1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ১৩

তেরো

অক্সফোর্ডশায়ারের সেই হোটেল কক্ষ।

পাশাপাশি দুই চেয়ারে বসে ভিডিয়ো ক্লিপ দেখছে রানা ও লিয়া। ছবির মান নিম্ন শ্রেণির। থরথর করে কাঁপছে দৃশ্য। ভিডিয়োতে দেখা গেল মোমবাতি থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে কমলা-হলদেটে আভা। ক্যামেরাম্যান আছে পাথরের বিরাট এক ঘরে। মেঝেতে কালো-সাদা টাইল্স্। ঘরের আরেক প্রান্তে কয়েক ফুটের ব্যবধানে তিনটে পাথরের পিলার। বহু ওপরে গম্বুজের মত ছাত। তিনটে পাথরের পিলারের সামনে ছোট, উঁচু মঞ্চ। পেছন-দেয়ালে ঝুলছে রামছাগলের সোনার মাথা। আগুনের কাঁপা আলোয় চকচক করছে ওটার দুই শিং।

ভুরু কুঁচকাল লিয়া। ‘বুঝছি না জায়গাটা কোথায়।’

‘আবছা আওয়াজ শুনছ?’ বিড়বিড় করল রানা। ভলিউম বাড়িয়ে দিল ল্যাপটপের। এবার শুনল শ্বাস-প্রশ্বাসের ভারী আওয়াজ। ওই শব্দ করছে ক্যামেরাম্যান। হঠাৎ আরেকদিকে ঘুরল ক্যামেরা। ঝাপসা হলো দৃশ্য। মাইক্রোফোনে ভেসে এল ভীত কণ্ঠ, বিড়বিড় করছে: মাই গড! ও, মাই গড!’

‘অ্যালেকের গলা, ফিসফিস করল লিয়া। খামচে ধরল টেবিলের কিনারা। চাপ খেয়ে সাদা হয়েছে সুন্দর আঙুলের ডগা।

গভীর মনোযোগ দিয়ে ছায়াছবি দেখছে ওরা।

ঠিক দিকে তাক করা হলো ক্যামেরা।

কালো এবড়োখেবড়ো কী যেন ঢেকে দিল ছবির তিনভাগের একভাগ।

‘অ্যালেক লুকিয়ে আছে পিলারের আড়ালে,’ বলল রানা। এইমাত্র ধনুকের মত বাঁকা খিলানের তলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে একদল লোক। ঘোলাটে হলো দৃশ্য। ক্যামেরা ঝাঁকি খাওয়ার পর চালু হলো অটোফোকাস।

দলে অন্তত বারো থেকে পনেরোজন লোক। পরনে কালো সুট। পিলারের আরও পেছনে সরল ক্যামেরা।

‘ওখানে কী করছে অ্যালেক?’ ফিসফিস করল লিয়া।

মঞ্চের সামনে অর্ধচন্দ্রের মত হয়ে দাঁড়াল লোকগুলো। প্রত্যেকে যেন পাথুরে মূর্তি। অ্যাটেনশনের ভঙ্গি, তবে দু’হাত পেছনে বাঁধা। কারও চেহারা দেখা গেল না। সবচেয়ে কাছের জন আছে অ্যালেকের কাছ থেকে মাত্র ক’ফুট দূরে। ক্যামেরা তাক হলো তার দিকে। লোকটার চুল বালিরঙা। আর্মি ছাঁট দেয়া। অটোফোকাসের কল্যাণে স্পষ্ট দেখা গেল তার মুখের এক অংশ। মুচড়ে গেছে ক্ষত-বিক্ষত একটা কানের লতি। ওটা ছিঁড়ে গেলে সেলাই করা হয়েছিল অযত্নের সঙ্গে।

মঞ্চের দিকে মন দিল রানা। ওদিকটা আবছা বলে ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য ক’মুহূর্ত পর বুঝে গেল ও, ওটা কী ধরনের মঞ্চ। ওই ঘরের মূল আকর্ষণ ওটার বেদি।। দু’দিকে দেয়ালের গায়ের বারোটা গর্তে জ্বলছে বারোটা মোমবাতি। ওই মঞ্চে বোধহয় ঘটবে নারকীয় কোনও বীভৎস হত্যাকাণ্ড। আগেও এমন কালো জাদুর আচারানুষ্ঠান দেখেছে রানা।

বেদির মাঝখানে দেখা যাচ্ছে দু’ফুট ব্যাসের একটা গাছের এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ গুঁড়ি। উচ্চতায় আট ফুট। ওপরে লোহার রিভেট করা বেল্ট থেকে ঝুলছে ভারী দুটো শেকল।

ঘরের ভেতর নড়াচড়া দেখল রানা ও লিয়া। বেদিওয়ালা মঞ্চের পেছনে খুলে গেছে লোহার উঁচু দরজা। ঘরে ঢুকল তিনজন লোক। দু’পাশের দু’জনের মুখে আঁটা কালো মুখোশ। তৃতীয়জন বোধহয় বন্দি। শক্ত করে ধরা হয়েছে তার দু’হাত। ছুটে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাঝের লোকটা। টেনে হিঁচড়ে তাকে মঞ্চে তুলে দাঁড় করানো হলো বেদির সামনে।

নড়ল ক্যামেরা।

উত্তেজিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ফোঁসফোঁস আওয়াজ।

পাথুরে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরল বন্দির ভীতসন্ত্রস্ত চিৎকারের প্রতিধ্বনি।

‘আমার মনে হয় বাকি দৃশ্য তোমার না দেখাই ভাল,’ লিয়াকে বলল রানা। হাত বাড়িয়ে দিল স্টপ বাটনের দিকে।

‘পুরোটা দেখতে চাই,’ চাপা স্বরে আপত্তি জানাল লিয়া।

কাঠের গুঁড়ির ওপর লোকটাকে ঠেসে ধরল কালো মুখোশ পরা লোকদু’জন। বন্দির হাতে জড়িয়ে দিল ভারী শেকল। আগের চেয়ে জোরে শোনা যাচ্ছে তার চিৎকার।

মুখোশ পরা ডানদিকের জন সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত উঁচু করে কী যেন দেখাচ্ছে বন্দিকে। তার পিঠে ফোকাস হলো ক্যামেরার লেন্স। লোকটা কী করছে, বোঝা গেল না। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল বন্দির আর্তনাদ। প্রাণপণে ছুটে যেতে চাইছে শেকল থেকে।

সরে এল মুখোশধারী। কী যেন ঝুলছে বন্দির মুখে। ওটা সরু দড়ি বা কেই। কালো পোশাক পরা লোকটা পিছিয়ে যেতেই টানটান হলো কেইল্।

রানা বুঝে গেল এবার কী ঘটবে।

থরথর করে কাঁপছে ক্যামেরা।

‘হায়, যিশু!’ ঢোক গিলল আতঙ্কিত লিয়া। ‘জিভে বড়শির মত কী যেন গেঁথে দিয়েছে!’

কালো পোশাক পরা লোকটা ঘুরে দাঁড়াল দর্শকদের দিকে

গিটারের তারের মত টানটান হলো কেই। এখন আর চিৎকার করার সাধ্য নেই বন্দির। মুখ থেকে ছয়ইঞ্চি বেরিয়ে এসেছে জিভ। কোটর থেকে খসে পড়তে চাইছে বেচারার চোখদুটো। বাঁশপাতার মত কাঁপছে শরীরটা।

সামনে বাড়ল দ্বিতীয় মুখোশধারী। মোমবাতির লালচে আলোয় ঝিক করে উঠল কী যেন। রানা ও লিয়া দেখল, মাথার ওপর নকশাখচিত একটা ড্যাগার তুলেছে লোকটা।

মোমের আলোয় ঝিলিক তুলে নেমে এল ড্যাগার। ভয় পেয়ে মাথা পিছিয়ে নিতে চাইল বন্দি। কিন্তু পারল না। কচ্ করে কেটে নেয়া হলো তার জিভ। সাপের মত কিলবিল করে মঞ্চের সামনের দিকে চলে গেল কেব্‌ল্। ওটার সঙ্গে গেঁথে আছে কাটা জিভ। বন্দির মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় এদিক-ওদিক করছে মাথা। উল্টে গেছে দুই চোখ।

অবশ্য ওই ব্যথা অল্প সময়ের জন্যে। সামনে এগিয়ে ঘ্যাচ করে বন্দির পেটে ছোরা গাঁথল মুখোশধারী। আগে বোধহয় কসাই ছিল। পেশাদারী দক্ষতার সঙ্গে পেট চিরে বন্দির পাঁজরের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিল ধারালো ছোরা।

অসহায় মানুষটার রক্ত ও পিচ্ছিল নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসতেই অন্যদিকে চোখ ফেরাল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *