1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৮

আট

আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। মুখ ভারী করেছে ভিয়েনার কালচে আকাশ। যে-কোনও সময়ে ঝরঝর করে শুরু হয়ে যাবে তুষারপাত। পুরনো গ্রেটকোটের গলার বোতাম আটকে নিল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট লুদভিগ কেইলম্যান।

একবার কাউকে দেখলে তার চেহারাটা কখনও ভোলে না সে, তাই ব্যস্ত স্কয়্যারের ভিড়ে চেনা মেয়েটাকে দেখেই পিছু নিয়েছে।

একদল টুরিস্টের ভেতর দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছে মেয়েটা। পরনে নেভি-ব্লু কেইপ, সঙ্গে ম্যাচ করা বেরেই। দুটোই দামি ও অভিজাত। টার্গেটের তিরিশ গজ পেছনে থাকল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেইলম্যান। সামনের একটা টি- রুমে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।

দোকানটা পাশ কাটাবার সময় কাঁচের দেয়ালের ওদিকে চোখ বোলাল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। ধনীদের জন্যে রুচিশীলভাবে সাজানো টি-রুম। ভিয়েনায় এ ধরনের রেস্তোরাঁর অভাব নেই—যে-কারও মনে হবে যেন অতিরিক্ত কারুকাজ করা একটা ওয়েডিং কেক। এ ধরনের অতিরিক্ত আভিজাত্য দেখলে গা জ্বলে সাদামাঠা মানুষ কেইলম্যানের।

দূরের কোণে চেয়ার টেনে বসেছে যুবতী, হাতের পাশেই নীল কেইপ। হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে চকচকে পেপারব্যাক বইটা নিয়ে মন দিল ওটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে টি- রুমে ঢুকল সার্জেন্ট। মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখবে এমন একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসল। গ্রেটকোটের পকেট থেকে নিউজ পেপার বের করে মেলে ধরল নাকের কাছে। গোপনে চোখ রেখেছে মেয়েটার ওপর। তার গোল মার্বেলের টেবিলটা বড় বেশি ছোট। ভারী ওজনের চাপ সামলাতে গিয়ে মচমচ আওয়াজ তুলছে হালকা চেয়ার। চারপাশের সব ঝকঝকে, তকতকে।

একবছর আগে অ্যালেক বেকারের লাশ লেক থেকে উদ্ধার করা হলে মেরি বার্নলেকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেইলম্যান ছিল অফিসার ইন চার্জ।

সেসময়ে মেয়েটার চুল ছিল সোনালি ও দীর্ঘ। এখন তার চুল হয়ে গেছে ববকাট, কালো রঙের। প্রায় চেনাই যাচ্ছে না তাকে। তবে ঘড়েল গোয়েন্দা কেইলম্যান। মেয়েটাকে চিনতে ভুল হয়নি তার। এই মুহূর্তে ধূসর-নীল চোখদুটো মেন্যু দেখছে। একটু পর হাতের ইশারায় ডাকল এক ওয়েইটারকে। স্যাকার টর্ট ও ক্রিম আর সবুজ শার্ট্রোয় দেয়া গরম কোকোর অর্ডার দিল। –

লোভী কুত্তী, মনে মনে বলল সার্জেন্ট কেইলম্যান। হঠাৎ করেই নিখুঁত হয়েছে তোর জার্মান উচ্চারণ!

এ যে সেই একই মেয়ে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এসপ্রেসো কফির অর্ডার দিল সার্জেন্ট। কালো হতে হবে ওটাকে। চিনি একদম চলবে না। মচমচ শব্দ করা চেয়ারে হেলান দিয়ে পেপার পড়ছে এমন ভঙ্গি করল সে। মনের ভেতর ঘুরছে অ্যালেক বেকারের সেই কেসটা।

মেরি বার্নলে। তখন বয়স বলেছিল চব্বিশ। জাতীয়তা আমেরিকান। একবছর আগে সে ছিল সুইট্যারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রদূত ডেভিড বিউলারের স্ত্রী। দক্ষতার সঙ্গে চাপা দেয়া হয় বেকারের সঙ্গে তার মাখামাখির খবর। দূতাবাসের অফিসাররা · কেলেঙ্কারি ঢাকতে হামলে পড়েছিল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ওপর। কোনভাবেই যেন প্রকাশ না পায় দূতের স্ত্রীর সঙ্গে নটখট চলছিল সাধারণ এক ব্রিটিশ যুবকের। জিজ্ঞাসাবাদের সময় খুব কাঁদছিল মেয়েটা। সবই রেকর্ড করেছে লুদভিগ। আর তার পরেই চাপা পড়ল সেই ফাইল। তার কয়েক দিন পর খোঁজ নিতে গিয়ে সার্জেন্ট বুঝল, গায়েব হয়ে গেছে প্রতিটা রেকর্ড। সঠিক সময়ে করোনার-এর রিপোর্ট হাতে এলেও তদন্তে নামল না কেউ। ওই কেসের বিষয়ে হাল ছেড়ে দিল সবাই।

ভোলেনি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেইলম্যান। এখানে- ওখানে একটু খোঁজ নিতেই পুলিশের ওপরমহল থেকে ওকে হুকুম দেয়া হলো: এ কেসের ব্যাপারে তদন্ত বন্ধ করো। স্পর্শকাতর বিষয়।

শত শত ফাইলের নিচে চাপা পড়ল কেসটা। তার কয়েক দিন পর কেইলম্যান জানল, অস্ট্রিয়া থেকে সরিয়ে দূরের এক দেশে তিন বছরের জন্যে দূত করা হয়েছে ডেভিড বিউলারকে। লুদভিগের যতটা মনে পড়ে, তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল মেক্সিকোতে। এরপরেও বেশ কয়েক সপ্তাহ চারদিকে চোখ রেখেছিল সার্জেন্ট।

তো এই মেয়ে সেই দূতের স্ত্রী হলে, এখন এখানে কী করছে সে? ক্রিসমাসের জন্যে বেড়াতে এসেছে বান্ধবীদের কাছে? হয়তো তা-ই। সেক্ষেত্রে খামোকা নিজের সময় নষ্ট করছে লুদভিগ। ষোলো বছর ধরে পুলিশের চাকরি করছে। কেন যেন তার মন বলছে, এসবের ভেতর ভিন্ন কিছু আছে। পুরুষদের টয়লেটে একটা কিউবিকলে ঢুকে পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিল সে। টি-রুমের মেন্যুতে দেখা ফোন নম্বর অনুযায়ী কল দিল। কাজ শেষে আবারও গিয়ে বসল নিজের টেবিলে। কফি ফুরোতেই কাউন্টার থেকে এল ম্যানেজারেসের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর: ‘এক্সকিউয মি, লেডিস অ্যাণ্ড জেণ্টলমেন, আপনাদের ভেতর কি মেরি বার্নলে আছেন? তাঁর জন্যে জরুরি মেসেজ আছে আমার কাছে। …কেউ নেই এ নামে?’ চারদিকে চোখ বোলাল ম্যানেজারেস। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবারও মন দিল নিজের কাজে।

মেরি বার্নলে নামটা শুনেই বরফের মূর্তি হয়েছে সুন্দরী যুবতী। ঠোঁটের কাছে কাপ তুলেও নামিয়ে রাখল টেবিলে। কোকো শেষ না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল, নার্ভাস। খবরের কাগজের আড়ালে হাসল লুদভিগ কেইলম্যান। ভাবছে: আজ তোকে বাগে পেয়েছি, বেটি!

কেইপ আর ব্যাগ তুলে নিয়ে আধখাওয়া স্যাকার টর্ট ফেলে কাউণ্টারে গেল মেয়েটা। পাওনা মিটিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল টি-রুম ছেড়ে।

টেবিলের ওপর পয়সা রেখে নকল মেরি বার্নলের পিছু নিল ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেইলম্যান। শত শত শপারের মাঝ দিয়ে হাঁটছে মেয়েটা। হাত নেড়ে দাঁড় করাল একটা ট্যাক্সি। ভিড়ের ভেতর কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এগোল সার্জেন্ট কেইলম্যান। তবে ট্যাক্সি বিশ ফুট দূরে থাকতেই ওই গাড়িতে উঠে পড়ল মেয়েটা। ধুপ্ শব্দে বন্ধ হলো পেছনের দরজা। রাস্তায় গাড়ির স্রোতে দেখতে না দেখতে মিলিয়ে গেল ট্যাক্সি।

‘ধুশালা!’ বলে আবারও টি-রুমে ফিরল কেইলম্যান। ম্যানেজারেসকে নিজের পুলিশের ব্যাজ দেখাল। ‘পোলিযেই। দু’মিনিট আগে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে এক মহিলা। পেমেন্ট দিয়েছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। আমি তার নাম জানতে চাই।’

ঠাণ্ডা মাথায় কাউন্টারে রাখা ক্রেডিট কার্ডের স্লিপগুলো দেখল ম্যানেজারেস। ওপরের স্লিপটা নিয়ে সার্জেন্টের হাতে দিল।

চট্ করে নাম পড়ল কেইলম্যান। ক্রেডিট কার্ডের স্লিপে মেরি বার্নলে নামটা নেই। ওই মেয়ের নাম এখন জেনিসা ব্রোসেট!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *