎ শত্রুকে পরাজয় করিতেছেন; যজ্ঞকর্তা ভক্তব্যক্তির জন্য সর্বপ্রকার সুবিধা করিয়া দিতেছেন। সেই সুশ্রী ও সুবোধ সোমরস আপনার মূর্তি দুগ্ধের সহিত মিশ্রিত করিতেছেন, ক্রীড়াপ্রসক্তঘোটকের ন্যায় মেষলোমের দিকে ধাইতেছেন।

২৭। শতসংখ্যক ধারা জলের ন্যায় অবাধে বহমান হইয়া পরস্পর মিলন পূর্বক হরিতবর্ণ সোমরস প্রস্তুত করিতেছে। তাহাকে ক্ষীরে আচ্ছাদনপূর্বক অঙ্গুলিগণ শোধন করিতেছে। তিনি বেদির তৃতীয়তলে দীপ্যমান অগ্নির উপর সংস্থাপিত হইতেছেন।

২৮। হে সোম! এই তাবৎ প্রাণী তোমার স্বর্গীয় রেতঃ হইতে উৎপন্ন। তুমি সমস্ত বিশ্বভুবনের প্রভু। হে ক্ষরণশীল সোম! এই নিখিল জগৎ তোমার আজ্ঞাধীন। হে সোম! তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমতার অধিকারী।

২৯। হে সোম! তুমি বিশাল, বিস্তৃত সমুদ্র। হে কবি! তুমিই এই পাঁচ দিক (উর্ধের দিক লইয়া পাঁচ) ধারণ করিয়াছ। তুমি দ্যুলোক ও ভূলোককে ধারণ কর। হে ক্ষরণশীল সোম! তোমার জ্যোতি রাশি সূর্যের তুল্য।

৩০। হে সোম! এই ধূলিময় পৃথিবী ধারণ করিবার জন্য দেবতাদিগের উদ্দেশে পবিত্রেতে শোধন হইয়া থাক। উশিজ নামক ব্যক্তিগণ সর্বাগ্রে তোমাকে গ্রহণ করিয়াছিল। এই তাবৎ লোক তোমার দ্বারা চালিত হইয়াছে।

৩১। সোমরস শব্দ করিতে করিতে মেষলোম অতিক্রম করিতেছে। এই দ্রবাত্মক হরিতবর্ণ রস জলে পড়িয়া শব্দ করিতেছে। ইহার ধ্যান করিতে করিতে ইহার অভিলাষিগণ ইহার স্তব করিতেছেন। ইনি যেন একটা শব্দায়মান শিশু, স্তুতিরা যেন বাৎসল্যভরে ইহাকে লেহন করিতেছে।

৩২। এই সোম যেন সূৰ্য্য কিরণময় পরিচ্ছদ ধারণ করিতেছেন, আমার বোধ হয় ইনি ত্রিগুণ সূত্র টানিতেছেন, অর্থাৎ দিনের মধ্যে তিনবার যজ্ঞ হয়, ইনি ঋতের নূতন নূতন স্তোত্র যোগাইয়া দিতেছেন। এই নরপতি সোম আপন পাত্রে যাইতেছেন।

৩৩। এই সোম যিনি নদীগণের রাজা, স্বর্গের অধিপতি, তিন ক্ষরিত হইতেছেন। ঋত কে পথ দেখাইয়া দিতেছে, সশব্দে সেই সমস্ত পথ দিয়া যাইতেছেন। এই হরিতবর্ণ সোম সহস্রধারায় সিক্ত হইতেছেন। ইনি শোধিত হইতেছেন, তদর্শনে লোকের নানাবিধ বাক্যস্ফূৰ্ত্তি হইতেছে, ইহার সঙ্গে সঙ্গেই ধন আছে।

৩৪। কে ক্ষরণশীল সোম! তুমি সূর্যের ন্যায় অদ্ভুত। তোমার প্রচুর রস, তুমি মেষলোমের পবিত্র স্বরূপ পথ দিয়া চালাইয়া দিতেছ। তুমি প্রস্তরে নিষ্পীড়িত হইয়াছ; অধ্যক্ষগণ তোমাকে অঙ্গুলিদ্বারা শোধন করিয়াছে, এখন তুমি প্রচুর ধন লাভের উদ্দেশে তুমুল যুদ্ধে যাইতেছ।

৩৫। হে সোম! তুমি অন্ন ও পরাক্রম উৎপাদন কর। শ্যেন পক্ষী যেমন আপনার বাসায় এসে, তেমনি তুমি কলসের মধ্যে উপবেশন কর (৫)। তুমি নিষ্পীড়িত হইয়া ইন্দ্রের আনন্দ ও মত্ততা উপস্থিত কর, যেহেতু তুমিমাদকতাশক্তিসম্পন্ন। তুমি লোকের সমযোগ্য স্তম্ভস্বরূপ, তুমি চতুর্দিক দৃষ্টি কর।

৩৬। এই যে নবীন বালক সোম, যিনি বিজয়ী হইবার এই জন্মিয়াছেন, যিনি দিব্য লোকবাসী গন্ধর্বের ন্যায় রূপবান(৬), যিনি নরজাতির প্রতি কৃপাবান, সেই সোমকে সাত জন ভগিনীতে মিলিয়া জলের মধ্যে লালন পালন করে, কেন না তিনি পালিত হইলে সমস্ত বিশ্বভুবনের শ্রীবৃদ্ধি হইবে।

৩৭। হে সোম! তুমি উজ্জ্বল ও পক্ষযুক্ত ঘোটকী যুতিয়া প্রভুর ন্যায় বিশ্বভূবনে গতিবিধি কর। সেই ঘোটকীরা যেন ঘৃত, দুগ্ধ, মধু আহরণ করিয়া দেয়। হে সোম! মনুষ্যগণ যেন তোমার কার্য সিদ্ধ করিতেই ব্যাপৃত থাকে।

৩৮। হে ক্ষরণশীল সোম! নরজাতির প্রতি তোমার কৃপাদৃষ্টি। তুমি রস বৃষ্টি করিয়া থাক। তোমার রসময় তরঙ্গ তুমি চতুর্দিকে চালাইয়া দিয়া থাক। অতএব তুমি এইরূপে ক্ষরিত হও, যে আমরা যেন অর্থ ও সুবর্ণ লাভ করি। যেন ত্রিভূবনে আমরা নিরূপদ্রবে প্রাণ ধারন করি।

৩৯। হে সোম! তুমি এইরূপে ক্ষরিত হও, যেন আমরা গাভী ও অশ্ব ও সুবর্ণ লাভ করি। তুমি ত্রিভুবনে গর্ভাধানকারী জনকের স্বরূপ সংস্থাপিত আছ। হে সোম! তুমি বিশ্বব্যাপী; তোমার প্রসাদে লোকবল পাওয়া যায়।তোমাকে এতাদৃশ জানিয়া বিদ্বানগন বিবিধ বাক্য উচ্চারণপূর্বক তোমার উপাসনা করিতেছে।

৪০। এই যে সোম, ইনি অতি চমৎকার মধুর তরঙ্গ উঠাইতেছেন। জলের পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া মহিষের ন্যায় অবগাহন করিতেছেন। ইনি রাজা, পবিত্রই ইহার রথ, ইনি যুদ্ধে চলিলেন; ইনি সহস্র স্থানে গতিবিধিকরিয়া প্রচুর অন্ন জয় করিতেছেন।

৪১। সোম সংসারের আয়ু অর্থাৎ জীবনস্বরূপ; তিনি আমাদিগের স্তুতিবাক্য অহর্নিশি উদয় করিয়া দিতেছেন, সেই স্তুতিবাক্য যাহার প্রভাবে আমরা সন্তানাদি লাভ করি, যাহা আমাদিগের জন্য অশেষ কাম্যবস্তুতে পরিপূর্ণ আছে। হে সোম! তুমি ইন্দ্রকর্তৃক পীত হইয়া উহার নিকট আমাদিগের জন্য সন্তান ও ধন ও ঘোটক ও উত্তম অট্টালিকা চাহিয়া দাও।

৪২। প্রভাত উপস্থিত হইবামাত্র সুবোধ ব্যক্তি সেই রমণীয় মূর্তিধারী হরিতবর্ণ আনন্দকর সোমরসের ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করেন। সেই সোম সংসার রক্ষা করিবার উদ্দেশে নরলোকবাসী ও দিব্যলোকবাসী এই দুই জাতীয়ব্যক্তিবর্গের বলাধান করিবার জন্য তাহাদিগের উদরে প্রবেশ করিয়া থাকেন।

৪৩। পুরোহিতগণ সোমকে মাখিতেছেন, পৃথক করিতেছেন, উত্তমরূপে মাখিতেছেন, মধুসংযুক্ত করিতেছেন ও তৎপ্রতিভাবে মাখিতেছেন, যেহেতু সেই সোম ক্রতু অর্থাৎ কাৰ্য্যকুশল। যখন সিন্ধু, অর্থাৎ তাহার রস উচ্ছসিত হয়, তখন তিনি নিম্নে পতিত হন, তিনি রস সেচন করিতে থাকেন, তৎক্ষণাৎ সুবর্ণাভরণধারী পুরোহিতগণ তাহাকে জলে লইয়া যান, যেরূপ লোকে পশুকে স্নানের জন্য জলে লইয়া যায়।

৪৪। সেই ক্ষরণশীল জ্ঞানী সোমের নাম করিয়া সকলে গান কর, তাহার প্রকাণ্ড ধারা অন্ন আহরণ করিতে যাইতেছে। যেরূপ সর্প আপনার পুরাতন চর্ম ত্যাগ করে, সেইরূপ সেই ধরা যাইতেছে। সেই রস সেচনকামী হরিতবর্ণ সোম ক্রীড়াসক্ত ঘোটকের ন্যায় দৌড়াইতেছেন।

৪৫। সেই সোম রাজার ন্যায় অগ্রে অগ্রে চলিয়াছেন; তিনি জলের স্রোতের ন্যায় সতেজে যাইতেছেন। সংসারে দিন পরিমাণ করিবার জন্য তিনি নিযুক্ত আছেন। তিনি হরিতবর্ণ, তিনি জলে স্নান করিয়াছেন, তিনি দেখিতে এমনি সুশ্রী, যেন তাহার শরীরে ঘৃত গড়াইয়া পড়িতেছে। তিনি ধনের ভাণ্ডার স্বরূপ। তিনি উজ্জ্বল রথে আরোহণপূর্বক ক্ষরিত হইতেছেন।

৪৬। সোম দ্যুলোকের ধারণাকর্তা, স্তম্ভস্বরূপ, তিনি উচ্চ হইয়া আছেন, তিনি মত্ততার উৎপাদক, তিনি সর্বতোভাবে তিন প্রকার উপাদানে (ঘৃত ও দুগ্ধ ও সোমের নিজ রস) প্রস্তুত। তিনি সর্বলোকে বিচরণ করেন। সেই উজ্জল সোমরস যখন শব্দ করেন, তখন স্তবকর্তারা তাহাকে লেহন করেন, সেই সময়ে আবার ঋক উচ্চারণকারীরা শোধিত সোমের নিকটবর্তী হন।

৪৭। হে সোম! শোধন কালে তোমার অস্থির ধারাগুলি একত্র মিলিত হইয়া মেষের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ণ লোমগুলি অতিক্রম করিতেছে। সেই সময়ে তুমি দুই পাত্রের মধ্যে সংস্থাপিত হইয়া দুগ্ধের সহিত মিশ্রিত হও। প্রস্তুত হইয়াতুমি কলসে যাইয়া উপবেশন কর।

৪৮। হে ক্রিয়াকুশল সোম! তুমি স্তবের দ্বারা পরিতোষিত হইতেছ, এখন মেষলোমের উপর সুমিষ্ট রস ঢালাইয়া দাও। তাবৎ রাক্ষসদিগকে ধ্বংস কর, অত্রির যজ্ঞে আমরা এই দীর্ঘ ছন্দের স্তব পাঠ করিতেছি, যেন আমরাবীরপুত্ৰ লাভ করি ।

————

(১) সায়ণ তিনরূপ ব্যাখ্যা দিয়াছেন।

(২) অর্থাৎ ধারারূপ নদীমুর্তি ত্যাগ করিয়া কলস্বরূপ সমুদ্রমূর্তি ধারণ করিলেন।

(৩) সায়ণের ব্যাখ্যা কতক বিভিন্ন।

(৪) মূলে এই আছে, যথা “যানঃ দোহতে ত্রিঃ অহনৃ অসশ্চুবীক্ষুমৎ বাজবৎ মধুমৎ সুবীর্য্যর।“ তিন দিন যুদ্ধের পর ইক্ষু আদি খাদ্য লাভের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে।

(৫) শ্যেনপক্ষীর সহিত তুলনা।

(৬) এখানেও গন্ধর্ব অর্থে সূর্য্য।

(৭) সর্প পুরাতন চর্মত্যাগ করে, সে বিষয়ে তৎকালে জানা ছিল।