1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪০

চল্লিশ

একই দিন।

স্লোভেনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় নানদের সেই আশ্রম।

মাদার ব্রোমেইস্টারের ক্যালকুলেটর নেই, তাই অঙ্কের টেক্সট্ বুকে রাখা নোটবুকে সতর্কতার সঙ্গে দশ নম্বর প্রশ্নের উত্তর লিখল এমিলি। অবশ্য অঙ্কে সবসময়ই মাথা খেলে ওর। ডেস্কে স্কুলের বইপত্র রেখে হাড্ডির মত শক্ত চেয়ার ছেড়ে পিছলে নেমে পড়ল এমিলি। ভাবছে, এবার মাদার সুপিরিয়রের অফিস থেকে বেরিয়ে কী করবে। বুকশেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে-তাকে চামড়া দিয়ে মোড়া ভারী সব বই। বেশির ভাগই ধর্মের বিষয়ে লেখা। ধূর! একেকটা শব্দের উচ্চারণ করতে গেলে খসে পড়তে চায় দাঁত। তার চেয়ে ঢের মজার জিনিস হচ্ছে কাবার্ডে রাখা পুরনো ম্যাগাযিনগুলো। প্রতিটায় আছে শব্দফাঁদ। তবে এরই ভেতর ডিকশনারির সাহায্য নিয়ে প্রায় সবই সমাধা করে ফেলেছে ও। তা হলে এখন কী করা যায়?

জানালা দিয়ে বহু দূরের বিশাল পাহাড়ের দিকে তাকাল এমিলি। আনমনে ভাবল, কী সুন্দরভাবে সাদা বরফে ছেয়ে আছে সব! স্কুলের লেখাপড়ার তাড়া বা ঝামেলা নেই। নির্জন আশ্রমে বলতে গেলে প্রায় ছুটিই কাটাচ্ছে। তবে ভাল লাগত বাবা থাকলে। নানরা সবাই আদর করেন। সময় করে ওর সঙ্গে খেলেন লিয়া। তবে স্কুলের বান্ধবীদের কথা মনে এলেই কেমন খারাপ লাগে ওর। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ব্রিজিটার কথা। মানুষটা সারাক্ষণ মায়ের মত ওকে আগলে রাখেন। আর সেটা বুঝতে পেরে খুব ভাল লাগে ওর। বাবা কেন যে ব্রিজিটাকে বিয়ে করছে না! – ভাবল এমিলি। তা হলেই তো সত্যিকারের একটা পরিবার হয়ে যেত ওরা।

মাদার সুপিরিয়রের ডেস্কে পড়ে আছে প্রাচীন আমলের টেলিফোন। আশ্রমে আর কারও ওই জিনিস নেই। যন্ত্রটা বেশ রহস্যময়। ভারী ও কালো। বাঁকা বিদঘুটে রিসিভার একমাথায় কয়েলের মত পেঁচানো তার। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত হচ্ছে যন্ত্রের বুকে বসে থাকা গোল ডায়াল করার জায়গাটা। ওটার ভেতর একটু পর পর আঙুল ঢুকিয়ে ঘোরাবার গর্ত। এমিলি পুরনো সিনেমায় দেখেছে, ওগুলো ব্যবহার করেই ডায়াল করতে হয়। সহজেই গর্তে ঢুকবে ওর আঙুল। আনমনে হাসল এমিলি। বাবার মোটাসোটা আঙুলগুলো পারবে ওসব গর্তে ঢুকতে?

ভাবতে কেমন অবাক লাগে, ভীষণ বিশ্রী এই পচা টেলিফোন দিয়ে যোগাযোগ করত আগের আমলের মানুষ! যন্ত্রটার সামনে থামল এমিলি। গর্তে আঙুল ভরে ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর ঘুরিয়ে অবাক হয়ে দেখল, খিরখির আওয়াজে আগের জায়গায় ফিরে খট্ করে থামছে ডায়ালার। আরও কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখল এমিলি।

মনে এল অন্য চিন্তা। আরেহ্, এই জঘন্য যন্ত্র দিয়েও তো ব্রিজিটার সঙ্গে কথা বলতে পারবে! ব্রিজিটাকে জানানো যায় নতুন বান্ধবী লিয়ার কথা। লিয়া মস্ত বড় গায়িকা। সিডি বের হয়। টেলিভিশনেও দেখা যায় ওঁকে। হঠাৎ এমিলির মনে হলো, এই কথাগুলো ব্রিজিটাকে জানাতে না পারলে ওর আর বেঁচে থেকে লাভ কী?

চট করে অফিসের দরজার দিকে তাকাল ও। প্রার্থনাঘর থেকে আসছে সমবেত কণ্ঠসঙ্গীতের আওয়াজ। নিজেকে বলল এমিলি, আমি তো কারও ক্ষতি করছি না। মাত্র একবার একটা ফোন দেব। বেশিক্ষণ কথাও বলব না। তাতে নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে না?

ভারী রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাল এমিলি। ওর মনে আছে অস্ট্রিয়ার টেলিফোন কোড। দেরি না করে ব্রিজিটার নম্বরে ডায়াল করল। ওদিক থেকে পরিচিত মানুষটার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েই বলল, ‘ব্রিজিটা! আমি! এমিলি! আপনি কেমন আছেন?’

.

কয়েক চামচ চিনি ও ঘন দুধ দিয়ে তৈরি কফিতে চুমুক দিয়ে ফায়ারপ্লেসে আগুনের শিখা দেখছে লিয়া। পট-পট আওয়াজে পুড়ছে চ্যালা কাঠ। এই পাহাড়ি এলাকা খুব নির্জন। নিজেকে মনে হচ্ছে কোনও দ্বীপে বন্দি হওয়া মানুষের মত। আঠারো ঘণ্টা হয়নি রানা চলে গেছে। বিদায়ের সময় তেমন কথাও হয়নি। অথচ, ওর মনে জমে আছে রানাকে বলার মত কত কথা! ভাল করেই জানে, রাতে শুয়ে পড়লে প্রতিটা কথা ঘুরে ফিরে আসবে ওর মনে। এরই ভেতর অন্তত এক শ’বার নিজের কাছে জানতে চেয়েছে: তুমি কি নতুন করে আবারও প্রেমে পড়লে? জানো না, খাঁচা থেকে একবার বেরিয়ে গেলে আর কখনও ফেরে না মুক্ত-বিহঙ্গ?

বুকের ভেতর এসব কী হচ্ছে ওর?

কেন একটু পর পর মনে পড়ছে রানার মুখটা?

নিজেই চেয়েছে চুমু দিক রানা। অথচ, মানুষটা চুমু দিতেই পিছিয়ে গেল কেন!

যতবার ওই মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে, নিজেকে দোষ দিচ্ছে লিয়া। কেন রে? ভাল মানুষটার অনুভূতি নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোকে?

খামারবাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ শুনল লিয়া। এইমাত্র ভেতরে ঢুকেছে এমিলি। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বসে পড়ল উঁচু একটা চেয়ারে।

‘সারাদিন কী করেছ, এমিলি?’ জানতে চাইল লিয়া

‘মেলা কাজ। মাদার সুপিরিয়র কিছু অঙ্ক দিয়েছিলেন।’ টেলিফোনে ব্রিজিটার সঙ্গে পনেরো মিনিট গল্প করেছে, তা চেপে গেল এমিলি। ‘তারপর তো ছিলাম সিস্টার বার্যের ওখানে। তিনি শুয়োরের ছানাগুলোকে খাবার দিলেন ডিমগুলোও তুললাম দু’জন মিলে। আমারও একটা চাই।’

‘এখন ডিম খাবে?’

‘না। আমি শুয়োরছানা পুষব। কিন্তু ভিয়েনায় বোধহয় ওদেরকে রাখতে দেয় না। বলুন তো, তা হলে আমার কী হবে?’

‘সত্যিই, খুবই চিন্তার বিষয়!’ গম্ভীর হলো লিয়া 1 কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তবে একটা কথা, ওগুলো কিন্তু বেশিদিন ছোট থাকে না। তখন বিরাট হয়ে নোংরা করে দেবে তোমাদের বাড়ি। আর ওদের গায়ের গন্ধও খুব বাজে হয়।’

মুচকি হাসল এমিলি। ‘এমনিতেই বাড়িতে ওরকম একটা আছে। গায়ে ঘামের গন্ধ। আমার বাবা!’

‘ছি, এসব বলে না, এমিলি,’ নরম সুরে বলল লিয়া। ‘লিয়া?’

‘হুঁ?’

‘একবার দেখতে দেবেন আপনার গলার ওই সোনার লকেট?’

‘নিশ্চয়ই!’ গলা থেকে চিকন চেইনটা খুলে লকেট এমিলির হাতে দিল লিয়া।

ঝিনুকের মত আকৃতির লকেট দেখল এমিলি। ‘দারুণ সুন্দর। পেছনে খোদাই করা আছে আপনার নাম।’ একদিকে ছোট ক্যাচ। ওটা টিপতেই দু’ভাগ হয়ে গেল লকেট। ভেতরে দু’দিকে ছোট দুটো ছবি। এমিলি জানতে চাইল, ‘ছবিতে এঁরা কারা?’

‘একসঙ্গে যে দু’জনকে দেখছ, তাঁরা আমার বাবা-মা,’ বলল লিয়া। ‘আর উল্টো দিকের মানুষটা আমার বড়ভাই।’

‘আপনার মা খুব সুন্দরী ছিলেন, আপনার মতই,’ বলল এমিলি। অন্য ছবিটা দেখছে। ‘এঁর সঙ্গে আপনার চেহারার একটু মিল আছে।’

‘বড়ভাই যে,’ বলল লিয়া। ‘ওর নাম অ্যালেক।’

‘এঁরা কোথায় থাকেন?’

কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল লিয়া, ‘স্বর্গে।’

কথাটা বুঝতে পেরেছে এমিলি। জানতে চাইল, ‘তিনজনই?’

‘হ্যাঁ। আমাদের পরিবারে শুধু আমি বেঁচে আছি।’

‘আমার মাও স্বর্গে থাকেন। আপনার কি মনে হয় স্বর্গে আপনার ভাই বা বাবা-মার সঙ্গে আমার মার পরিচয় হয়েছে?’

বাচ্চাদের কাছে মৃত্যু কেমন তা বুঝে বিষণ্ণ হাসল লিয়া। ‘হ্যাঁ, ওখানে তো সবাই সবাইকে চেনে।’

‘জানেন, আসলে স্বর্গে গিয়ে কী করে এরা?’

‘খেলে, মজা করে, গান গায় বা নাচে বোধহয়।’

‘তা হলে তো খুব ভাল। আমারও খেলতে ভাল লাগে।

‘তুমি এখন খেলতে চাও?’

ঘন ঘন মাথা দোলাল এমিলি। ‘চলুন, রানা আমাকে যে খেলাটা শিখিয়ে দিয়েছে, দু’জন মিলে সেটা খেলি।’

বাড়িতে বসে থেকে রানার চিন্তা মন থেকে দূর হবে না, বুঝে গেছে লিয়া। রাজি হয়ে গেল এমিলির প্রস্তাবে। রাবারের বুট ও ভারী রেইনকোট পরে মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। ঝলমল করছে সুনীল আকাশ। পর্বতের সফেদ তুষারে ছাওয়া চূড়ায় লেগে ঠিকরে ফিরছে সূর্যের সোনালি আলো। ফার্মহাউসের উঠান পেরিয়ে কনভেন্টের দালানগুলোর দিকে চলল ওরা। তুষারে খেলতে পছন্দ করে রটওয়েইলার কুকুরটা। গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আবার উঠে এক ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে। পেছনে ছিটকে দিচ্ছে তুষারের কণা। একটু দূরের পাথরের প্রার্থনাঘর থেকে এল নানদের গান। লিয়ার চিনতে দেরি হলো না, ওটা প্যালেস্ট্রিনার সুরেলা একটা প্রার্থনা-সঙ্গীত।

‘আপনি লুকিয়ে পড়ন,’ প্রস্তাব দিল এমিলি। ‘দেখি খেলাটা মনে রেখেছে কি না জো।’ জ্বালানি কাঠ রাখার গুদামের বাঁক ঘুরে সুন্দর করে ছাঁটা বড় একটা ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ও। লিয়া শুনল, এক এক করে সংখ্যা গুনছে মেয়েটা। দশ বলা শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘জো! মিস লিয়াকে খুঁজে বের কর্!’ ঝড়ের বেগে কাঠের গুদামের ওদিক থেকে মুহূর্তে হাজির হলো বিরাট কুকুরটা। সামনের দু’পা লিয়ার কাঁধে তুলে চেটে দিল গাল। বদলে ওর মাথায় আলতো চাপড় মেরে আদর জানাল লিয়া। নানদের গাওয়া মিষ্টি গানের সুর ছাপিয়ে এল হেলিকপ্টারের রোটরের ধুপ- ধুপ্ আওয়াজ। খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে যান্ত্রিক ফড়িং।

কপালে হাত রেখে জ্বলজ্বলে সূর্যের দিকে তাকাল লিয়া। কনভেন্টের অনেক ওপরে ভাসছে দুটো হেলিকপ্টার। খুব ধীরে নেমে আসছে মাটির দিকে। ‘নিশ্চয়ই পাহাড়ে কেউ বিপদে পড়েছে,’ আনমনে বলল লিয়া। কিন্তু আকাশ-দানব দুটো আরও কাছে আসতে বুঝল, গুগুলো মাউন্টেন রেসকিউ এয়ারক্র্যাফট নয়। কালো রঙের। গায়ে কিছু লেখা নেই। লিয়ার মনে প্রশ্ন জাগল: নির্জন এই আশ্রমে হঠাৎ কেন হাজির হয়েছে এরা?

ওর চোখ লক্ষ্য করে ওদিকে তাকাল এমিলি। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘যাক গে, এবার কিন্তু আমার পালা। আপনি জো-র কলার চেপে ধরুন। পুরো দশ গুনবেন কিন্তু।’

ঘুরেই দৌড় দিল এমিলি।

এখনও দুই হেলিকপ্টারের দিকে চেয়ে আছে লিয়া। ধীর গলায় গুনছে: ‘এক… দুই… তিন… চার….

নানদের গান ছাপিয়ে বিকট আওয়াজে নামছে দুই হেলিকপ্টার। কেন যেন ভয় লেগে উঠল লিয়ার। ‘ছয়… সাত… ‘আট….

যথেষ্ট, মনে মনে বলল লিয়া। সংখ্যা গোনা বাদ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এমিলি! ফিরে এসো!’

হেলিকপ্টারের আওয়াজে কথা শুনতে পায়নি মেয়েটা। লিয়া কলার চেপে ধরেছে বলে ছুটে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে কুকুরটা। মাটির মাত্র এক শ’ ফুট ওপরে ভাসছে কালো হেলিকপ্টার। কান ফেটে যেতে চাইছে রোটর ও ইঞ্জিনের গর্জনে। আশ্রমের ছাত টপকে ওদিকে নেমে পড়ল দুই যান্ত্রিক ফড়িং।

কোথাও কিছু গোলমাল হয়ে গেছে, বুঝল লিয়া। হাত থেকে ছেড়ে দিল জো-র কলার। এইমাত্র একটা দালান ঘুরে ওদিকে গেছে এমিলি। তুষারের মাঠে তীরবেগে ওর পিছু নিল কুকুরটা।

হতাশা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল লিয়া।

.

গুনতে গুনতে ছুটছে এমিলি। ভাল করেই জানে, যে-কোনও সময়ে পেছনের দালান ঘুরে লম্বা লম্বা লাফে হাজির হবে জো। ছুটতে ছুটতে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল মেয়েটা। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর শক্ত কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল তুষারের ওপর।

ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল, ওকেই দেখছে অচেনা এক লোক। ভ্যানিলা আইসক্রিমের মত ঠাণ্ডা আর সাদা তার দুই চোখ। পাথুরে চেহারায় একফোঁটা হাসি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *