1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪৯

ঊনপঞ্চাশ

ব্রাসেলসের পাহাড়ি এলাকা আর্ডেনেস-এ বাস করে অভিজাত সব নামকরা পরিবার। আর ওখানেই বিশাল জমি নিয়ে রাজনীতিক এডি অ্যামনের কাঁচ ও স্টিলের তৈরি অত্যাধুনিক রাজকীয় বাড়ি।

ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। বাড়ির ভেতর জ্বেলে দেয়া হয়েছে আলো। একটু আগে বাড়ি ফিরেছেন এডি অ্যামন। এখন তাঁর সঙ্গে থাকতে হবে না বলে রিসেপশন এরিয়ায় নিজেদের আর্মচেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে রাজনীতিকের দুই বডিগার্ড। কাজ নেই, তাই ঘেঁটে দেখছে দ্য ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ও অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাযিন। বাড়ির ভেতরে হিটিং সিস্টেমের কল্যাণে চমৎকার উষ্ণতা। মনে মনে দুই বডিগার্ড খুশি, বাইরে তুষারপাতের ভেতর পায়চারি করতে হচ্ছে না। তবে কষ্টের যেমন শেষ আছে, তেমনি আরামেরও শেষ আছে। দু’ঘণ্টা পর কোট পরে তাদেরকে বেরোতে হবে আরও দু’জনের সঙ্গে কম্পাউণ্ড চক্কোর দিতে। তখন ওদের বদলে আগুন পোহাবে বাইরে কাঁপতে থাকা চার বডিগার্ড।

সারাদিনের কাজ শেষে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে গেছেন এডি অ্যামন। অথচ, বিশ্রামের উপায় নেই! তৈরি করতে হবে আগামী ক’দিনের জন্যে পাঁচটা বক্তৃতার খসড়া। এ ছাড়া, সই করতে হবে একগাদা ফাইলে। আজ অন্তত পঞ্চাশটা চিঠি বাছাই করেছে তাঁর পিএ। ওগুলোর হলদে হাই-লাইট করা অংশ পড়ে মন্তব্য জানাতে হবে। বাড়ি ফিরে বডিগার্ডদেরকে আজকের মত শুভরাত্রি জানিয়ে দিয়েছেন অ্যামন। প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে এসেছেন দোতলায় নিজের ব্যক্তিগত কোয়ার্টারে। অর্গানিক কোকোর গরম কাপে এক চিমটি সিনামন ফেলে চামচ দিয়ে নেড়ে নিয়ে ডেস্কে রেখেছেন ধোঁয়া-ওঠা কালো কোকো।

অ্যামন ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতেই ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি সিস্টেমের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আটকে গেছে সমস্ত রিইনফোর্সড দরজা। জুতো খুলে নরম স্যাণ্ডেল পরে গরম কাপ হাতে প্রাইভেট সিটিং রুমে ঢুকেছেন রাজনীতিক বাইরে ভয়ঙ্কর বিপদ থাকলেও নিজের তৈরি এই প্রশান্তিময় ঘরে তাঁর মনে হয়, তিনি এখানে নিরাপদ। ভুলে যান বাইরে পাহারা দিচ্ছে একদল সিকিউরিটি গার্ড। আসলে তাঁর স্ত্রী এই বাড়তি সতর্কতার ব্যবস্থাটা না নিলেই বেশি স্বচ্ছন্দে থাকতেন তিনি। অবশ্য এ-ও ঠিক, বোমা-বিস্ফোরণে ওই শ্যালে উড়ে যাওয়ার পর সতর্ক না হয়ে উপায়ও ছিল না। সর্বক্ষণ কেউ না কেউ ঘাড়ের কাছে আছে ভাবতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। ওই একই অনুভূতি ডায়ানারও। বেচারির কপাল ভাল, ক’দিনের জন্যে আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে যেতে পেরেছে নিউ ইয়র্কে।

সিটিং রুমে চেয়ারে বসে কোকোর কাপে চুমুক দিলেন অ্যামন। বড্ড ক্লান্ত। তবে কেন জানি অস্থির লাগছে মন। একবার ভাবলেন পাশের স্টাডিরুমে গিয়ে কমপিউটার চালু করবেন কি না। আনমনে উড়িয়ে দিলেন ভাবনাটা। ল্যাপটপ চালু হলে ডায়ানার সঙ্গে দু’চারটা কথার পর আবারও বসবেন আগামী সপ্তাহের বক্তৃতা তৈরির কাজে। অথচ, এখনই ওগুলো লাগছে না। থাক না, আগামীকাল নতুন উদ্যমে নামবেন কাজে। জড়িয়ে যাবেন তাঁর রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে।

প্যাটিয়োর দরজা দিয়ে বাইরে তাকালেন। চাঁদের রুপালি আলো ভাসিয়ে দিয়েছে ছাতে তৈরি সুন্দর বাগানটা। এডি অ্যামনের ধারণা, বাড়ির সেরা জায়গা ওটা। চারপাশে উঁচু পাথরের পিলারের মাঝে হরেক ফুলের গাছ ও ঝোপঝাড়। ওখানে দাঁড়ালে নাকে লাগে কাঁচা মাটি ও ফুলের সুবাস। বাগানের মাঝে গম্বুজের মত কাঁচের ছাতির নিচে ছোট এক ফোয়ারা। চারপাশে চেয়ার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায় এখানে বসে।

নক্ষত্রজ্বলা সুন্দর রাতে ঝিরঝিরে হাওয়ায় ভেসে আসছে বেশ কয়েকটা ফুলের মিষ্টি সুবাস। ছাত-বাগানে একটু হাঁটবেন বলে তিন মিনিটে কাপের কোকো শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন এডি অ্যামন। কিন্তু তখনই চোখ পড়ল, ছাতে দাঁড়ানো একটা কালো ছায়ার উপর।

ওটা কোনও লোক!

হাতে লম্বা কী যেন!

বোধহয় পিস্তল! সাইলেন্সার লাগানো।

টেবিলে রাখা ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়ালেন এডি অ্যামন। কিন্তু তার আগেই ঘরে ঢুকল লোকটা। তাঁর বুকে পিস্তল তাক করে নিচু গলায় বলল, ‘ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়াবেন না। কোনও আওয়াজ নয়, নইলে বাধ্য হব গুলি, করতে।’

পাথরের মূর্তি হলেন অ্যামন। কালো পোশাক পরা লোকটার হাতে বড় একটা পিস্তল। মুখে কালো স্কি মাস্ক। চোখদুটো খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হলো রাজনীতিকের।

‘কে তুমি?’ বেসুরো কণ্ঠে বললেন তিনি। ধক ধক করছে হৃৎপিণ্ড। মন বলছে: এ লোক তোমাকে খুন করতে এসেছে!

কিন্তু পরক্ষণে ভাবলেন, আমি তো আর বাধা দিতে পারছি না, তা হলে খুন করছে না কেন?

অবাক চোখে দেখলেন কোমরের হোলস্টারে পিস্তল রাখল দীর্ঘদেহী লোকটা। মুখ থেকে খুলে ফেলল স্কি মাস্ক। তাতে ভয় বাড়ল এডি অ্যামনের। মুখ দেখতে দিয়েছে, তার মানে তাঁর বাঁচার উপায় নেই।

‘আপনি আর্মচেয়ারে বসুন, প্লিয,’ নরম সুরে বলল যুবক। ‘আপনার সঙ্গে জরুরি কয়েকটা কথা আছে আমার।’

কয়েক মুহূর্ত বিদেশি যুবকের দিকে চেয়ে রইলেন অ্যামন, তারপর নিঃশব্দে বসলেন কাছের আর্মচেয়ারে।

পালিশ করা পাইন টেবিলের অপরপাশে নিজেও একটা আর্মচেয়ারে বসল যুবক। পেরিয়ে গেল পুরো একমিনিট তারপর সহজ সুরে বলল সে, ‘আপনার সাহায্য চাইছে একজন।’

বিস্মিত হলেন এডি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনি আমার বাড়িতে ডাকাতের মত ঢুকেছেন। পিস্তল তাক করেছেন আমার দিকে। তারপর এখন বলছেন একজন সাহায্য চাইছে আমার কাছে। একটু খুলে বলুন, শুনি।’

‘সত্যিই তার সাহায্য দরকার,’ বলল রানা।

‘কেউ সাহায্য চাইলে আমার অফিসে যোগাযোগ করে,’ বললেন অ্যামন।

মৃদু হাসল রানা। চট্ করে বুঝে গেছে, এই লোক আদতে দুঃসাহসী। ‘আমার পুরো কথা শেষ হলে আপনি বুঝবেন, কেন স্বাভাবিক কোনও উপায়ে আপনার সঙ্গে দেখা করিনি।’

ভুরু কোঁচকালেন অ্যামন। ‘তবে আপনার সঙ্গে খোশগল্প করার ইচ্ছে আমার না-ও হতে পারে।’

‘এ ছাড়া উপায়ও তো নেই আপনার,’ বলল রানা।

‘গুলি করলে নিজেও পার পাবেন না। বাড়ির এই সুইটে অনেকগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা আছে। আপনার প্রতিটা পদক্ষেপ রেকর্ড হচ্ছে।’

‘না হয় মিথ্যা না-ই বা বললেন,’ বলল রানা, ‘আপনি নিজের ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে ক্যামেরা লাগাবেন, তা আমার মনে হয়নি।’

‘সিকিউরিটি গার্ডদের এড়িয়ে এখানে এলেন কী করে?’

‘পরে কখনও বলব,’ বলল রানা। ‘আমি এখানে এসেছি জরুরি একটা কাজে। আপনি শুধু মন দিয়ে আমার কথা শুনে যান। যদি আমাকে সাহায্য করেন, বদলে আমিও আপনার উপকার করব। আর, হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি, নাম মাসুদ রানা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে কাজ করি। আপনি সহযোগিতা করলে সত্যিই আপনার উপকার হবে।’

যুবকের সাহস দেখে হাসলেন এডি অ্যামন। ‘আপনি উপকার করবেন আমার? কীভাবে?’

‘জানিয়ে দেব কারা খুন করেছে স্টিভ কাসলারকে।’

মাঝপথে হোঁচট খেল রাজনীতিকের হাসি। মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। ‘স্টিভ?’

মাথা দোলাল রানা। ‘আপনার গুরু। আপনার বন্ধু।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অ্যামন। তারপর দ্বিধা নিয়ে বললেন, ‘স্টিভ খুন হয়নি। ওটা ছিল একটা গাড়ি-দুর্ঘটনা।’

‘রাজনীতিকরা সাধারণত ভাল মিথ্যুক হন। কিন্তু আপনি তাদের কাতারে ঠাঁই পাবেন না।’

‘আমি তদন্ত করিয়েছি,’ বললেন অ্যামন। ‘সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায়নি। ওটা আসলেই দুর্ঘটনা ছিল।’

‘আপনার চোখ-মুখ বলছে, নিজেই নিজের কথা বিশ্বাস করেন না,’ বলল রানা। ‘শ্যালে উড়ে যাওয়ার ঘটনাটাও ভাল করেই জানি। ওটাও কি তা হলে কোন দুর্ঘটনা ছিল?’

‘আপনি এসব জানলেন কী করে?’

‘জানার জন্যে অনেকক্ষণ ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়েছে।’

দুশ্চিন্তায় ঘামছেন অ্যামন। ঢোক গিলে বললেন, ‘কী বলতে চান, খুলে বলুন, প্লিয।’ তাঁর মনে হচ্ছে, এ যুবক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। এখনই উচিত ছুটে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এই লোক গোপন এসব তথ্য জানল কী করে!

‘ভুলেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড় দেবেন না,’ বলল রানা। ‘দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ধরা পড়বেন।’

আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্মচেয়ারে হেলান দিলেন এডি অ্যামন।

কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিল রানা, তারপর বলতে লাগল, ‘বেশ দীর্ঘ কাহিনী। একদম প্রথম থেকে বলছি।’

বুকে দু’হাত ভাঁজ করে রানার দিকে চেয়ে আছেন অ্যামন। চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস।

‘গতবছর আমার এক বন্ধু দেখে ফেলে অস্বাভাবিক এক মৃত্যু,’ বলল রানা। ‘ওখানে ওর থাকার কথা ছিল না। তাই ওকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে ওর সংগ্রহ করা প্রমাণ ও পাঠিয়ে দেয় ওর ছোটবোনের কাছে। হয়তো ওই মেয়ের নাম শুনে থাকবেন। এমিলিয়া বেকার। অপেরায় গান গাইত।’

মাথা দোলালেন রাজনীতিক। ‘হ্যাঁ, শুনেছি তার গান। খুবই ভাল গায়।’

এবার এক এক করে সবই খুলে বলল রানা। অনেকক্ষণ লাগল গুছিয়ে বলতে। সতর্ক চোখে ওর দিকে চেয়ে শুনলেন এডি অ্যামন। তারপর রানা থেমে যাওয়ায় নিচু গলায় জানতে চাইলেন, ‘এরা খুন করেছে ওই মেয়েকে?’

দীর্ঘশ্বাস চেপে মাথা দোলাল রানা।

কোথাও তো এমন কোনও খবর পাইনি!’

‘জানবেন পরে,’ বলল রানা। ‘হয় দেখানো হবে দুর্ঘটনায় মারা গেছে, নইলে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে।

চুপ করে কী যেন ভাবছেন রাজনীতিক। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আপনার কথা সত্যি হলে এসব তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কিন্তু যা বুঝলাম, আপনার হাতে কোনও প্রমাণ নেই। আমাকে খুলেও বলেননি স্টিভ কাসলারের মৃত্যুর…’

‘আমি এখুনি ওই বিষয়ে যাচ্ছিলাম। আমার বন্ধু অ্যালেক বেকার দেখে ফেলেছিল আপনার বন্ধু কাসলারের হত্যাকাণ্ড।’

‘আপনি বলেছেন প্রমাণ আছে।’

মাথা দোলাল রানা। ‘ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিয়ো রেকর্ডও করেছিল অ্যালেক। ওটা ছিল একটা সিডি-রমে।’

‘ওটা এখন কোথায়?’

‘ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে,’ বলল রানা।

‘তার মানে কোনও প্রমাণ নেই? আমিও তা-ই ভেবেছি।’

স্টাডিরুমের দিকে চাইল রানা। ‘আপনার কমপিউটারটা একবার ব্যবহার করতে পারি?’

‘কী কারণে ওটা দরকার?’

‘চলুন, ঘুরে আসি স্টাডিরুম থেকে,’ উঠে দরজার কাছে চলে গেল রানা।

ওকে অনুসরণ করলেন অ্যামন। পাশের ঘরে ঢুকে ডেস্কের ওপর ল্যাপটপ দেখালেন। ‘কী করবেন?’

‘আমার ই-মেইল চেক করব, বলল রানা। ‘সেই সঙ্গে আপনার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ সব দূর করে দেব।’

‘আপনার আচরণ পাগলাটে লাগছে।’

কথাটা পাত্তা দিল না রানা। ওর ওয়েব মেইল-এর ইন- বক্সে মাত্র একটা মেইল পাওয়া গেল। ওটা ফিওনা যার্নের সাইবার ক্যাফে থেকে নিজেকেই নিজে পাঠিয়েছে রানা। বুঝে গিয়েছিল যখন তখন বিপদ হবে। এবার ওই মেইলটা হয়তো কাজে লাগবে। মেইলের সঙ্গে রয়েছে অ্যাটাচ করা ভিডিয়ো। বেশ ভারী ওটা। সঠিক জায়গায় ক্লিক দিতেই কাজ করল আধুনিক, শক্তিশালী ল্যাপটপ। মাত্র মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে ডাউনলোড করল ভিডিয়ো।

‘ওটা কী?’ জানতে চাইলেন এডি অ্যামান।

‘মন দিয়ে দেখুন।’

চেয়ারে বসলেন অ্যামন। তাঁর দিকে চশমা এগিয়ে দিল রানা। ঘুরে এল সিটিং রুম থেকে। ড্রিঙ্ক ক্যাবিনেট থেকে এনেছে ব্র্যাণ্ডির বোতল ও গ্লাস। ভদ্রলোকের হাতের পাশে রাখল গ্লাস ভরা ব্র্যাণ্ডি। ‘আমার ধারণা, ড্রিঙ্কটা আপনার কাজে লাগবে।’

ভিডিয়ো ক্লিপ ফুরাবার আগেই শেষ হলো রাজনীতিকের ব্র্যাণ্ডি। একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছেন তিনি। সব দেখার পর বিড়বিড় করলেন, ‘খুব অসুস্থ লাগছে!’ চেয়ার ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে হড়হড় করে বমি করলেন বেসিনে

কয়েক মিনিট পর ফিরলেন ডেস্কের সামনে। দরদর করে ঘামছেন। থরথর করে কাঁপছে দু’হাতের আঙুলগুলো। বিড়বিড় করলেন, ‘ওরা তাঁকে খুন করেছে! তারপর সাজিয়ে নিয়েছে গাড়ি-দুর্ঘটনা।’ কাঁপছে তাঁর গলা।

‘আজ সকালে জেনেছি স্টিভ কাসলার কে ছিলেন,’ বলল রানা। ‘আমি ইউরোপের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে মনে হলো, যাকে কিডন্যাপ করব, তাঁর বিষয়ে রিসার্চ করা উচিত।’

‘আপনি তা হলে মানুষকে কিডন্যাপ করেন?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘তা নয়। তবে যারা কিডন্যাপ করে, সুযোগ পেলে তাদের কাছ থেকে জিম্মিকে ছুটিয়ে নেয়াকে কর্তব্য বলে মনে করি। আপনি ছিলেন সহজ টার্গেট। মিডিয়ার কারণে আপনার সম্পর্কে জানতে কোনও কষ্ট হয়নি। এজন্যে আমাকে ঢের তথ্য দিয়েছে ভিয়েনার ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি। আপনার ওপর যা লিখেছে, তাতে বিশটা বই লেখা যাবে। পারিবারিক ছবিও দেখেছি। ওখানে ছিলেন স্টিভ কাসলার। তখনই প্রথম চিনলাম তাঁকে: ভিডিয়োর সেই মানুষ। কয়েকটা ছবিতে ক্যাপশনও ছিল। জেনে গেলাম উনি আসলে কে।’

‘ওই ছবি তোলা হয়েছিল স্টিভের বাড়িতে, জেনেভায়, ‘ শুকনো গলায় বললেন অ্যামন।

‘আরেকটা ছবিতে দেখলাম, তাঁর শেষকৃত্যে আপনি গেছেন,’ বলল রানা, ‘ক্যাপশনে লেখা: ‘ইউরোপলিটিশিয়ান শেষ শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর প্রিয় বন্ধু এবং শ্রদ্ধেয় গুরুকে।’

‘আমার বাবার মত ছিলেন,’ বললেন অ্যামন। ধপ করে বসলেন চেয়ারে। ‘শ্যালেতে বিস্ফোরণ হওয়ার আগে ফোনে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।’

‘কটিনায়?’

মাথা দোলালেন রাজনীতিক। বুঝতে পারিনি, কেন এত তাড়া দিচ্ছেন। তবে পরে বুঝেছি, তাঁর কথামত তখুনি ওই শ্যালে থেকে বেরিয়ে না গেলে বাঁচতাম না আমরা কেউ।’

রানার মনে পড়ল লুকা ব্রুনারের একটা কথা: ‘নিজের জিভ যে সামলে রাখতে পারে না, তার পরিণতি এমনই হয়।’

‘উনি আমার সেরা বন্ধু,’ নিচু গলায় বললেন অ্যামন, ‘আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন বলে শাস্তি হিসেবে খুন করা হয়েছে তাঁকে।’

‘ওই একই দিনে খুন হয়েছে আমার বন্ধু,’ বলল রানা। ‘কারণ, সবই দেখে ফেলেছিল সে। ছবি তুলেছিল।’

মুখ তুলে তাকালেন এডি অ্যামন। ‘আর এরপর খুন করেছে আপনার বন্ধুর বোনকে।’ রানার গম্ভীর চেহারা খেয়াল করে জানতে চাইলেন তিনি, ‘আপনি ভালবাসতেন ওই মেয়েটাকে?’

জবাব দিল না রানা।

‘আপনার জানা আছে, কে করেছে এসব?’

ওপর-নিচ মাথা দোলাল রানা। ‘জানি তারা কারা, আর কোথা থেকে উঠে এসেছে।’

‘মাত্র একটা কল করলেই এদেরকে গ্রেফতার করবে পুলিশ।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘প্রমাণ নেই।’ কমপিউটার দেখাল। ‘ভিডিয়োতে কারও চেহারা পরিষ্কার নয়। আমি চাই এক জায়গায় এদেরকে জড় করতে। তারপর আবারও কাউকে খুন করার আগেই তাদেরকে ধরতে। ওটাই একমাত্র উপায়।’

‘সেটা করবেন কীভাবে?’

‘সেজন্যেই আপনার সাহায্য চাইছি,’ বলল রানা। ‘আপনি আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলে তবেই আমি সফল হব।’

চিন্তায় পড়লেন এডি অ্যামন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে রানার চোখে তাকালেন। ‘জানি না পাগলামি করছি কি না। তবে আমি এখন আপনাকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করি। বলুন, আমাকে কী করতে হবে?’

‘আমরা হাতে বেশি সময় পাব না,’ বলল রানা। ‘লং ডিসট্যান্স কল দিতে হবে কয়েক জায়গায়।’

‘তাতে কোনও সমস্যা নেই।’

‘তারপর রওনা হব। অন্যসব কাজ আপাতত ফেলে রাখতে হবে আপনার। তা পারবেন?’

‘পারা তো উচিত,’ বললেন অ্যামন। ‘আমাকে কোথায় যেতে হবে?’

‘ভিয়েনায়। তার আগে প্রাইভেট জেট বিমান ভাড়া করতে হবে।’

‘লাগবে না,’ বললেন রাজনীতিক। ‘আমারই আছে।’

‘কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ,’ বলল রানা, ‘আপনার প্রাণসংশয় হতে পারে।’

‘স্টিভ কাসলার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন,’ দ্বিধাহীনভাবে বললেন অ্যামন। ‘আর স্রষ্টার এই দুনিয়ায় শতভাগ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। ধরে নিন, আমি আপনার সঙ্গে আছি।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা, ‘সেক্ষেত্রে আমরা সেরে নেব দরকারি সব কাজ।’

‘কী করবেন ভাবছেন?’ জানতে চাইলেন অ্যামন।

মৃদু হাসল রানা।

‘প্রথমে আপনাকে কিডন্যাপ করব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *