একত্রিশ
তরুণ রসি গুচ্চি ঠিকই বলেছে, ফিয়াট গাড়িটা পুরনো হলেও ভাল কণ্ডিশনে আছে। সোয়া চারঘণ্টায় রানা ও লিয়া পৌঁছুল মিলান শহরে। একবার একটা অটোস্ট্রাডা সার্ভিস স্টেশনে থেমে মাথার স্কার্ফ, বড় কাঁচের সানগ্লাস, জিন্সের প্যান্ট ও গরম জ্যাকেট কিনেছে লিয়া।
মিলানের চালকরা উন্মাদের মত গাড়ি চালায়। নানান ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে মাঝ-সকালে শহরতলীতে আঠারো শতকের মিউযিক মিউযিয়াম মিউসেয়ো ভিসকণ্টির সামনে পৌঁছল ওরা। উঁচু পোর্টিকোওয়ালা দেয়ালের ভেতর সুন্দর সাজানো বাগান। ওখান থেকে কানে আসে না রাস্তার গাড়ির প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ, হৈ-চৈ।
জাদুঘরের ভেতরে কাঠের পালিশের কড়া গন্ধ। দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। নিচতলায় মাঝবয়সী ক’জনকে দেখতে পেল রানা ও লিয়া। নিচু গলায় কথা বলছে তারা। ভার্নিশ ও মোম-পালিশের গুণে আয়নার মত চকচক করছে নকশা কাটা পার্কেই মেঝে। জাদুঘরে মৃদু শব্দে বাজছে ক্লাসিকাল মিউযিক। প্রতিটি ঘরের দরজায় ঝুলছে ভেলভেটের ভারী পর্দা। পাহারা দিচ্ছে অন্তত আশি বছর বয়সী এক সিকিউরিটি গার্ড।
এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময় চারপাশ দেখে নিচ্ছে রানা। এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে নজর রাখছে দেয়ালে-বসানো ভিডিয়ো ক্যামেরার দিকে। ব্রাসের বাদ্যযন্ত্র দেখা শেষ হলে সামনে পড়ল চমৎকার কারুকাজ করা অ্যান্টিক হার্প। পরের ঘরের গ্যালারিতে নাম করা সুরকারদের পুরনো তৈলচিত্র।
‘এখানে কিচ্ছু নেই,’ নিচু স্বরে বলল রানা, ‘ব্যাটারা মরে গিয়েও পাউডারমাখা নকল পরচুলা পরে ছবিতে পোষ দিচ্ছে।’
‘তুমি খুব বেরসিক,’ ফিসফিস করে বলল লিয়া।
মেইন হল থেকে বাঁকা হয়ে ওপরে গেছে কাঠের সিঁড়ি। রানা ও লিয়া দোতলায় ওঠার সময় মচ-মচ আওয়াজ তুলল ধাপগুলো। সামনেই পড়ল দীর্ঘ একটা ঘর। ওখানে দেয়ালের পাশে সারি দিয়ে রাখা কাঁচের ক্যাবিনেটের ভেতর নানান আমলের অপেরায় ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য জিনিসপত্র। একটা ক্যাবিনেটের সামনে থমকে গেল লিয়া। ছোট একটা ব্রাসের প্লেক থেকে পড়ল: ‘আঠারো শ’ চুরানব্বুই সালে জনসাধারণের সামনে এই গাউন পরেন স্বয়ং ক্রুসো।’ আরেকটা ক্যাবিনেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ‘কী দারুণ! ভাবতে পারো, বায়ান্ন সালে মিলানে নর্মা গানটা গাওয়ার সময় এই ড্রেস পরেন মারিয়া ক্যালাস। অদ্ভুত ব্যাপার! এই মিউযিয়ামের কথা আগে কখনও শুনিনি কেন?’
‘লিয়া, আমরা পুরনো পোশাক দেখতে এখানে আসিনি। সময় পেলে পরে সব দেখে নেব। এবার এগোও। খুঁজে বের করতে হবে মোযার্টের চিঠি।’
আবারও এন্ট্রান্স ফয়েতে ফিরল ওরা। মেলা বয়স হলেও কানদুটোকে তুখোড় চালু রেখেছে বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড। সবই শুনেছে রানার কথা। মাথা নাড়ল সে। ‘কী আফসোস, আমাদের এখানে চিঠি বা ডকুমেন্ট নেই।’
‘এটা ছাড়া অন্য কোনও মিউসেয়ো ভিসকণ্টি আছে?’ জানতে চাইল রানা। জবাব শোনার আগেই বুঝে গেছে নেতিবাচক উত্তর পাবে।
আবারও মাথা নাড়ল সিকিউরিটি গার্ড। ‘না, নেই। আমি এখানে আছি তেপ্পান্ন বছর। এটা ছাড়া ইটালির আর কোথাও এ ধরনের কোনও মিউযিয়াম নেই।’
লিয়াকে নিয়ে সরে গেল রানা।
‘জানতাম এখানে এসে কোনও লাভ হবে না,’ বলল লিয়া।
‘কিন্তু কিছু না কিছু এখানে দান করেছেন প্রফেসর। তার প্রমাণ হচ্ছে ওই রসিদ।’
দীর্ঘ করিডোর ধরে চলল ওরা। দু’পাশের দেয়ালের ধারে কাঁচের কেসে প্রাচীন সব বেহালা, ভায়োলা আর চেলো। ‘তিনি সংগ্রাহক ছিলেন,’ বলল লিয়া। ‘যে-কোনও কিছুই দান করে থাকতে পারেন। তা হতে পারে বাদ্যযন্ত্রের ছবি।’ একটা কাঁচের কেসের ভেতরের বেহালা দেখাল লিয়া। ‘সেটা এটাও হতে পারে। জানার কোনও উপায় নেই।’
‘ভুল করছি আমরা,’ হঠাৎ থমকে গিয়ে বলল রানা।
‘কীসের ভুল?’ জানতে চাইল লিয়া
‘ওটা ফিরে গেছে নিজের বাড়িতে,’ বলল রানা।
অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল লিয়া।
‘”অ্যালেক ই-মেইল করার পর মোযার্টের চিঠি সরিয়ে ফেলেছি গোপন জায়গায়। কেউ ওটা খুঁজে পাবে না।’’ জানাল রানা। ‘ওই চিঠি ঠিক জায়গায় ফিরেছে, মানে অন্যকিছু। তিনি কিন্তু জাদুঘর বোঝাননি। ওই চিঠি তো এখানে কখনও ছিল না।’
‘তা হলে ভুল জায়গায় এসেছি আমরা?’
‘মনে হয় না,’ বলল রানা। দেখে নিল দূরের করিডোর। ‘আমাদেরকে খুঁজে নিতে হবে পিয়ানোর সেকশন।’
এবার ওর কথা বুঝতে পেরেছে লিয়া। ‘তাই তো, এখন তো মনে হচ্ছে তুমি ঠিকই বলেছ।’
‘দেখলে তোমার বাবার ওই পিয়ানোটা চিনতে পারবে?’
‘পলকে!’
দ্রুত হাঁটতেই খট্ খট্ শব্দ তুলল পার্কেই মেঝে। করিডোর ধরে ফিরে চলল ওরা কিবোর্ড ইন্সট্রুমেন্ট সেকশনের দিকে। খিলান দেয়া এক জায়গায় পৌঁছে দরজার লাল পর্দা সরাল ওরা। ওদিকে পা বাড়াতেই দেখল চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরনো কিবোর্ড ইন্সট্রুমেন্ট, পিয়ানো, স্পিনেট ও হার্প-সি-কর্ড। খুব যত্নের সঙ্গে রাখা হয়েছে সবকিছু। চকচক করছে নতুন পালিশের গুণে। তবে পাথরের কলাম ও নানান ফিতার কারণে বাদ্যযন্ত্রগুলো স্পর্শ করতে পারবে না কেউ।
প্লেকে লেখা: দয়া করে হাত দেবেন না কিছুতে।
বাদ্যযন্ত্রগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে জানতে চাইল রানা, ‘ওটা দেখতে পেলে?’
‘ওই যে, ওটা,’ জানালার কাছের এক পিয়ানো, দেখাল লিয়া। ওটা বিশাল এবং কারুকাজ করা। জাদুঘরের আলোয় চকচক করছে ওটার কাঠে খোদাই করা নকশা। পিয়ানোটা ঘুরে দেখল লিয়া। নিচু গলায় বলল, ‘শেষবার দেখেছি অর্ধেক মেরামত অবস্থায়। খুলে রাখা হয়েছিল কাঠের নানান অংশ। তবে ওটা যে এটাই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’
‘তোমার কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’
‘না। যে-কোনও জায়গায়, যে-কোনও দিন চিনব।’
গভীর মনোযোগ দিয়ে পিয়ানো দেখছে রানা। ওটা ভারী ভার্নিশ দেয়া। জায়গায় জায়গায় মাদার অভ পার্ল। চিকচিক করছে এবোনি কি এবং হাতির দাঁতের নকশা। কিবোর্ডের ওপরে সোনার অক্ষরে লেখা নির্মাতার নাম: জোসেফ বোম, ভিয়েনা। কারুকার্যময় তিনটে পায়ার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পিয়ানো। সামনে দুটো, পেছনে একটা পা। বাদ্যযন্ত্রটা দৈর্ঘ্যে হবে পুরো বারো ফুট। ভারী ও পোক্ত।
‘এবার বলো তো, ওটার কোন্ পা ফাঁপা?’ জানতে চাইল রানা।
ডানহাতে থুতনি ধরে ভাবতে লাগল লিয়া। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘সামনের দুটোর যে-কোনও একটা।’
‘বামেরটা না ডানেরটা?’
‘আমার মনে হয় ডানের পায়া। …না-না, বামেরটা।’
সিকিউরিটি কর্ডনের ওপর ঝুঁকল রানা। খুব কাছ থেকে পিয়ানো পরীক্ষার উপায় নেই। চট করে চারপাশে তাকাল ও। আশপাশে কেউ নেই। পায়ের আওয়াজ থেকে বোঝা যাচ্ছে, পাশের ঘরে আছে বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড।
‘না, ডানের পায়া,’ বলল লিয়া। ‘এবার কোনও ভুল করিনি।’
‘তোমাকে তো খুব শিওর মনে হচ্ছে না।’
‘না, আমি নিশ্চিত।’
এক কোণে অনেকটা ওপরে ব্র্যাকেটে বসে ওদের দিকে চেয়ে আছে সিকিউরিটি ক্যামেরার কালো চোখ। পিয়ানো থেকে সরে ঘরের দেয়ালের কাছে গিয়ে ক্যামেরার ব্লাইও স্পটে থামল রানা। মুখ তুলে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত পর আবার ফিরল পিয়ানোর কাছে। মৃদু হেসে বলল, ‘ক্যামেরা কাজ করে না। ওটার বয়স মনে হচ্ছে এই পিয়ানোর সমান। পেছনের তারগুলোর বেশিরভাগ ছুটিয়ে রাখা।’
‘ইতালিয়ানরা এসব ব্যাপারে খুব বেখেয়াল, বলল লিয়া।
‘তাতে আমার অসুবিধে নেই,’ পিয়ানোর কাছে বসল রানা। মনোযোগ দিয়ে দেখল ডান পায়াটা। যত্নের সঙ্গে মেরামত করা হয়েছে পিয়ানো। এতই নিখুঁত হাতের কাজ, বোঝার উপায় নেই ওটার বয়স প্রায় দুই শ’ বছর। তবে ভার্নিশ দেয়া ডান পায়ার ওপরে খুব সরু ফাটল। নখ দিয়ে সেখানে আঁচড় কাটল রানা। খসে পড়ল খানিকটা ভার্নিশ পায়ার ওপর সরু চেরা দাগ। ওখানে বোধহয় করাত চালিয়েছে কেউ। কিন্তু প্রায় চোখেই পড়ছে না চিহ্নটা। যে শেষবার মেরামত করেছে পিয়ানো, বোধহয় সরিয়ে নিয়েছে ফাঁপা পায়া। বদলে বসিয়ে দিয়েছে নিরেট একটা। তখন কাজ শেষে রঙ লেপে তার ওপর প্রলেপ দিয়েছে ভার্নিশের।
এটা আসল ফাঁপা পায়া কি না, সেটা বোঝার মাত্র একটাই উপায় আছে।