তিন
এইমাত্র বিশাল ডানা মেলে ফ্রান্সের আকাশে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৮৮ ড্রিমলাইনার অচিন পাখি। ডিম্বাকৃতি জানালা দিয়ে বহু নিচে সফেদ মেঘের ভেলা দেখছে মাসুদ রানা। মনে পড়ছে গত কয়েক দিনের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি।
লিলির বাবা খোন্দকার আশরাফ আলী তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান—রাষ্ট্রদূত। ষোলোই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সেকেণ্ড অফিসার রাফাত হোসেন দূতাবাসে রেখেছিলেন নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী। তবে বিকেলে রাষ্ট্রদূত আশরাফ আলীর একমাত্র মেয়ে লিলি সুপারমলে গিয়ে টুকটাক কিছু জিনিস কিনতে চাইলে সঙ্গে দেন বিসিআই-এর জুনিয়র এজেণ্ট জুনায়েদ মালিককে। তবে কপাল ছিল মন্দ, কেনাকাটা শেষ হলে সুপারমল থেকে বেরোবার সময় তিনদিক থেকে এল একরাশ গুলি, ঝাঁঝরা হলো সাহসী বাঙালি তরুণ জুনায়েদের বুক। সেসময়ে লিলি এবং ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় একদল তুর্কি সন্ত্রাসী।
এদিকে বছরের পর বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছে, প্রাণপণে বিরোধিতা করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের, তারা এবার জোর গলায় বলতে লাগল: প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নিজেরাই তো দেখতে পাচ্ছেন, এমন কী উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও আজ আর নিরাপদে নেই!
লিলি কিডন্যাপ হওয়ার পরদিন সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ফোনে কথা বললেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের সঙ্গে। বয়সে বড়দেরকে তিনি সবসময় উপযুক্ত সম্মান দেন। নরম সুরে অনুরোধ করলেন, বিসিআই যেন তুরস্কের ওই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। দুপুর হওয়ার আগেই নিজের অফিসে রানাকে ডেকে নিয়ে ব্রিফ করলেন বিসিআই চিফ রাহাত খান। এবং সেই অনুযায়ী ওই রাতেই তুরস্কের পথে বিমান যোগে রওনা হয়েছিল মাসুদ রানা। ইস্তাম্বুলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে কিডন্যাপারদের বিষয়ে জানতে ওর ব্যয় হয়েছে একদিন। এরপর উনিশ ডিসেম্বরে পাহাড়ি এলাকায় নরপশুগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করেছে লিলি ও সিণ্ডিকে। পরদিন ইস্তাম্বুলে পৌঁছে মেয়েদুটোকে তুলে দিয়েছে ওদের অভিভাবকদের হাতে।
আপাতত জরুরি কোনও কাজ নেই, রানারও বিশ্রাম দরকার, তাই ওকে নিজে থেকেই সাত দিনের ছুটি দিয়েছেন বিসিআই চিফ। টেলিফোনে জলদ-গম্ভীর কণ্ঠে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে ডেকে নেব তোমাকে।’
না চাইতেই ছুটি পেয়ে খুশি হয়েছে রানা। ফোন রেখে ভেবেছে: আজ দেখি দারুণ খোশ মেজাজে আছে বুড়ো!
কট্টর বৃদ্ধের কথা ভেবে আনমনে হাসল রানা। ঘুরে তাকাল পাশের সিটের দিকে। আজকাল বিমানের টিকেট হয়ে গেছে দুর্লভ বস্তু। অথচ বিযনেস ক্লাসের অর্ধেক সিটই থাকে খালি। শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সই নয়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতির জালে জড়িয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশ। চট করে এ থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। তবে এমন একটা সময় আসবেই, যখন লাখো-কোটি তরুণ- তরুণীর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠবে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ। সফল তারা হবেই। আজ হোক বা কাল।
জানালা দিয়ে নিচের সাদা মেঘ দেখছে রানা। আয়ারল্যাণ্ডে নির্জন সৈকতের ধারে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়ি ছিল ওর পরের গন্তব্য। স্থির করেছিল ওখানে কাটিয়ে দেবে কয়েকটা দিন, বিশ্রাম নেবে। তবে সেটা আর হবে না।
গত ক’দিন ব্যস্ত ছিল বলে অফ ছিল মোবাইল ফোন। গতকাল রাতে ইস্তাম্বুলের হোটেলে বসে ওটা চেক করতেই পেল ভয়েস মেইল। ওই সুমধুর কণ্ঠস্বর কোনদিনও ভুলবে না রানা।
এমিলিয়া ওর বন্ধু অ্যালেকের ছোটবোন। তার চেয়েও বড় কথা, মেয়েটার জন্যে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না রানা। ওর স্পষ্ট মনে আছে, শেষবার এমিলিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছিল বেশ ক’বছর আগে। এরপর আর কখনও ওকে মেসেজ দেবে বা ফোন করবে মেয়েটা, ভাবতে পারেনি রানা।
ভয়েস মেইলে এমিলিয়াকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হয়েছে ওর। মেয়েটা ক্লান্ত স্বরে বলেছে: ‘রানা, জানি না তুমি এখন কোথায়, বা এই বার্তা সত্যি পাবে কি না। এ-ও জানি না কার কাছে সাহায্য চাইব। এখন আছি লণ্ডনের দ্য নেড হোটেলের লিউটেন্স সুইটে। সম্ভব হলে দেখা কোরো আমার সঙ্গে। অপেক্ষা করছি তোমার জন্যে।’ সামান্য বিরতি নিয়ে বলেছে: ‘রানা, আছি খুব ভয়ের ভেতর। প্লিয, যদি পারো, এসো।’
তবে ওই ভয়েস মেইল পাঁচ দিন আগের।
আয়ারল্যাণ্ডে বন্ধু জর্জকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে রানা, আপাতত উঠছে না তার বাড়িতে। এ মুহূর্তে বিমানে চেপে হিথ্রো এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে ও। কেন যেন টনটন করছে ওর বুকটা। বারবার মনে পড়ছে বিচ্ছেদের বিষাদময় সেই স্মৃতি।
বছরখানেক আগে অ্যালেকের শেষকৃত্যে দূর থেকে এমিলিয়াকে দেখেছে রানা। সেই আগের মতই অপূর্ব লেগেছে। সেদিন পান্না-সবুজ চোখদুটোয় ছিল অদ্ভুত ঔদাসীন্য। নাম করা অপেরা তারকা, লণ্ডনে ফিরেছিল ইউরোপিয়ান ট্যুর স্থগিত করে। লাফঝাঁপ মেরে ওর ছবি তুলছিল অন্তত দশজন ফোটো সাংবাদিক।
রানার বড় ইচ্ছে হয়েছিল ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মনে ছিল না-বলা বহু কথা। তবে দ্বিধা কাটাতে না পেরে ফিরে গিয়েছিল কবরস্তান থেকে হোটেলে। তার আগে বিখ্যাত অপেরা তারকার পিএ-র হাতে দিয়েছিল নিজের ভিযিটিং কার্ডটা। পরদিন দৈনিক পত্রিকার পাতায় এমিলিয়ার ছবি দেখল রানা। বড়ভাইকে কবর দিয়ে ফিরেছে মন্টি কার্লোয় নিজ বাড়িতে। এরপর বহুদিন আর বেরোয়নি বাড়ি থেকে।
মেয়েটার কথা ভাবলে কাঁটার মত খচ্ করে কী যেন বেঁধে রানার বুকে। সময়টা তখন ওর জন্যে উপযোগী ছিল না। রানা ওকে বলতে পারেনি কেন চলে যেতে হচ্ছে ওকে। পরে ভেবে দেখেছে, এ-ই তো ভাল যে এমিলিয়ার সঙ্গে পরিণয়ে জড়িয়ে যায়নি। থাকুক না বুকের গভীরে ভীষণ হুতাশ আর চরম দুঃখ। ওসব নিয়েও তো বাঁচে মানুষ!
আজ আবারও দাউ দাউ করে জ্বলবে ওর বুকে আগুন। কারণ সত্যিই আবার দেখা হচ্ছে ওদের দু’জনের!