আঠারো
আড়াই ঘণ্টা পর ওরা পৌঁছুল সাউথ্যাম্পটনে। একটু দ্বিধা বোধ করছে মাসুদ রানা। নিজের পরিচিত কোন বন্ধুর সাহায্য নিতে পারলে খুশি হতো। কিন্তু ওর ধারণা এত কম সময়ে তৈরি হতে পারবে না ওরা কেউ, খামোকা বিব্রত করা হবে।
পুবাকাশে জ্বলজ্বল করছে কালপুরুষের নক্ষত্রগুলো। মেরিনার পানিতে ঝিকিয়ে উঠছে রুপালি জ্যোৎস্না। দীর্ঘ জেটির দু’পাশে মৃদুমন্দ ঢেউয়ে দুলছে দুই সারিতে রাখা সাদা ইয়টগুলো।
.
ষাট ফুটি ইয়ট আইল্যাণ্ডারের ডেকে গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছে ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। মন দিয়ে শুনছে ইয়টের খোলে কলকল আওয়াজে চাপড় দিচ্ছে সাগরের ঢেউ। একটু আগে দূরে কোথাও ধুপ্ করে বন্ধ হয়েছে গাড়ির দরজা। মিনিটখানেক পর জেটিতে গর্ডন চিনতে পারল পরিচিত মেয়েটির অবয়ব।
বহুদিন পর লিয়ার দেখা পাবে ভাবতে গিয়ে আনমনে হাসল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। হয়তো ঘনিষ্ঠভাবেই পাবে!
কিন্তু লিয়ার পাশে হাঁটছে সুঠামদেহী এক লোক।
এ আবার কে?
ইয়টের কাছে লিয়া পৌছুতেই শক্ত হলো গর্ডনের চোয়াল। ভাবছে, সুপুরুষ লোকটাকে বিয়ে করে ফেলেনি তো মেয়েটা? আগে কখনও একে দেখেনি ফ্র্যাঙ্ক। লোকটা সুঠামদেহী দেখতে দারুণ, পরনে জিন্সের প্যান্ট ও চামড়ার জ্যাকেট। দৈর্ঘ্যে তার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি উঁচু। বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের ভেতর। নিজের দৈহিক হাল মনে পড়তেই শ্বাস ছেড়ে ভুঁড়িটা পিঠের দিকে টানল গর্ডন। ক’সপ্তাহ স্কোয়াশ খেলেনি বলে এখন বড্ড আনফিট লাগছে তার নিজেকে।
কিন্তু বড় কথা হচ্ছে: লোকটা আসলে কে?
একে সঙ্গে আনবে, আগে থেকে বলেনি লিয়া!
‘ব্যাপারটা ভাল লাগছে না,’ নোঙর করা ইয়টের কাছে পৌঁছে বলল রানা। মেরিনার আলোয় দেখছে ভারী গড়নের এক লোক ইয়টের ডেকে। পরনে সাদা, পুরু উল-মেশানো ফ্লিসের সোয়েটার ও ঢলঢলে ঢিলে প্যান্ট। মাথায় বেইসবল ক্যাপ। ওর দিকেই কঠোর চোখে চেয়ে আছে সে। ‘তোমার বন্ধুরও ভাল লাগছে না আমাকে দেখে।’
‘রানা, মানুষ খারাপ নয় গর্ডন। সহজে নিচু রেইলিং টপকে ডেকে উঠল লিয়া। মুখে মিষ্টি হাসি। একটু টলমল করছে বলে দু’হাতে ওকে ধরল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। ‘এত কম সময়ে তৈরি হয়ে গেছ বলে অনেক ধন্যবাদ।’
রানা আর গর্ডনের পরিচয় করিয়ে দিল লিয়া।
বাদামি যুবকের উদ্দেশে মৃদু নড করল ইয়টের মালিক।
জবাবে একই আচরণ পেল রানার তরফ থেকে। শীতল স্বরে বলল গর্ডন, ‘তুমি বলোনি সঙ্গে অতিথি আনবে!’
তার কাঁধে হাত রেখে ডানগালে ছোট্ট একটা চুমু দিল লিয়া। নরম সুরে বলল, ‘একটু ভদ্র আচরণ করো, গর্ডন। তুমি কি চাও আমরা নেমে যাই?’ পিছিয়ে এসে তাকাল গর্ডনের পুরনো স্কিপারের দিকে। দড়াদড়ি নিয়ে কাজ করছে বয়স্ক মানুষটা। ‘হাই, রাফায়েল!’
‘বহুদিন পর দেখা,’ হাসল ইয়টের ক্যাপ্টেন। ‘আবার এই ইয়টে পা রেখেছ বলে ভাল লাগছে।’
‘আশা করি বেশি বিরক্ত করিনি,’ বলল লিয়া।
মাস্তুল থেকে লাফিয়ে নেমে দু’হাত ডলতে ডলতে লিয়ার দিকে এল বৃদ্ধ। ছোটখাটো মানুষ সে। শরীরে তারের মত পেঁচানো পেশি। দাড়ি ধূসর রঙের। চকচক করছে কালো দুই চোখের মণি। ‘নো প্রবলেম, লিয়া। ডিসেম্বরের ঝড়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরোতেও কখনও কোনও সমস্যা হয়নি আমার।’
‘গুড,’ বলল লিয়া। ‘আর আমার সঙ্গে যাকে দেখছ, তার নাম মাসুদ রানা। অনেক পুরনো বন্ধু। একইসঙ্গে ফ্রান্সে যেতে চাই।
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল স্কিপার।
‘আমিও,’ হাতটা ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে ঝাঁকিয়ে দিল রানা। প্রশংসার চোখে দেখছে সাদা ইয়ট। ‘কতক্ষণ লাগবে ফ্রান্সের তীরে পৌঁছুতে?’
কাঁধ ঝাঁকাল রাফায়েল। ‘সেইন্ট-ভাস্ট-লা-হিউগ তো? .. কমবেশি নয় ঘণ্টা।’
‘তোমাদের সঙ্গে লাগেজ দেখছি না?’ বলল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। ‘শুধু একটা ক্রেডিট কার্ড,’ হাসল লিয়া। ‘সেইণ্ট-ভাস্ট- এ পৌঁছে শপিং করে নেব।’
‘যা ভাল বোঝো,’ বলল গর্ডন। পরক্ষণে জানতে চাইল, ‘তোমার হাঁটু ছিলে গেল কী করে?’
জিন্সের প্যান্টের ছেঁড়া জায়গাটা দেখল লিয়া। ‘পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘রক্ত বেরিয়েছে দেখছি।’
‘সামান্য একটু ছিলে গেছে। তেমন কিছু নয়।’
রানার দিকে চেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন, ‘ঠিক আছে, সুস্বাগতম আইল্যাণ্ডার ইয়টে। এবার দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাদের কেবিনদুটো।’
তার পিছু নিয়ে কমপ্যানিয়নওয়েতে নেমে এল রানা ও লিয়া। ইয়টে যথেষ্ট জায়গা। সুন্দর করে সাজানো। ‘দক্ষ মিস্ত্রির হাতে চেরি কাঠে তৈরি,’ রানাকে দেখে নিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল গর্ডন। ‘লম্বায় এ ইয়ট একষট্টি ফুট। ক্লাসিক মডেল। প্রতিটি জিনিস স্বয়ংক্রিয়। লিয়ার কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে, বহুবার সাগর পাড়ি দিয়েছে। বাদ পড়েনি বাডেইরা, সেইণ্ট লুসিয়া, গ্রেনাডার মত বন্দরও।’ লিয়ার দিকে তাকাল সে। তোমার মনে আছে, মাস্টিকে ছোট্ট এক হোটেলে উঠেছিলাম আমরা?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে, পরদিন ভোরে আমার কামরা থেকে শুনলাম তোমার বুকফাটা আর্তনাদ,’ বোমা ফাটাল লিয়া, ‘বাগানে জগিং করার সময় কামড়ে পেছন থেকে আধ কেজি মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিল ধেড়ে বাঁদরটা। তারপর তোমাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। অনেক দিন থাকতে হলো ওখানে। আজও কি শীতকালে জায়গাটা ব্যথা করে?’
ফ্যাকাসে মুখে খুক খুক করে কাশল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন।
এই লোক আলগা ফুটানি দেখাতে ভালবাসে, বুঝে গেছে রানা। তবে ওর ওই ঠাটবাটের গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়েছে লিয়া। গর্ডন এখন প্রাণপণে ভুলতে চাইছে হিংস্র বাঁদরের সেই আচমকা আক্রমণের ব্যাপারটা।
‘মাস্টার কেবিন আমি ব্যবহার করি,’ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লিয়াকে দেখল গর্ডন। ‘তোমরা থাকবে অতিথিদের জন্যে রাখা অন্য দুই কেবিনে।
‘তাতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই,’ বলল লিয়া।
তিন কেবিনের ভেতর সবচেয়ে ছোটটা রানাকে দিল ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন। আরেকবার দেখে নিল রানার আধ-পুরনো চামড়ার জ্যাকেট ও হাতে ধরা ক্যানভাস ব্যাগ। ব্যাগটা বেশ ভারী মনে হলো তার। হাত তুলে দেখিয়ে দিল বাঙ্কের ওপরের স্টোরেজ ইউনিট। ‘মালপত্র ওখানেই রাখতে হবে।’
ঠিক বিশ মিনিট পর রওনা হলো ইয়ট। হু-হু হাওয়ার তোড়ে ফুলে উঠল পাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীর ছেড়ে খোলা সাগরে বেরিয়ে এল ওরা।
গোপনে ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ফ্র্যাঙ্ক গর্ডন, তাই নিজে থেকেই কিচেনে ডিনার তৈরির কাজে নেমে পড়ল লিয়া। রানা টের পেল, বিরক্তি ভরা চোখে বার বার ওকে দেখছে ইয়টের মালিক। লিয়ার সঙ্গে তার মধুর মিলনে ওকেই একমাত্র বাধা বলে ধরে নিয়েছে সে। তাকে আরও বিরক্ত না করে নিজের কেবিনে ফিরল ও। বাঙ্কে বসে খুলল মোযার্ট ফাইল।
অ্যালেকের পোড়া নোট থেকে কিছু উদ্ধার করা খুব কঠিন কাজ। কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল একটা কাগজে লেখা অর্ডার অভ আর… ব্যস, আর কিছু নেই। ওটা থেকে কিছুই বুঝল না ও। হতাশ হয়ে কাগজটা রেখে দিল ফাইলে।
আরেকটা কাগজে অ্যালেক লিখেছে ঐতিহাসিক তথ্য ও সংখ্যার তালিকা। লাল কালিতে তিন জায়গায় লিয়োনার্দো লিখে ঘিরে দিয়েছে ওগুলো। গতবছর ডিসেম্বরের তারিখ। তার দু’সপ্তাহ পর মারা গেছে অ্যালেক।
পুড়ে ছাই হয়েছে কাগজের নিচের দিকের লেখা।
এ ছাড়া, প্রায় প্রতিটি কাগজের মার্জিনে আছে গোক্ষুর সাপ আঁকা ছবি। একটা কোবরার স্কেচের নিচে বড় করে লেখা: দ্য কোবরা???
বোধহয় ফুরিয়ে গিয়েছিল কলমের কালি। জরুরি কিছু ভাবছিল অ্যালেক। তবে সেটা কী বিষয়ে, জানার উপায় নেই।
আধঘণ্টা আধপোড়া কাগজ ঘেঁটে দেখার পর হাল ছেড়ে দিল রানা। তখনই ওর কেবিনে এল লিয়া। হাতে ধোঁয়া ওঠা এক মগ কফি। ওটা ধরিয়ে দিল রানার হাতে। সরু বাঙ্কে ওর পাশে বসল। দুই কেবিনের মাঝে পাতলা দেয়াল, গর্ডন যেন শুনতে না পায়, তাই নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘কী বুঝলে?’
‘কিছুই বুঝতে পারিনি,’ মাথা নাড়ল রানা। কফির মগ পাশে রেখে তুলে নিল ফাইল থেকে একটা কাগজ। ওটা বাড়িয়ে দিল লিয়ার দিকে। ‘জানতে চাই কী লেখা ছিল অর্ডার অভ আর-এর পর। এ ছাড়া, নানান জায়গায় গোক্ষুর সাপ আর এক লোকের মুখের স্কেচ কেন এঁকেছে অ্যালেক?’
‘লোকের মুখ?’ কাগজটা নিল লিয়া। লিয়োনার্দো লেখা জায়গাটা ওকে দেখাল রানা। বৃত্ত তৈরি করেছে শব্দটাকে ঘিরে। কৌতূহলী চোখে ওটা দেখে নিয়ে রানাকে দেখল লিয়া।
‘লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চি?’ জানতে চাইল রানা, ‘অ্যালেক তাঁর কোনও শিল্প দেখতে ইতালিতে গিয়েছিল? পাশেই লেখা তারিখ।’
‘ওখানে গিয়ে থাকলেও আমাকে কিছু বলেনি।’
‘ভাল করে ভেবে দেখো,’ বলল রানা, ‘এটা জরুরি। তুমিই একমাত্র মানুষ, যে জানত অ্যালেক কোথায় যাচ্ছে বা কী করছে।’
ডানহাতে থুতনি ধরল লিয়া। ‘কিন্তু আমার এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই।’
‘আরও গভীরভাবে ভাবো,’ বলল রানা।
‘কিন্তু কী নিয়ে ভাবব তাই তো জানি না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিয়া।
‘মোযার্টের চিঠিতে লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির কথা এসেছিল? ওটার কারণে ফ্লোরেন্সে গিয়ে থাকতে পারে অ্যালেক?’
‘আমার তেমন কিছুই মনে পড়ছে না,’ অধৈর্য স্বরে বলল লিয়া। ‘তা ছাড়া, তারপর তো পেরিয়ে গেছে প্রায় একবছর। সবকিছু তো মনেও নেই।
‘কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য না পেলে কোনও দিকেই এগোতে পারব না আমরা,’ বলল রানা।
‘তবে মনে পড়ছে একটা কথা, মুখ তুলে রানাকে দেখল লিয়া।
‘সেটা কী?’
‘ভুল পথে যাচ্ছি আমরা। লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চি নয়, এটা অন্য এক লোকের নাম।
‘কে সে?’
‘ইতালিয়ান সংগ্রাহক,’ পরিষ্কার মনে পড়েছে লিয়ার। ‘উদিই কিনে নিয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে মোযার্টের চিঠি। তাঁর নাম লিয়োনার্দো ডিয়ানো। একজন প্রফেসর।’
অ্যালেকের সিডি-রমে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ছবি দেখেছে, পেছনে ছিল মিউযিকের ওপরে লেখা হরেক রকম বইয়ে ভরা বুকশেল্ফ্, সবই মনে পড়ল রানার। ‘তা হলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল অ্যালেক?’
‘তা-ই বোধহয়,’ বলল লিয়া, ‘মনে হয় এখনও বেঁচে আছেন।’
‘কোথায় থাকেন তিনি?’
‘র্যাভেনায়,’ বলল লিয়া, ‘মনে নেই দান্তের সমাধির কথা? ওখানে গিয়েছিল অ্যালেক। ওই শহরে একটা কলেজে মিউযিক পড়াতেন লিয়োনার্দো ডিয়ানো।’
কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল রানা, ‘অ্যালেক ওই চিঠির বিষয়ে জানার জন্যে তাঁর ওখানে গিয়েছিল। আমাদেরও বোধহয় যাওয়া উচিত।’
‘তুমি ভাবছ, ওই চিঠি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন তিনি?’ জানতে চাইল লিয়া।
‘বহু টাকা খরচ করেন ওটার জন্যে, কাজেই হাতছাড়া করেছেন বলে মনে হচ্ছে না।’
‘কিন্তু ওই চিঠিতে কী আছে ভাবছ?’
‘ওটা পড়ার পর বুঝব।’