1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ১৬

ষোলো

দরজায় টোকা না দিয়েই পুলিশ চিফ এবিল-ফি-এর অফিসে ঢুকল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট লুদভিগ কেইলম্যান। কোটের পকেট থেকে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে ঠাস্ করে রাখল চিফের টেবিলের উপর। ব্যাগের ভেতর আছে লেকের তীরে পাওয়া সেই একুশটা বুলেটের খোসা।

প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখছে চিফ। ক’মুহূর্ত পর ভুরু কুঁচকে তাকাল লুদভিগের চোখে। ‘এর মানে কী, লুদভিগ?’ ক্লান্ত আর হতাশ দেখাচ্ছে তাকে। মাত্র একদিনেই আরেকটু বড় হয়েছে মাথার টাক। অসুস্থ মুখ সাদা মোমের মত ফ্যাকাসে। অক্ষিকোটরে ডেবে গেছে লালচে দু’চোখ। চোখের নিচে ত্বকে গভীর কালো ছোপ। লুদভিগ জানে, অবসরে যাওয়ার জন্যে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে চিফ।

‘মনে হচ্ছে আবারও চালু করতে হবে বেকারের কেস,‘ বলল লুদভিগ। সে লিয়ন এবিল-ফি-এর টিমের একমাত্র সদস্য, যে চিফকে ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করে না।

ডেস্কে দুই কনুই রেখে নাকের গোড়া দুই আঙুলে টিপে ধরল এবিল-ফিচ্। দুর্বল কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো জানতাম, আমরা ওই কেস নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। খেয়েদেয়ে আর কোনও কাজ পেলে না তুমি?’

‘ওই কেস অস্বাভাবিক,’ চিফের চোখ থেকে নিজের দৃষ্টি সরালো না লুদভিগ কেইলম্যান।

‘নতুন কিছু জানতে পেরেছ?’

ছোট্ট ব্যাগ দেখাল সার্জেন্ট। ‘নাইন এম. এম. গুলির খোসা।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি,’ বলল এবিল-ফিটচ্। ‘কিন্তু ফায়ারিং রেঞ্জের মেঝে থেকে এসব টুকিয়ে এনেছ কেন?’

‘ওগুলো ছিল লেকের তীরে, যেখানে মরেছে অ্যালেক বেকার।’

চোখ থেকে চশমা খুলে টিশ্য পেপার দিয়ে প্লাস্টিকের লেন্স ডলতে লাগল এবিল-ফি। ডেস্কের দিকে ঝুঁকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল কেইলম্যানের চোখে। ‘আসলে কী বলতে চাও? ওটা তো কোনও কেসই নয়। পানিতে ডুবে মরেছে অ্যালেক বেকার। সাধারণ একটা দুর্ঘটনা।’

‘আমার তা মনে হয় না।’

‘গুলির খোসা দিয়ে কী প্রমাণ করবে?’

‘এখনও জানি না। তবে মনে হলো, ওগুলোর বিষয়ে আপনাকে জানিয়ে রাখা ভাল।’

‘আমরা আগেই জানি কী ঘটেছে। সাক্ষীকে জেরা করার সময় তুমি নিজেও সেখানে ছিলে। জবানবন্দিও দিয়েছে সে।’

‘কিন্তু ওই সাক্ষী ছিল মিথ্যুক এক মেয়ে।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল চিফ এবিল-ফিচ্। পেটে দু’হাত ভাঁজ করে বিরক্ত স্বরে জানতে চাইল, ‘ওই সাক্ষী মিথ্যুক, একথা আবার কোথায় টুকিয়ে পেলে? যা বলছ, জেনে বলছ?’

‘ভাল করেই জানি।’

‘তোমার বক্তব্য একটু বেশি কড়া হয়ে যাচ্ছে না, সার্জেণ্ট?’

‘তা ঠিক।’

‘তোমার কথা সঠিক, সেটা প্রমাণ করতে পারবে?’

‘পারব,’ জোর দিয়ে বলল কেইলম্যান।

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিয়ন এবিল-ফিচ্। লুদভিগের মনে হলো, চিফের কাঁধে চেপেছে এক মণ ওজন। চেয়ারে আরও একইঞ্চি দেবে গেছে মানুষটা।

হতাশ সুরে বলল চিফ, ‘বরাবর বিপদে তোমার পাশে থেকেছি, লুদভিগ। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মকর্তা আমার মত এতটা সহ্য করবে না।’

‘তা জানি, চিফ। সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ।’

‘সেক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, দয়া করে তোমার মুখটা একদম বন্ধ রাখো,’ বলল এবিল-ফিচ্ ‘পরিষ্কার মনে আছে আমার মেরি বার্নলে আসলে কে। সেসময়ে কনসুলেট থেকে খুব চাপ এসেছিল। নতুন করে আবারও ওই ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ হালকা হওয়া মাথার চুলে হাত বোলাল সে। ‘মনে হচ্ছে, ওই কেস নিয়ে তোমার কাজ না করাই ভাল। লুদভিগ, অ্যালেক বেকার হয়তো বড়লোকের বখে যাওয়া ফালতু কোনও ছেলে। মাতাল হয়ে গাধামি করে ডুবে মরেছে। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই মঙ্গল। নিজেকে বিশ্রাম দাও। এসব না করে খুঁজে নাও সহজ কোন কাজ।

কাঠের ডেস্কে আঙুলের কড়া ঠুকল লুদভিগ। ‘যদি প্রমাণ করে দেখাতে পারি, আবারও চালু করবেন বেকারের কেস?’

‘সেক্ষেত্রে লাগবে পাথরের মত শক্ত প্রমাণ।’

‘কিন্তু সেটা যদি জোগাড় করতে পারি?’,

বিরক্ত হলো এবিল-ফিচ্। ‘ঠিক আছে, প্রমাণ পেলে আবারও চালু করব কেসটা।’ কঠোর হলো চিফের চোখ। ‘আশা করি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছ, আমি কী বলেছি?’

‘হ্যাঁ, বুঝেছি,’ ঘুরে চিফের অফিস থেকে বেরিয়ে গেল লুদভিগ কেইলম্যান।

.

লেক থেকে সরাসরি পুলিশ স্টেশনে গেছে লুদভিগ। ওখান থেকে বেরিয়ে এখন চলেছে এমিলির স্কুলের দিকে। তবে পৌঁছুতে দেরি হচ্ছে। পথে ভীষণ জ্যাম। বিশটা মিনিট এক জায়গায় বসে স্টিয়ারিং হুইলে তবলা বাজিয়ে অধৈর্য হয়ে গেল বেচারা। নীরবে দেখছে সামনের গাড়ির পেছনের বাম্পার।

পথের ধারে দোকানের শো-কেসে বসানো একাধিক টিভিতে চলছে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান। প্রথমে ওদিকে মন দিল না লুদভিগ। অবশ্য, একটা অনুষ্ঠানে যে রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে তাকে চেনে লুদভিগ। আজকাল দেয়ালে দেয়ালে থাকে তার ছবির পোস্টার। বিশাল এক বড়লোকের একমাত্র সন্তান। টাকার অভাব নেই, তাই বিলাসিতার রাজ্যে হয়ে উঠেছে কট্টর সমাজতন্ত্রী। কী যেন নাম? ক’মুহূর্ত পর লুদভিগের মনে পড়ল: এডি অ্যামন। মধ্যবিত্তরা ভাবছে, মন্দার গভীর মহাসাগরে তলিয়ে যাওয়া ইউরোপকে বাঁচাতে হলে ক্ষমতায় বসাতে হবে এই লোককে।

ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে চোখ যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল লুদভিগ। ঠিক সময়ে না গেলে বাসে উঠবে এমিলি। তখন ফিরে গিয়ে ওকে খুঁজতে হবে বাসস্টপে। ওখানে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাববে এমিলি, আজ ওকে নিতে এল না কেন ব্রিজিটা?

মহা মুশকিল!

হঠাৎ লুদভিগের মনে পড়ল, এই মুশকিল আসান করা খুব সহজ। থাবা মেরে গাড়ির ছাতের লাল-নীল বাতি জ্বেলে দিল সে। জোর আওয়াজে চালু হয়েছে সাইরেন। জাদুর মত কাজ হলো। মাত্র দুই মিনিটে সামনে থেকে সরে গেল গাড়িগুলো। মাঝের সরু রাস্তা ধরে এগোল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। বাঁক ঘুরে পড়ল পরের রাস্তায়। একটু পর লুদভিগ পৌঁছুল সেইণ্ট মেরি’য কলেজের উঁচু দেয়ালের বাইরে।

ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। বাইরে বাসে ওঠার জন্যে জটলা পাকিয়ে হৈ-চৈ করছে ধূসর ইউনিফর্ম ও গাঢ় নীল কোট পরা ছোট্ট মেয়েগুলো। জাগুয়ার আর বিএমডাব্লিউ-র মত দামি গাড়ি থেকে নামছে অভিজাত পোশাক পরা বড়লোকদের স্ত্রীরা, খুঁজে নিচ্ছে যার যার মেয়েকে।

পথের ধারে গাড়ি রেখে সাইরেন বন্ধ করল লুদভিগ। নেমে পড়তেই কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল একদল মহিলা। দ্রুত বাসের দিকে চলল লুদভিগ। বাচ্চা মেয়েদের ভিড়ে এমিলি নেই। অবশ্য খুব কাছেই ওর ক’জন বান্ধবী। ওদের কাছে জানতে চাইল লুদভিগ, ‘তোমরা এমিলিকে দেখেছ?’

জবাবে মাথা নাড়ল মেয়েগুলো। বাসে উঠে ভেতরটা দেখল লুদভিগ। এমিলি ওখানেও নেই।

স্কুলের খোলা গেট দিয়ে বেরোল ক’জন মেয়ে। পিঠে ভারী ব্যাগ নিয়ে পথের পাশে ফুটপাথে উঠল ওরা। গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছে বাড়ির দিকে। কী নিয়ে যেন হাসছে। তাদের একজনের হাতে বেহালার কেস। মেয়েটার নীল বনেটের নিচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সোনালি চুলের বেণী। বাস থেকে নেমে মেয়েগুলোর দিকে চলল লুদভিগ। জোর গলায় ডাকল এমিলির নাম ধরে। তাতে ঘুরে ওর দিকে তাকাল মেয়েরা। বিশাল শরীরের লালচে মুখের এক পুলিশ অফিসার পুরনো আমলের রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মত হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসছে। তবে যার কাছে বেহালা, সে কোনও দিকে না চেয়ে গল্পে মজে বান্ধবীর সঙ্গে হেঁটে চলেছে। লুদভিগকে দেখেনি ওরা। ক’মুহূর্তে ওদের পেছনে পৌঁছে গেল সার্জেন্ট। বেহালাবাদক মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল।

‘এমিলি, এদিকে কোথায় চললে…’

ঘুরে তার দিকে তাকাল মেয়েটা। ভয় পেয়েছে। পিছিয়ে গেল এক পা।

‘সরি,’ বলল লুদভিগ, ‘আমি ভেবেছি তুমি এমিলি কেইলম্যান। তুমি কি ওকে দেখেছ?’

নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েদুটো। বড় বড় চোখে দেখছে লুদভিগকে। আরেকবার মাথা নেড়ে ঘুরে হেঁটে চলল ওরা। মাঝে মাঝে কাঁধের ওপর দিয়ে দেখছে পুলিশ অফিসারকে। লোকটা ফিরে চলেছে স্কুলের গেটের দিকে। বামের মেয়েটা টোকা দিল নিজের মাথায়। নীরবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওই পুলিশটা পাগল!

খিলখিল করে হেসে ফেলল ওর বান্ধবী।

দ্রুত গিয়ে স্কুলে ঢুকল লুদভিগ। ড্রাইভওয়ের দু’পাশে গাছের সারি। আবারও শুরু হয়েছে সাদা পালকের মত তুষারপাত। চোখ থেকে তুষার সরিয়ে লুদভিগ চিনে ফেলল এমিলির প্রিয় এক শিক্ষিকাকে। ওর দিকেই হেঁটে আসছেন তিনি।

‘ফ্রাউ অ্যালিয়াহ্, আপনি কি এমিলিকে দেখেছেন?’ সামনে বেড়ে জিজ্ঞেস করল লুদভিগ।

এ প্রশ্নে বিস্মিত হয়েছেন টিচার। ‘কেন, বাসে ওঠেনি, হের কেইলম্যান? আমি তো দেখলাম বান্ধবীদের সঙ্গে গেটের দিকে গেল।’

মাথা নাড়ল লুদভিগ। ‘না, ওদের সঙ্গে নেই।’

‘দুশ্চিন্তা করবেন না, হের কেইলম্যান। তা হলে বোধহয় অন্য কোনও বান্ধবীর সঙ্গে বাড়ির দিকে গেছে।’

‘এমিলি এটা করবে না,’ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল লুদভিগ।

আইভি লতা দিয়ে সাজানো সুন্দর এক তোরণ পেরিয়ে স্কুলের গেটের দিকে চলেছে ছোট্ট এক মেয়ে, হাতে ক্ল্যারিনেটের কেস। মাথার চুল কালো, চোখদুটো বাদামি। লুদভিগকে দেখে ভয়ে বিস্ফারিত হলো ওর দুই চোখ।

‘অ্যাবি, এমিলিকে দেখেছ?’ জানতে চাইলেন ফ্রাউ অ্যালিয়াহ্।

‘ও তো চলে গেছে,’ দুর্বল স্বরে বলল অ্যাবি। ‘কোথায় গেছে?’ জানতে চাইল লুদভিগ।

পুলিশের অফিসার চেয়ে আছে দেখে ভয় ও লজ্জায় লাল হলো পিচ্চি।

‘কী হলো, জবাব দাও,’ নরম সুরে বললেন শিক্ষিকা। বসলেন মেয়েটার সামনে। আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। ‘ভয়ের কিছু নেই। বলো তো, কোথায় গেছে?

‘একটা গাড়িতে উঠেছে। এক লোকের সঙ্গে।’

কালো হলো শিক্ষিকার মুখ। ‘ওই লোককে চেনো তুমি?’

‘না। চিনি না।’

‘কতক্ষণ আগের কথা, বলো তো?’

গেটের দিকে তাকাল অ্যাবি। ওদিকে থামছে একের পর এক বাস। ‘আমি এমিলির সঙ্গে ছিলাম। তারপর মনে পড়ল, ভুলে ফেলে এসেছি আমার ক্ল্যারিনেট। তাই আবারও স্কুলে ঢুকলাম। তার আগে দেখলাম এমিলির পাশে থামল একটা গাড়ি। ওটা থেকে নামল একজন। হেসে এমিলিকে বলল, সে হের কেইলম্যানের বন্ধু।’ কাতর চোখে লুদভিগের দিকে তাকাল পিচ্চি মেয়েটা।

ধুপ-ধাপ শব্দে পাঁজরে হাতুড়ি পিটছে সার্জেন্ট লুদভিগের হৃৎপিণ্ড। শীতেও ঘামছে। ‘ওই লোক দেখতে কেমন?’ অ্যাবির কাছে জানতে চাইল লুদভিগ।

‘তা জানি না,’ দুর্বল স্বরে বলল অ্যাবি, ‘তবে অনেক লম্বা। পরনে দামি সুট ছিল।’

‘কী ধরনের গাড়িতে করে এসেছিল? ওটার রঙ বলতে পারবে?’

‘কালো,’ বলল অ্যাবি, ‘তবে কী-গাড়ি, তা বুঝিনি।’

বলতে পারবে কোন্ দিকে গেছে?’

সরাসরি রাস্তা দেখিয়ে দিল অ্যাবি।

ওদিকে এইমাত্র ছেড়ে গেল একটা বাস।

রাস্তার বহু দূরে চেয়ে রইল লুদভিগ।

এখানে কেউ বলতে পারবে না কোথায় এমিলি।

ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে কে যেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *