1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪৩

তেতাল্লিশ

ব্যস্ত ইন্টারসেকশনে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে হালকা গাড়িটাকে দু’টুকরো করেছে বিশাল ট্রাক। বিকট আওয়াজে ছিটকে দু’দিকে গেছে মার্সিডিয গাড়ির দুই অংশ। কড়া ব্রেক কষে থামতে গিয়ে সামনের গাড়িতে গুঁতো দিয়েছে পেছনের গাড়িগুলো। কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে দূরে গিয়ে চিত হয়ে পড়ল মার্সিডিযের পেছনদিক। সামনের অংশ রাস্তায় কমলা ফুলকি তুলে ছেঁচড়ে গিয়ে থামল ফুটপাথের ওপর।

ইন্টারসেকশন ভরে গেছে ভাঙা কাঁচে। কালো পিচে ছিটিয়ে আছে তপ্ত মোবিল। চারপাশে নানান ধরনের হর্নের আওয়াজ। বুলেভার্ডে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে হৈ-চৈ করছে অনেকে। এঁকেবেঁকে থেমেছে গাড়িগুলো। ভয়ে এদিক-ওদিক সরছে পথচারীরা। এমনসময় হঠাৎ আকাশ ভেঙে নামল বরফ–ঠাণ্ডা বৃষ্টি। গুড়গুড় শব্দে বাজ পড়তেই থরথর করে কাঁপল চারপাশ। তখনই শুরু হলো তুমুল শিলাবৃষ্টি।

মাথা নিচু করে ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের কাঁচের টুকরো চুল থেকে ঝরাল রানা। দামি মার্সিডিয গাড়িটা এখন মুচড়ে যাওয়া ধাতু ও প্লাস্টিকের বিদঘুটে জঞ্জাল। চুরমার হয়েছে জানালা। সামনের সিটের পেছনে যেখানে গাড়ির বাকি অংশ থাকার কথা, সেখানে এবড়োখেবড়ো বিরাট গর্ত। ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার বিকট আওয়াজে ঝনঝন করছে রানার কান। ঠিকভাবে কাজ করছে না মাথা। গাড়ির মেঝেতে বাক্স ফেটে ছিটিয়ে আছে বেশকিছু বুলেট। সামনে ইঞ্জিন থেকে আসছে পোড়া গন্ধ। ভেঙে একটা কবজায় ভর করে ঝুলছে পাশের দরজা।

রানার বামে গুঙিয়ে উঠল লুদভিগ কেইলম্যান। প্রায় অচেতন। কাটাকুটি ভরা মুখটা ভরে গেছে রক্তে।

রাস্তায় চিৎকার’ ও হৈ-চৈ শুনল রানা। জোরালো আওয়াজে গাড়ির ছাতে পড়ছে বড় বড় বরফখণ্ড। সিটে বাঁকা হয়ে পেছনে তাকাল ও। চাকা পিছলে পনেরো গজ দূরে থেমেছে ট্রাক। ধুম্ করে খুলে গেল দরজা। একে একে ক্যাব থেকে নামল পাঁচজন লোক। সবার পরনে কালো ফ্ল্যাক জ্যাকেট। হাতে হেকলার অ্যাণ্ড কক্ অ্যাসল্ট রাইফেল। ওগুলো মিলিটারি ওয়েপন। পুরো অটোমেটিক। হাই- ক্যাপাসিটি ম্যাগাযিনে হাই-ভেলোসিটি অ্যামিউনিশন। ওই বুলেট ভেদ করবে লোহা বা ইঁট। কালো হকি মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে লোকগুলো। শিলাবৃষ্টি তোয়াক্কা না করে কাঁধে রাইফেলের কুঁদো তুলে বিধ্বস্ত মার্সিডিয গাড়ির দিকে এল তারা। শুরু হলো গুলির কান ফাটানো বিকট আওয়াজ। গাড়ির দরজা ভেদ করে রানার মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে ড্যাশবোর্ডে লাগল একরাশ গুলি। ছিঁড়ে যাওয়ায় ফুলকি ঝরাল কিছু বৈদ্যুতিক তার।

ঘোরের ভেতর নিজের হাতের দিকে তাকাল রানা। এখনও মুঠোয় আছে গুলিতে অর্ধেক ভরা ম্যাগাযিন। সব কিছু বড় ধীর মনে হলো ওর। এগিয়ে আসছে আততায়ীরা। তবে কেন যেন সাড়া দিচ্ছে না ওর মগজ।

ঠিকভাবে খেয়াল করো, নিজেকে ধমক দিল রানা। অন্য হাতে .৪৫ পিস্তলটা। ওটার ভেতর ম্যাগাযিন ভরল। স্লাইড টেনে ছেড়ে দিল। প্রথম বুলেট চেম্বারে ঢুকতে না ঢুকতেই খুব কাছে দেখল প্রথম টার্গেট। গুলিটা বুকে লাগতেই টলমল করে পিছিয়ে গেল লোকটা। এখনও কাঁধে রাইফেল। আবার সামনে বাড়ল সে। গায়ে আছে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।

চিৎকার ও গুলির আওয়াজের ওপর দিয়ে এল কালো রঙের তিনটে অডি. কুয়াট্রো গাড়ির চাপা গর্জন। সামনের কয়েকটা গাড়িতে গুঁতো মেরে থামল ওগুলো। ঝটকা দিয়ে তিন গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় নামল তিনজন লোক। প্রত্যেকের হাতে পিস্তল। ওই তিনজন লুদভিগের দলের অফিসার। খোলা দরজার ওদিকে আড়াল নিয়ে গুলি করল তারা কালো মুখোশ পরা রাইফেলধারীদের লক্ষ্য করে। মিলিটারি রাইফেলের গর্জনের তুলনায় পটকার মত আওয়াজ তুলছে পুলিশের পিস্তল। একরাশ অটোমেটিক বুলেট লাগল তিন গাড়ির গায়ে। অনায়াসে ভেদ করছে স্টিলের দরজা ও বডি। পিছিয়ে গিয়ে চিত হয়ে পড়ল লুদভিগের এক সঙ্গী। বুক থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে রক্ত। ভীষণ ভয়ে নানাদিকে ছুটে পালাচ্ছে পথচারীরা। কানে এল পুলিশের সাইরেন।

চারপাশে তাকাল রানা। অস্পষ্ট দেখাচ্ছে পিস্তলের সাইট। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ওপর ভরসা করে কাছের লোকটার গলার দিকে নল তাক করল রানা। ট্রিগার টিপে দিতেই বরফে ছাওয়া রাস্তায় পড়ল লোকটা। দু’হাতে চেপে ধরেছে গলা। মার্সিডিযের জানালার ফ্রেম ভেদ করে ঢুকল একটা বুলেট। রানার চুলে বিলি কেটে পেছনের জানালায় লাগল ওটা। জবাবে অন্ধের মত পর পর দু’বার গুলি পাঠাল রানা। অডি গাড়ি থেকে এল গুলির আওয়াজ। রানাকে সাহায্য করছে পুলিশ অফিসাররা। গুলির মুখে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে গেল রাইফেল হাতে চার আততায়ী। মানুষের আর্তনাদ ও চিৎকার ছাপিয়ে খুব কাছে চলে এসেছে পুলিশের সাইরেন।

সচেতন হয়ে দুই হাতে ঊরু চেপে ধরে ছটফট করছে লুদভিগ। লাথি দিয়ে মার্সিডিযের দরজা খুলে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল রানা। আরও পিছিয়ে গেছে চার ঘাতক। লুদভিগের দলের কাছ থেকে বাধার মুখে পড়বে, ভাবতেও পারেনি।

পরিত্যক্ত গাড়িগুলোর মাঝখানে পুলিশের গাড়ির ঝলমলে আলো। ঘুরেই দৌড় দিল চার আততায়ী। অডি গাড়ির ছাতের ওপর দিয়ে তাদের দিকে গুলি পাঠাল লুদভিগের দলের এক অফিসার। চার খুনির একজন মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। হাত থেকে ছুটে গেছে রাইফেল। অন্য তিনজন ফুটপাথে উঠে দৌড়ে ঢুকে পড়ল সরু এক গলিতে। সশস্ত্র পুলিশের লোক ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসতেই তাদের দিকে নিজেদের ব্যাজ তুলে ধরল লুদভিগের দলের পুলিশরা।

একবার লুদভিগের দিকে তাকাল রানা। বেচারা ব্যথা ও রক্তশূন্যতায় ফ্যাকাসে। কর্কশ স্বরে রানাকে বলল, ‘পা ফুটো করে দিয়েছে! তুমি যাও! পারলে পিছু নাও!’

রানা বুঝে গেল, লুদভিগের সঙ্গে ওকে দেখা গেলে তার ফলাফল ভাল হবে না। বহু প্রশ্ন উঠবে, যার কোনও জবাব নেই। এখনও ওকে দেখেনি পুলিশ সদস্যরা। দানবীয় জার্মান বন্ধুর দিকে চেয়ে মাথা দোলাল রানা, তারপর থেমে থাকা গাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে ছুটে গিয়ে ঢুকল সামনের সরু গলিতে। ষাট গজ দূরে পালিয়ে যাচ্ছে তিন আততায়ী।

তাদের পিছু নিল রানা। একটু পর পেছনে আবছা হয়ে এল সাইরেনের আওয়াজ। শিলার পতন থেমে শুরু হয়েছে বরফ বৃষ্টি। অগভীর ছোট এক পানির ডোবায় পা পিছলে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রানা। দুর্ঘটনার কারণে কাজ করছে না মগজ। কানে ঝনঝন আওয়াজ। শ্বাস অনিয়মিত। সরু গলিতে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেল লোকগুলো।

শহরের এদিকটায় পুরনো আমলের সব বাড়ি। একটু পর পর সরু গলি। দৌড়ের গতি না কমিয়ে বাঁক নিল রানা। আবারও দেখল পঞ্চাশ গজ দূরে সেই তিন আততায়ী। গলির ভেতর বুটের ধুপ-ধাপ আওয়াজ।

সুযোগ পেলে পিছু নেব, ভাবছে রানা। কিন্তু দৌড়ে গিয়ে অপেক্ষারত এক ভলভো গাড়িতে উঠল লোকগুলো। তক্ষুণি গর্জন ছেড়ে রানার দিকেই তেড়ে এল গাড়িটা। পেছনের দুই জানালা দিয়ে বেরোল রাইফেলের দুটো নল। বদ্ধ জায়গায় বিকট আওয়াজে গর্জে উঠল অস্ত্রদুটো।

জবাবে উইণ্ডশিল্ড লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। ফাটল ধরে চুরচুর হলো গাড়ির সামনের কাঁচ। তবে ভলভো আসছে তুমুল বেগে। ট্রিগার টিপে রানা টের পেল, পিস্তলে আর একটাও গুলি নেই। সবমিলিয়ে পাঁচটা বুলেট ভরেছিল ম্যাগাযিনে। এরপর ঘটল সেই দুর্ঘটনা। থেমে গিয়ে বামের সরু এক গলিতে ঢুকল রানা। পেছনে শুনল গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন। কিছুটা এগিয়ে থেমে গেছে ভলভো। খুলে আবারও বন্ধ হলো দুটো দরজা। রানার গলির দিকে ছুটে আসছে বুটের আওয়াজ।

পিছু নেয়া দূরের কথা, ওকেই এবার প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে, ভাবল রানা। ডানে-বামে কয়েকটা সরু গলি পেছনে ফেলে সামনে মাঝারি এক রাস্তা পেয়ে ডানে বাঁক নিল ও। বুঝে গেছে, এবার বিভ্রান্ত হয়ে নানান গলিতে খুঁজবে আততায়ীরা। ততক্ষণে এই রাস্তার কোনও বাঁক ঘুরে হারিয়ে যাবে ও। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে হাঁটতে লাগল রানা। প্রথম সুযোগে দূরে সরে যেতে হবে দুর্ঘটনার এলাকা থেকে।

রাস্তার বামে দেখল লাল এক মিটসুবিশি গাড়ি। ওটার ভেতর বসে কী যেন করছে কে যেন। গাড়িটা পাশ কাটাবার সময় রানা দেখল, ওর দিকেই চেয়ে আছে সুন্দরী এক মেয়ে।

না থেমে হেঁটে চলল রানা। ভাবছে, ভিয়েনার এদিকটায় আছে কমদামি ছোট কিছু হোটেল। আপাতত দু’এক ঘণ্টার জন্যে লুকিয়ে পড়বে ওগুলোর কোনওটায়।

হাঁটতে হাঁটতে পেছনে গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ শুনল রানা। সেই মেয়ে বোধহয় নামছে গাড়ি থেকে। খুব অস্বস্তি বোধ করছে রানা। একবার ঘুরে দেখবে কি না ভাবছে, এমনসময় কানের কাছে শুনল হিশ্ আওয়াজ তখনই কী যেন এসে বিঁধল ওর ঘাড়ে। প্রথমে তীক্ষ্ণ ব্যথা হলো, তারপর ওর চোখের চারপাশ থেকে ছুটে এল কালো একটা পর্দা। হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ল রানা। কাত হয়ে ঘোলা চোখে দেখল হেঁটে আসছে মেয়েটা, হাতে লম্বা এক ট্র্যাঙ্কুইলাইযার গান।

জ্ঞান হারাবার আগে রানা শুনল, মেয়েটা জার্মান ভাষায় বলছে: ‘সরি, মাসুদ রানা। আসলে কিছু করার ছিল না। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে ওই লোকের পাঠানো খুনিরা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *