1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

তুষারস্নাত ভিয়েনা।

কানের কাছে মোবাইল ফোনের কর্কশ আওয়াজে গভীর ঘুমের ঘোর কাটিয়ে বিছানায় উঠে বসল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট লুদভিগ কেইলম্যান। বেডসাইড টেবিলের ঘড়ি দেখাচ্ছে রাত দুটো সাত মিনিট। এত রাতে ফোন করবে এমিলি? পর- মুহূর্তে ভাবল লুদভিগ: তা করবেই বা কী করে? আগেই তো মেয়েটার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে সে। হঠাৎ ভীষণ ভয় লেগে উঠল লুদভিগের। খুব খারাপ কোন সংবাদ নয় তো?

না, এমিলি ফোন করেনি। লাইনে অচেনা এক মেয়ে। মিষ্টি কণ্ঠ। নিজের নাম বলেছে এমিলিয়া বেকার। কান পেতে কথা শুনছে লুদভিগ। ক্রমেই কেটে যাচ্ছে ঘুমের রেশ। হাই তুলে জানতে চাইল, ‘তা হলে আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা করতে পারি?’

ফোনের স্পিকার হাত দিয়ে চেপে ধরে রানার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল লিয়া।

আগেই এ বিষয়ে লিয়ার সঙ্গে কথা বলেছে রানা। ঠিক করেছে, লোকজনের ভিড়ে ভিয়েনার খোলামেলা কোনও জায়গায় ডিটেকটিভ সার্জেন্টের সঙ্গে দেখা করবে ওরা। যাতে প্রয়োজনে চট করে মিলিয়ে যেতে পারে জনস্রোতের মাঝে।

তবে যে-কোনও দিক থেকে হামলা হতে পারে, তাই আগে লুদভিগ কেইলম্যানকে পরীক্ষা করে দেখবে রানা। লিয়ার দিকে চেয়ে মাথা দোলাল ও।

লুদভিগকে জানাল লিয়া, ‘আপনি আসবেন ওই লেকে।’ কোন্ লেক জানতে চাইল না ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ‘বেশ। ঠিক কখন?’

‘আগামীকাল সকাল নয়টায়।’

.

আটটা পনেরো মিনিটে লেকের কাছে পৌঁছল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট লুদভিগ কেইলম্যান। শক্ত তুষারের ওপর কড়মড় আওয়াজ তুলছে ভারী মার্সিডিযের চাকা। ফোর-হুইল-ড্রাইভ ব্যবহার করে মৃদু হোঁচট খেতে খেতে ঠিক জায়গায় গিয়ে. থামল গাড়িটা। নেমে পড়ল সার্জেন্ট। একবার দেখে নিল হাতঘড়ি। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল লেকের তীরে। এক এক করে পেরোচ্ছে মুহূর্তগুলো। লুদভিগের নাকের ফুটো দিয়ে বেরোচ্ছে ঘন কুয়াশার মত সাদা শ্বাস। গরম রাখার জন্যে গ্রেটকোটের পকেটে রেখেছে দু’হাত। তবে কিছুক্ষণ পর শীত লেগে উঠতে থার্মোস থেকে কাপে ঢেলে নিল কালো, ঘন কফি। পরের বিশ মিনিটে গিলল আরও দুই কাপ কফি। গত বছরের চেয়েও শীত এবার বেশি। এরই ভেতর জমাট বেঁধে গেছে লেক।

দূরে গাড়ির আওয়াজে সতর্ক হলো লুদভিগ। কপালে হাত রেখে তাকাল নিচু সূর্যের দিকে। ওদিকেই রয়েছে পাইন গাছের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। লেকের তিন শ’ গজ দূরে এসে বাঁক নিয়ে অন্যদিকে গেছে। ওই পথে হলদে এক হ্যাচব্যাক গাড়ি দেখল লুদভিগ। এদিকেই আসছিল গাড়িটা। কিন্তু থামল না। আরেকবার হাতঘড়ি দেখল সে। এরই ভেতর বেজে গেছে সকাল সোয়া নয়টা।

কোথায় গেল মেয়েটা?

বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করল লুদভিগ। মনে মনে গালি দিচ্ছে নিজেকে। ভুল করেছে এখানে এসে। ওই মেয়ে আসলে আসবে না। রাস্তা থেকে কয়েকটা নুড়িপাথর তুলে বরফের প্রান্তরে ব্যাঙবাজি খেলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। একটু পর বেগ আসতে ঝোপের ধারে প্রস্রাব করল।

সাড়ে নয়টায় খোলা জায়গায় শীতে প্রায় মরার দশা হলো তার। এরই ভেতর অর্ধেক খালি হয়েছে থার্মোস। সকাল দশটায় বুঝল, আসবে না ওই মেয়ে। সময় নষ্ট করছে সে।

বিড়বিড় করে গালি দিয়ে মার্সিডিয়ের সামনে পৌঁছুল লুদভিগ। আনমনে বলল, ‘সমস্যা কী বেটির? দেখা করবে না, ভাল কথা, কিন্তু খামোকা ভোগানোর মানেটা কী?’ গাড়িতে উঠে ইগনিশনে চাবি ভরল সে। হিটার চালু হতেই কমতে লাগল শীত। আবারও কাকে যেন গালি দিয়ে কমিয়ে দিল ব্লোয়ারের গতি। এবার ফিরবে শহরে। কিন্তু ইঞ্জিন চালু করতেই লুদভিগের মাথার পেছনে ঠেসে ধরা হলো পিস্তলের বরফ-ঠাণ্ডা মাল। সেফটি ক্যাচ অফ করার ধাতব আওয়াজটা বোমার মত কানে লাগল লুদভিগের।

পেছন থেকে এল শীতল একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর: ‘হাত নাড়াতে যেয়ো না। একটু নড়লেই খুন হয়ে যাবে।’

স্থির হয়ে গেল লুদভিগ।

পেছনের সিট থেকে সামনে ঝুঁকে লুদভিগের হোলস্টার থেকে সিগ সাওয়ার পিস্তলটা নিয়ে নিল রানা। শেষপর্যন্ত গুলি ভরা অস্ত্র পেয়ে খুশি। মনোযোগ দিয়ে দেখছে সার্জেন্টকে। লোকটা ভালুকের মত বিশাল। বাঁদরের পাছার মত লালচে মুখ। হাতাহাতি মারপিটে অভ্যস্ত। ক’বার নাক ভেঙেছে আল্লাই মালুম। বিপজ্জনক লোক। বেমক্কা যদি এই লোকের একটা ঘুষি লেগে যায় চোয়ালে তবে অন্তত একঘণ্টার জন্যে ঘুমিয়ে পড়বে রানা।

ঠোঁট বাঁকা করে বলল লুদভিগ, ‘কী চাও আমার কাছে?’

জবাব দিল না রানা।

ঘুরে তাকাতে চাইল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। সুযোগ পেলে দু’হাতে ছিঁড়ে নেবে পেছনের লোকটার ঘাড় থেকে মাথা। ‘তুমি যদি আমার মেয়েটাকে কিডন্যাপ করা সেই শুয়োরের বাচ্চা হও, তো বলে দিচ্ছি: ওকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিয়েছি। চাইলেও ওকে আর কিডন্যাপ করতে পারবে না।’

‘আমি কেন তোমার মেয়েকে কিডন্যাপ করব?’ জানতে চাইল রানা।

দ্বিধায় পড়ল লুদভিগ। অদ্ভুত প্রশ্ন তুলেছে পেছনের লোকটা। তার জার্মান উচ্চারণ নিখুঁত হলেও সেটার ভেতর অন্য দেশের টান রয়েছে। আমেরিকান? ব্রিটিশ? নাকি উপমহাদেশীয়? মাথা না ঘুরিয়ে চোখের কোণে তাকে দেখতে চাইল লুদভিগ। তবে কান ছাড়া কিছুই দেখল না। ব্যাটা খুব সতর্ক। আড়াল করে রেখেছে নিজের মুখ। কিন্তু কে এই লোক?

‘কারণ, ভাল করেই জেনে গেছি, তুমিই খুন করেছ অ্যালেক বেকারকে,’ টোপ ফেলল লুদভিগ। পরক্ষণে ডাহা মিথ্যা বলল, ‘ওই খবর শুধু আমি জানি, তা ভেবো না। কাজেই আমাকে খুন করলেও রেহাই পাবে না।’

‘অ্যালেক বেকার আমার বন্ধু ছিল,’ বলল রানা। ‘তবে কেউ না কেউ তাকে খুন করেছে। আমি এসেছি সেই খুনি বা খুনিদেরকে খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নিতে।’ খালি .৪৫ পিস্তল বেল্টে গুঁজল ও। পুলিশের নাইন এমএম সিগ সাওয়ার পিস্তলটা পুরোপুরি লোডেড, তবে ওর মনে হচ্ছে না ওটা কাজে লাগাতে হবে।

লুদভিগ কেইলম্যানের আধঘণ্টা আগে এখানে হাজির হয়েছে রানা। লুকিয়ে ছিল পাইনের জঙ্গলে। প্রচুর সময় নিয়ে খেয়াল করেছে পুলিশের লোকটাকে। সে অন্য কাউকে গোপনে আনলে, আগেই জেনে যেত। তা ছাড়া, মনের ভেতর পাপ থাকলে বাচ্চাদের মত এদিকে-ওদিকে পাথর ছুঁড়ত না লুদভিগ। অন্য কেউ সঙ্গে থাকলে ভুলেও খোলা জায়গায় প্রস্রাব করত না। খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক হলেও বারবার তার চোখ যেত যেখানে লুকিয়ে আছে তার সঙ্গী। মাথার পেছনে পিস্তলের মা ধরার পরেও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নেই লোকটার। রানা জেনে গেছে, এ কোনও বিপদ ডেকে আনবে না। তবে পুরো বিশ্বাস করা যায় না।

‘থার্মোসে কফি আছে?’ জানতে চাইল রানা।

লুদভিগ বুঝল, মাথার পেছন থেকে সরে গেছে পিস্তল। খুব ধীরে ঘুরে রানার দিকে তাকাল সে। যেভাবে ভ্রূকুটি করেছে, যেন নীরবে বলছে: অ্যাই, আমার পিস্তল তোমার হাতে কেন? এক্ষুণি ফেরত দাও!’

‘তোমার খারাপ মতলব আছে কি না, নিশ্চিত না হয়ে উপায় ছিল না,’ থার্মোসের দিকে আঙুল তাক করল রানা। ‘দেবে এক কাপ?’ হিটারের গুণে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে গাড়ির ভেতরটা। কয়েক ঘণ্টা বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে দাঁড়িয়ে বা বসে হাড়গোড় শীতে জমে গেছে ওর।

‘ঠাণ্ডা হয়ে গেছে,’ বলে থার্মোস রানার দিকে বাড়িয়ে দিল লুদভিগ।

বামহাতে নিয়ে দুই পায়ের ফাঁকে থার্মোস রাখল রানা। ওটার মুখ খুলে কাপে ঢেলে নিল মৃদু উষ্ণ কফি। একবারের জন্যে নড়ল না ডানহাতের পিস্তলের নল। দুই ঢোকে কাপ খালি করে থার্মোসের মুখ আটকে ফেরত দিল লুদভিগের হাতে।

পুলিশ অফিসার বুঝেছে, খুন করতে এখানে আসেনি এই লোক। ‘এমিলিয়া বেকারের কে হও তুমি?’ জানতে চাইল লুদভিগ। ‘বয়ফ্রেণ্ড? হাসব্যাণ্ড?’

‘না। আমি ওর পারিবারিক বন্ধু।’

‘অপেরা তারকারা আজকাল সশস্ত্র বন্ধু নিয়ে ঘোরে?’

মৃদু হাসল রানা। ‘অ্যালেক যখন আর্মিতে ছিল, সেসময়ে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল ওর।’

মাথা দোলাল লুদভিগ। বুঝে গেছে, এই লোক আগে আর্মিতে ছিল। নইলে চোখ এড়িয়ে হাজির হতে পারত না। সহজ সুরে জানতে চাইল সে, ‘তোমার নাম কী?’

‘আমাকে রানা নামে ডাকতে পারো।’

‘আমার নাম লুদভিগ কেইলম্যান।’

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, লুদভিগ। এবার কিছুক্ষণ ড্রাইভ করো। এ সময়ে তোমার কাছ থেকে জেনে নেব অ্যালেকের মৃত্যুর বিষয়ে জরুরি কিছু তথ্য। তারপর সন্তুষ্ট হলে বা বিশ্বাস করতে পারলে, তোমাকে নিয়ে যাব এমিলিয়া বেকারের ওখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *