1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ২২

বাইশ

একটু পর ভোর হবে।

ইংলিশ চ্যানেলের বিক্ষুব্ধ জল কেটে হেলে-দুলে এগিয়ে চলেছে সাদা ইয়ট আইল্যাণ্ডার। দূরে গাঢ় নীল দিগন্তের গায়ে ঝিকমিক করছে ফ্রান্সের জনপদের খুদে সব রঙিন আলো। ঝড় থামার পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছে সাগর। ইয়টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়তে উড়তে কর্কশ শব্দে ডাকছে কয়েকটা সি- গাল। ওঅটর-প্রুফ পোশাক ছেড়ে কেবিনের দিকে চলল রানা। পাশ কাটাচ্ছে যখন, আদর করে ওর কাঁধ চাপড়ে দিল স্কিপার রাফায়েল। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে খুব ক্লান্ত বৃদ্ধ।

হ্যাচওয়ে পেরোবার পর রানার সঙ্গে দেখা হলো লিয়ার। দুশ্চিন্তার ছাপ ওর চোখে। হাতে ফ্রাইং প্যান। ওটা থেকে আসছে ভাজা মাংসের লোভনীয় সুবাস।

জিভে পানি চলে এল রানার।

নরম সুরে বলল লিয়া, ‘নাস্তা তৈরি।’

‘গর্ডন কোথায়?’ সিঁড়ি বেয়ে নামল রানা।

‘এখনও বোধহয় নিজের কেবিনে ঘুমাচ্ছে।’

‘সত্যিকারের ক্যাপ্টেন,’ বিড়বিড় করল রানা।

মন্তব্য না করে ওর হাতে বাটারটোস্টের সঙ্গে ভাজা মাংস ও স্ক্র্যাম্বল করা ডিম ভরা বড় একটা প্লেট ধরিয়ে দিল লিয়া রানা ডাইনিং রুমে বসতেই জ্যাকেট পরে ওপরের ডেকে চলে গেল ও স্কিপার রাফায়েলকে নাস্তা পৌঁছে দিতে।

রানা নাস্তা খেতে শুরু করতেই দড়াম করে খুলে গেল মাস্টার কেবিনের দরজা। ভুরু কুঁচকে বেরিয়ে এল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। ভীষণ রাগে লাল হয়ে আছে তার মুখ।

এদিকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে লিয়া। গর্ডনের চেহারা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

‘খবরদার, একটুও নড়বে না,’ কর্কশ স্বরে রানাকে বলল গর্ডন। ডানহাতে শক্ত করে ধরেছে প্যারা-অর্ডন্যান্স পিস্তল। নল সরাসরি তাক করা রানার বুকের দিকে।

একটু থমকে গিয়ে পিস্তলের দিকে তাকাল রানা।

‘খুব অবাক হচ্ছ, মেজর, নাকি?’ আড়ষ্ট হাসি দিল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। ‘লিয়া, এই লোক আসলে তোমার বন্ধু নয়। এর চেয়ে হারামি লোক জীবনে দেখিনি। তুমি জানোও না এর ব্যাগের ভেতর কী পেয়েছি। তিন-তিনটে পিস্তল, সঙ্গে গাদাগাদা গুলি।’ রানার ওপর পিস্তল তাক করে রেখে নিজের কেবিনের দরজার ওদিক থেকে ক্যানভাস ব্যাগ টেনে আনল সে। ‘শুধু যে পিস্তল, তা নয়। এই ময়লা ব্যাগের ভেতর আছে বড় নোটে সবমিলিয়ে পনেরো হাজার ইউরোরও বেশি। এবার জবাব দাও, মেজর! অস্ত্র চোরাচালানি, তাই না? ড্রাগও বিক্রি করে বেড়াও? দুটোই একইসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছ?’ বিজয়ীর হাসি ফুটল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডনের মুখে। ‘তবে যা-ই করে বেড়াও, এবার আর তোমার রেহাই নেই। আমি তোমাকে গ্রেফতার করছি। এবার ডেকে আনব পুলিশ আর কোস্ট গার্ড।’

‘গর্ডন,’ কাতর স্বরে বলল লিয়া। ‘তুমি কি পাগল হলে?’

‘ভয় পেয়ো না। তোমার নাম প্রকাশ হবে না। তুমি তো আর এসবের ভেতর জড়িত নও, তাই না?’

‘তুমি এত গাধা কেন, বলো তো, গর্ডন?’ বলল লিয়া। ‘যা খুশি করে বোসো না। পরে তোমাকে ব্যাখ্যা করে সব খুলে বলব। আমরা কোনও অপরাধ করছি না।’

ওর কথা পাত্তা না দিয়ে রানার দিকে পিস্তলের নল নাচাল লোকটা। ‘নিজেকে কী ভাবো, মেজর? শেষপর্যন্ত আমার হাতে ধরা তো তোমার পড়তেই হলো!’

উদাস মুখে চুপচাপ নাস্তা খেয়ে চলেছে রানা। শুকনো গলায় বলল, ‘পিস্তলের ব্যাপারে সবসময় মেনে চলতে হয় তিনটে নিয়ম। ওগুলো কি তুমি জানো, গর্ডন?’

‘তোমার কাছ থেকে কিছু শিখতে হবে না আমার, আরও লাল হলো গর্ডনের মুখ। ঠোঁটে টিটকারির হাসি।

‘কিন্তু সিঙ্গল অ্যাকশন সেমিঅটোমেটিক পিস্তলের ক্ষেত্রে ওই তিন নিয়ম সর্বদা প্রযোজ্য।’

অনিশ্চিত হাসল গর্ডন। বুঝতে চাইছে রানার বক্তব্য আসলে কী।

নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে নরম সুরে বলল রানা, ‘প্রথমে কক করে লক করবে পিস্তল। গুলি করতে হলে অফ করবে সেফটি ক্যাচ। তারপর ট্রিগার টিপে দিলেই খুন হব আমি।’ প্লেট সামনে ঠেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে মিউযিক ডিরেক্টরের দিকে পা বাড়াল রানা।

‘সাবধান, আমি কিন্তু গুলি করে দেব!’ হুমকি দিল গর্ডন।

‘চেম্বারে বুলেট থাকলে আগে কক করবে হ্যামার। সেজন্যে ব্যবহার করবে বুড়ো আঙুল।’ আরেক পা সামনে বাড়ল রানা।

‘আমি কিন্তু সাবধান করেছি তোমাকে…’

‘অস্ত্রের হ্যামারিং নেইল ঠিক রাখতে হলে চেম্বারে গুলি রাখবে না ভাল শুটার।’ গর্ডনের সামনে পৌঁছে গেছে রানা। ওর বুকের একইঞ্চি দূরে কালো মাল। থরথর করে কাঁপছে গর্ডনের পিস্তল ধরা হাত।

‘তবে, গাধা, গুলিই তো নেই তোমার পিস্তলের চেম্বারে! ওটা আমার হাতে দাও, নইলে লাথি মেরে তোমার মোটকা পাছা ফাটিয়ে দেব।’ হাত বাড়িয়ে পিস্তল কেড়ে নিল রানা। চেক করে দেখল ম্যাগাযিন। ভেতরে এগারোটা গুলি। ব্যাকপ্যাক তুলে বুঝল, অনেক হালকা হয়েছে ওটা। টাকা আছে, তবে সরিয়ে নেয়া হয়েছে পিস্তল ও গুলি ভরা বাড়তি ম্যাগাযিন। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল রানা, ‘অন্য দুই পিস্তল কোথায়?’

অস্বস্তি নিয়ে দু’হাত ডলছে মিউযিক ডিরেক্টর। ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। নিচু গলায় বলল, ‘ফেলে দিয়েছি।’

‘সাগরে?’

মাথা দোলাল গর্ডন।

কোমরের বেল্টে পিস্তল গুঁজল রানা। ‘লিয়া, খুঁজে বের করো ফ্রান্সের উপকূলের ম্যাপ।’ কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল গর্ডনের চোখে। ‘সোজা সেঁধিয়ে যাও নিজের কেবিনে। আবারও বেরোলে নোঙরের সঙ্গে বেঁধে সাগরে ফেলে দেব।’

প্রাণভয়ে ছুটে মাস্টার কেবিনে গিয়ে ঢুকল সুরকার। সে দরজা বন্ধ করার আগেই রানা বলল, ‘আরেকটা কথা, গর্ডন।’

‘কী?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল লোকটা।

‘তোমার নির্দেশনায় তৈরি দ্য ফায়ার ইন অ্যাটিক ভাল করেই দেখেছি,’ ডাহা মিথ্যা বলল রানা। ‘ওটার মত এত পচা সিনেমা জীবনেও দেখিনি!’

পেটে লাথি খেলেও এতটা কুঁকড়ে যেত না ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। নীরবে বন্ধ করে দিল কেবিনের দরজা।

‘ওকে তো একদম পিষে দিলে।’ টেবিলে মানচিত্র রাখল লিয়া। ‘বেচারা ভেবেছিল ভয়ঙ্কর এক চোরাচালানির হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করছে।’

জবাব না দিয়ে মানচিত্র দেখতে লাগল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *