1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪৭

সাতচল্লিশ

চিত হয়ে শুয়ে প্রায়ান্ধকার ঘরের ছাত দেখছে রানা। মনে হলো, পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ। তবে সন্দেহ হতেই হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, সময় পেরিয়েছে মাত্র পাঁচ মিনিট। বারবার মনের ভিতর ঘুরছে দুটো চিন্তা: কীভাবে বেরোব এখান থেকে? আর, কীভাবে উদ্ধার করব এমিলিকে?

দুর্বল জায়গা খুঁজতে অন্তত দশবার পরীক্ষা করেছে ঘরটা। সামান্য যতটুকু আলো, তা আসছে ছাতের কাছে উঁচু ওই জানালা থেকে। হাঁচড়েপাঁচড়ে দেয়াল বেয়ে উঠে কালো রঙের শীতল লোহার শিক ধরেছে রানা। দেয়ালে দু’পা ঠেকিয়ে প্রাণপণে টেনেও সামান্যতম নড়াতে পারেনি জানালার ফ্রেম। ওটা উপড়ে নিতে হলে লাগবে মোটা শেকল আর শক্তিশালী ট্রাক্টর।

আবারও নিচের ছায়ায় নেমে পরীক্ষা করেছে দেয়ালের প্রতিটা পাথর। দু’স্তরে গেঁথে বোধহয় তৈরি করা হয়েছে পুরু দেয়াল। আসলে কিছু করার নেই ওর। আগেই পরখ করেছে দরজা। ওটা লোহার মোটা পাত দিয়ে তৈরি। কবজা, হ্যাণ্ডেল ও নিভেট সবই বাইরের দিকে। সব দেখা হলে বাঙ্কে এসে শুয়ে পড়েছে হতাশ রানা। হাতুড়ি পেলে দরজা ভাঙত। কিন্তু তেমন কিছু নেই ঘরে।

পাথুরে কুঠরিতে বন্দি হলেও বেশি অসহায় বোধ করছে রানা ভিন্ন কারণে। আটকা পড়েছে চিন্তার জালে। বারবার মন বলছে: লিয়া নেই! ওকে বাঁচাতে পারোনি! ওর মৃত্যুর দায় আসলে তোমার! ভেবেছিলে ওই আশ্রম নিরাপদ? তা ছিল না! তোমার দোষেই ভীষণ আতঙ্কের মধ্যে অসহায়ভাবে খুন হয়েছে লিয়া!

আর কিডন্যাপ হয়ে গেছে বাচ্চা মেয়েটা।

সময়মত উদ্ধার করতে না পারলে খুন হয়ে যাবে।

নিশ্চিত ওই মৃত্যু ঠেকাতে হলে আগে বেরোতে হবে এই বন্দিশালা থেকে। অন্তত চেষ্টা করতে হবে। তাতে মরলেও দুঃখ নেই ওর।

আগামীকাল শুরু হবে সেই বিপজ্জনক মিশন। ও যে ধরনের ইকুইপমেন্ট চাইবে, সবই নাকি দেয়া হবে—বলেছে কোবরা। ভেহিকেল, উপযুক্ত পোশাক, নগদ টাকা, অস্ত্র আর সেল ফোন। কিডন্যাপ করবে রানা এডি অ্যামনকে। কাউণ্ট কোবরা বলেছে, কাজটা শেষ হলেই মুক্তি দেবে ওকে। তবে লোকটা যেমন জানে, রানাও জানে: ওটা মিথ্যা প্রলোভন। ওর মুক্তি নেই। কারণ, সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেবে ও। কাজেই…

লোহার দরজায় ঘুষি মেরে মুঠো রক্তাক্ত করলে কোন লাভ নেই। আর রাগে চিৎকার করা তো একেবারেই নিরর্থক।

বিক্ষিপ্ত মন শান্ত করতে বাঙ্ক থেকে নামল রানা। হতক্লান্ত শরীরে মেঝেতে শুরু করল বুকডন। ব্যথায় টনটন করছে পেশি। একশ’টা বুকডনের পর না থেমে একই ব্যায়াম চালিয়ে গেল আরও একশত বার। মাংসপেশির ভয়ানক যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিল মানসিক যাতনা। ব্যায়াম শেষে প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। ভাবতে লাগল, এরপর কী করবে।

অবশ্য তখনই দরজার কাছ থেকে এল চাবির মৃদু ঝনঝন শব্দ। ঘুরে গেল তালার ভেতরের যন্ত্রাংশ। দরজা খুলে যেতেই করিডোর থেকে ঘরের মেঝেতে পড়ল এক ফালি হলদে আলো। কে যেন ঢুকল কুঠরির ভেতর।

মহিলা। আতঙ্কগ্রস্ত। দ্বিধান্বিত।

তাকে চিনল রানা। চাপা রাগ নিয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি এখানে কেন?’

‘না এসে পারিনি,’ বলল মেয়েটা। হলদে আলোয় রানা দেখতে পেল তার চোখ ভেজা।

‘ঢুকলে কী করে? চাবি পেলে কোথায়?’

ছায়ায় ঝম্ করে উঠল একগোছা চাবি। ফিসফিস করল মেয়েটা, ‘স্টাডিরুমে আরেক সেট চাবি রাখে লুকা ব্রুনার।’

‘মেরি বার্নলে বা যা-ই নাম হোক তোমার, কী চাও বলে বিদায় নাও এখুনি।’

চোখ সরু করে ঠোঁটে আঙুল রাখল ক্রিস্টা। ‘শ্শ্! এদিকেই আছে মাইক বুচার। তোমার সঙ্গে দেখা করেছি জানলে স্রেফ খুন করে ফেলবে আমাকে।’

‘তা হলে বরং তাকে ডাকি,’ বলল বিরক্ত রানা, ‘খুনের দৃশ্যটা দেখতে খারাপ লাগবে না আমার।

‘যা করেছি, সেজন্যে আমি দুঃখিত,’ বলল ক্রিস্টা।

‘তাই নাকি?’

পা টিপে রানার সামনে এসে থামল ক্রিস্টা। জানালার আলোয় রানা দেখল, আতঙ্কিত দুই জ্বলজ্বলে চোখ।

নিচু গলায় মেয়েটা বলল, ‘আমার নাম ক্রিস্টা গুন্থার। সত্যিকারের নাম। আমি কোনও মিথ্যা বলছি না।’

‘তোমার নাম দিয়ে আমি কী করব?’ বলল রানা, ‘মতলবটা বাতলাও।

‘বাচ্চা মেয়েটাকে ধরে এনেছে এরা,’ বলল ক্রিস্টা। ‘তা-ই জানাতে এসেছ?’

‘সাহায্য করতে চাই,’ ফিসফিস করল ক্রিস্টা। ফ্যাস- ফেঁসে কণ্ঠে তাড়া দেয়ার ভঙ্গি।

‘কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না,’ বলল রানা। ‘তোমাকে ডার্ট মেরে অজ্ঞান না করে উপায় ছিল না। আমার কথা বিশ্বাস করো, প্লিয!’

‘কেন বিশ্বাস করব?’

‘কারণ, আমি সাহায্য করতে পারব। আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি এদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানি।’

মেয়েটা অভিনয় করছে না। সত্যিই আছে ভীষণ ভয়ের ভেতর, টের পেল রানা। ‘তা হলে সব খুলে বলো।’

‘লুকা ব্রুনার পার্টি দেবে,’ বলল ক্রিস্টা। ‘তার দলের গণ্যমান্যরা ওখানে থাকবে। কাকে যেন খুন করবে তারা।’

‘সেই লোকের নাম কী?’ জবাব যদিও আগেই জানে, তবু জিজ্ঞেস করল রানা।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ক্রিস্টা। ‘গুরুত্বপূর্ণ কেউ। নাম আমার জানা নেই। তবে এটা জানি, এ ধরনের পার্টি দিলেই কাউকে না কাউকে খুন করে ব্রুনার। ওটা সিগনালের মত। খুনটা করা হয় রাত নয়টা থেকে দশটার ভেতর। সেসময়ে পুরোদমে চলে পার্টি। অতিথিরা মজে থাকে নানা ধরনের মদ ও বাদ্যযন্ত্রের সুরের ঘোরে। লুকা ব্রুনারের দলের লোক এক এক করে সরে নেমে যায় বাড়ির নিচের মন্দিরে। আর তখনই খুন করা হয় কাউকে না কাউকে।’

‘এরা কারা? যারা খুন করছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘সবাই ব্রুনারের ব্যবসায়িক পার্টনার। আর কিছু জানি না। বয়স্ক লোক সবাই। নীচ। রাজনীতি বা টাকার জন্যে পারে না এমন কিছু নেই। প্রয়োজনে যাকে খুশি খুন করে।’

‘ঠিক কোথায় খুনটা করা হবে?’ জানতে চাইল রানা।

দু’চোখে আতঙ্ক নিয়ে লোহার দরজাটা দেখল ক্রিস্টা। ‘বাড়ির নিচে একটা মন্দির আছে। আমার মনে হয় ওখানেই মানুষ খুন করে। জায়গাটা নিজে কখনও দেখিনি। সবসময় দরজায় তালা দেয়া থাকে।’

‘গম্বুজের মত ছাত, দূরে দূরে পিলার? মেঝেতে দাবার বোর্ডের মত সাদা-কালো টাইলস্?’

‘জানি না,’ বলল ক্রিস্টা, ‘হয়তো। আরেকটা কথা তোমাকে জানাতে চাই। ওই বাচ্চা মেয়েটার ব্যাপারে।’

‘এমিলি?’

মাথা দোলাল ক্রিস্টা। ‘ওকে খুন করবে। গুরুত্বপূর্ণ লোকটা মারা যাবার পর। ব্যবহার করবে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন।

কড়া চোখে ওকে দেখল রানা। ‘আমাকে কেন এসব বলছ? এমিলি খুন হলে তোমার কী?’

‘আমি চাই না ওর ক্ষতি হোক,’ বলল ক্রিস্টা। ‘তুমি হয়তো ওই পিশাচগুলোর হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে। ওর চোখে অনুনয়ের দৃষ্টি। একবার লোহার দরজা দেখে নিয়ে কাতর স্বরে বলল, ‘এদের পৈশাচিকতা দেখতে দেখতে প্রায় পাগল হয়ে গেছি আমি।’ গলা আরও নিচু করল ক্রিস্টা, ‘লুকা ব্রুনার যখন বলল মেয়েটার কথা, তখনই বুঝেছি কিছু না কিছু করতে হবে। প্লিয, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমার যদি উপায় থাকত, তোমাকে ধরিয়ে দিতাম না। কিন্তু ওই এলাকার প্রতিটা গলির মুখে ছিল তার সশস্ত্র লোক। তাদের চোখ এড়িয়ে বেরোতে পারতে না। তা ছাড়া, আমি নিজেও তিন বছরের বেশি ধরে ওই লোকের হাতে জিম্মি নামী-দামি লোকগুলোকে জালে পুরতে আমাকে দিয়ে ফাঁদ পাতে।’

চুপচাপ সবদিক ভেবে দেখছে রানা। একটু পর জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা এখন বাড়ির কোথায় আছি?’

‘এটা ভিয়েনার কাছে আর্নস্টব্রানের পুরনো মিলিটারি বেস। গোটা কম্পাউণ্ড কিনে নিয়েছে লুকা ব্রুনার।’

‘এমিলিকে কোথায় রেখেছে?’

‘তার বাড়িতে।’

‘কাউন্ট কোবরার ম্যানশনে?’

চট করে মাথা দোলাল ক্রিস্টা। ‘একটা ঘরে তালা মেরে আটকে রেখেছে। বাইরে গার্ড আছে।’

‘ওই ম্যানশনটা কোথায় সংক্ষেপে বলো,’ বলল রানা। ‘ভিয়েনার ছয় কিলোমিটার উত্তরে। তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। আমিও পালিয়ে যাব। গাড়িও তৈরি রেখেছি।’

বাইরে ভারী লোহার দরজা খোলার খটাং-খট্ শব্দ শুনল ওরা। সরু করিডোর ধরে আসছে ভারী বুটের আওয়াজ। শ্বাস আটকে ফেলল ক্রিস্টা। ‘ওই যে বুচার। আসছে! এবার আমাকে খুন করবে!’

থমকে গেছে রানা।

মেয়েটা কোথাও লুকাতে পারবে না।

পায়ের আওয়াজ পৌছে গেছে কুঠরির দরজার কাছে। হাতে একদম সময় নেই!

‘আমাকে চুমু দাও,’ বলল রানা। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে।

অবাক হয়ে ওর চোখ দেখল ক্রিস্টা, তারপর বুঝল। এ ছাড়া উপায় নেই ওদের। রানাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। উষ্ণ, ভেজা ঠোঁট চেপে বসল রানার নিষ্ঠুর ঠোঁটের ওপর।

দড়াম করে খুলে গেল কুঠরির লোহার দরজা। করিডোরের হলদে আলোয় রানা দেখল, চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে মাইক বুচার। ওদেরকে দেখেই কর্কশ শব্দে হেসে উঠল সে। ‘ওউ? প্রেমকাহিনী? তবে তো বুড়ো হাবড়া শালা ঠিকই বলেছিল! যৌবনের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ছুটে এসেছ এখানে? আমাকে কিছুতেই পছন্দ হলো না, না?’

‘একবার দেখেই আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি, ‘ বেসুরো কণ্ঠে বলল ক্রিস্টা। এক পা পিছিয়ে গেল রানার কাছ থেকে। লোহার চৌকাঠ নিচু বলে মাথা নুইয়ে কুঠরিতে ঢুকল বুচার। খপ্ করে ধরল ক্রিস্টার কবজি। একটানে সরাল দরজার দিকে। টিটকারির হাসি তার মুখে। কর্কশ স্বরে বলল, ‘বিরাট বিপদে পড়ে গেছ, হারামজাদি!’

‘ওকে মারধর কোরো না,’ বলল রানা, ‘দোষটা আমার।’ ঠোট বাঁকা করে হাসল বুচার। ‘তোমার দোষ? কী করে? এই শালী তো কয়েক দিন ধরে তোমাকে নিয়ে শয়নে-স্বপনে বাসররাত কাটাচ্ছে!’

‘দয়া করে ব্রুনারকে কিছু বোলো না,’ অনুনয়ের সুরে বলল ক্রিস্টা। ‘আমাকে খুন করবে।’

‘তা ঠিক,’ বলল বুচার। ‘এতই কষ্ট দিয়ে খুন করবে, যতটা করেনি অন্য কাউকে।’ হঠাৎ ব্রিটিশ সাইকোপ্যাথের চোখে জ্বলে উঠল কামনার লাল আগুন। আজকে ক্রিস্টাকে বাগে পেয়েছে সে। এমন সুযোগই এত দিন খুঁজছিল। চাপা স্বরে বলল, ‘আমরা হয়তো একটা চুক্তি করতে পারি বিছানায় শুয়ে।’ রানার দিকে চেয়ে চোখ টিপল সে।

রানা দেখছে বুচারের বেল্টে ঝুলছে বেরেটা ৯২। মাত্র চার পা যেতে পারলে হয়তো ওটা হাতে পাবে। লোকটা বুঝবার আগেই ভেঙে দেবে তার ঘাড়। এরপর পিস্তল হাতে বেরিয়ে শেষ করবে তার দলের অন্যদেরকে।

এটাকে পরিকল্পনা বলা যায় না। বড় জোর অতিকল্পনা। তবে কাজ হতেও পারে হয়তো।

এক পা এগোল রানা। পরক্ষণে আরেক পা।

বুচারের বাহুডোর থেকে ছুটতে চাইছে ক্রিস্টা। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকল পাঁচজন সশস্ত্র গার্ড। কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না। প্রত্যেকের অস্ত্র রানার বুকে তাক করা।

পরিস্থিতি বুঝে কাঠের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল রানা।

‘পরে তোমার সঙ্গে খোশগল্প হবে, রানা,’ হাসল বুচার। ক্রিস্টাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। তার পিছু নিল গার্ডরা। ধুম্ করে বন্ধ হলো লোহার দরজা। ক্লিক শব্দে আটকে গেল তালা।

আবারও ঘরে একা হয়ে গেল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *