1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ২

দুই

তুরস্কের বিরান এক পাহাড়ি এলাকা।

একতলা বাড়ির রান্নাঘরের টেবিলে বসে রামি খেলছে দুই দোস্ত। হঠাৎই শুনল দ্রুতবেগে আসছে ভারী কোন গাড়ি। তাস থেকে মুখ তুলে জানালা দিয়ে প্যাটিয়োর দিকে চোখ যেতেই আতঙ্কে আত্মা উড়ে গেল তাদের। নাকের কাছে হাজির হয়েছে কালো রঙের পুরনো এক জিপগাড়ি! ড্রাইভিং সিটে কালো মুখোশ পরা এক লোক! পরক্ষণে জানালা ও পলকা দেয়াল বিধ্বস্ত করে চারপাশে কাঁচ ও কাঠের টুকরো ছিটিয়ে ঘরে প্রবেশ করল যন্ত্রদানব!

কড়া ব্রেক কষে থামল ধুলোমাখা কালো গাড়ি।

এদিকে প্রাণ বাঁচাতে চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লোকদু’জন। নানাদিকে ছিটকে গেছে খালি বিয়ারের বোতল। অবশ্য গোলাগুলির ট্রেইনিং আছে লোকগুলোর। দেরি না করে মেঝে ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। হোলস্টার থেকে রিভলভার নিয়েই গুলি করল জিপের সামনের দিক লক্ষ্য করে। ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল উইণ্ডশিল্ড। কোনও ঝুঁকি না নিয়ে রিভলভারের বেশিরভাগ গুলি খরচ করল তারা ড্রাইভিং সাইডে। ভেতর থেকে এল না কোন গোঙানি বা আর্তনাদ। বোধহয় ঝাঁঝরা হয়ে মারা পড়েছে ড্রাইভার।

কিন্তু এদিকে ‘খটাং’ শব্দে খুলে গেছে জিপের পেছন- দরজা। মেঝেতে লাফিয়ে নেমেছে এক যুবক। পরনে কালো কমব্যাট জ্যাকেট। মুখে কালো স্কি মাস্ক। কালো গ্লাভ্স্ পরা হাতে সাইলেন্সার সহ .৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার পি. পি.। পলকের জন্যে তাকে দেখল লোকদু’জন, পরক্ষণে তার দিকে ঘুরিয়ে নিল রিভলভারের নল। ততক্ষণে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে তাদের।

নিষ্কম্প হাতে তাদের দিকে ওয়ালথার তাক করল যুবক। নিখুঁত লক্ষ্যে এক এক করে দুটো গুলি বিধিয়ে দিল লোকদু’জনের হৃৎপিণ্ডে। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল তাসুড়ে দুই কিডন্যাপারের লাশ। ঘরের ডানদিকের মেঝেতে ছিটকে গেছে গুলির দুটো তামার খোসা।

গতপরশু থেকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে বিনকিউলার হাতে এই বাড়ির ওপর চোখ রেখেছে কালো পোশাক পরা যুবক। কোন তাড়া ছিল না তার। ভাল করে জেনে নিয়েছে এদের রুটিন। বাড়ির পেছনের গ্যারাজে জংধরা ফোর্ড জিপ রেখেছে এরা। ইগনিশনেই থাকে চাবি। বাড়ির বেড়া টপকে কুঁজো হয়ে পেছন জানালার তলা দিয়ে পৌঁছুনো যায় জিপের কাছে। দিনের এ সময়ে বিয়ার গিলতে গিলতে রামি খেলে লোকদু’জন।

যুবক এ-ও জানে, এরা কোথায় রেখেছে বন্দিনীকে।

বিধ্বস্ত কিচেনে উড়ন্ত ধুলোবালি থিতু হওয়ার আগেই ওয়ালথার হাতে বাড়ির অভ্যন্তরে পা রাখল যুবক। একবার দেখল হাতঘড়ি। দেয়াল ভেঙে ঢোকার পর পেরিয়ে গেছে পুরো দুই মিনিট।

কঠিন দুই লাথি খেয়ে কবজা ভেঙে একদিকে কাত হলো বন্দিনীর ঘরের দরজা। বিছানায় বসে ভয়ে কাঁপছে কিশোরী মেয়ে। ভেতরে ঢুকল যুবক। বিছানার কোণে চাদর গায়ে কুঁকড়ে বসে আছে মেয়েটা, চোখে ভীষণ আতঙ্ক।

যুবক ভাল করেই জানে, মেয়েটির বয়স মাত্র তেরো বছর বারো দিন। মেয়েটার পাশে থামতেই কান্নার ভঙ্গিতে বিকৃত হয়ে গেল কিশোরীর মুখ। ওকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেবে? একবার ভাবল যুবক, তারপর সিদ্ধান্ত নিল: প্রয়োজন নেই

যুবক মুখ থেকে স্কি মাস্ক খুলতেই তার সুপুরুষ তামাটে চেহারা দেখতে পেল মেয়েটা। কুচকুচে কালো মণিদুটো দেখছে ওকে। ওখানে খেলা করছে অদ্ভুত মায়া। আস্তে করে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল যুবক। নরম সুরে বাংলা ভাষায় বলল, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

কান্না ভুলে দ্বিধান্বিত চোখে তাকে দেখছে কিশোরী। এ বাড়ির সবার চোখে চরম নিষ্ঠুরতা দেখেছে ও। এই যুবক একদম আলাদা।

জ্যাকেটের পকেট থেকে নিয়ে মেয়েটাকে একটা ছবি দেখাল যুবক। ওটাতে আছে মাঝবয়সী এক দম্পতি। মাত্র দশ দিন আগেও নিরাপদে তাঁদের কাছেই ছিল একমাত্র সন্তান লিলি। তারপর আকাশ ভেঙে তাদের ওপর নেমে এল ভয়ানক বিপর্যয়।

‘কোনও ভয় নেই,’ নিচু গলায় বলল যুবক। ‘আমার নাম মাসুদ রানা। তোমার বাবা-মা অপেক্ষা করছেন তোমার জন্যে। দু’এক দিনের ভেতর তাঁদের কাছে তোমাকে পৌঁছে দেব।’

দরদর করে দু’চোখ বেয়ে পানি নেমে গাল ভিজিয়ে দিল কিশোরী লিলির। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি পুলিশ?’

মৃদু মাথা নাড়ল রানা। ‘না, পুলিশ নই।’ হাত বাড়িয়ে দেয়ায় ওর বাহু ধরে বিছানা থেকে নামল খোন্দকার আসমা লিলি। পরনে দামি, তবে ঘামে ভেজা, ময়লা লাল ব্লাউজ ও সবুজ পেটিকোট। গত ক’দিনে কুঁচকে গেছে ওগুলো। এখন ঘরে নেই ওর প্রিয় সবুজ শাড়িটা। লিলি খেয়াল করছে, ওর প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ নেই যুবকের চোখে।

রানার হাত ধরে ঘর থেকে বেরোল লিলি। কিচেনের মেঝেতে দুটো লাশ দেখেও কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না ওর। বাড়ি থেকে বেরোতেই সূর্যের কড়া রোদে কুঁচকে গেল চোখ। গত ক’দিন বসে থেকে আড়ষ্ট হয়ে গেছে ওর হাত-পা। একটু টলমল করছে মেয়েটা। তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে একটু দূরের ঝোপে ঢুকল রানা। সাবধানে লিলিকে তুলে দিল ল্যাণ্ড রোভার জিপের প্যাসেঞ্জার সিটে। ভয় ও শীতে থরথর করে কাঁপছে বেচারি। পেছন-সিট থেকে ব্ল্যাঙ্কেট নিয়ে ওর হাতে দিল রানা। চট্‌ করে দেখল হাতঘড়ি।

কিডন্যাপারদের অন্য তিনজন ফিরবে আরও পাঁচ মিনিট পর। এটাই তাদের নিয়মিত রুটিন।

গাড়ির নাক ঘুরে ড্রাইভারের দরজা খুলল রানা। ‘চলো, এবার রওনা হওয়া যাক।’

জবাবে খুব দুর্বল কণ্ঠে অস্ফুট কী যেন বলল মেয়েটা।

‘কিছু বললে?’ জানতে চাইল রানা।

‘সিণ্ডির কী হবে?’ একটু জোরে জিজ্ঞেস করল লিলি। চেয়ে আছে রানার চোখে।

সরু হলো বিসিআই এজেন্টের দুই চোখ। ‘সিণ্ডি কে?’

তর্জনী তুলে বাড়িটা দেখাল লিলি। ‘ওখানে রয়ে গেছে।’

‘তাকেও কি তোমার মতই কিডন্যাপ করা হয়েছে?’ আস্তে করে মাথা দোলাল লিলি। ‘একই স্কুলে পড়ি আমরা।’

সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিল না রানা। ‘ঠিক আছে, চুপ করে একটু বোসো। তিন মিনিটের ভেতর ফিরছি।’

মাথা দোলাল কিশোরী।

‘বলো তো, বাড়ির কোথায় ওকে পাব?’ জানতে চাইল রানা।

মেয়েটা যেখানে থাকবে বলে জানিয়েছে লিলি, দু’মিনিটের ভেতর সে-ঘরের সামনে পৌছে গেল বিসিআই এজেন্ট। বাইরের ঘরে ট্রাইপড়ে কয়েকটা ক্যামেরা। কিছুটা দূরে সরু বিছানা। ঘরের কোণে সস্তা লাইটিং ইকুইপমেন্ট ও মিউট করা টিভি। নিঃশব্দে চলছে ভিসিআর। টিভির ইমেজ দেখে মুহূর্তে সব বুঝে গেল রানা। লোকগুলোর ভেতর চিনতে পেরেছে একজনকে। এখন কিচেনে লাশ হয়ে পড়ে আছে সে। উলঙ্গ জানোয়ারটা চড়াও হয়েছিল বারো বছরের নিষ্পাপ এই কিশোরীর ওপর।

প্রচণ্ড রাগে অন্তরটা জ্বলছে রানার। লাথি মেরে টেবিল থেকে টিভি ফেলতেই মেঝেতে পড়ে বিকল হলো ওটা। চারদিকে ছিটিয়ে গেল স্ফুলিঙ্গ।

সিণ্ডির ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, ভয়ঙ্কর নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে বেচারির। ভিডিয়োর সেই একই মেয়ে। কড়া ড্রাগ দেয়া হয়েছে বলে শ্বাস-প্রশ্বাস নেই বললেই চলে। নড়ছে না বুকের পাঁজর। পরনে ময়লা টি-শার্ট ও জাঙ্গিয়া। সাবধানে মেয়েটাকে বিছানা থেকে তুলে কাঁধে নিল রানা। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢুকল ঝোপের ভেতর। শুইয়ে দিল ল্যাণ্ড রোভারের পেছন-সিটে নিজের জ্যাকেট খুলে ঢেকে দিল শীর্ণ, অপুষ্ট দেহ। সিণ্ডির হাত ধরল লিলি, ঘুরে তাকাল রানার চোখে। ওর দৃষ্টিতে একহাজার নীরব প্রশ্ন।

‘সুস্থ হয়ে উঠবে,’ বলল রানা। সতর্ক হয়ে উঠেছে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে। ফিরছে অন্য তিন কিডন্যাপার। ঘন ঝোপের ভেতর ল্যাণ্ড রোভার চোখে পড়বে না তাদের। কালো জিপগাড়ি কিচেনে ঢুকলেও আপাতত আছে আড়ালে। অবশ্য একটু পর সবই দেখতে পাবে তারা।

ল্যাণ্ড রোভারের ড্রাইভিং সিটে উঠে কান পাতল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর শুনল কর্কশ পুরুষকণ্ঠ। এইমাত্র বাড়ির গেট খুলেছে লোকটা। নুড়িপাথরে কড়কড় আওয়াজ তুলল সুজুকি জিপের চওড়া চাকা। ভাল সাইলেন্সার নেই বলে ইঞ্জিনের আওয়াজ বেশি। জোরালো ফাটফাট আওয়াজে বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল গাড়িটা। খুলে গেল দরজা। আবারও বন্ধ হলো ধুম্ শব্দে। পায়ের আওয়াজ। গলা ছেড়ে হাসছে লোকগুলো।

নিঃশব্দে ড্রাইভিং দরজা বন্ধ করল রানা। ইগনিশনের দিকে হাত বাড়িয়ে ভাবছে: কেউ বুঝবার আগেই ঝড়ের বেগে চলে যাব বহু দূরে। দু’এক দিনের ভেতর লিলি আর সিণ্ডিকে পৌছে দেব ওদের অভিভাবকদের হাতে। এরপর আবার ফিরব। প্রতিশোধ নেব জুনায়েদের করুণ মৃত্যুর। চরম শাস্তি পেতে হবে এই কিডন্যাপারদেরকে।

ইগনিশনের চাবিটা ধরেও হঠাৎ করেই সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল রানা। কেমন যেন থমকে গেছে। মনের আয়নায় একে একে ভেসে উঠছে জুনায়েদের হাসিমুখ ও গুলিতে ঝাঁঝরা বুক নিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়া লাশ। রানার মনে পড়ল, টিভির সেসব নোংরা দৃশ্য। কিডন্যাপার লোকটা দু’হাতে খামচে ধরেছে কিশোরীর অপুষ্ট স্তন। প্রাণপণে আর্তচিৎকার করছে মেয়েটা। শরীর মুচড়ে সরে যেতে চাইছে দানবের কাছ থেকে। ক্ষয়ে যাওয়া বড় বড় দাঁত বের করে হাসছে লোকটা।

কাঁধের ওপর দিয়ে অচেতন সিণ্ডিকে দেখল রানা।

পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখছে লিলি, চোখে ভয়।

অন্তর থেকে কে যেন রানাকে জানিয়ে দিল, এবার কী করতে হবে। সিটের নিচ থেকে একটানে ব্যাকআপ ওয়েপনটা নিল রানা। অস্ত্রটা কালো রঙের ভয়ঙ্কর-দর্শন বারো গজের ইথাকা ইতালিয়ান শটগান। নল কেটে নেয়ায় সবমিলে দৈর্ঘ্যে দু’ফুট। টিউব ম্যাগাজিনে ০০ বাক রাউণ্ড। দুর্ভেদ্য কোনও ঘরে ঢুকতে হলে এই জিনিসই চাই।

দরজা খুলে ল্যাণ্ড রোভার থেকে নেমে পড়ল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো।’

কিডন্যাপাররা বাড়ির সামনের বারান্দায় উঠতে না উঠতেই তাদের পেছনে পৌঁছে গেল রানা। মোটা লোকটা তুর্কি ভাষায় বাজে কৌতুক বলছে লম্বা সঙ্গীকে। তৃতীয়জনকে বিপজ্জনক মনে হলো রানার। তার হাতে একগোছা চাবি কোমরের বেল্টে কোল্ট ১৯১১-এ১ মডেলের নকল চাইনিয পিস্তল। অপেশাদারী ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখা হয়েছে হ্যামার।

ক্ল্যাক-ক্ল্যাঙ্ক শব্দে কক হলো ইথাকা শটগান। ধাতব শব্দটা শুনেই চরকির মত ঘুরে তাকাল তিন কিডন্যাপার। বিস্ফারিত হলো তাদের আতঙ্কিত চোখ। অস্ত্র বের করার কোনও সুযোগ পেল না তারা। লম্বা লোকটা হাঁ করতেই ঠোঁট থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত সিগারেট।

বরফ-শীতল চোখে তিন নরপশুকে দেখছে মাসুদ রানা। পরমুহূর্তে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ইথাকার ম্যাগাজিন খালি করল তিন জানোয়ারের বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *