1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ২৮

আটাশ

কাঁচভাঙা জানালার আশি গজ দূরে গাছের ডালে বসে আছে স্নাইপার। এইমাত্র চেয়ার থেকে কার্পেটে ঢলে পড়েছেন প্রফেসর ডিয়ানো। গ্লাভ্স পরা বুড়ো আঙুলে চট্ করে সিলেক্ট ফায়ার টগল টিপে সিঙ্গল শট থেকে ফুল অটোমেটিক গুলির জন্যে তৈরি হলো স্নাইপার। পরক্ষণে স্টাডিরুমের জানালা দিয়ে এল একরাশ গুলি। চারদিকে ছিটকে গেল ভাঙা কাঁচ। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে স্নাইপারের। হাসছে সে।

চট্ করে কমপিউটারের ড্রাইভ থেকে ডিস্ক বের করে নিল রানা। পরক্ষণে প্রফেসরের টেবিলের ওপর দিয়ে পিছলে এগিয়ে লিয়াকে নিয়ে মেঝেতে পড়ল। বুলেটের আঘাতে ভেঙে গেছে মনিটর, ভেতর থেকে বেরোচ্ছে নীলচে ধোঁয়া।

আরেক দফা গুলি ভেঙে দিল জানালার অবশিষ্ট কাঁচ। টেবিলে এখন এবড়োখেবড়ো গর্ত। চিরকালের জন্যে বিকল হয়েছে কমপিউটার। ছিঁড়েখুঁড়ে ভর্তা হয়ে গেছে স্টাডিরুমের পেছনে বুকশেলফের অমূল্য কিছু বই। ভেঙে পড়ার সময় জ্বলন্ত মোমদানীসহ মেঝেতে পড়েছে গ্র্যাপার বোতল। ওটার কড়া অ্যালকোহলে আগুন লাগতেই দপ্ করে জ্বলে উঠেছে পুরু কার্পেট।

জানালার নিচে পুরু দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে রানা ও লিয়া। গুলির আঘাতে চারপাশে ছিটকে পড়ছে কাঠ ও কাঁচের টুকরো। বেল্ট থেকে টান দিয়ে .৪৫ পিস্তলটা বের করে আন্দাজে জানালা দিয়ে বাইরে গুলি পাঠাল রানা। পোড়া কাঠের গন্ধ পেয়ে ওদিকে তাকাল। জ্বলছে দরজার চৌকাঠ ও কপাট।

টেবিলের পাশে রক্তের পুকুরে পড়ে আছেন প্রফেসর ডিয়ানো। হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর পাশে পৌঁছুল লিয়া। অস্বচ্ছ চোখে ছাত দেখছেন বৃদ্ধ। বুকের ফুটো দিয়ে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত। লিয়া ভাবছে, তাঁকে বাঁচাতে হলে সরাতে হবে জানালার কাছ থেকে।

‘ওই চিঠি…’ ঢোক গিললেন প্রফেসর ডিয়ানো। আর কিছুই বলছেন না

‘ওটা কোথায় রেখেছেন, স্যর?’ জানতে চাইল লিয়া। ওর চোখে তাকালেন প্রফেসর। দু’ঠোঁটের কশে জমেছে ফেনা ও ঘন লাল রক্ত।

গুলি থেমে যাওয়ায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। আশপাশে কোনও নড়াচড়া নেই। তবে উঠান থেকে এল কথাবার্তা ও পায়ের আওয়াজ। খড়মড় শব্দ তুলছে রেডিয়ো।

ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। বুকশেলফে জ্বলছে অসংখ্য বই। ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া।

খক-খক করে কাশলেন প্রফেসর ডিয়ানো। কী যেন বলতে গিয়ে বুক চিরে বেরোল দীর্ঘশ্বাস। কাত হয়ে গেল মাথাটা।

তাঁকে দেখে নিয়ে বলল রানা, ‘উনি মারা গেছেন।’

বৃদ্ধের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে লিয়া। ‘কিছু বলবেন, স্যর?’

‘লিয়া, উনি মারা গেছেন,’ একটু জোরে বলল রানা, ‘বেরোতে হবে এখান থেকে।’ আগুনে জিনিসপত্র পোড়ার ফুটফাট শব্দ ছাপিয়ে বাইরে থেকে আসছে লোকজনের গলা ও বুটের আওয়াজ। পিস্তল চেক করল রানা। চেম্বার ও ম্যাগাযিনে আর আছে মাত্র তিনটে গুলি।

স্টাডিরুমের দরজায় লকলক করছে করলা আগুন। তারই মাঝ দিয়ে ছুটে বেরোতে হবে। উঠে স্ট্যাণ্ড থেকে মৃত প্রফেসরের জ্যাকেট নিল রানা। অন্যহাতে টেনে তুলল লিয়াকে। ওর গায়ে জড়িয়ে দিল ভারী টুইড জ্যাকেট। লিয়ার কবজি ধরে আগুনের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল রানা। গোড়ালিতে কামড় বসাচ্ছে আগুন। রানা ঝট করে সামনে বেড়ে লাথি দিতেই কেঁপে উঠে খুলে গেল জ্বলন্ত কপাট। একহাতে চোখ ঢেকে ছুটে আগুনের প্রাচীর পেরোল ওরা। বেরিয়ে এসেছে বাইরের করিডোরে।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে বুটের ধুপ-ধাপ আওয়াজ। ঘুরে লিয়াকে নিয়ে ডানদিকে চলল রানা। সামনের দরজা পেরিয়ে পৌঁছে গেল ছোট এক সিঁড়ির কাছে। ধাপ বেয়ে উঠে যেতেই সামনে পড়ল আরেকটা দরজা। ওরা দু’জন এখন ঠিক কোথায় আছে সেটা বুঝে গেছে রানা। বাড়িতে ঢোকার আগে এদিকে দেখেছে উঁচু, চৌকো ক্লক টাওয়ার। ওপরে কপাটবন্ধ দুটো জানালা। দু’দিকে ঢালু ছাত। টান দিয়ে দরজা খুলল রানা।

ওর ধারণাই ঠিক।

ঘোরানো সিঁড়ি উঠেছে আরও ওপরে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে, ঘুরে হুড়কো দিয়ে ওক কাঠের ভারী দরজা আটকে দিল রানা। একবার দেখে নিল বদ্ধ জায়গাটা। এসে পড়েছে লোকগুলো, কথা বলছে নিচু গলায়। পরক্ষণে লাথি পড়ল দরজার ওপর। ভয়ে চমকে উঠেছে লিয়া।

‘এসো,’ ওর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। ভারী ওজনে মচমচ করছে বহু পুরনো কাঠের ধাপ।

লিয়াকে সামনে রেখে এগোল রানা। নিচে ‘বুম্!’ শব্দে গর্জে উঠল শটগান। টাওয়ারের ভেতর আওয়াজটা বিকট শোনাল। পুরনো দরজা থেকে ছিটকে এল কাঠের চল্টা। এখনই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে লোকগুলো।

সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারের ওপরে উঠে এল রানা ও লিয়া। জানালা খুলতেই সামনে পড়ল লাল টাইল্স্ দেয়া ঢালু, চওড়া ছাত। লিয়ার হাত ধরে জানালা টপকে টালির ওপর নেমে পড়ল রানা। উঁচু ছাত থেকে বহু দূরে দেখল দিগন্তে সবুজ জঙ্গল ও ডুবন্ত লাল সূর্য।

দু’দিকে ঢালু টালির ছাত। লিয়াকে নিয়ে পা টিপে এগোল রানা। পায়ের তলায় পিছলে যাচ্ছে পোড়া মাটির পুরনো টাইল্স্। লিয়া পড়ে যাচ্ছে দেখে পা দৃঢ় করে ওর পতন ঠেকাল রানা। ছাতের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, নিচে ক্যানভাসের ক্যানোপি ও শক্ত সিমেন্টের চাতাল।

এদিকে খুলে গেছে টাওয়ারের জানালা। ওখানে এক লোক, পরনে কালো জ্যাকেট, হাতে নাকবোঁচা মেশিন পিস্তল। অস্ত্রের মুখে ঝলসে উঠল কমলা আগুনের শিখা। রানা ও লিয়ার পায়ের কাছে বিধল একরাশ গুলি। ঘুরেই পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। বুকে বুলেট বিঁধতেই টাওয়ারের ভেতর পড়ল লোকটার লাশ।

বেল্টে পিস্তল গুঁজে লিয়ার মায়াবী সবুজ চোখে তাকাল রানা। নরম সুরে বলল, ‘আমার ওপর ভরসা রাখো, লিয়া।’

নীরবে রানাকে দেখছে মেয়েটা।

পরক্ষণে ওকে নিয়ে উঁচু ছাত থেকে খসে পড়ল রানা।

নিচ থেকে ক্যানভাসের সরু ক্যানোপি দ্রুত উঠে আসছে দেখে ভীষণ ভয় পেল লিয়া। আটকে ফেলেছে শ্বাস। কয়েক মুহূর্ত পর ওদেরকে নিয়ে প্যাটিয়োর দেয়াল থেকে উপড়ে এল অ্যালিউমিনিয়ামের পলকা ফ্রেম। স্লো-মোশনে ক্যানভাস সহ মুচড়ে নামল নিচের মেঝেতে। বাড়ির বাইরে এই জায়গাটা ব্যবহার করা হয় অতিথি আপ্যায়নে।

কপাল মন্দ, ইঁটের বারবিকিউ-এর ওপর কোমর দিয়ে পড়েছে রানা। লিয়া নেমেছে নরম প্লাস্টিকের গোল টেবিলের ওপর। আস্তে করে ওকে নিয়ে কাত হয়ে মাটিতে পড়ল টেবিল। বলতে গেলে কোনও ব্যথাই পেল না লিয়া। ধড়মড় করে উঠে কোমর চেপে ধরল রানা। ব্যথায় বিকৃত মুখ। পরমুহূর্তে সম্বিত ফিরে পেয়ে লিয়ার হাত ধরে ঝেড়ে দৌড় দিল ও বাগানের ভেতর দিয়ে। ভয়ে হাঁফাচ্ছে লিয়া। পেছনে ওরা শুনল কয়েকজনের চিৎকার। ওদের দিকে এল গুলি। কানের পাশ দিয়ে একটা গুলি যেতেই গতি ‘না কমিয়ে সামনের ঘন ঝোপে লিয়াকে নিয়ে ঢুকল রানা। আধমিনিট পর সামনে পড়ল পার্কের মত একটা জায়গা। গাছের মাঝ দিয়ে দৌড়ে চলেছে রানা ও লিয়া। মুখে লাগছে পাতা ভরা ডাল। একটু দূরে পাথরের উঁচু দেয়াল। তবে ধসে গেছে ওটার একটা অংশ। ওই সরু ফাঁক দিয়ে যেতে পারবে যে- কেউ।

কয়েক মুহূর্ত পর দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে পুরনো এক ফার্মহাউসের এলাকায় ঢুকল ওরা। কাদা ভরা জমিতে অসংখ্য ঝোপঝাড়। একটু দূরে জীর্ণ কাঠের দালান। এতই পুরনো, গায়ে জন্মেছে সবুজ শেওলা। পেছনে তাকাল রানা, দেয়ালের ধসে পড়া সরু অংশের দিকে ছুটে আসছে ছয়জন লোক। মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।

পিস্তলে মাত্র দুটো গুলি আছে, সামনের জনের দিকে অস্ত্র তাক করেও সিদ্ধান্ত পাল্টে নিল রানা। গুলি করলে খুন হবে বড়জোর দু’জন। এরপর খালি পিস্তল হাতে কিছুই করতে পারবে না ওরা। লিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গিয়ে ঢুকল বড়সড় একটা ঘরে। চারপাশে দেয়ালের তাকে নানান বাক্স ও যন্ত্রপাতি। খালি একটা র‍্যাক টেনে সরাল রানা। ওটা দিয়ে বন্ধ করল প্রবেশপথ। কিন্তু তখনই কপাটে আছড়ে পড়ল ভারী দেহের কেউ। র‍্যাক সরে সামান্য খুলে গেল দরজা। বিপদ বুঝে লাথি মেরে কপাট বন্ধ করল রানা। তবে দরজা ও চৌকাঠের মাঝে আটকা পড়েছে লোকটার মোটাসোটা হাত। মুঠোয় স্করপিয়ন মেশিন পিস্তল। বদ্ধ জায়গায় গুলির শব্দে কানে তালা লেগে গেল ওদের।

ফুঁপিয়ে উঠল লিয়া।

কাছের তাক থেকে জংধরা একটা যন্ত্র নিল রানা। ওটা এয়ার-পাওয়ার্ড নেইল গান। দরজা ও চৌকাঠের ফাঁক থেকে হাত টেনে নিতে ব্যস্ত লোকটা। দেরি না করে সামনে বেড়ে তার বাহুর ওপর যন্ত্রটা ধরে ট্রিগার টিপল রানা। জংধরা চারইঞ্চি লম্বা পেরেক ঘ্যাঁচ করে চৌকাঠে গেঁথে দিল লোকটার বাহু। হাহাকার করে উঠল মোটা। হাতের গভীর ক্ষত থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে রক্ত। আরও তিনবার ট্রিগার টিপে আরও তিনটে পেরেক তার বাহুতে গাঁথল রানা। বিকট চিৎকার ছাড়ছে লোকটা। হাত থেকে মেঝেতে পড়েছে স্করপিয়ন মেশিন পিস্তল। ওটা তুলে রানা দেখল, একটা গুলিও নেই। বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলল খালি অস্ত্রটা।

ছাউনির কাঠের পাতলা দেয়াল ভেদ করে ঢুকছে একের পর এক গুলি। বুলেট লেগে ধসে পড়ল স্তূপ করা কিছু ক্রেট। ওপাশে কাঠের তক্তার দেয়ালে সরু একটা ফাঁক। বেরোতে পারবে যে-কেউ। লিয়ার হাত ধরে ওদিক দিয়ে কাদা ভরা গলিতে বেরোল রানা। কয়েক পা যেতেই পাশে পড়ল গোলাঘর। দেরি না করে ওটার ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা।

কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ হতে দেখেছে খুনিরা। যার যার অস্ত্র হাতে এগোল তারা। দূরে কা-কা শব্দে ডাকছে দুটো কাক। এ ছাড়া থমথম করছে গোটা ফার্মহাউস।

গোলাঘরের দরজার কাছে পৌঁছুতেই ভারী ইঞ্জিন চালু হওয়ার আওয়াজ শুনল আততায়ীরা। মেঝের সঙ্গে চেপে ধরা হয়েছে গাড়ির অ্যাক্সেলারেটর। প্রতিক্রিয়া দেখাবার কোনও সুযোগ পেল না খুনিরা। হঠাৎ উড়ে গেল পাতলা কাঠের তক্তার দেয়াল। বিকট গর্জন ছেড়ে গোলাঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরোল পুরনো এক ফ্ল্যাটবেড ট্রাক। ওটার সামনের চাকার নিচে পিষে কাদায় গেঁথে গেল দু’জন আততায়ী। বাকিরা প্রাণের ভয়ে ঝাঁপ দিল নানাদিকে। একজন গড়ান দিয়ে উঠে বসে গুলি চালাল ট্রাকের ক্যাব লক্ষ্য করে। এদিক-ওদিক দুলতে দুলতে চলেছে যান্ত্রিক দানব। ওটার পিঠে পলিথিন দিয়ে মোড়া খড়ের বিশাল তিনটে গাদা। ওখানে ঢুকল বেশিরভাগ গুলি। রেডিয়োতে অন্যদেরকে দুঃসংবাদ জানাল খুনিদের নেতা।

ফার্মহাউস পেরিয়ে আঁকাবাঁকা গ্রাম্যপথে টিলার কাঁধে উঠছে প্রাচীন ট্রাক। ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার কালো আঁধার। ট্রাকের দুর্বল হলদে আলোয় রানা দেখল, পথের একদিকে খাড়া পাহাড়ি পাথুরে দেয়াল, অন্যদিকে গভীর খাদ।

‘এটা আরও জোরে চলে না?’ ডিযেল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজের ওপর দিয়ে জানতে চাইল লিয়া।

মেঝেতে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরেছে রানা। ধুলো ভরা ডায়ালের কাঁটা দেখাচ্ছে ষাট মাইল গতি। ইঞ্জিনের সাধ্য নেই যে আরও জোরে ছুটবে। রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে শক্তিশালী দুই গাড়ির উজ্জ্বল আলো।

ওর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে প্যাসেঞ্জার জানালা দিয়ে পেছনে তাকাল লিয়া। শীতের হু-হু হাওয়ায় উড়ছে দীর্ঘ কালো চুল। গলা উঁচিয়ে জানতে চাইল, ‘ওরা কি আসলেই খুনি?’

রানা কিছু বলার আগেই গুলি লাগল ট্রাকের গায়ে। একটা বুলেট চুরমার করল উইং মিরর।

‘সুযোগ পেলেই চাকায় গুলি করবে,’ বলল রানা, ‘তুমি বরং শক্ত হাতে হুইলটা ধরো।’

‘তুমি কী করবে?’ জানতে চাইল লিয়া।

জবাব না দিয়ে রানা বলল, ‘মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখো।’ লিয়া স্টিয়ারিং হুইল ধরতেই দরজা খুলে ক্যাব থেকে বেরোল রানা। কান ও পোশাক ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে ঠাণ্ডা হাওয়া। ট্রাকের মাত্র দু’ফুট দূরে সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে পড়ছে পাথুরে দেয়াল। মাঝে মাঝে অতল খাদ। পেছনের গাড়িদুটোর উজ্জ্বল আলো এখন ট্রাকের ওপর। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে খড়ের বেলের দিকে চলেছে রানা।

দূর থেকে এল গুলির আওয়াজ। ট্রাকের পেছনে খড়ের গাদার জন্যে রানাকে দেখছে না খুনিরা। এদিক-ওদিক দুলে ছুটে চলেছে পুরনো ট্রাক। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো এক ঝোপের ডালের চাপড় খেয়ে ট্রাকের পাশে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঝুলে থাকল রানা। ক’মুহূর্ত পর পৌঁছুল পেছনদিকের খড়ের গাদার পাশে।

ট্রাকের পেছনে কালো পাতলা পলিথিন দিয়ে মোড়া তিনটে খড়ের বেল। একেকটা আট ফুট উঁচু বৃত্তাকার বল বাতাসের ঝাপটা খেয়ে খড়-খড় আওয়াজ তুলছে পলিথিন। পুরু কিছু দড়ি দিয়ে টানটান করে বাঁধা হয়েছে খড়ের বেল। ট্রাকের পাশে ঝুলতে ঝুলতে অন্যহাতে বেল্ট থেকে পিস্তল নিল রানা।

চারটে দড়ি।

গুলি আছে মাত্র দুটো।

পাথুরে দেয়াল থেকে সরে খাদের পাশে গেল ট্রাক। এ মুহূর্তে একহাতের জোরে ঝুলছে রানা। কয়েক শ’ ফুট নিচে খাদের পাথুরে এবড়োখেবড়ো মেঝে। পেছনের গাড়ির হেডলাইট পড়ল রানার গায়ে। পরক্ষণে কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। বুলেট ছিঁড়ে দিল রানার জ্যাকেটের বামকনুইয়ের কাপড়। চিরে গেছে বাহুর পেশি। তীব্র ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল রানা। ৪৫ ক্যালিবারের পিস্তলের মাল কাছের দড়িতে ঠেকিয়ে টিপে দিল ট্রিগার। মুঠোর ভেতর লাফিয়ে উঠেছে পিস্তল। ছিঁড়লেও টান পড়ল না দড়ির দুই প্রান্তে। ঘটলও না কিছু।

ভুল দড়িতে গুলি করেছে রানা। ওর কানের কাছে ট্রাকের ধাতব গায়ে লাগল কয়েকটা গুলি। আরেকটা দড়ির ওপর পিস্তলের মা ঠেকাল রানা। এটাই শেষ গুলি। একমুহূর্ত পর টিপে দিল ট্রিগার।

ছিটকে উঠল ছেঁড়া দড়ি। আরেকটু হলে ঝটকা দিয়ে রানার মুঠো থেকে ছুটিয়ে নিত পিস্তল। ট্রাক ওপরের দিকে উঠছে বলে হঠাৎ করেই দুলে উঠে গড়াতে লাগল খড়ের বেল। ধুপ-ধাপ আওয়াজে পড়ল পেছনের রাস্তায়। ট্রাকের টেইল-লাইটের লাল আলোয় রানা দেখল, মস্ত একেকটা লাফ দিয়ে গাড়িগুলোর দিকে চলেছে টাইট করে বাঁধা খড়ের গোলা।

কড়া ব্রেক কষে থামতে চাইল পেছনের দুই গাড়ির ড্রাইভার। আঁধার থেকে এল চাকা ঘষ্টে যাওয়ার কর্কশ আওয়াজ। গাড়িদুটো সরে যেতে চাইলেও পথ বড় বেশি সরু। ধুম্ শব্দে সামনের গাড়ির নাকে উঠল পাথরের মত শক্ত খড়ের বেল। চারদিকে ছিটকাল ভাঙা কাঁচ। একপাশে সরতে গিয়ে উল্টে গেল সামনের গাড়ি। আর তখনই পেছন থেকে ওটাকে গুঁতো দিল দ্বিতীয়টা। রানা দেখল, জোর ধাক্কা খেয়ে চরকির মত ঘুরেই আড়াআড়িভারে রাস্তা পেরোল সামনের গাড়ি। পাহাড়ি গভীর খাদে পড়ে সাঁই করে নেমে গেল কয়েক শ’ ফুট নিচের পাথুরে জমিতে। দূর থেকে শোনা গেল বিস্ফোরণের চাপা আওয়াজ। এদিকে পাহাড়ি দেয়ালে নাক গুঁজে মুড়ির ভাঙা টিনের বাক্সের মত তুবড়ে গেছে পেছনের গাড়িটা।

কর্কশ ঘড়-ঘড় শব্দে ছুটে পালাচ্ছে প্রাচীন ট্রাক। রক্তে ভিজে গেছে রানার বামকনুই। ট্রাকের পেছনে উঠে দেখল, দূর থেকে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনার এলাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *