1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৭

সাত

সরু পথে মানুষ বা গাড়ির আনাগোনা নেই। স্কয়্যারে পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল লিয়া ও রানা। ছোট এক দোকান থেকে কিনল দু’তিন দিন চলার মত খাবার। লিয়া ফোন দিল স্থানীয় এক ট্যাক্সি সার্ভিস এজেন্সিতে। ফলে মিনিট দশেক পর হচিন্সটন হলে ওদেরকে পৌছে দিতে হাজির হলো তোবড়ানো এক সবুজ ট্যাক্সি।

বরফে ছাওয়া শীতার্ত ওক ও উইলো গাছের মাঝ দিয়ে গেছে আঁকাবাঁকা দীর্ঘ পথ। অক্সফোর্ডশায়ারে জন্স গ্রামের আকাশে নেমেছে সন্ধ্যার কালো আঁধার। চারপাশে বিশাল এলাকা নিয়ে মাঝে হচিন্সটন হলের কাউন্টি হাউস। একটু আগে আকাশে উঁকি দেয়া চাঁদের রুপালি আলোয় রানা দেখল, বাড়িটার ফ্যাকাসে ধূসর দেয়াল, উঁচু চিমনি এবং চকচকে ছাত। এ মুহূর্তে আলো নেই কোনও জানালায়। একটু দূরের গাছ থেকে হু-উ হু-উ শব্দে হুতাশ করে উঠল একটা পেঁচা।

ড্রাইভারের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল ওরা। বাড়ির সদর দরজা ভারী ওক কাঠের তৈরি। পাশের পাথুরে দেয়ালে ইলেকট্রনিক প্যানেল। ওখানে লিয়া কয়েকটা নম্বর টিপে দিতেই ডিসআর্ম হলো অ্যালার্ম সিস্টেম। বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বেলে নিল ওরা।

‘চমৎকার বাড়ি,’ ফাঁকা এন্ট্রান্স হলে গমগম করে উঠল রানার কণ্ঠ। প্রশংসার চোখে দেখছে কারুকাজ করা কাঠের প্যানেলিং ও চওড়া সিঁড়ি।

এখন তো কিছুই নেই। তবে সব কাজ শেষ হলে তখন সত্যিই ভাল লাগবে দেখতে।’ একবার শিউরে উঠে হাসল লিয়া। ‘ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা! এই বাড়ির মতই বয়লারটাও অনেক পুরনো। শুনেছি তেমন কাজও করে না।

‘তাতে সমস্যা নেই,’ বলল রানা, ‘আগুন জ্বেলে নিলে কিছুক্ষণের ভেতর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তাপমাত্রা।

‘তুমি সঙ্গে এলে সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ, রানা।’

লিয়ার পিছু নিয়ে মস্ত কিচেনে পা রাখল রানা। পাইনের বড় টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ। প্রথম সুযোগে পরীক্ষা করে দেখল কিচেনের দরজা। ঠিকভাবেই কাজ করছে পুরনো আমলের তালা। কয়েকটা ড্রয়ার টেনে দেখার পর দরকারি জিনিসটা পেয়ে গেল রানা। লিয়ার অগোচরে চট্ করে ওর জ্যাকেটের ভেতরে চলে গেল করাতের মত ফলাওয়ালা ছুরিটা।

‘এবার বাইরে থেকে জ্বালানি কাঠ আনতে হবে,’ বলল রানা। ‘একটু দেখেও আসব চারপাশটা। আমি বেরিয়ে গেলে ভেতর থেকে দরজায় তালা মেরে দেবে তুমি।’

‘কিন্তু…’

‘দুশ্চিন্তা কোরো না।’

তর্কে না গিয়ে রানা বেরিয়ে যেতেই চাবি ঘুরিয়ে তালা লাগিয়ে দিল লিয়া। শুনতে পেল করিডোরে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে রানার পদশব্দ।

গ্রামের দোকান থেকে কেনা ওয়াইনের বোতলের ছিপি খুলল লিয়া। ওয়াক-ইন প্যান্ট্রিতে ঢুকে সংগ্রহ করল দুটো গ্লাস। আবার কিচেনে ফিরে এসে দেয়াল থেকে ঝুলন্ত ভারী লোহার ফ্রাইপ্যান নিয়ে চাপিয়ে দিল গ্যাসের চুলার ওপর। শপিং ব্যাগ থেকে ডিম নেয়ার সময় আনমনে হাসল। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর। এত দিন পর আবারও ওর পাশে মাসুদ রানা! পাগলের মত ভালবেসেছিল ও এই অদ্ভুত মানুষটাকে। খুশিমনেই দূরে ছুঁড়ে ফেলত নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। কিন্তু শেষে মিলন হলো না ওদের। সবই আসলে কপালের লিখন। নইলে আজ হয়তো রানার সঙ্গে ছোট্ট কোন কিচেনে বসে গল্প করত ও। সর্বক্ষণ ওকে ব্যস্ত করে রাখত দুটো কি তিনটে বাচ্চা। ওদের ভেতর শৈশবের রানাকে দেখত সকৌতুকে। বুক চিরে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লিয়ার।

‘তুই ওকে খুব পছন্দ করিস, তা-ই না?’ একবার বলেছিল ওর ভাই অ্যালেক, ‘কিন্তু মনে রাখিস, রানা যেমন ধরনের মানুষ, তুই হয়তো কোনদিনই সুখী হবি না।’

বোধহয় অ্যালেকের কথাই ঠিক। তখন ওর কাঁচা বয়স। রানাও সবে মাত্র যুবক হয়ে উঠেছে। কী মিষ্টি করেই না হাসত! আর চোখদুটোর কুচকুচে কালো মণিতে খেলা করত অদ্ভুত এক মায়া। আগে কখনও কারও চোখে এমন দুর্বার আকর্ষণ দেখেনি লিয়া। আজ সবই রূপকথার মত লাগছে ওর কাছে। প্রথম দর্শনে পড়ে গিয়েছিল রানার প্রেমে। আর ওটাই ছিল ওর শেষ প্রেম। ওদের দু’জনের পরিচয়ের পর তিনটে মাস কীভাবে উড়ে পার হয়ে গিয়েছিল, নিজেও বুঝতে পারেনি লিয়া। শেষবার যখন দেখা হলো, দ্বিতীয়বারের মত ওর ঠোঁটে চুমু এঁকে দিয়েছিল রানা। কথা ছিল, পরদিন বিয়ে করবে ওরা। অথচ… তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেল মানুষটা!

ভাবতে গেলে অবাক লাগে, এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ ছয়টা বছর!

কে জানে, কতটা বদলে গেছে রানা?

আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে ওর মুখ। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি-হাসিটা সবসময় থাকত, আজ আর তা নেই। বরাবরের মতই সুঠামদেহী হলেও ক্ষিপ্র চিতার মত হয়েছে ওর চলার গতি। আগে এমন দৃঢ়পায়ে হাঁটত না। চোখের দৃষ্টি বদলে গেছে। কথা বলে কম: টু দ্য পয়েন্ট।

থাক না রানার কথা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল লিয়া।

অ্যালেক একদিন বলেছিল, দুনিয়ার নানান প্রান্তে ভয়ঙ্কর সব অপারেশনে জড়িয়ে গেছে রানা। একদম পাল্টে গেছে। কাজেই ওর উচিত রানার কথা ভুলে যাওয়া। বিষাদময় অতীত নিয়ে ভাবতে চাইছে না লিয়া। নিজেকে ব্যস্ত করে তুলল রাতের খাবার তৈরির কাজে।

.

স্টাডিরুমে ফায়ারপ্লেসের সামনে কার্পেটে বসেছে লিয়া ও রানা। এই ঘরটা মস্তবড় বাড়ির অন্যসব ঘরের চেয়ে আকারে ছোট। রানা কিছুক্ষণ আগে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে দেয়ার পর গরম হয়ে উঠেছে স্টাডিরুম। আগুনের দাউ দাউ কমলা শিখার প্রতিচ্ছবি পড়ছে চকচকে ওক কাঠের প্যানেলে। ঘরের চার কোনায় মৃদু দুলছে অদ্ভুত সব ছায়া। একদিকে কয়েকটা প্যাকিং কেস, কার্ডবোর্ডের বাক্স, খোলা হয়নি এখনও।

‘ভাজা ডিমের স্যাণ্ডউইচ আর কমদামি ওয়াইন,’ হাসল লিয়া। ‘আমিও হয়ে গেছি তোমারই মত সৈনিক!’

চুপ করে থাকল রানা।

স্যাণ্ডউইচে কামড় দেয়ার ফাঁকে ওয়াইনের বোতল হাত বদল করছে ওরা। মিনিট পাঁচেক পর আধখালি হলো বোতলটা। অ্যালকোহলের কল্যাণে মনের অস্বস্তি কমে গেছে লিয়ার। খাবার শেষ করে লালচে আগুনের নৃত্যরত শিখার দিকে চেয়ে নীরবে বসে থাকল ওরা।

আগুনের আভায় লিয়াকে দেখছে রানা। মনে পড়ছে শেষবার কবে বসেছে ওর পাশে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। কঠিন এক ট্রেইনিঙের ফাঁকে ছুটি পেয়ে মধ্য ওয়েল্‌স্-এ অ্যালেক ও লিয়ার বাবা গ্যারি বেকারের বাড়িতে জড় হয়েছিল ওরা। বাড়িটা ছিল অনেক পুরনো। হারিয়ে বসেছিল আগের আভিজাত্য। অযত্নে উঠানে জন্মেছিল ঝোপঝাড়। লিয়ার বাবা ছিলেন পিয়ানো মেরামতকারী এক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তবে সময়টা ভাল যাচ্ছিল না তাঁর। মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। পেকে গিয়েছিল চুল-দাড়ি। অতিরিক্ত পর্ট গিলতেন বলে দুই গাল লালচে দেখাত। বিষাদে ছাওয়া চোখে কী যেন হারিয়ে ফেলার অব্যক্ত যন্ত্রণা। আসলে কোনদিন মেনে নিতে পারেননি কোলন ক্যান্সারে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর অকাল মৃত্যুটাকে।

রানার সম্পর্কে সবকিছু জানবেন বলে স্টাডিরুমে ডেকে নেন তিনি অ্যালেককে। নিচতলায় বসে ছিল রানা ও লিয়া। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। জানালার কাঁচ বেয়ে নামছে অবিশ্রান্ত জলের ধারা। ফায়ারপ্লেসে দাউ দাউ আগুনের লাল শিখা। কয়েক ঘণ্টা পাশাপাশি বসে গল্প করেছিল ওরা। সেদিনই প্রথমবারের মত লিয়ার ঠোঁটে চুমু দিয়েছিল ও। এবং তারপর, দ্বিতীয়বার…

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার। চট্ করে ফিরল বাস্তবে। আগুনের কম্পিত আলোয় দেখল লিয়ার ফর্সা গাল। গত ক’বছরে অঢেল সুনাম পেলেও বোধহয় একটুও বদলে যায়নি মেয়েটা।

‘কী ভাবছ?’ মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।

আগুনের দিক থেকে ওর দিকে ফিরল লিয়া। ‘ভাবছি তোমার কথাই।’

‘আমি তো অতি সামান্য মানুষ; দুনিয়া কাঁপানো, নাম করা কোনও গুণী শিল্পী নই।’

‘নিশ্চয়ই বিয়ে করেছ? মেয়েরা তো সবসময় পছন্দ করত তোমাকে।’ সরাসরি রানার চোখে তাকাল লিয়া।

এবার কিছু না কিছু বলতে হবে বুঝতে পেরে সোজাসাপ্টা জানাল রানা, ‘না, লিয়া। বিয়েটা করা আর হয়ে ওঠেনি।’

‘তা হলে আগের মতই রয়ে গেছ: যেদিকে মন, সেদিকে গমন? স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী?’

তিক্ততার তীর নীরবে হজম করল রানা। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘এ-ই বোধহয় ভাল হয়েছে, লিয়া।’

‘অথচ আমি তোমাকে সত্যিই ভালবেসেছিলাম,’ অস্ফুট স্বরে বলল লিয়া।

‘আমিও,’ ওকে দেখল রানা।

আগুনের দিকে ফিরল লিয়া। ‘সত্যিই কি তাই?’

‘আমার প্রাণের চেয়েও অনেক বেশি।‘

‘কিন্তু সবসময় তোমার কাছে চাকরিই ছিল একনম্বরে।‘

‘তুমি তো জানতে, আমার চাকরি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত, ওই দায় কখনও এড়ানো যায়?’

‘অ্যালেক ঠিকই বলেছিল, আজও সেই চাকরিই তোমার জীবনের সবকিছু।’

নীরবে মাথা দোলাল রানা।

‘সেদিন অপেরায় ছিল আমার প্রথম শো,’ ফিসফিস করল লিয়া। ‘খুব খুশি হয়ে ভেবেছিলাম শ্রোতাদের ভেতর না থাকলেও ঠিক সময়ে তুমি পৌঁছে যাবে।’

চুপ করে আছে রানা।

‘তুমি বুঝতেও চাওনি যে ভেঙে দিচ্ছ আমার বুকটা,’ নিচু গলায় বলল লিয়া।

‘যেদিন আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা, তার আগের রাতে এল জরুরি তলব—তক্ষুণি ফিরতে হবে,’ বলল রানা। ‘তবে প্রথম সুযোগে তোমাকে ফোন করেছি। একবার নয়, বহুবার। কিন্তু তুমি আমার কল রিসিভ করোনি। মেসেজ দিয়েছি, জবাব দাওনি। তারপর সব বিস্তারিত জানিয়ে ই-মেইল করেছি। বহুবার। সেগুলো তো তুমি পেয়েছিলে, তা-ই না?’

একটু থমকে গিয়ে চট্ করে রানার দিকে তাকাল লিয়া। ‘তোমার কল রিসিভ করার কোনও যুক্তি ছিল না। এত অপমানিত হয়েছি যে খুলে দেখিনি মেসেজ। কোনদিন ভুলব না, কথা দিয়েও তুমি আসোনি। নিজেকে অসহায়, বঞ্চিত, প্রতারিত মনে হয়েছিল সেদিন। বান্ধবীদের কাছে খুব ছোট হয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উধাও হবে আমার নায়ক। আমার ধারণা, বানিয়ে বলছ এখন; তুমি আসলে ই-মেইল করোইনি। করে থাকলে রাগ কমলে নিশ্চয়ই খুলে দেখতাম তোমার কৈফিয়ত।’

‘তখন হু-হু করে বাড়ছে তোমার ব্যস্ততা,’ নরম কণ্ঠে বলল রানা। ‘তাই কি আমার মেইল চোখে পড়েনি তোমার? এতগুলো চিঠি লিখলাম… একটাও পাওনি?’

‘কই, না!’

‘আর কারও অ্যাকসেস ছিল তোমার কমপিউটারে?’

পলকের জন্যে লিয়ার চোখে ফুটল দিশেহারা একটা ভাব। বলল, ‘অ্যালেক দেখত। তুমি ভাবছ ও মুছে দিয়েছে ওসব?’

‘আমি কিছুই ভাবছি না। আন্দাজ করতেও চাই না।’

রানার কথাটা কাঁপিয়ে দিয়েছে লিয়াকে। ও জানে, মিথ্যে বলার মানুষ রানা নয়। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখ। বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল পেলব হাতের ফর্সা, সুগঠিত আঙুলের লাল নেইল পলিশের দিকে। আজ বারবার ভেবেছে, ওর জীবনটা কেমন হতো রানা ওকে বিয়ে করলে! আর এখন এস শুনছে? অ্যালেক রানার পাঠানো ই-মেইল গোপন না করলে হয়তো সত্যিই বদলে যেত ওর জীবন!

‘ভাবতেও পারিনি আমারই আপন ভাই তোমার আর আমার মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে,’ আগুনের লাল শিখার দিকে তাকাল লিয়া। রানা আর ওর প্রতি চরম অন্যায় করেছে অ্যালেক। তবে আজ আর কোনও জবাবদিহি করতে পারবে না সে। লিয়া আর কখনও তাকে বলতে পারবে না, ‘ভাইয়া, আমরা কী অন্যায় করেছিলাম যে তুমি এমন নিষ্ঠুর কাজটা করলে!’

চুপচাপ গনগনে আগুনের দিকে চেয়ে আছে ওরা। কারও কিছু বলার নেই। চিমনির দিকে ছিটকে উঠছে লাল সব স্ফুলিঙ্গ।

বেশ অনেকক্ষণ পর বলল লিয়া, ‘অ্যালেকের কথা মনে পড়ছে। অনেক বড় ছিল ওর মন। ও কেন এরকম একটা কাজ করতে গেল…’

‘কারণটা জানি না, তবে আঁচ করতে পারি,’ বলল রানা। ‘অ্যালেক ধরে নিয়েছিল, আমরা দু’জন আসলে আলাদা দুই জগতের মানুষ। বিয়ে হলে সেটা শেষ হতো বিচ্ছেদের মাধ্যমে। তাই চায়নি আমার কৈফিয়ত তোমাকে নরম করে ফেলুক। অথচ আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল অটুট।’

‘সুযোগ পেলেই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো ও।’

‘আমিও ওকে খুব পছন্দ করতাম,’ বলল রানা। ‘এত কম বয়সে চলে যাবে, ভাবতে পারিনি।’

‘ও বলেছে, তুমি নাকি হয়ে উঠেছ দুনিয়ার সেরা যোদ্ধা।’

হাসল রানা। তারপর প্রসঙ্গ বদলে হঠাৎই প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, কেন ওই লেকে গিয়েছিল অ্যালেক বলতে পারো?’

‘কারও জানা নেই,’ বলল লিয়া, ‘সেরাতে ওর সঙ্গে যে মেয়েটা ছিল, সে বলেছে: বরফ ভেঙে পানিতে তলিয়ে যায়।’

‘ওই মেয়ে আসলে কে?’

‘নাম মেরি বার্নলে। গত বছর অস্ট্রিয়ায় সুইট্যারল্যাণ্ডের যে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাঁর স্ত্রী সে। অ্যালেককে জড়িয়ে মেয়েটার নামে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্রী বদনাম। অবশ্য রাজনৈতিকভাবে চাপা দেয়া হয় পুলিশি ফাইল। সাধারণ মানুষ আর জানতে পারেনি কী ধরনের তদন্ত করা হয়েছে।’

‘আমাকে কি খুলে বলবে, আসলে কী হয়েছিল?’ বলল রানা।

‘বেশি কিছু তো নিজেই জানি না। তবে সেদিন অ্যালেক ছিল ভিআইপিদের এক পার্টিতে। জানি না ওখানে কারা ছিল। ওর ওই দুর্ঘটনা অন্য কেউ দেখে থাকলেও মুখ খোলেনি।’

‘ভিআইপি?’ বলল রানা। ‘যতটা চিনতাম অ্যালেককে, ও তো ওই ধরনের পার্টিতে যাওয়ার মত মানুষ ছিল না।

‘সেরাতে লেকের ধারে গিয়েছিল মেয়েটাকে নিয়ে। পুলিশি জেরার সময় মেরি বার্নলে বলেছিল, তাকে পাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে অ্যালেক। পার্টিতে আসতে দেরি করছিলেন তার স্বামী। তখন একটু বেশি শ্যাম্পেন খেয়ে ফেলে সে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গিলছিল আমার ভাইও।’

‘একটু বেশিই খেত,’ স্বীকার করল রানা।

‘একইসঙ্গে নেচেছে ওরা। একইসঙ্গে ড্রিঙ্ক করেছে। তবে আমার ভাইয়ের মত অত মাতাল ছিল না ওই মেয়ে। দূরে কোথাও গিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটাতে চাইল ওরা। মেরি বার্নলে পুলিশকে পরে বলেছে, আমার ভাই বারবার চেয়েছিল ভাল কোন হোটেলের রুম নেবে।’

‘বড়লোকদের পার্টি, অনায়াসেই নির্জন কোন বেডরুম ওরা ব্যবহার করতে পারত।

‘তা করেনি।’

‘মাতাল অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করা অ্যালেকের স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না,’ বলল রানা।

‘আমারও তাই ধারণা,’ বলল লিয়া, ‘কিন্তু হোটেলের দিকে যাওয়ার সময় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে। আমি নিজে দেখেছি ওই গাড়ির সামনের দিক মুচড়ে গিয়েছিল।’

‘ওর সেই ইয়ারিস হ্যাচব্যাক গাড়ি?’

‘সরাসরি কোথাও গুঁতো দিয়েছিল। দেয়াল বা গাছে।’

‘মাতাল হয়ে ভাঙা গাড়ি নিয়ে হোটেলে গেলে সাক্ষীর অভাব থাকত না,’ বলল রানা।

মাথা নাড়ল লিয়া। ‘ওরা হোটেলে যায়নি। তার আগেই ঠিক করেছিল পথের ধারে আড়ালে কোথাও থামবে।’

‘ওই লেকের তীরে?’

মৃদু নড করল লিয়া। ‘তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। মেয়েটার কথা যদি সত্য হয়, আমার ভাই বরফে স্কেট করছিল তখন।’

‘অ্যালেকের চরিত্রের সঙ্গে এসব একটুও মিলছে না।’

‘আমিও অবাক হয়েছি,’ বলল লিয়া। ‘তবে মেরি বার্নলের কথা ঠিক হলে, মাতাল হয়ে অ্যালেক চলে গিয়েছিল বরফে ঢাকা লেকের বেশ ভেতরে। মেয়েটার প্রথমে মনে হয়েছিল খুব মজা হচ্ছে। তবে একটু পর বিরক্ত হয়ে ফিরে যায় গাড়িতে। ঘুমিয়ে পড়ে পেছনের সিটে।’

‘তার মানে মাতাল হয়ে চেতনা হারিয়েছে,’ বলল রানা। ‘তবে সে তুলনায় অনেক কিছুই মনে রেখেছে সে।’

‘তার বলা কথাগুলোই শুধু জানি। আর কোনও সাক্ষী তো ছিল না।’

‘দু’জন ঘনিষ্ঠ সময় কাটাবার পর স্কেট করতে গিয়ে ওই লেকে নেমেছে অ্যালেক?’

‘মেয়েটা বলেছে দৈহিক কিছু ওদের ভেতর ঘটেনি।’

‘তার মানে, হোটেলে যাওয়ার ধৈর্য ছিল না অ্যালেকের, অথচ সেক্স ভুলে চলে গেল লেকের বুকে স্কেট করতে?’

‘এটা আমারও অস্বাভাবিক লেগেছে,’ বলল লিয়া। ‘এমন তো হওয়ার কথা নয়। তবে মাতাল হয়ে গেলে…’

মাথা নাড়ল রানা। ‘ঠিক আছে, আর বাধা দেব না, তুমি পুরো কাহিনী শেষ করো।’

‘ভীষণ শীতে ঘুম ভাঙল মেরি বার্নলের। পুলিশকে পরে বলেছে, গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছিল আধঘণ্টার জন্যে। তারপর ঘুম ভাঙলে বুঝল আশপাশে কেউ নেই। লেক থেকে ফেরত আসেনি আমার ভাই। তবে লেকের বরফের মেঝেতে ছিল গোল একটা গর্ত।’

লোহার পোকার দিয়ে চ্যালা কাঠ ফায়ারপ্লেসের আগুনে গুঁজল রানা। ভাবছে: অ্যালেক প্রশিক্ষিত সৈনিক, তার তো এভাবে বোকার মত ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়!

‘অস্ট্রিয়ায় আসলে কী করছিল অ্যালেক?’ জানতে চাইল রানা।

‘একটা বই লিখবে বলে রিসার্চ করছিল।’

মেঝেতে পোকার রেখে লিয়ার দিকে তাকাল রানা। ‘কী ধরনের বই লিখতে চেয়েছিল?’

‘মোযার্টের ওপর।’

‘বায়োগ্রাফি বা ওই ধরনের কিছু?’

‘মোযার্টের জীবনের কাহিনী তো হাজারটা লেখা হয়েছে,’ বলল লিয়া। ‘অ্যালেক চেয়েছিল মোয়ার্টের মৃত্যু-রহস্যের ওপর রিসার্চ করে একটা বই তৈরি করবে।’

‘অদ্ভুত সাবজেক্ট।’

‘এ বিষয়ে আর কেউ কিছু লিখেছে বলে জানা নেই আমার,’ বলল লিয়া। ‘ওই কাজে মন ঢেলে দিয়েছিল অ্যালেক। নিয়মিত জানাত কেমন চলছে ওর রিসার্চ। আসলে ওর সব খরচ আমিই চালিয়ে নিতাম। তাই সবই শেয়ার করত। আমার হাতে সময় কম বলে ওসব নোট কখনও পড়ে দেখিনি। আর… ওই দুর্ঘটনার পর ইচ্ছে হয়নি সেসব কাগজ ঘেঁটে দেখি। যে-রাতে মারা গেল, তার আগে আমাকে কী যেন পাঠিয়েছিল। কিন্তু মন খারাপ হবে বলে ওটা আর কখনও খুলে দেখিনি।’ মেঝে থেকে ওয়াইনের বোতল তুলে ছোট্ট চুমুক দিল লিয়া। ‘অবশ্য গত কয়েক মাস ধরে ভাবছি, ওর রিসার্চের বাকি অংশটা আমারই লিখে শেষ করা উচিত।’

‘তার মানে ওর লিখতে শুরু করা বইটা তুমি নিজে লিখে শেষ করতে চাইছ?’

‘ওর স্মৃতিরক্ষা করতে চাইলে সেটা করাই ভাল,’ ত তুলে একটু দূরের কয়েকটা কার্ডবোর্ড বাক্স দেখাল লিয়া। ‘মণ্টি কার্লো থেকে সব নোট এনেছি। ওগুলোর ভেতরেই আছে।’ রানার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল লিয়া। ‘তুমি কি আমাকে পাগল ভাবছ?’

‘বইটা লিখে শেষ করতে চাও, সেজন্যে? না। আমার বরং মনে হচ্ছে ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তবে খাটতে হবে অনেক!’

‘তা ঠিক, আমি গায়িকা; লেখিকা তো নই,’ বলল লিয়া 1 ‘তবু মনে হচ্ছে শেষ করতে পারব কাজটা। তাতে নিজেরও ভাল লাগবে। মনে হবে অ্যালেকের জন্যে কিছু অন্তত করতে পেরেছি।’

মেঝে থেকে ওয়াইনের বোতলটা তুলে গলায় লালচে তরল ঢালল রানা। ভাবছে, কিচেন থেকে আনবে আরেকটা বোতল? পরক্ষণে দূর করে দিল ভাবনাটা। নিচু গলায় বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম সবাই জানে কীভাবে মারা গেছেন মোযার্ট।’

‘প্রতিযোগী সুরকার বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছেন তাঁকে?’ হাসল লিয়া। ‘ওটা তো পুরনো থিয়োরি। আজকাল ওটা বলে না কেউ।’

‘অ্যালেক তা হলে ওই বিষয়ে কী ভেবেছিল?’

‘খুন হন মোযার্ট। তবে ওর থিয়োরি অন্যরকম। আর সেজন্যেই ওর বইটা হবে একেবারেই আলাদা।’

‘খুন? মোযার্টকে খুন করল কে?’

‘আমার মনে হয় অ্যালেক ভাবত তাঁকে খুন করেছে ফ্রিম্যাসনরা।’

এক পায়ের প্যান্ট গুটিয়ে ঘুরে বেড়ানো একদল লোক কী কারণে খুন করবে মোযার্টকে?’

গম্ভীর হয়ে গেল লিয়া। ‘অ্যালেক কিন্তু সত্যিই ভাবত, ওরাই খুন করেছে।’

‘কিন্তু ফ্রিম্যাসনরা খুন করবে কেন?’

‘মোযার্ট খুন হন দ্য ম্যাজিক ফ্রুটের কারণে।’

‘অপেরার ওই পালার কথা আগেও বলেছ। তা হলে অ্যালেক ভাবত, ওটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে মোযার্টের খুনের? কিন্তু প্রমাণ কোথায়?’

‘ম্যাসনিক সিম্বলে ভরা দ্য ম্যাজিক ফুট,’ ধৈর্যের সঙ্গে বলল লিয়া, ম্যাসনরা প্রতিজ্ঞা করেছিল ওগুলো গোপন রাখবে।’

‘আর ওসব জানতেন মোযার্ট?’

‘হ্যাঁ, জানতেন, কারণ তিনি নিজেও ফ্রিম্যাসন ছিলেন।’

‘জানতাম না। কিন্তু তাতে কী? বেশি বকবক করেছিলেন বলে খুন হন তিনি?’

‘অ্যালেকের তা-ই ধারণা। আমি অবশ্য এ-ব্যাপারে প্রায় তেমন কিছুই জানি না।’

‘বইটা তুমি লিখে প্রকাশ করার পর পড়ে নেব,’ হাসল রানা। ‘তবে এসব তথ্য কোথা থেকে পেল অ্যালেক?’

‘বাবার সেই আবিষ্কারের পর,’ বলল লিয়া। ‘মনে নেই ওটার কথা?’

মাথা দোলাল রানা। মনে আছে। ‘ওই চিঠি?’

‘রিসার্চ শুরু করার সময় ওটাই ছিল প্রথম সূত্র,’ বলল লিয়া। ‘ওটার কারণেই বইয়ের নাম অ্যালেক দিয়েছিল: দ্য মোযার্ট’স ডকুমেন্ট।’

রানা কিছু বলার আগেই বেজে উঠল মোবাইল ফোন। পকেট থেকে ওটা নিয়ে কল রিসিভ করল লিয়া। ‘এমিলিয়া বেকার বলছি।’

ওদিক থেকে পুরুষকণ্ঠ শুনল রানা। মন দিয়ে কথা শুনছে লিয়া। কুঁচকে গেল ভুরু। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আমি এখন দ্য নেড হোটেলে নেই।’ ওদিকের বক্তব্য শুনে জানাল, ‘আমি আছি আমার কাউন্টি হাউস হচিন্সটন হলে। …আপনি কি আরও কিছু বলবেন?’

লোকটার কথা শুনতে পাচ্ছে না বলে লিয়ার মুখের দিকে তাকাল রানা।

বিস্ফারিত হলো লিয়ার দু’চোখ। ‘মাই গড! পুরো ফ্ল্যাট?’ কি থেকে কী যেন বলছে লোকটা। চিন্তার ছাপ পড়ল লিয়ার চেহারায়। ‘ওগুলো চুরি হয়নি? …না…. বুঝতে পেরেছি।’ আবারও শুনছে মন দিয়ে। আনমনে এলোমেলো করল মাথার চুল। নিচু গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। জী, আমাকে জানিয়ে দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।’

ফোন রেখে বড় করে শ্বাস ফেলল লিয়া। বিড়বিড় করে বলল, ‘সর্বনাশ!’

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘পুলিশের ফোন। লণ্ডনে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে কারা যেন, সবকিছু তচনচ করেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *