1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ২৪

চব্বিশ

বিকেল পাঁচটা।

বোর্দোর ফ্রান্সারলিয়ার

গমগম করছে বোর্দো ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স অ্যাণ্ড ইকোনমিক্স অডিটোরিয়াম। জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়া হয়েছে প্রতিটি প্রবেশপথ। সিট শেষ, চলাচলের পথেও গিজগিজ করছে শত শত মানুষ। আগে কখনও এত মানুষ হয়নি বিশাল এই অডিটোরিয়ামে। যারা এটার আয়োজন করেছেন, ভাবতেও পারেননি উঠতি এক রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা শোনার জন্যে আগ্রহী হবে এত লোক।

বাইরে ঝরছে তুষার। তারই ভেতর সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছে শতখানেক পুলিশ ও কয়েকটি সিকিউরিটি টিম। এইমাত্র এডি অ্যামনের মোটরকেড ভেতরে যাওয়ার জন্যে পথ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ব্যারিকেড। প্রিয় নেতার আগমনে ব্যানার হাতে চিৎকার করছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের একপাশে প্রতিবাদ করতে জড়ো হয়েছে স্বস্তিকা হাতে ন্যাড়ামাথা নিয়ো ফ্যাসিস্টদের একটা দল। তারা যেন ঝামেলা করতে না পারে, সেজন্যে তাদেরকে ঘিরে রেখেছে পুলিশবাহিনী। ফ্যাসিস্টদের একজন এডি

এডি অ্যামনের কুশপুত্তলিকায় আগুন দিতে যাওয়ায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একদল পুলিশ। লোকটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল নিজেদের ভ্যানের দিকে। হৈ-চৈ ও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে বলে ওদিকে ছুটল মিডিয়ার লোকজন। বারবার ঝলসে উঠছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। আজ টিভি সংবাদে এবং আগামীকাল সকালে দৈনিক পত্রিকায় দেখা যাবে, পুলিশের ভ্যানে তোলা হচ্ছে রক্তাক্ত এক লোককে। গোলমাল করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে অন্তত বারোজন তরুণ ও যুবক।

রায়ট শিল্ড ও ব্যাটন হাতে পুলিশ অফিসাররা তৈরি। সঙ্গে আছে টিয়ার গ্যাস গান। টিভি ক্রু ও দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকরা মনেপ্রাণে চাইছে রক্তারক্তি হোক। সেক্ষেত্রে জমবে তাদের রিপোর্ট।

ভারী লাল পর্দার ওদিক থেকে মঞ্চে এসে ক্যামেরার দিকে চেয়ে হাসিমুখে দাঁড়ালেন ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলার রবার্তো ফ্রান্সিসকো। পডিয়ামের পেছনে বিশাল স্ক্রিনে এডি অ্যামনের পার্টির পঞ্চাশ ফুট উঁচু স্লোগান লেখা ব্যানার। তাতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, কী কারণে রাজনীতিতে এসেছেন এডি অ্যামন। তিনি চান নতুন ইউরোপ, যেখানে থাকবে সবুজ প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা, ভাল কিছু করার আশা ও প্রতিজ্ঞা। স্ক্রিনে প্রতিটি ইউরোপিয়ান দেশের একত্রিত পতাকা। লোকারণ্যে ভরে গেছে সব উইং। অডিটোরিয়ামের ওপরতলায় কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সব দিকে চোখ রেখেছে একদল সশস্ত্র সিকিউরিটি পারসোনেল।

পডিয়ামে পৌঁছে গেলেন চ্যান্সেলার রবার্তো ফ্রান্সিসকো। দু’হাত ওপরে তুলতেই নীরব হলো বিশাল অডিটোরিয়াম। লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন,’ বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় বললেন তিনি, ‘ভাল করেই জানি, আজ যিনি বক্তৃতা দেবেন, তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। আগে কখনও কোন রাজনৈতিক নেতা এত কম সময়ে সাধারণ মানুষের এত ভক্তি ও ভালবাসা অর্জন করতে পারেননি। এমনি এমনি তাঁকে বলা হয় না ব্রাসেলসের জেএফকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়নে সত্যিকারের এক দক্ষ স্থপতি তিনি। নিজেই ব্যক্তিগতভাবে গরিবের জন্যে দান করেছেন শত কোটি ইউরো। অবিশ্রান্ত লড়ছেন ইউরোপের দেশগুলোর শিক্ষার মান বাড়াবার জন্যে। বয়স মাত্র চল্লিশ, অথচ মানুষের মন এতই দ্রুত জয় করে নিয়েছেন, হয়তো কিছু দিনের ভেতর তিনি হবেন ইউরোপিয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই মহাদেশের জন্যে তাঁর তৈরি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে কোনও দেশে থাকবে না নিউক্লিয়ার এনার্জি প্ল্যান্ট। ইউরোপের পরিচিত রাজনৈতিক আঙিনায় নিজ দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। লেডিস অ্যাও জেন্টলমেন, এবার আপনাদের সামনে হাজির হচ্ছেন সেই স্বনামধন্য এডি অ্যামন।

পডিয়াম থেকে পিছিয়ে ব্রাসেলসের রাজনীতিকের দিকে হাতের ইশারা করলেন চ্যান্সেলার। মঞ্চে উঠলেন এডি অ্যামন। ঝলসে উঠল শত শত ক্যামেরা।

বিশাল অডিটোরিয়ামের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পাঁচ শত মানুষ। রাজনৈতিক নেতার পরনে চমৎকার মানানসই নীল সুট। গলায় টাই পরেননি তিনি। পডিয়ামে দাঁড়াবার আগে জনগণের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। আনন্দধ্বনি থেমে যাওয়ার পর শুরু করলেন বক্তৃতা।

‘লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, নিজেদের কাজ ফেলে আজ আপনারা আমার কথা শুনতে এসেছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ অ্যামনের পেছনের স্ক্রিন থেকে বিদায় নিল বিশাল স্লোগান। বদলে ফুটল নতুন ইমেজ। নিজেদের ভেতর বিড়বিড় করে আলাপ করছে শ্রোতারা। অতি ডানপন্থী প্রতিবাদকারীদের দেখা যাচ্ছে বাইরে। মাথা ন্যাড়া, হাতে স্বস্তিকা। মুখগুলোয় ভয়ানক হিংস্রতা।

হাসলেন এডি অ্যামন। ‘প্রতিবাদ করছে বলে ধন্যবাদ দেব আমাদের নিয়ো-নাযি বন্ধুদেরকেও।’ কথাগুলো বুঝতে দেয়ার জন্যে ক’মুহূর্ত চুপ থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আজ ওরা এসেছে বলে আপনাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়া সহজ হবে আমার জন্যে। …লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, বলা হয় একত্রিত হয়েছে ইউরোপ।’ তিনি থেমে যাওয়ায় হাসতে লাগল শত শত মানুষ। কিন্তু এডি অ্যামনের মুখ থেকে বিদায় নিয়েছে হাসি। দর্শকদের ওপর থেকে ঘুরিয়ে আনলেন দৃষ্টি। ‘অথচ বাস্তবে ইউরোপে আমরা এসব কী দেখছি? জাতীয়তাবাদ ও লোভের সাগরে ডুবে গেছে প্রতিটি দেশ। তবে এখনও সময় আছে নিজেদের সামলে নেয়ার। আমরা চাইলে সবাই মিলে গড়তে পারব একত্রিত ইউরোপ, যেখানে থাকবে না কোনও হিংসা, নীচতা ও নোংরামি। এমন এক ইউরোপ, যেখানে সত্যিকার স্বাধীনতা ভোগ করবে সাধারণ মানুষ।’

নেতার কথা শুনে গলা ফাটিয়ে সমর্থন জানাল শত শত মানুষ।

এডি অ্যামনের পেছনের স্ক্রিন থেকে বিদায় নিল নিয়ো- ফ্যাসিস্টরা। নতুন করে ফুটে উঠল ব্যানার। সেখানে লেখা: প্রথমবারের মত একত্রিত হও ইউরোপ!

আগের চেয়ে বাড়ল মানুষের উল্লাস।

মঞ্চের পেছনে রিসেপশন রুমে মনিটর দেখছেন ডায়ানা অ্যামন, হাতে কফি ভরা স্টায়রোফোমের কাপ। স্বামীর নিখুঁত আচরণ ও শ্রোতা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা দেখে মৃদু হাসছেন তিনি। চারপাশে অ্যামনের দলের লোকজন ও সিকিউরিটি পারসোনেলরা ব্যস্ত। ঘরের আরেক মাথায় সবকিছুর ওপর নজর রেখেছেন জিআইজিএন কাউন্টার টেরোরিস্ট পুলিশ রেসপন্স ইউনিটের প্রাক্তন কমাণ্ডার আঁদ্রে অ্যালার্ড। নিরাপত্তা নিখুঁত করতে তাঁকেই স্বামীর ব্যক্তিগত সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধান করেছেন ডায়ানা। সরকারী এজেন্টদের ওপর ভরসা নেই তাঁর। নিজের কাজ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন অ্যালার্ড। উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে তাঁর ন্যাড়ামাথা। দু’হাত বুকে ভাঁজ করে ভুরু কুঁচকে নানাদিকের সারি সারি স্ক্রিনের দিকে নজর রেখেছেন তিনি।

প্রতিটি সমাবেশে স্বামীর পেছনে সমস্ত সমর্থন নিয়ে হাজির থাকেন ডায়ানা অ্যামন। সত্যিকারের ভাল মানুষ তাঁর স্বামী। তবে মনে মনে ডায়ানা চান, এত ঝুঁকি না নিয়ে আর্কিটেকচার নিয়ে আগের মত ব্যস্ত থাকুন স্বামী। মাঝে মাঝে নিজেকে পাগল মনে হয় ডায়ানার। দিনের পর দিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটতে হচ্ছে তাঁদেরকে। প্রতিদিন একের পর এক প্রেস ইন্টারভিউ। এমন কী এডিও ভাবেননি, মাত্র ক’বছরের ভেতর এত আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পাবেন। এজন্যে তৈরিও ছিলেন না। ডায়ানা জানেন, জনপ্রিয়তার সঙ্গে বেড়ে গেছে হামলার সম্ভাবনা। সাধারণ মানুষের জন্যে এই ধরনের সভায় দুনিয়ার সেরা সিকিউরিটি পারসোনেলরাও দিতে পারবে শতভাগ নিরাপত্তা। প্রতিটা অডিটোরিয়ামে অসংখ্য মানুষকে তল্লাসী করে ঢুকতে দেয়া অসম্ভব। শ্রোতাদের ভেতর মাত্র একজন ফ্যাসিস্ট ফ্যানাটিক অস্ত্র সহ ঢুকে পড়লেই সর্বনাশ!

এ কথা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলেন ডায়ানা অ্যামন। তিনি জানেন, গত জানুয়ারিতে কটিনায় যা ঘটল, তা কোনও দুর্ঘটনা ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *