1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪২

বেয়াল্লিশ

এমিলি যেখানে লম্বা লোকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে, ওখান থেকে পরিষ্কার দেখছে কনভেন্টের ওদিকের মাঠে নেমেছে কালো দুটো হেলিকপ্টার। যন্ত্রদুটোর পেট থেকে নেমে দালানগুলোতে গিয়ে ঢুকছে আট-দশজন লোক। তাদের পরনে সাদা ওভারঅলের মত পোশাক, হাতে বোধহয় আগ্নেয়াস্ত্র। সিনেমায় ওই জিনিস দেখেছে এমিলি। মুখ ফিরিয়ে দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাতেও কালো পিস্তল!

খপ্ করে মাথার চুল ধরে হ্যাঁচকা টানে এমিলিকে দাঁড় করাল দানবটা। ব্যথায় কাতরে উঠল বেচারি। একহাতে ওর মুখ চেপে ধরল লোকটা।

পেছনের দালান ঘুরে ঝড়ের বেগে এল কালো কী যেন। এমিলি চিনল জোকে। মনিবের মেয়ের সঙ্গে অচেনা লোকটাকে দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছে কুকুরটা। গলা থেকে বেরোল চাপা গর্জন। বিদ্যুদ্বেগে এসে কবজি কামড়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে এমিলির কাছ থেকে লোকটাকে সরাল প্রভুভক্ত কুকুর। এক ধাক্কায় শত্রুকে মাটিতে ফেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ভয় পেয়ে চিৎকার জুড়েছে এমিলি। একটা খিলানের তলা দিয়ে এল আরও দু’জন লোক। অস্ত্র তাক করেই গুলি করল জো-র বুকে। শেষবারের মত গর্জন ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কুকুরটা। ছটফট করছে মৃত্যু-যন্ত্রণায়। রক্তে ভরে গেল সাদা তুষার।

এদিকে মাঝে মাঝে পিছলে গেলেও কনভেন্টের দিকে ছুটছে লিয়া। পরিষ্কার দেখেছে কী পরিণতি হয়েছে জো-র। দালানগুলোকে ঘিরে রাখা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকছে ক’জন লোক। লাথি দিয়ে খুলছে দরজা। হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। হেলিকপ্টারের গর্জন ছাপিয়ে শুরু হলো গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। থেমে গেছে নানদের প্রার্থনা- সঙ্গীত। ওদিক থেকে এল আর্তচিৎকার। তবে সবই চাপা পড়ল ব্রাশ ফায়ারের কর্কশ আওয়াজে।

এমিলিকে বগলের ভাঁজে নিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে ছুটল একলোক। চিৎকার করতে করতে হাত-পা ছুঁড়ছে মেয়েটা।

বুকের ভেতর ভীষণ লাফাচ্ছে লিয়ার হৃৎপিণ্ড। দেখল, প্রার্থনাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন এক নান। খুব ভয় পেয়েছেন তিনি। বুকে ও পেটে গুলি খেয়ে উঠানে চিত হয়ে পড়লেন। রক্ত ছড়িয়ে গেল কালো-সাদা পোশাকের সামনের দিকে। দু’জন লোক এসে মানুষটার গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে গেল প্রার্থনাঘরের দিকে। তুষারে থাকল তাজা রক্তের পুরু দাগ। প্রার্থনাঘরের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে চোখ গেল লিয়ার। বেদির সামনে রক্তাক্ত নানদের লাশের স্তূপ তৈরি করছে কয়েকজন মিলে।

এমিলিকে সাহায্য করতে যে-কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি লিয়া, কিন্তু ওর আসলে কিছুই করার নেই। ঘুরেই ছুটল ফার্মহাউসের দিকে। এখনও ওকে দেখেনি কেউ।

ঝড়ের বেগে বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিয়া। থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর র্যাকে রাখা বন্দুকটা টান দিয়ে নামিয়ে নিল। খুব কাঁপছে হাত। ড্রয়ার খুলে কয়েকটা কার্তুজ নিয়ে রাখল জ্যাকেটের পকেটে। রানা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে, ঠিক সেভাবে বন্দুক খুলে দুই নলে ভরল দুটো কার্তুজ।

বন্দুক হাতে ফার্মহাউস থেকে বেরিয়ে মনে মনে বলতে লাগল: পালিয়ে যাও! পালিয়ে যাও! পালাতে হবে তোমার!

ফার্মহাউসের পাশের গলি ধরে ছুট দিল লিয়া। কিন্তু গলা চিরে বেরোল অস্ফুট আর্তনাদ। এইমাত্র গলির আরেক মুখে থেমেছে একলোক। দু’জনের মাঝে দূরত্ব মাত্র পাঁচ ফুট। তার বুকের দিকে অস্ত্র তুলল লিয়া। তবে ওর মাথা লক্ষ্য করে অস্ত্র ধরেছে ওই লোকও। চোখ তার পাথরের মত কঠিন। চাপা গলায় বলল, ‘বন্দুক ফেলো, মেয়ে!’

আর কিছু ভাবার সময় নেই। দুই ট্রিগারে একইসঙ্গে চাপ দিল লিয়া। লাফিয়ে উঠল দোনলা বন্দুক। মারাত্মক ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল ও। এত কাছ থেকে দুই কার্তুজের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে লোকটার মুখ। ছিটকে দেয়ালে লাগল রক্তের ছিটা। ঠোঁটে লোকটার রক্তের লবণাক্ত স্বাদ পেল লিয়া। দেরি না করে লাশ টপকে ছুট দিল। সরে যেতে হবে কনভেণ্ট থেকে বহু দূরে। তুষারে পিছলে যেতে যেতেই রিলোড করল শটগান। তবে ওকে দেখে ফেলেছে আরেক লোক। লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়ে আসছে সে।

ফার্মের নিচু দেয়াল টপকে জঙ্গলে ঢুকল লিয়া। বুঝে গেছে, ওকে খুনের অনুমতি নেই, থাকলে আগেই খুন হতো। লোকটার গুলি নাক গুঁজল ওর পায়ের কাছে। এঁকেবেঁকে দৌড় দিল লিয়া। কিছুক্ষণ পর পেছনে পড়ল রানা আর ওর তৈরি করা সেই ভাঙা তুষারমানব। কাছে চলে এসেছে লোকটা! ঘুরে তার দিকে বন্দুক তাক করেই সামনের ট্রিগার টিপল লিয়া।

‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। উপত্যকা পেরিয়ে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে এল প্রতিধ্বনি।

ঊরুতে ভীষণ ব্যথা পেয়ে থমকে গেছে লোকটা। চোখ নামিয়ে জায়গাটায় আঙুল বোলাতেই দেখল রক্ত। আহত হয়েছে বলে ভীষণ রেগে গেল সে। অস্ত্র তুলল মেয়েটাকে শেষ করে দিতে। নির্দেশের কাঁথা পুড়ি! নিজের চোখে দেখেছে, ওই শালী কী হাল করেছে জিমের!

লাইন-অভ-ফায়ার থেকে সরতে গিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটছে লিয়া। তবে লোকটা ওর দিকে অস্ত্র তাক করে ট্রিগারে চাপ দিতেই খট-খট আওয়াজে গর্জে উঠল সাবমেশিন গান। লিয়ার ডানদিকের গাছগুলোতে লাগল একরাশ গুলি।

মুহূর্তে খালি হয়েছে ম্যাগাযিন। অস্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেল্টের খাপ থেকে টান দিয়ে কমব্যাট নাইফ নিল লোকটা।

গাছের শাখা-প্রশাখা ভেঙে গভীর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটছে লিয়া। একটা ডালের বাড়ি খেয়ে ওর হাত থেকে মাটিতে পড়ল বন্দুক। থেমে আবারও ওটা তুলে নেবে ভাবল লিয়া, কিন্তু তখনই দেখল খুব কাছে চলে এসেছে লোকটা!

হাঁপাতে হাঁপাতে আবারও দৌড় দিল লিয়া।

কিন্তু যাবে কোথায়?

জঙ্গল থেমে গেছে এক নদীর তীরে। জঙ্গলের শেষ গাছ পেরোলে দশফুট নিচে পাহাড়ি নদীর পাথুরে পাড়। পালিয়ে যেতে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে লিয়া!

বন্দুকটা পড়ে আছে দেখে তুলে নিয়েছে ধাওয়াকারী লোকটা। চট্ করে বুঝে গেল, একটা হ্যামার এখনও কক করা। তার মানে গুলি আছে বন্দুকে। নিষ্ঠুর হাসল লোকটা। মেয়েটা আছে বড়জোর বিশ গজ দূরে। পরনে রঙচঙে কুইন্টেড জ্যাকেট। জঙ্গলে খুব সহজ শিকার!

বন্দুকটা লিয়ার দিকে তাক করেই ট্রিগার টিপল সে। কাঁধে জোরালো ধাক্কা দিল কুঁদো। বিকট আওয়াজ তুলে ওপরে উঠেছে বন্দুকের নল। ধূসর ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে সে দেখল, ঘুরেই জঙ্গলের কিনারার ঝোপ ভেঙে নিচের পাথরে গিয়ে পড়ল মেয়েটা।

এক দৌড়ে জঙ্গলের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।

দশফুট নিচে ঝোপের মাঝে কাত হয়ে পড়ে আছে সুন্দরী। নিষ্পলক দু’চোখ আকাশে স্থির। কুলকুল শব্দে বইছে পাহাড়ি নদী। মেয়েটার বাহু বেয়ে কবজি থেকে নদীর জলে মিশছে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত। নিজের বুটের দিকে চোখ যেতেই ঘাতক দেখল, লাল হয়েছে তুষার। মেয়েটার ওপর আবারও চোখ ফিরল তার।

নাহ্, শ্বাস নেয়া বা ফেলার কোনও লক্ষণ নেই।

পেরোল কয়েক মিনিট।

মুহূর্তের জন্যেও নড়ল না মেয়েটা।

সন্তুষ্ট হয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট এক ক্যান ডিজিটাল ক্যামেরা বের করল লোকটা। যন্ত্রটা চালু করে যুম করল লিয়ার ওপর। তিনটে ছবি নিয়ে পকেটে রাখল ক্যামেরা। ঘুরে দাঁড়াবে, এমনসময় চোখের কোণে ধরা পড়ল কীসের যেন ঝিলিক। ওটা সোনার চেইন, সঙ্গে ছোট লকেট ভাঙা ঝোপের ডাল থেকে ঝুলছে। হ্যাঁচকা টানে চেইন ও লকেট হাতের মুঠোয় নিল লোকটা। তালুতে মেখে গেল কয়েক ফোঁটা রক্ত।

জঙ্গলের ওদিকে লেলিহান লাল আগুনে পুড়ছে নানদের নিরাপদ আশ্রম। এখন কোথাও আর্তনাদের আওয়াজ নেই এরই ভেতর আকাশে উঠেছে প্রথম হেলিকপ্টার। রোটরের দাবড়ি খেয়ে নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া।

একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফিরতি পথে চলল আততায়ী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *