আটত্রিশ
আধঘণ্টা পর কফি, পাউরুটি টোস্ট ও ডিমের গন্ধে নিজের ঘর থেকে বেরোল লিয়া। নিচতলা থেকে আসছে আন্তরিক আলাপ ও হাসি। দু’সারি সরু সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে রানা আর এমিলিকে দেখতে পেল লিয়া। টেবিলে বসে তাস দিয়ে নড়বড়ে এক বাড়ি তৈরি করছে ওরা। ছাত হিসেবে খুব সাবধানে শেষ তাস বসাল রানা। ধীরে ধীরে সরিয়ে নিল হাত। একটু টলমল করলেও টিকে গেল ওর সৃষ্টি। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছে এমিলি, এবার বড় করে শ্বাস নিয়ে ফুঁ দিল বাড়ির ওপর। টেবিলে ছড়িয়ে গেল তাসগুলো।
‘অ্যাই, তুমি চিটিংবাজি করছ!’ আপত্তি তুলল রানা।
খিলখিল করে চেয়ারে দুলে দুলে হাসতে লাগল এমিলি।
ওপর থেকে সব দেখছে লিয়া। ভাবছে, যে কখনও সংসার করবে না, তেমন একজন মানুষ কীভাবে এত সহজে খেলতে পারে বাচ্চাদের সঙ্গে! রানাকে প্রিয় বন্ধু হিসেবে ধরে নিয়েছে এমিলি। এখন মানুষটার ভেতর একফোঁটা কঠোরতা নেই। হঠাৎ কয়েক বছর আগের সেই হাসিখুশি রানাকে মনের চোখে দেখতে পেয়ে নিজেকে শাসন করল লিয়া: ‘লিয়া, খবরদার, আবারও ওকে কাছে টানতে যাস নে!’
লিয়াকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে লজ্জা পেয়ে হাসল এমিলি। ওপরতলায় পায়ের আওয়াজ শুনে তড়িঘড়ি করে বলল, ‘বাবা উঠে পড়েছে! লিয়া, আপনি সিঁড়ি থেকে জলদি নেমে পড়ুন!’
‘কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল লিয়া।
‘কারণ বাবা উঠলে জো-ও উঠবে। আর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলে ও একেবারেই থামতে পারে না। শেষে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবেন। জো সবসময় ওই কাজটা করে। খুশিতে ঝলমল করে উঠল এমিলির দু’চোখ। কালো একটা বিরাট কামানের গোলার মত সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে নামছে বিশাল কুকুরটা! ‘ওই যে এল!’
সংঘর্ষ এড়াতে সিঁড়ির একপাশে সরল লিয়া। লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল এমিলি। কুকুরটাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ‘চল্, জো! তোকে নাস্তা দেবেন সিস্টার বার্য।’ খুলে ধুম্ করে বন্ধ হলো দরজা। নীরবতা নামল ফার্মহাউসের ভেতরে।
‘মেয়েটা খুব মিষ্টি,’ বলল লিয়া।
‘ওর তুলনা নেই,’ নির্দ্বিধায় জানাল রানা।
‘তোমাকে খুব পছন্দও করে।’
‘আমিও ওকে খুব পছন্দ করি।’
‘তুমি চাইলে ওর মত দুটো বাচ্চার বাবা হতে পারো।’ বুকের ভিতর হঠাৎ করেই কীসের এক হুতাশ টের পেল রানা। দু’জনের জন্যে কফি ঢালল কাপে। খেয়াল করেছে, গতদিনের উত্তেজনা ও ভয় কাটিয়ে উঠেছে লিয়া। গরম কফি নিয়ে মুখোমুখি বসল ওরা। শুনতে পেল দোতলায় ধুপ-ধাপ আওয়াজ করছে লুদভিগ।
‘তোমরা কি আজই ফিরবে?’ জানতে চাইল লিয়া।
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘বিকেলের দিকে।’
‘তোমাকে ছাড়া জায়গাটা কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগবে।’
‘এটাই হয়তো তোমার জন্যে ভাল।’
কফিতে চুমুক দিল লিয়া। ‘ফিরে গিয়ে কী করবে তুমি?’
‘প্রথমে দেখা করব গ্রাফহসলার পরিবারের সঙ্গে।’
‘তোমার সঙ্গে কথা বলবে তারা?’
‘চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।’ হঠাৎ দরজার ওপরের র্যাকে চোখ পড়েছে রানার। ‘আরে, আগে তো এটা দেখিনি!’ র্যাকের ওপর রয়েছে একটা ডাবল ব্যারেল শটগান। চেয়ার ছেড়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। নামিয়ে নিল বন্দুকটা। ‘ভাল অস্ত্র মনে হচ্ছে!
‘তবে পুরনো আমলের।’
‘হ্যাঁ, বয়স অন্তত এক শ’। তবে রাখা হয়েছে খুব যত্নে।’ কাঠের বাঁট ও ব্যারেল দেখল রানা। স্টক ও হ্যামারে হাতের কারুকাজ। আধুনিক অস্ত্র নিখুঁত হলেও সেসবে এ ধরনের সৌন্দর্য থাকে না। ফলে পিছিয়ে পড়ে শিল্পের মাপকাঠিতে। এই বন্দুক রাবার ও পলিমার প্লাস্টিকের নয়। কাঠের কারুকাজ যেমন করেছে, তেমনি ভালবেসে নিখুঁত করতে চেয়েছে শিল্পী অস্ত্রটাকে।
‘এখনও কাজ করে?’ জানতে চাইল লিয়া। নাস্তা শেষ করে কফির মগ টেনে নিয়ে চুমুক দিল।
‘এসব তৈরি করা হয় প্রায় চিরকালের জন্যে,’ বলল রানা। ‘হয়তো এই বন্দুক দিয়ে খরগোশ শিকার করত কেয়ারটেকার বার্নার্ড।’ ওটার অ্যাকশন পরীক্ষা করল রানা। পুরনো ঘড়ির মত ক্লিক শব্দে উঠেছে হ্যামার। তিনটে জোরালো ক্লিক হতেই লক হয়েছে। দুটো ট্রিগার একটা আরেকটার পেছনে। এক এক করে দুই ট্রিগার টিপল রানা। মাত্র দেড় পাউণ্ড চাপেই দেবে গেছে ট্রিগার। নিয়মিত তেল দেয়া হয়েছে অ্যাকশনে। ব্যারেলে উঁকি দিয়ে রানা দেখল, ধুলোবালি, মরিচা নেই। নেড়েচেড়ে দেখল অস্ত্রটা। সহজ সুরে বলল, ‘দু’চারটে গুলি করে দেখে নেব।’ একটু খুঁজেই একটা ড্রয়ারে পেয়ে গেল এক বাক্স কার্তুজ।
বাইরে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে সাদা তুষার। ‘আমিও তোমার সঙ্গে আসব?’ জানতে চাইল লিয়া।
‘নিশ্চয়ই।’ রাবারের বুট পরে লিয়াকে নিয়ে বাইরে এল রানা। হাতের বন্দুক কাঁধে ফেলে সরে গেল কনভেন্ট থেকে।
আজ নীল আকাশ ঝকঝকে। উত্তরদিক থেকে বইছে তাজা হাওয়া। কনভেন্ট অনেক পেছনে রেখে তুষার ভরা এক টিলা পাশ কাটিয়ে গেল ওরা। একবার কনভেন্টের দিক দেখে নিল রানা। ‘এত দূর থেকে গুলির আওয়াজে হার্ট অ্যাটাক হবে না নানদের।’ দূরের পাহাড় দেখল। ‘গুলির আওয়াজে অ্যাভালাঞ্চও হবে না।’ একটা পাইন গাছে ঠেস দিয়ে বন্দুক রেখে লিয়ার দিকে তাকাল ও। ‘এবার আমাকে সাহায্য করো।’
‘কী কাজে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল লিয়া।
‘আমার চাই সত্যিকারের একটা তুষারমানব।’ দু’হাতে তুষার তুলে স্তূপ তৈরি করছে রানা।
ওর পাশে হাত লাগাল লিয়াও। হাসতে হাসতে বলল, ‘বহুদিন ছেলেমি করি না। মনে পড়ছে ছোটবেলায় অ্যালেক আর আমি তুষারমানব তৈরি করতাম। কিন্তু কাজ শেষ হলেই আমার ঘাড় ধরে পিঠে একগাদা তুষার গুঁজে দিত ও। তখন কোদাল হাতে ওকে ধাওয়া দিতাম।’
তুষারের স্তূপ তৈরি করতে করতে মৃদু হাসছে রানা।
কৌতূহলী চোখে ওকে দেখছে লিয়া।
ওর চোখে তাকাল রানা। ‘কী?’
‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না,’ বলল লিয়া।
‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘তুমি আর তোমার সৈনিক জীবন।’
‘অ্যালেক তো সব জানত।’ আরও কিছু তুষার ছোট্ট ঢিবির ওপর চাপাল রানা। ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে তুষার-মানব।
কেন যেন মনে হয়, দেবতাদের মত তোমার বুকেও কোনও পাপ নেই, বলল লিয়া, ‘সবসময় চেয়েছ দুর্বল মানুষের পক্ষ নিয়ে লড়তে, পারলে উপকার করতে।
চুপ করে থাকল রানা। চারফুট উঁচু হতেই তুষারমানবের কাঁধে বসিয়ে দিল তুষারের গোল একটা মাথা।
‘নাক চাইলে গাজর লাগবে,’ বলল লিয়া। ‘আরও চাই মাথায় উলের হ্যাট আর মুখে কাঠি। তখন দেখাবে সত্যিকারের পাইপ টানা তুষারমানবের মত।’
চোখ দেয়ার জন্যে বরফের মূর্তির মাথায় তর্জনী দিয়ে খুঁচিয়ে দুটো গর্ত করল রানা। ‘এতেই চলবে। এবার চলো।
‘কোথায়?’
গাছে ঠেস দেয়া বন্দুকের দিকে চলেছে রানা।
‘এবার বঝেছি,’ পিছু নিল লিয়া।
‘কী বুঝেছ?’
‘তুমি তুষারমানবের গায়ে গুলি করবে।’
‘ঠিক।’
‘পুরুষমানুষ… গোলাগুলি ছাড়া আর কী বুঝবে?’
‘তোমাকে বাঁচাতে হবে না ওর হাত থেকে?’ ডানদিকের ব্রিচে কার্তুজ ভরে বন্দুক আটকে নিল রানা। তিরিশ গজ দূরের ভয়ঙ্কর তুষারমানবের দিকে অস্ত্রটা তাক করল।
দুই কানে দুই তর্জনী গুঁজলো লিয়া।
ডানদিকের হ্যামার তুলে ট্রিগার টিপতেই রানার কাঁধে লাগল বন্দুকের কুঁদোর জোরালো গুঁতো। পাহাড়ে গিয়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে এল প্রতিধ্বনি।
কান থেকে হাত সরিয়ে বিড়বিড় করল লিয়া, ‘মৃত্যু- দেবতার হাতে খুন হয়েছে তুষারমানব।’
মাথাটা উড়ে গেছে ওটার।
‘আমিও চেষ্টা করে দেখব?’ জানতে চাইল লিয়া।
‘ভাল হয়,’ ওর হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিল রানা। দেখিয়ে দিল কীভাবে খুলতে হবে ব্রিচ। ওটার ভেতর থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল গুলির খালি খোসা। ধূসর ধোঁয়া বেরোচ্ছে ব্রিচ থেকে। রানার কাছ থেকে দ্বিতীয় কার্তুজ নিয়ে ওখানে ভরল লিয়া। কীভাবে কাঁধে শক্ত করে ধরতে হবে বন্দুকের বাঁট, বা গ্রিপে কোথায় থাকবে হাত, বুঝিয়ে দিল রানা।
‘ভীষণ জোরে ধাক্কা দেবে?’ জানতে চাইল লিয়া।
‘দেবে, তবে খুব বেশি নয়।’ এক পা পিছিয়ে গেল রানা।
ওকে অনুকরণ করে হ্যামার তুলল লিয়া। একটু একটু কাঁপছে হাতের বন্দুক। মাথাহীন তুষারমানবের বুকে নল তাক করে বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে টিপে দিল ট্রিগার। -বিক্ষত হলো বরফ-মানবের বুক। নানাদিকে ছিটকে গেল তুষার।
‘গুড শট,’ বলল রানা।
‘খুন করেছি!’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল লিয়া। ঘুরেই হাত থেকে বন্দুক ফেলে জড়িয়ে ধরল রানাকে। এত খুশি যে লিয়া বুঝতেও পারেনি কী করছে।
ভারসাম্য হারিয়ে ওকে নিয়ে তুষারের মেঝেতে পড়ল রানা। খিলখিল করে হাসছে লিয়া। ফিরে গেছে ছয় বছর আগে। চোখ থেকে চুল সরাল। লালচে হয়ে উঠেছে দুই গাল। চোখের পাপড়িতে মেখে আছে তুষারকণা।
হঠাৎ থমকে গিয়ে দু’জন দু’জনকে দেখল ওরা।
‘বলো তো, এসব কী করছি আমরা?’ ফিসফিস করল লিয়া।
‘জানি না,’ আলতো করে লিয়ার গাল স্পর্শ করল রানা। মনে ভর করেছে অদ্ভুত ঘোর। ওর নিষ্ঠুর ঠোঁট নেমে এল লিয়ার কোমল অধরে। আবারও হারিয়ে ফেলার ভয়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল ওরা। ভুলে গেল দুনিয়ার সবকিছু। তবে একটু পর সরে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল লিয়া। লজ্জায় গোলাপি হয়েছে ওর দুই গাল।
বুক ভরা অতৃপ্তি নিয়ে উঠে পড়ল রানা।
পোশাক থেকে তুষারকণা ঝাড়তে শুরু করে বলল লিয়া, ‘বোধহয় আর না এগোনোই আমাদের ভাল?’
অনিশ্চিত মনে চুপ থাকল রানা। অস্বস্তি নিয়ে তুলে নিল বন্দুকটা। ওটা পরিষ্কার করে বলল, ‘চলো, ফেরা যাক।’
সারাটা দিন ওরা ভাবল রঙিন ওই মুহূর্তগুলোর কথা। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়েছে ওদের সম্পর্ক। মাঝে বাধা হয়ে উঠেছে অদৃশ্য কোনও প্রাচীর। না পারবে ওটা ডিঙিয়ে যেতে, না পারবে ফিরে যেতে। বোকার মত কাজ করে বসে সকাল থেকে নিজেকে দোষ দিচ্ছে রানা: ফেলে আসা সেই অতীতের কবে যেন দু’দিকে চলে গেছে ওদের দুই পথ!
মাথা থেকে সব দূর করতে গিয়ে এমিলি ও কুকুরটার সঙ্গে বাইরে গিয়ে খেলল রানা। জো খুব বুদ্ধিমান। রানা শিখিয়ে দিল, চুপ করে বসে থাকতে হবে। তারপর তিন মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনবার হাততালি দিলেই খুঁজে আনতে হবে এমিলিকে। কয়েক বছর বয়স কম হলে জো হতো আদর্শ পুলিশ বা মিলিটারি ডগ। লুকোচুরি খেলতে দারুণ মজা ওর। ওদিকে এমিলিও আছে দারুণ ফুর্তিতে।
ধীরে ধীরে এল বিকেল। চিলেকোঠায় ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে রানা, এমনসময় পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেল। ঘুরে দেখল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে লিয়া। মেয়েটার ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি। চোখদুটো একটু ভেজা। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘সাবধানে থেকো।’ রানা কিছু বলার আগেই এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল লিয়া। রানার কানে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে আবার ভুলে যেয়ো না যেন!’
‘আবার দেখা হবে, লিয়া,’ ওর চুলের সুগন্ধি বুক ভরে টেনে নিল রানা।
‘বেশি দেরি কোরো না,’ বলল লিয়া। ওর দু’চোখের কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু পড়ল রানার ঘাড়ে। ‘আমি আবারও তোমাকে হারিয়ে ফেলতে চাই না।’
.
তুষারে ছাওয়া পথে ফিরে চলেছে মার্সিডিয। জরুরি কথা নেই বলে নীরবতা ভাঙছে না লুদভিগ কেইলম্যান। চুপচাপ পেরিয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা, একটা কথা হলো না রানা ও তার। ডুবে আছে যে যার চিন্তায়। তবে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত পেরোবার পর রানা জানতে চাইল, ‘মাদার সুপিরিয়রের সঙ্গে তোমার পরিচয় কীভাবে?’
‘পত্রিকার কলামিস্ট ছিলেন। পেছনে লেগে গিয়েছিল প্রভাবশালী একদল ব্যবসায়ী। কয়েকবার হামলা হওয়ার পর পরিচয় হলো তাঁর সঙ্গে। বাজে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তাঁকে বললাম, বাঁচতে হলে অস্ট্রিয়া ছেড়ে কোথাও চলে যেতে হবে তাঁকে।’
‘তারপর?’
‘জানালেন, তাঁর কোথাও যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি নেই। তখন ধরলাম পরিচিত এক মোহন্তকে। তিনি প্রস্তাব দিলেন, স্লোভেনিয়ায় বহু দূরের এক কনভেন্টে ঠাঁই দিতে পারবেন মিস বোমেইস্টারকে। চুপ করে গেল লুদভিগ। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘এমনিতেই আত্মীয়-স্বজন ছিল না, রাজি হলেন। তাও অন্তত পনেরো বছর আগের কথা। বুদ্ধিমতী মহিলা। একসময়ে হয়ে গেলেন মাদার সুপিরিয়র। এখন আর লেখালেখির সময় পান না।’
‘তার মানে তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলে,’ বলল রানা।
মাথা নাড়ল লুদভিগ। ‘তা নয়। নিজে কিছুই করতে পারতাম না। আমি শুধু দু’একটা সুতোয় টান দিয়েছি।’
‘তোমার ডিপার্টমেন্টের কাউকে বিশ্বাস করো?’
‘মাত্র তিনজনকে। ওরা আমার নিজ হাতে তৈরি। অন্যদের কথা বলতে পারব না।’
‘তোমার সেই চেনা সুপিরিয়র অফিসার?’
‘কমপক্ষে দশ বছর ধরে তাঁকে চিনি। ভুলেও নিজেকে নোংরামির ভেতর জড়াবেন না। তবে ওপর থেকে আদেশ এনে অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে তাঁকে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না।’
পিছিয়ে যাচ্ছে পিচঢালা পথ।
আবারও নীরব হলো ওরা।
রানা জানে, অস্ট্রিয়ায় চট্ করে পিস্তল বা গুলি পাওয়া খুব কঠিন। হাতে সময়ও পাবে না যে রানা এজেন্সি বা গগলের মাধ্যমে ওগুলো সংগ্রহ করবে। অনেকক্ষণ পর আবারও নীরবতা ভাঙল রানা, ‘আমার জরুরি কিছু জিনিস দরকার।’
‘কী ধরনের?’
‘পিস্তলের গুলি,’ বলল রানা, ‘ক্যালিবার ফোর্টি-ফাইভ। পিতলের জ্যাকেট পরা। ভাল কণ্ডিশন হতে হবে। অন্তত দু’শ’ রাউণ্ড। ফেডারেল অথবা রেমিংটন কোম্পানির।’
‘দেখি জোগাড় করতে পারি কি না, বলল লুদভিগ। ‘নইলে অন্য পিস্তল হলেও চলবে। তবে নাইন এমএম- এর কম না হলেই ভাল।’
চেনা এক লোককে বলব। আশা করি জোগাড় করে দিতে পারবে।’
ঝড়ের বেগে চলেছে গাড়ি। কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল লুদভিগ, ‘এমিলিয়া আর তোমার কাহিনীটা কী?’
দ্বিধা নিয়ে জবাব দিল রানা, ‘কোনও কাহিনী নেই।’
‘তা তো বুঝতেই পেরেছি।’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘একসময়ে ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তবে কিছু কারণে আর মিলন হয়নি।’ আর কিছু বলার নেই ওর।
—ঠিক আছে, নাক গলাতে চাই না,’ বলল লুদভিগ, ‘তবে একটা কথা বলতে চাই।’ চুপ হয়ে গেল সে।
‘বলো।’
‘মেয়েটা তোমাকে ভালবাসে। তুমি ওকে পছন্দ করে থাকলে সময়টা নষ্ট কোরো না।’
লুদভিগের দিকে তাকাল রানা।
পাথরের মত চেহারা করে গাড়ি চালনায় ব্যস্ত লোকটা। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘জীবনে সবাই ভালবাসা পায় না, রানা।’ খুব নিচু স্বরে জানাল, ‘আমি জানি, কারণ মারা গেছে আমার মনের মানুষ।’