1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৯

নয়

হচিন্সটন হলের আট বেডরুমের যে-কোনও একটায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে লিয়া বারবার, কিন্তু রাজি হয়নি রানা। লিয়ার বেডরুমের বাইরে করিডোরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাটিয়েছে ও সারাটা রাত। ভোর হয়ে আসায় এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর। ভাল করেই জানত, বিপদ যদি না-ও আসে, কষ্টকর অতীত-স্মৃতি ঘুমাতে দেবে না ওকে। ভাবতে অদ্ভুত লেগেছে, সামনের ওই ঘরেই ঘুমাচ্ছে লিয়া, অথচ আজ ওদের মাঝে কী বিশাল প্রাচীর। হয়তো এই দুর্লঙ্ঘ্য বাধা আর কোনদিনই পেরোতে পারবে না ওরা!

ভোর ছয়টা বেজে যাওয়ার পরেও জেগে থাকল রানা। ধুলো ভরা জানালার কাঁচের ওপাশ থেকে প্যাসেজে এসে পড়ল দিনের প্রথম ধূসর আলো। ওর মনে পড়ল, গতরাতে পুলিশের সেই ফোনের কথা। তখন থেকে লিয়া আর কিডন্যাপারদের কথা গভীরভাবে ভাবছে ও। গত পাঁচ দিনের ভেতর লিয়ার ওই ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছে কেউ। প্রতিবেশীরা ছিল ছুটিতে। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে দেখেছে লিয়ার ফ্ল্যাটের দরজা আধখোলা। তখনই দেরি না করে ফোন করেছে পুলিশে।

ওটা সাধারণ ডাকাতি নয়। কার্পেট ও ফ্লোর-বোর্ড তো তুলেইছে, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে তোষক, বালিশ এমন কী কুশনগুলো পর্যন্ত চিরে দেখেছে। কী যেন খুঁজছে ওরা, চুরি যায়নি কিছুই। লিয়ার বিছানার পাশের টেবিলে মুক্তোর মালা, সোনার ঘড়ি ও হীরের দুল পেয়েছে পুলিশের লোক। ওগুলো ছুঁয়েও দেখেনি হবু কিডন্যাপার। ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছে রানার কাছে।

উঠে আড়মোড়া ভেঙে স্লিপিং ব্যাগ ভাঁজ করে রেখে নিচতলায় নামল রানা। কফির পানি ফুটতে শুরু করেছে, এমনসময় শীতে কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল লিয়া। রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে সিম-কার্ডে রয়ে যাওয়া রানার পাঠানো সেই মেসেজগুলো ঘেঁটে দেখেছে ও। এখন আর মনে কোনও সন্দেহ নেই। ওকে কখনও ঠকাতে চায়নি মাসুদ রানা। নিজের ভুলেই এলোমেলো হয়েছে ওর জীবন। দোষ দেবে না অ্যালেককে, কারণ বেচারা চেয়েছে ওর ভাল হোক। যদিও তাতে ফল হয়েছে উল্টো। কীভাবে রানা আর ওর জীবনটা জটিল হয়ে গেল, এসব ভাবতে গিয়ে রাতে আর ঘুমাতে পারেনি লিয়া। বার বার দরজাটা সামান্য ফাঁক করে দেখেছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সিধে হয়ে বসে আছে সৈনিক। কী যেন ভাবছে।

এখন রানার চোখে চোখ রাখতে গিয়ে লজ্জা লাগছে।

লিয়ার কালো চুল অবিন্যস্ত। তাতে ওকে আরও সুন্দরী লাগল রানার। দু’কাপ গরম কফি হাতে টেবিলে বসে নীরবে কিচেনের জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখল ওরা। কী আশ্চর্য বিশাল কর্মকাণ্ড! আঙুল গরম করতে দুই হাতে কফির গরম মগ ধরেছে লিয়া। ওকে খুব ক্লান্ত বলে মনে হলো রানার।

‘এবার?’ জানতে চাইল লিয়া। ‘এখানে রয়ে যাবে, না তোমার পরিচিত লোকদেরকে ফোন দেবে?’

‘তুমি নিরাপদে আছ, সেটা আগে নিশ্চিত করতে চাই,’ বলল রানা। ‘তবে দিনের পর দিন তোমাকে পাহারা দিতে পারব না। নানান কাজে বাইরে যাবে তুমি। সেসময়ে চোখ রাখার জন্যে লোক লাগবে।’ কী যেন ভাবল রানা। ‘তবে আগে জানতে হবে আসলে কী ঘটছে।’

‘তুমি কি এখানে আমার সঙ্গে রয়ে যাবে?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘আপাতত, ক’দিনের জন্যে।’

কফির মগ টেবিলে নামিয়ে রাখল লিয়া। ‘ঠিক আছে। তা হলে দরকারি জিনিসগুলো বাক্স থেকে বের করতে হবে। বেশ কিছু সোয়েটার এনেছি, ওগুলো চাই। এই বাড়ির ভেতরটা বরফের মত ঠাণ্ডা!’

কফি শেষ করে উডশেড থেকে চেরা কাঠ এনে স্টাডিরুমের ফায়ারপ্লেসের কাছে গুছিয়ে রাখল রানা। চুপ করে ওর কাজ দেখছে লিয়া। একটু পর জ্বলে উঠল লাল আগুন। শিখাগুলো লকলক করে উঠে গেল চিমনি দিয়ে ওপরের দিকে। পেছনে নড়াচড়া টের পেয়ে ঘুরে তাকাল রানা। ‘কী করছ?’

লাফ দেয়া বন্ধ করে ওকে দেখল লিয়া। ঠোঁটে ফুটেছে লজ্জার হাসি। ‘এই বাড়িতে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার বাড়িটার কথা। একেবারেই টাকা ছিল না আমাদের। উপায় ছিল না আগুন জ্বেলে ঘর গরম করার। তাই একটু পর পর লাফ দিত বাবা, আর জোরে জোরে হাঁটত। অ্যালেক আর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত জগিং করতে। আর তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে যখন বাড়ি ফিরতাম, ঠাণ্ডা বাড়িটাও মনে হতো দারুণ আরামদায়ক আর কুসুমগরম।’

কয়েকটা চেরাই কাঠ ফায়ারপ্লেসে গুঁজল রানা। ‘তোমাদের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা আর্মি অফিসারদের মত। ওরা ওটাকে বলত: চরিত্রশোধন।’

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লিয়া। ‘যাবে আমার সঙ্গে একটু খোলা জায়গায় হাঁটতে? কত দিন কোথাও যাই না। হয়তো ভাল লাগবে।’

‘চলো, ঘুরে দেখি তোমার এস্টেট,’ রাজি হলো রানা।

বাড়ির পেছনের ভারী দরজা খুলে রানাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এল লিয়া। তালা আটকে সোয়েড কোটের পকেটে রাখল চাবি। সূর্যের দিকে মুখ তুলে বুজে ফেলল সবুজ দুই চোখ। মুখে ফুটে উঠল বিষণ্ণ হাসি। রানার বড় ইচ্ছে হলো লিয়ার ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে দিতে। তবে সামলে নিল নিজেকে। কৈশোরে শোনা একটা বাংলা গানের কথা মনে পড়ল :

“ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো এখন কত দূরে…
আজ আসে না রাজার কুমার পক্ষিরাজে উড়ে ॥

আজ সত্যিই ওরা এতটাই দূরে সরে গেছে। ওরা তো বলা চলে প্রায় অচেনা মানুষই!

কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল ওরা। চারপাশে নানাধরনের গাছের হালকা জঙ্গল। বাড়ির উঠান ধীরে ধীরে নেমে গেছে সুন্দর এক নীলজলের লেকে। তীরের সরু পথে এগোল ওরা। শীতের বৃষ্টির প্রকোপে ঝরে পড়েছে শুকনো ডাল ও মরা পাতা। ওদের চারপাশে শুরু হলো চেরি লরেলের সবুজ এক সুড়ঙ্গ। মাথার ওপরে পাতার ফাঁক গলে মাঝে মাঝে ঝিক করে উঠছে শীতের দূরাগত উজ্জ্বল সোনালি রোদ।

‘এ জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগে,’ সামনের দিক দেখিয়ে হাসল লিয়া। হরিৎ সুড়ঙ্গের কোণ ঘুরে সামনে ওরা দেখল সবুজ মাঠ ও তার পর কাঁচের মত ঝিকমিক করা এক নদী। দূরের তীরে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে চরছে একপাল ঘোড়া।

‘গরমকালে এখানে বসিয়ে নেব দুটো বেঞ্চ, বলল লিয়া, ‘দারুণ হবে, তাই না?’ চুপচাপ চেয়ে রইল ও কিছুক্ষণ সবুজ উপত্যকার দিকে। তারপর ওর চোখে ফুটে উঠল দুশ্চিন্তার ছায়া।

‘আমি বোধহয় জানি তুমি কী ভাবছ,’ বলল রানা, ‘তবে তোমার নিরাপত্তার জন্যেই জানা দরকার আসলে কী ঘটছে।’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ ঘাসে ছাওয়া মাঠের দিকে তাকাল লিয়া।

‘তোমার কি ধারণা, বিশেষ কিছু খুঁজতে তোমার ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল লোকগুলো?’ জানতে চাইল রানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিয়া। ‘জানি না। ওই ফ্ল্যাট অপেরার খুব কাছে। তাই কিছু দিনের জন্যে ভাড়া নিয়েছিলাম। কাউকে চিনি না। সময়ও তেমন কাটাইনি ওখানে।’

‘তুমি যখন ওখানে উঠলে, ফাঁকা ছিল ওটা? হয়তো ওখানে জরুরি কিছু রেখে গিয়েছিল আগের ভাড়াটে?’

আস্তে করে মাথা নাড়ল লিয়া। ‘ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। কিছুই ছিল না। অন্যকিছু নয়, তারা গিয়েছিল আমাকে কিডন্যাপ করতে। বা হয়তো কিছু একটা আছে আমার কাছে, যেটা তাদের চাই। কিন্তু জানি না ওটা আসলে কী?’

রানা ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই এক পা সরে গেল লিয়া। আকাশের দিকে তাকাল রানা। যে-কোনও সময়ে শুরু হবে বৃষ্টি। কালো হয়ে আসছে চারপাশ। এরই ভেতর হাঁটতে গিয়ে প্রায় একঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করেছে ওরা।

‘চলো, বাড়ি ফিরি,’ বলল রানা।

আধঘণ্টা পর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বাড়ির পেছনে পৌঁছে গেল ওরা। আকাশে এখন ঢেউয়ের পর কালো মেঘের ঢেউ। উন্মাতাল হাওয়ায় ভর করে ইলশে গুঁড়ির মত করে পড়ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বাড়ির পেছন-দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিয়া। ওকে পাশ কাটিয়ে কিচেনের দিকে চলল রানা। ওখানেই আছে ওর ব্যাকপ্যাক। কিচেনে ঢুকে ওটা থেকে ফোন নিতে গিয়েও হঠাৎ করেই সরু হয়ে গেল রানার দুই চোখ।

ওর মুখের কঠিন অভিব্যক্তি খেয়াল করেছে লিয়া। ‘হঠাৎ কী হলো?’

নিজের ঠোঁটে তর্জনী রাখল রানা। মানা করছে আওয়াজ করতে। জবাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে লিয়া বোঝাতে চাইল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

চুপ করে আছে রানা। দু’সেকেণ্ড পর বাহু ধরে প্রায় টেনে নিয়ে ওয়াক-ইন প্যান্ট্রিতে লিয়াকে ঢুকিয়ে দিল

‘রানা…’ বলতে শুরু করেও রানার গম্ভীর চেহারা দেখে লিয়ার চোখে ফুটল ভয় ও দ্বিধা।

‘এখান থেকে সরবে না, কোনও আওয়াজ করবে না,’ ফিসফিস করল রানা। দরজাটা বন্ধ করে দিল। নিজে রয়ে গেছে কিচেনে। চুলা থেকে কাঁচা লোহার ভারী ফ্রাইপ্যানটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরের প্যানেল করা করিডোরে। এগোচ্ছে নিঃশব্দে।

লোকগুলোকে পেল রানা স্টাডিরুমে। এখন ওর দিকে তাদের পিঠ। মুখে মুখোশ। পরনে কমব্যাট জ্যাকেট। করডিউরা রিগে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল।

লোকদু’জন ব্যস্ত হয়ে উপুড় করে মেঝেতে ফেলছে প্যাকিং কেসের ভেতরের সব। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে মিউযিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, চিঠি ও ব্যবসায়িক ডকুমেণ্ট। কয়েক সেকেণ্ড পর একটা ট্রাঙ্ক হাতড়ে মেঝেতে কাপড়-চোপড়ের স্তূপ তৈরি করল বামের লোকটা। ডানদিকের জনের হাতের ছোরাটার ফলা দু’দিকে ধারালো। ফায়ারপ্লেসের পাশে বাদামি টেপ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা বড় এক কার্ডবোর্ড বক্স কাটছে সে। লোকদু’জন টের পেল না কখন ঘরে ঢুকেছে-রানা।

হাঁ হয়ে গেল কার্ডবোর্ড-বক্স। ওটা থেকে মেঝেতে ছিটিয়ে পড়ল কাগজপত্র, বই ও ফোল্ডার। ঝুঁকে ওগুলোর ভেতর থেকে সরু একটা বক্স ফাইল নিল লোকটা। কয়েক মুহূর্ত ফাইলের ভেতরের কাগজপত্র দেখল সে, তারপর ইশারা করল সঙ্গীর উদ্দেশে।

বামদিকের জন ঘুরতেই রানার লোহার ভারী ফ্রাইপ্যানের কিনারা ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল তার খুলিতে। ভয়ঙ্কর আঘাতটা কুঠারের কোপের মত। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। মৃত্যু-যন্ত্রণায় লাথির ভঙ্গিতে লাফাচ্ছে দুই পা।

বক্স ফাইল হাত থেকে ফেলেই হ্যাঁচকা টানে হোলস্টার থেকে পিস্তল নিতে চাইল দ্বিতীয়জন। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত রানা। ওর ঘুষি লাগল লোকটার বামচোয়ালে। খুন করতে চাইছে না, তাই খপ্ করে তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে ধাক্কা দিল, সেই সঙ্গে বামপা বাড়িয়ে দিয়েছে পিস্তল- ধারীর পায়ের পিছনে। দড়াম করে শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ল লোকটা। ওর কণ্ঠনালী থেকে হাত না সরিয়ে নিচু গলায় জানতে চাইল রানা, ‘কার হয়ে কাজ করছ, বাছা?’ পরের সেকেণ্ডে তার কম্পমান হাত থেকে কেড়ে নিল পিস্তল। ওটা ভারী ক্যালিবারের অস্ত্র। প্যারা-অর্ডন্যান্স .৪৫। হাই ক্যাপাসিটি ম্যাগাযিন। স্টেইনলেস স্টিলের। কক ও লক করা। চকচক করছে গান অয়েলের গুণে। তেলের গন্ধটা একদম তাজা।

ইন্টারোগেট করার সময় সহজ পথে কাজ করতে অভ্যস্ত রানা। সেফটি অফ করে মাঘলের ডগা দিয়ে লোকটার প্রায় ফরসা হয়ে আসা চাঁদিতে টোকা দিল। নিচু স্বরে বলল, ‘জবাব দাও, নইলে মরবে।’

মুখোশের ফুটোর ভেতর লোকটার চোখদুটো বিস্ফারিত হতে দেখে কণ্ঠনালীর চাপ সামান্য কমাল রানা। মেঝের সরু বক্স ফাইলের দিকে তাকাল লোকটা। ওটার ঢাকনিতে মার্কার পেন দিয়ে লেখা: দ্য মোযার্ট ডকুমেন্ট।

লোকটার মাথার পাশে পিস্তলের মা ঠেকিয়ে জানতে চাইল রানা, ‘তোমরা কেন এসেছ?’

জবাব পাওয়ার আগেই দড়াম করে খুলে গেল দরজা। গুলি করতে করতে ঘরে ঢুকল তৃতীয় একজন লোক। পিস্তলের গুলির আওয়াজে ভরে গেল ছোট্ট ঘর। কোথাও কাভার নেয়ার উপায় নেই রানার। কানের পাশ দিয়ে ভারী বুলেটের শক ওয়েভ যেতেই বুঝে গেল, আরেকটু হলেই খুন হতো।

বসে পড়ে জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে হতভম্ব বন্দিকে হ্যাঁচকা টানে নিজের সামনে আনল রানা। তবে মাংসের এই বর্ম রক্ষা করবে না ওকে। করুণ আর্তনাদ ছাড়ল লোকটা। এইমাত্র তার জ্যাকেট ভেদ করে বুকে বিঁধেছে কয়েকটা গুলি। তার পায়ের ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ল সরু বক্স ফাইল। ওটার কাগজগুলো গিয়ে পড়েছে ফায়ারপ্লেসের আগুনের ভেতর।

মৃতপ্রায় খুনির কাঁধের ওপর দিয়ে প্যারা-অর্ডন্যান্স পিস্তল করল রানা। দু’বার বুম বুম শব্দে গর্জে উঠল ওর হাতের অস্ত্রটা। কাত হয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ল আততায়ী। ওখান থেকে পিছলে নামল মেঝেতে লাশ হয়ে।

মানব-বর্ম হাতছাড়া করল রানা। ফায়ারপ্লেসে পুড়ে মুচড়ে কালো হচ্ছে ফাইলের কাগজপত্র। জ্বলছে ছোট কার্পেট। উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে কার্পেটের আগুন নেভাল রানা। দু’হাতে সরাতে লাগল জ্বলন্ত কাগজপত্র। কিছুক্ষণ পর বুঝে গেল, যেক’টা কাগজ বাঁচাতে পেরেছে, সেগুলোও আধপোড়া।

তৃতীয় আততায়ীর পাশে গিয়ে বসল রানা। লোকটার মুখোশ, অস্ত্র আর পোশাক অন্য দু’জনের মতই। প্রথম গুলিটা লেগেছে বুকে। রিকয়েলের কারণে পিস্তলের নল ওপরে উঠেছে বলে দ্বিতীয় গুলি উড়িয়ে দিয়েছে মাথার ঘিলু।

চাপা শ্বাস ফেলল রানা। এদের কাছ থেকে কিছুই জানা যাবে না। আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর দেহের সব পেশি। বাড়ির ভেতর কোথাও ধুপ্ করে বন্ধ হয়েছে একটা দরজা। চওড়া করিডোরে এসে কিচেনের দিকে ছুটল রানা। বাইরে থেকে এল এক লোকের মোটাগলার চিৎকার। তারপর চালু হলো ডিয়েল ইঞ্জিন। পাথরের কুচির ওপর ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ। ঘুরে বাড়ির সামনের হলের দিকে ছুটল রানা। পায়ের নিচে পিছলে যাচ্ছে পালিশ করা কাঠের মেঝে। ঝড়ের বেগে সামনের দরজা খুলে দেখল, একটা ট্র্যানযিট ভ্যানে উঠেছে লোকটা। চার চাকা হড়কে দ্রুত গতি তুলছে গাড়িটা।

ভ্যানের পেছনের দরজা লক্ষ্য করে ছয়টা গুলি পাঠাল রানা। ঠক-ঠক করে বুলেট বিঁধেছে দরজায়। একটা বুলেট চুরমার করেছে পেছনের কাঁচ।

এঁকেবেঁকে চলেছে ভ্যান। ওটা লক্ষ্য করে আরও তিনটে গুলি পাঠাল রানা। ওর লক্ষ্য এখন চাকা। তবে দেখতে না দেখতে দূরে সরে গেল ভ্যান। ঢাকা থেকে খসে পাথরের কুচির উপর দিয়ে খটাখট শব্দ তুলে ছুটে চলে গেল প্লাস্টিকের একটা হাবক্যাপ। ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে বাঁক নিয়ে উধাও হলো গাড়িটা।

ঘুরে কিচেনের দিকে চলল রানা। একমিনিট পেরোবার আগেই খুলল প্যান্ট্রি ডোর। ভেতর থেকে ঝড়ের বেগে ওর দিকে ছুটে এল লিয়া। শক্ত হাতে ধরেছে ভারী ম্যাগলাইট টর্চ। গায়ের জোরে ওটা নামাল রানার মাথা লক্ষ্য করে। ওই টর্চ মাথায় লাগলে মুহূর্তে কোমায় চলে যাবে যে-কেউ। একেবারে শেষ সময়ে ঝট্ করে সরে লিয়ার কবজি ধরল রানা। ভীষণ ভয়ে হাপরের মত হাঁপিয়ে চলেছে লিয়া। চোখদুটো উন্মাদিনীর!

লিয়াকে ধরে কয়েকবার ঝাঁকি দিল রানা। ‘লিয়া! আমি রানা! আমার দিকে তাকাও!’

চোখ তুলে ওকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটা রানার বুকে। ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ।

‘বাড়িতে ওদের কয়েকজন ঢুকেছিল,’ বলল রানা। ‘তুমি এখন নিরাপদ। তবে হাতে বেশি সময় পাব না। আবারও ফিরবে ওরা।’ ঘুরে কিচেনে গিয়ে ঢুকল রানা।

থরথর করে কাঁপছে লিয়া। পিছু নিল রানার। ‘এবার?’

‘দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও,’ বলল রানা। নিজের ব্যাগ তুলে সোজা গিয়ে ঢুকল স্টাডিরুমে। পেছনে ভিড়িয়ে দিল দরজা। ফায়ারপ্লেসের দিকে ঝুঁকে জড় করল আগুনে আধপোড়া কাগজ। ওর হাতের চাপে মুড়মুড় করে গুঁড়ো হলো কয়েকটা। এসব ডকুমেন্টের মধ্যে আছে মোটা এক এনভেলপ। ভেতরে চার বর্গইঞ্চি চওড়া কিছু। খুব হালকা। মাত্র পুড়ছিল একদিকের কোনা। ভেতরের জিনিস বোধহয় আস্তই আছে। খোলা হয়নি এনভেলপ। ওপরে লেখা লিয়ার মন্টি কার্লোর ঠিকানা। পোস্টমার্ক ভিয়েনার। তারিখ অনুযায়ী অ্যালেকের মৃত্যুর পর সিল দেয়া হয়েছে ওটার স্ট্যাম্পে।

সরু বক্স ফাইলে সব রাখল রানা। দ্য মোযার্ট ডকুমেন্ট লেখা অংশে চকচক করছে কয়েক ফোঁটা লাল রক্ত। স্ট্র্যাপ খুলে ফাইলটা ব্যাগে রাখল রানা। দুই লাশের কাছ থেকে সংগ্রহ করল দুটো .৪৫ পিস্তল। বাদ পড়ল না ট্যাকটিকাল রিগের পাউচে রাখা বাড়তি ম্যাগাযিন। ভাল করেই বুঝেছে, এরা পেশাদার খুনি। দ্রুত মৃতদেহ সার্চ করল রানা। যা ভেবেছে তা-ই, কারও কাছে কোনও কাগজপত্র বা আইডি নেই।

ঘরের দরজার নব ঘুরছে দেখে মুখ তুলে তাকাল রানা। বাধা দেয়ার আগেই ভেতরে ঢুকল লিয়া। মুহূর্তে বেচারি হলো পাথরের মূর্তি। মেঝেতে তিনটে লাশ। হাত-পা ছড়িয়ে ঘোলাটে চোখে দেখছে উঁচু ছাত। মুখে মুখোশ। মেঝেতে জমছে রক্তের লাল পুকুর। পেছন-দেয়ালে ছিটকে লেগেছে একরাশ রক্ত। একটা লাশের মাথার পাশে গেঁথে আছে কাঁচা লোহার ফ্রাইপ্যান। সব দেখে বনবন করে ঘুরছে লিয়ার মাথা। টলে পড়ত, কিন্তু খপ্ করে ওর কাঁধ ধরে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করল রানা। শুকনো গলায় বলল, ‘চাইনি এই দৃশ্য তোমাকে দেখতে হোক।’

লিয়াকে ধরে ঘর থেকে বেরোল রানা। অস্ফুট স্বরে বলল মেয়েটা, ‘তুমিই খুন করেছ?’

‘পরে এসব নিয়ে কথা হবে,’ বলল রানা। ‘এবার রওনা হব। তুমি রেডি তো?’

দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা দোলাল লিয়া।

চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। আট মিনিট আগে ভেগে গেছে খুনিদের দলের অন্যরা। স্বাভাবিক সুরে বলল রানা, ‘মাঠ পার হয়ে গিয়ে উঠব দূরের রাস্তায়। ওখান থেকে সংগ্রহ করে নেব কোনও গাড়ি।’

‘বাড়ির পেছনে গ্যারাজে আমার গাড়ি আছে,’ প্রায় ফিসফিস করে বলল লিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *