1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ১১

এগারো

হচিন্সটন হল পেছনে ফেলে তীরবেগে ছুটছে নীল টিভিআর টুস্কান। কোথায় যাবে এখনও জানে না রানা। কান্ট্রি রোডে গাড়িঘোড়ার চাপ নেই। ঝড়ের বেগে ছয় মাইল যাওয়ার পর গাড়ির গতি কমাল রানা। বারবার দেখছে রিয়ার ভিউ মিরর, জানতে চায় পেছন থেকে তেড়ে আসছে কি না কোনও গাড়ি।

একপাশে জঙ্গুলে সরু পথ পেয়ে ওখানে ঢুকল রানা টিভিআর টুস্কানের ইঞ্জিন বন্ধ করে লিয়ার দিকে তাকাল।

ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়েছে বেচারির মুখ।

‘অসুস্থ লাগছে?’ জানতে চাইল রানা। ঘুরে পেছনের সিট থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওটা থেকে বের করল প্রায় শেষ করে আনা উইস্কির বোতল। ওটা লিয়ার হাতে দিয়ে বলল, ‘হয়তো টেনশন কমবে।’

বোতলের ছিপি খুলে দু’ঢোক সোনালি তরল গিলে মুখ বিকৃত করল লিয়া। খালি বোতল রানার হাতে ফেরত দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ।’

ব্যাকপ্যাকে খালি বোতল রাখল রানা। এদিকে হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে ফোন বের করেছে লিয়া। ওর কাছে জানতে চাইল রানা, ‘কাকে ফোন দেবে?’

‘পুলিশকে।’

ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে লিয়ার হাত থেকে ফোনটা নিল রানা। ‘উচিত হবে না।’

‘কেন?’

‘গতরাতে কেউ জানত না আমরা আছি হচিন্সটন হলে। ফোনে পুলিশকে জানানোর পর ভোরেই এল একদল খুনি।’

‘এটা কী বলছ, রানা?’

‘ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়,’ বলল রানা, ‘তা ছাড়া, ওই বাড়িতে আছে খুন হওয়া তিনটে লাশ। পুলিশ ওখানে গেলে ধরে নেবে তুমিও এসবে জড়িত। ফলে গ্রেফতার হব।’ ব্যাগ থেকে সরু বক্স ফাইল নিয়ে ওটা লিয়াকে দেখাল রানা। ‘এটা খুঁজছিল।’ ফাইলের লেবেলে তামাটে রঙ ধরেছে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ফোঁটা।

‘মোযার্ট’স্ ডকুমেন্টস্? ওটাই তো অ্যালেকের রিসার্চ!’ অসহায় চোখে রানাকে দেখল লিয়া। ‘কিন্তু কেন কেউ…’

‘আমাদের এই ফাইলের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা উচিত, ‘ বলল রানা। পায়ের কাছে রাখল ব্যাকপ্যাক। ওটা থেকে এল অস্ত্রের ঠোকাঠুকির ভোঁতা ধাতব আওয়াজ। স্টিয়ারিং হুইলে ঠেকিয়ে কোলের ওপর খাড়া করে ফাইলটা রাখল রানা। খুট শব্দে খুলল ওটার ঢাকনির ক্যাচ।

ফাইলে পোড়া কাগজপত্র দেখে চমকে গেল লিয়া। ‘এই হাল? সবই তো পুড়ে গেছে!’

রানার কোল থেকে ফুটওয়েলে পড়ল পুরু এনভেলপ। ওটা না তুলে ফাইলের কাগজপত্র দেখতে লাগল রানা। সাবধানে ধরছে আধপোড়া কাগজ।

কিছু ডকুমেণ্ট হাতে লেখা, আবার কিছু কমপিউটার প্রিন্ট। পুড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগই পড়ার উপায় নেই ডকুমেন্টগুলো দেখে রানা ধারণা করল, এসবই ঐতিহাসিক তথ্য। এখানে ওখানে মোযার্টের নাম লেখা।

ফাইল থেকে বাজেভাবে পুড়ে যাওয়া একটা কাগজ তুলল লিয়া। গুঁড়ো হলো ওটা ওর হাতের চাপে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল বেচারি। ‘অ্যালেকের রিসার্চ পেপার। বহু জায়গা ঘুরে নানান তথ্য সংগ্রহ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সবই এখন শেষ!

বক্স ফাইলে ছাই ও পোড়া কাগজ রাখল রানা। ঢাকনি বন্ধ করে লিয়ার দিকে তাকাল। ‘আসলে কী বিষয় নিয়ে কাজ করছিল অ্যালেক, লিয়া? কেন এগুলো খুঁজছিল এরা?’

‘আমি জানব কী করে?’ মাথা নাড়ল লিয়া।

‘গতকাল রাতে বলেছ, এসব নোট মাসের পর মাস অনেক দিন ধরে তোমার কাছে পাঠিয়েছে অ্যালেক—এটা কি ঠিক? সেক্ষেত্রে এত দিন পর কেন এগুলোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে কেউ? কারণটা কী? কী আছে এসবের ভেতর? আর তারা জানল কীভাবে যে এগুলো তোমার কাছে আছে?’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল লিয়া। জবাব নেই ওর কাছে। ‘অ্যালেকের এই বইয়ের ব্যাপারে তুমি ছাড়া আর কারা জানে?’

হঠাৎ ঝিক করে উঠল লিয়ার সবুজ চোখ। ‘হায়, ঈশ্বর!’

ওর দিকে চেয়ে আছে রানা।

ঢোক গিলল লিয়া। ‘অন্তত বিশ লাখ মানুষ জানে এই বইটার কথা!’

‘কী করে?’

‘আগামীবছর ইউরোপিয়ান ট্যুর সম্পর্কে বলার সময় টিভিতে বিবিসি মিউযিক প্রোগ্রামে উল্লেখ করেছি এই বইটার কথা। তখন বলেছি কীভাবে রিসার্চ করে সব তথ্য আমার কাছে পাঠাত অ্যালেক। এমন কী শেষ দিনেও নতুন কিছু পাঠিয়েছিল। তবে ওর মৃত্যুর পর ওগুলো দেখার মানসিকতা আমার আর ছিল না।

‘কবে প্রচার হয় ওই প্রোগ্রাম?’ জানতে চাইল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল লিয়া। ‘লণ্ডনে আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টার দু’দিন আগে।’

পায়ে কী যেন ঠেকে আছে বুঝতেই রানার মনে পড়ল এনভেলপটার কথা। ঝুঁকে তুলে নিল ওটা।

‘আরে, আমি তো এটা চিনি,’ ফিসফিস করল লিয়া। হাত বাড়িয়ে রানার কাছ থেকে নিল এনভেলপ। ‘এটার কথাই বলেছি। মৃত্যুর দিন পাঠিয়ে দিয়েছিল অ্যালেক।’ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনভেলপটা দেখল ও। ‘ফিউনেরাল শেষে বাড়ি ফিরে পেয়েছি। ক’দিন আগে আমার পিএস র‍্যাচেলকে বলেছি, অন্য সবকিছুর সঙ্গে এটাও যেন ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেয়।

‘এবার এটা খুলে দেখতে হবে,’ বলল রানা।

‘বুঝতে পেরেছি।’

সামান্য পোড়া এনভেলপটা নিয়ে একপ্রান্ত ছিঁড়ল রানা। ভেতরে র‍্যাপিং পেপারে মোড়া কিছু। রুপালি কাগজটা খুলতেই বেরোল অক্ষত একটা সিডি বক্স। কাভারে লেখা: মিউযিক। মোযার্ট’স্ অপেরা: দ্য ম্যাজিক ফুট।

লিয়ার দিকে তাকাল রানা। ‘হঠাৎ কেন তোমার কাছে এটা পাঠাবে অ্যালেক?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিয়া। ‘কারণ ওটা আমার। শোনার জন্যে নিয়েছিল অ্যালেক। ফেরত দিচ্ছিল।’

‘খামের ভেতরে আর কিছু নেই।’

সিটে হেলান দিল হতাশ লিয়া। ‘কিছুই তো বুঝছি না। আসলে এসব কী হচ্ছে, রানা?’

সিডিবক্সের ঢাকনিটা খুলল রানা। ক্যাচ খুলে আলগা হয়ে গেছে সিডিটা। ওটা পিছলে পড়ল ওর কোলে। দেখা গেল কেসের ভেতর রয়েছে আরেকটা সিডি। ওপরে লেখা: সিডি-রেকর্ডেবল। নিচে মার্কার পেন দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে লেখা: লিয়া, ‘যা-ই ঘটুক এই ডিস্ক চালু করে দেখবি না। গোপন কোথাও লুকিয়ে রাখ। আমি বাড়ি ফিরে আসছি।

অ্যালেক।

ড্যাশবোর্ডের নির্দিষ্ট বাটন টিপল লিয়া। বাতি জ্বলে উঠেছে গাড়ির সিডি প্লেয়ারে। ‘চালু করে দেখা যাক।’

‘এটা অডিয়ো ডিস্ক নয়,’ বলল রানা, ‘ভিডিয়ো চালু করতে হলে কমপিউটার লাগবে।

.

একঘণ্টা পর মাইলখানেক দূরে ছোট এক হোটেলে উঠল রানা ও লিয়া। রেজিস্ট্রি খাতায় লিখেছে, ওরা মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস গর্ডন। হোটেলে যাওয়ার পথে মার্কেট থেকে কিনে নিয়েছে নতুন একটা ল্যাপটপ কমপিউটার। এখন হোটেলের ঘরে বসে বাক্স থেকে জিনিসটা বের করছে রানা। র‍্যাপিং খুলে ল্যাপটপ রাখল রুমের বৃত্তাকার টেবিলের ওপর। মিনিট তিনেক লাগল মেশিনটা চালু করতে। দ্য ম্যাজিক ফুট-এর কেস থেকে ভিডিয়ো সিডি নিয়ে ভরল কমপিউটারের ডিস্ক ড্রাইভে। ফিসফিস শব্দে কাজ শুরু করল নতুন ল্যাপটপ ফ্ল্যাট স্ক্রিনে খুলে গেল একটা উইণ্ডো।

ডিস্ক লোড হতেই রানার পাশে চেয়ার টেনে বসল লিয়া। কয়েকটা ছবি ফুটতেই শুকনো গলায় বলল, ‘ইউরোপের নানান এলাকার ছবি। এই সিডি বোধহয় অ্যালেকের রিসার্চ ট্রিপের ফোটো ডায়েরি।

কুঁচকে গেল রানার ভুরু। ‘সেক্ষেত্রে তোমার মোযার্ট বক্সের ভেতর এই ছবির সিডি কেন রাখল?’

‘জানি না।’ একটা ছবির ওপর ক্লিক দিল লিয়া। মনিটরে দেখা গেল বৃদ্ধ এক লোকের ছবি। মানুষটার বয়স অন্তত সত্তর। গাল ও কপালের ত্বকে অসংখ্য ভাঁজ থাকলেও চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝিলিক। পেছনে উঁচু বুককেস। ওখানে শোপ্যান, বিটোফেন বা এলগারের মত নাম করা সব সুরকারের ওপরে লেখা বই।

‘কে এই লোক?’ জানতে চাইল রানা।

‘চিনি না,’ বলল লিয়া। আবারও ক্লিক দিল। বৃদ্ধের ছবির বদলে স্ক্রিনে ফুটেছে আরেকটা ছবি। বাড়িটা সাদা রঙের পাথরের। ছোট কোনও মন্দির বলে মনে হলো রানার। বাড়ির মাথার ওপর বড় গম্বুজ। ‘চিনেছি,’ বলল লিয়া ‘ইতালির র‍্যাভেনা। ওখানেই আছে দান্তের সমাধি। আমি একবার ওখানে গিয়েছি।’

‘অ্যালেকের রিসার্চ ছিল ভিয়েনায়,’ বলল রানা। ‘তা হলে ইতালিতে গেল কেন?’

‘জানি না।’

‘ইতালিতে প্রচুর সময় কাটাতেন মোযার্ট?’

ক’মুহূর্ত ভাবার পর বলল লিয়া, ‘মিউযিক স্কুলে পড়াশোনার সময় যা জেনেছি, তা বলতে পারি। বোলোগনায় কৈশোর কাটিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া, জরুরি প্রয়োজন না হলে কখনও ইতালিতে যেতেন না।’

‘ঠিক আছে, পরের ছবিতে যাও।’

লিয়া ক্লিক দিতেই এল পরের ছবি। পার্টিতে সুন্দরী দুই মেয়ের সঙ্গে অ্যালেক। ওর দুই গালে চুমু দিচ্ছে তারা। খুশি মনে হচ্ছে অ্যালেককে। হাতের গ্লাসে ককটেল ড্রিঙ্ক।

আবারও ক্লিক দিল লিয়া।

একই পার্টির ছবি। এবার অ্যালেক বসে আছে পিয়ানোর সামনে। ডাবল টুলে ওর পাশে এক তরুণ। দু’জন মিলে বাজাচ্ছে পিয়ানো। ‘কি’ টিপছে অ্যালেক, মুখে আনন্দের হাসি। পার্টির ড্রেস পরা কয়েকটা মেয়ে মিউযিক শুনছে, সবার হাতে শ্যাম্পেনের লম্বা গ্লাস। ঝলমল করছে সবার চেহারা। দারুণ মজায় আছে সবাই পার্টিতে।

ভাইয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না লিয়া। পরের ছবিতে গেল। এবারের ছবি তুষার ছাওয়া কোনও গ্রামের। পেছনে পাহাড়ের কোলে সাদা হওয়া সব গাছ। ভুরু কুঁচকে ফেলল লিয়া। ‘সুইট্যারল্যাণ্ড?’

ছবিটা মন দিয়ে দেখল রানা। ‘হয়তো, অথবা অস্ট্রিয়া।’ ছবির প্রপার্টি দেখল। এই ছবি তোলা হয়েছে অ্যালেক মারা যাওয়ার তিন দিন আগে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিয়া। ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

ছবি দেখা বাদ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে বেডের কিনারায় গিয়ে বসল রানা। পাশেই আছে একটা দৈনিক পত্রিকা। ওটার ওপর বক্স ফাইল থেকে নেয়া আধপোড়া কাগজপত্র। কয়েকটা কাগজের নিচে মুচড়ে যাওয়া একটা ডকুমেন্টের ওপর চোখ পড়ল ওর। ওটা অন্য কাগজ থেকে আলাদা। এতই পুড়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় গায়েব হয়েছে শব্দ বা অক্ষর। গোটা জিনিসটা জিগ্‌সও পাযলের মত। নিচে জার্মান ভাষায় কী যেন লেখা। ওদিকে মন দিল রানা। তবে কয়েকটা বাক্য ছাড়া আর কিছুই নেই ওখানে।

হঠাৎ করেই রানার মনে হলো, ওই ডকুমেন্ট মোযার্টের হাতে লেখা সত্যিকারের চিঠি। শ্বাস আটকে ফেলল। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ওটা আসলে সাধারণ ফোটোকপি।

ওটা কারও কাছে লেখা মোযার্টের চিঠি।

অ্যালেকের কথা মনে পড়ল রানার। ক’বছর আগে মোযার্টের চিঠি নিয়ে একটা কাহিনী বলেছিল অ্যালেক, পরিষ্কার মনে আছে ওর।

বেশ ক’বছর আগে বেকারদের অ্যান্টিক পিয়ানো মেরামতির দোকানে এসেছিল পুরনো এক পিয়ানো। তখন মাত্র মারা গেছেন লিয়া আর অ্যালেকের মা। স্ত্রীর মৃত্যুতে একদম হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন ওদের বাবা। দিনের পর দিন মদ গিলে পড়ে থাকতেন। সেকারণেই ধসে গেল পারিবারিক ব্যবসা। বিরক্ত হয়ে অন্য কারখানায় নিজেদের পিয়ানো মেরামতের জন্যে জমা দিতে লাগল কাস্টোমাররা। তবে সেসময়ে একদিন বাড়ির চিলেকোঠায় এমন এক জিনিস পেলেন গ্যারি বেকার, যেটা বদলে দিতে পারত তাঁর জীবনের মোড়।

ওই অতি পুরনো পিয়ানো ছিল উনিশ শতকে ভিয়েনার নাম করা বাদ্যযন্ত্র নির্মাণকারী জোসেফ ব্যমের নিজ হাতে তৈরি। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে উনিশ শ’ ত্রিশের দিকে ওটা পৌঁছেছিল ব্রিটেনে। যত্নের সঙ্গে রাখা হয়নি বলে, পিয়ানোর কেসওঅর্ক প্রায় খেয়ে নিয়েছিল ঘুণপোকা। ওই পিয়ানো মেরামত করতে চাইলে লাগবে মেলা সময়। তবে ওটা ছিল গ্যারি বেকারের পেশাদারী জীবনে পাওয়া সবচেয়ে সুন্দর পিয়ানো। ওটা দেখার পর খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। ভাবলেন, মেরামত করে নিলামে তুলবেন। তাতে হয়তো পাওয়া যাবে দশ বা বারো হাজার পাউণ্ড। ওই টাকা তখন তাঁর কাছে অনেক। কাজেই পর্ট বা শেরির বোতল সরিয়ে রেখে কাজে নেমে পড়লেন গ্যারি।

অবশ্য পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগেই পিয়ানোর একটা পায়ার ভেতর তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর স্বপ্নের জিনিসটা। ফাঁপা ছিল ওই পায়া। ভেতরে ছিল রিবন দিয়ে মুড়ে রাখা একটা ডকুমেন্ট। হলদে কাগজে লেখা অক্ষরগুলো জার্মান তারিখ সতেরো শ’ একানব্বুই সালের নভেম্বর মাসের একটি দিনের। চিঠির নিচে কার সই তা বুঝতে পেরে আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতেন গ্যারি বেকার।

চিঠির লেখক উলফগান আমাদিউস মোযার্ট!

মারা যাওয়ার ক’সপ্তাহ আগে ওই চিঠি লেখেন তিনি আজকাল আর তাঁর লেখা এ ধরনের চিঠি পাওয়া যায় না। কীভাবে পিয়ানোর ফাঁপা পায়ার ভেতর ওটা এল, তা এক গভীর রহস্য। গ্যারি বুঝে গেলেন, তিনি পেয়ে গেছেন এক ঐতিহাসিক সম্পদ। আর ওটাই হয়তো চিরকালের জন্যে বদলে দেবে তাঁর অর্থনৈতিক জীবন।

রানার সঙ্গে দেখা হলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু ওই চিঠির কথা বলত অ্যালেক। লণ্ডনে গিয়ে এক্সপার্ট মিউযিকোলজিস্ট আর অ্যান্টিকুয়েরিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন গ্যারি বেকার। তবে এক্সপার্টরা ওই চিঠি নকল বলে রায় দিলে মুখ থুবড়ে পড়ে তাঁর রঙিন স্বপ্ন।

‘ওটা হয়তো সত্যিই নকল নয়,’ আনমনে বলল রানা।

ঘুরে ওর দিকে তাকাল লিয়া। ‘কী সত্যি নয়?’

‘তোমার বাবার ওই চিঠি হয়তো আসল। আর সেজন্যেই ওটা পেতে তোমার পিছু নিয়েছে লোকগুলো। সত্যিকারের চিঠি হলে সেটার দাম কত হতে পারে?’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল লিয়া। ‘তোমার মনে নেই, বাবা ওটা বিক্রি করে দিয়েছিল? তুমি বোধহয় জানো না। তাও তো অন্তত সাড়ে পাঁচ বছর আগের কথা।’

‘ওটা জেনুইন নয় জেনেও কিনল কেন কেউ?’

মৃদু হাসল লিয়া। ‘মন ভেঙে গিয়েছিল বাবার। তবে সেসময়ে যোগাযোগ করলেন উন্মাদ এক সংগ্রাহক। তিনি ছিলেন ইতালির মিউযিক স্কলার। চিঠিটা কিনতে চাইলেন। বাবা যেমন ভেবেছিল কোটি কোটি টাকা পাবে, তেমন না পেলেও রাজি হয়ে গেল বিক্রি করতে। সেসময়ে ইতালিয়ান সংগ্রাহক আরও জানালেন, ওই পিয়ানোটাও তিনি কিনে নিতে চান। তখন মেরামতির মাঝপর্যায়ে আছে পিয়ানো। তবুও পুরো দামে ওটা কিনলেন তিনি। আমার মনে আছে, সব গুছিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এক্সপার্টরা হতাশ করলেও ওই টাকা পেয়ে আবারও সচ্ছল হলো বাবা। আর সেজন্যেই নিউ ইয়র্কে গিয়ে মিউযিক অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হতে পেরেছিলাম আমি।’

‘ওই ইতালিয়ান স্কলারের নাম কী?’ জানতে চাইল রানা। ‘মনে নেই,’ কয়েক মুহূর্ত ভাবল লিয়া। ‘এরপর পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়। তা ছাড়া, কখনও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। অ্যালেক চিনত। আমাকে বলেছিল, ওই ভদ্রলোকের বয়স অনেক। এতদিনে হয়তো আর বেঁচেই নেই।’

ফোটোকপি করা চিঠি আরেকদিকে সরিয়ে রাখল রানা। ঘাঁটছে অন্যান্য ডকুমেন্ট। কিছুক্ষণ পর অন্যকিছু চোখে পড়ল ওর। মনোযোগ দিল ওটার দিকে।

আগুনে পুড়ে গেছে অ্যালেকের লেখা কাগজের মার্জিন। কয়েক লাইন পড়ল রানা। এরপর কাগজে বোল্ড ক্যাপিটাল অক্ষরে আণ্ডার লাইন দিয়ে লেখা হয়েছে একটা বাক্য। তবে পুড়ে ছাই হয়েছে বাক্যের পরের অংশ। লিয়ার দিকে চেয়ে উচ্চারণ করে পড়ল রানা: ‘এখানে ইংরেজিতে লিখেছে: ‘অর্ডার অভ আর… কাঁধ ঝাঁকাল। ‘এটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে অ্যালেক?’

‘আমার জানা নেই।’

অন্যান্য কাগজের সঙ্গে পোড়া ডকুমেন্ট রাখল রানা। ‘আগুনে পুড়ে আবর্জনা হয়েছে সব।’

কমপিউটারে ফোটোগ্রাফ দেখা শেষ লিয়ার।

সিডিতে রয়েছে মাত্র একটা ফাইল।

রানা পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওটার ওপর ক্লিক করল লিয়া।

শুকনো গলায় বলল রানা, ‘এটা ফোটো ফাইল নয়, ভিডিয়ো ক্লিপ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *