1 of 2

কাউণ্ট কোবরা – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

বুচারের ঘুষিটা রানার নাকে-মুখে লাগার আগেই এল কড়া নির্দেশ: ‘হল্ট!’

মাঝপথে ঘুষি থামিয়ে ঘুরে তাকাল বিশালদেহী ব্রিটিশ সাইকোপ্যাথ। এইমাত্র হ্যাঙারে পা রেখেছে ষাটোর্ধ্ব ছোটখাটো এক লোক।

শরীরটা শিথিল করল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল হুকুম- দাতাকে। তার সঙ্গে আসছে চারজন বডিগার্ড, হাতে এমপি- ফাইভ সাবমেশিন গান। ছোটখাটো লোকটার পরনে কালো দামি সুট। গলায় ধূসর টাই। সুটের ওপর হাঁটু পর্যন্ত টুইড ওভারকোট। কংক্রিটের মেঝেতে খট্ খট্ আওয়াজ তুলল অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো চামড়ার দুর্মূল্য জুতো। লোকটার মুখ ঘোড়াটে লম্বা, কেমন যেন ফ্যাকাসে। নাকটা বাজপাখির চঞ্চুর মত, বাঁকা। ওটার কারণে প্রথম দর্শনে মনে হয়, সে হিংস্র কোনও শিকারী পাখি।

‘প্ল্যান বদল করেছি,’ বুচারের উদ্দেশে বলল সে। ‘ওকে নিয়ে এসো অফিসে।’ ইংরেজি নিখুঁত হলেও তার উচ্চারণে হালকা জার্মান টান।

ভীষণ হতাশ হয়েছে মাইক বুচার। চাপা স্বরে ধমকে উঠল গার্ডদের উদ্দেশে। মুঠো থেকে খুলল নাকল ডাস্টার। এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডকাফ থেকে রানার দু’হাত ছুটিয়ে দিল দুই গার্ড। কড়া ট্র্যাঙ্কুলাইযারের প্রভাবে রানার মনে হলো হুমড়ি খেয়ে পড়বে মেঝেতে। তবে নিজের সম্মান রক্ষার্থে টলমল করেও কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকল। কাটাতে চাইছে চোখের ঘোলাটে ভাব।

ওর পিঠে পিস্তলের নল দিয়ে খোঁচা দিল এক গার্ড। বাধ্য হয়ে হ্যাঙারের আরেকদিকে চলল রানা। অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর শেষে সামনে পড়ল স্টিলের চওড়া দরজা। ওটা খুলে দিল বুচার। আরও কিছুটা যাওয়ার পর খোলা এক দরজায় হাজির হলো ওরা। ভেতরের ঘরে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। পেছনদিকে একটা ডেস্ক আর দুটো মনিটরসহ একটা কমপিউটার।

টিউবের তৈরি চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে রানাকে বসাল এক গার্ড। ঝিমঝিম করছে ওর মাথা। পেটে ঘুষির টনটনে ব্যথা। পরিষ্কার করতে চাইছে মগজের ধূসর মেঘটা।

ডেস্ক ঘুরে ওর উল্টো দিকে সুইভেল চেয়ারে বসল প্রৌঢ়। নরম অথচ স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘আমার নাম লুকা ব্রুনার।’

ভাল করেই চেনে তাকে রানা। এই লোকই বর্তমান কাউণ্ট কোবরা।

পুরো একমিনিট মরা সাপের স্থির দৃষ্টিতে রানার চোখ দেখল লোকটা।

সে কী ভাবছে, বুঝতে চাইছে রানা।

কৌতূহল নিয়ে ওকে দেখছে লুকা ব্রুনার। চকচকে চোখে সামান্য বিস্ময়। হাতের ইশারায় বিদায় হতে বলল গার্ডদেরকে। প্রশিক্ষিত কুকুরের মত নীরবে বিদায় নিল তারা। ভাল করেই জানে, ব্রুনার নির্দেশ দিলে মুহূর্তমাত্র দেরি না করে তা পালন করতে হয়।

পকেট থেকে সিডি-রম বের করে কাউন্টের হাতে দিল মাইক বুচার। ‘এর সঙ্গে ছিল, স্যর।’

ডিস্কটা উল্টেপাল্টে দেখল ব্রুনার। তার আঙুল সরু ও দীর্ঘ। সিডি-রম ভরল কমপিউটারের সিডি ড্রাইভে। মৃদু আওয়াজে জিনিসটা লোড হতেই নীরবে হেলান দিল চেয়ারে। চুপচাপ দেখছে ভিডিয়ো। তার চশমার কাঁচে ছায়াছবির প্রতিচ্ছবি দেখছে রানা।

ভিডিয়ো শেষ হলে শান্ত ভঙ্গিতে ইজেক্ট করে আবারও ডিস্কটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। শীতল চোখে তাকাল রানার চোখে। পরক্ষণে আঙুলের চাপে মট্ করে ভাঙল সিডি- রম। টেবিলে টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিয়ে শুকনো গলায় বলল, ‘নিজের জিভ যে সামলে রাখতে পারে না, তার পরিণতি এমনই হয়। ওটা আমার কাছে আনার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

তুলে নিল কার্ডবোর্ডের টিউব। ওটার ভেতর থেকে নিল মোযার্টের হলদেটে চিঠি। মোড়ানো কাগজ খুলে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং। এতক্ষণে প্রায় সব বুঝলাম। রিসার্চ করছিলেন মিস্টার অ্যালেক বেকার।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটানে চিঠিটা দুই টুকরো করল সে। পরেরবার ছিঁড়ে ওটা হলো চার টুকরো। হলদে কাগজ বামহাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুলে ধরে ডানহাতে আবারও ছিঁড়ল। গ্যারি বেকারের প্রিয় চিঠি আরও কয়েকবার ছেঁড়ার পর ছড়িয়ে দিল টেবিলের ওপর। বামহাতে মেঝে থেকে নিল ওয়েস্টপেপার বাস্কেট। ডানহাতে কাগজের টুকরোগুলো ঠেলে ফেলল ওটার ভেতর।

পুরো সময়টা চুপ করে থাকল রানা।

লুকা ব্রুনারের চেয়ারের পেছনে দু’হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে মাইক বুচার। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। রানা বুঝে গেল, ওকে খুন করতে পারলে খুব খুশি হবে সে। চট্ করে ওর মনে এল: এই লোকের কোনও পূর্বপুরুষ কি ভারত উপমহাদেশে খুন হয়েছিল? এত রাগ কেন ওর এই অঞ্চলের লোকের ওপর?

শান্ত ভঙ্গিতে সরু এক ব্রিফকেস থেকে একটা ফাইল নিল লুকা ব্রুনার। আলাপের সুরে বলল, ‘আমার ধারণা আগে থেকেই তোমরা পরিচিত। আবারও দেখা হওয়ায় খুব খুশি।’

তিক্ত মনে ভাবল রানা, মাইক বুচার আগেও কোনও কারণ ছাড়াই ওকে খুন করতে চেয়েছে। সহজ সুরে বলল রানা, ‘আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। আমার নাম হচ্ছে….

‘মরিস রেনার,’ ওর মুখের কথা কেড়ে নিল ব্রুনার। ‘হ্যাঁ, তোমার কাগজপত্র অনুযায়ী তা-ই। ভালভাবে কাগজপত্র নকল করেছে দক্ষ কোনও জালিয়াত। চট করে বোঝাই যায় না যে নকল। তবে এটা বুঝলাম না, কেন তোমার অন্যান্য ছদ্মনাম ব্যবহার করলে না।

‘আপনি ভুল লোককে ধরে এনেছেন,’ মুখ গোমড়া করল রানা। ‘আমি একজন সাংবাদিক।’

কুঁচকে গেল লুকা ব্রুনারের ভুরু। ‘খেলতে চাইছ? তাতে লাভ কী? ভাল করেই জানি তুমি আসলে কে। মিথ্যা বলে কেউ পার পাবে না।’ ডেস্ক থেকে সিডির টুকরো তুলল সে। ‘এটাও জানি, কেন এসেছিলে।’ ফাইল খুলল কাউণ্ট। তোমার নাম মাসুদ রানা। লেখাপড়া করেছ ইংল্যাণ্ড ও বাংলাদেশে। এরপর যা যা করেছ, তার সবই আছে এই ফাইলে।’ গড়গড় করে বলতে লাগল সে। বাদ পড়ল না বিসিআই এবং অন্যান্য সংস্থায় ওর পদ ও দায়িত্বের বর্ণনা। রানা নিজেও এত কিছু মনে রাখেনি।

আসলে বলার মত কিছুই নেই ওর। চুপ করে চেয়ে রইল প্রৌঢ় লোকটার দিকে।

ফাইলের পুরো দুটো পৃষ্ঠা পড়ে শোনাবার পর হাসল কাউণ্ট কোবরা। ‘তোমার রেকর্ড ঈর্ষা করার মত। আসলে সেজন্যেই চাইনি আমার সহকারী বুচার এখুনি তোমাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিক।’

লোকটা থেমে যাওয়ায় জানতে চাইল রানা, ‘আপনি আসলে কিছু চাইছেন। সেটা কী?’

‘বাঁচার সুযোগ দিতে চাইছি। তবে সেজন্যে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।’

‘কী কাজ?’

‘যে ধরনের ট্রেইনিং, তাতে তোমার জন্যে তেমন কঠিন হবে না ওই কাজ।’

চুপ করে আছে রানা।

‘এমিলিয়া বেকারের সঙ্গে দেখা করার ক’দিন আগে টার্কিতে একটা কাজ করেছ। তেমনই কিছু করবে আমার হয়ে। ইংল্যাণ্ডে আমার বেশ ক্ষতি করেছ। ফলে চরম শাস্তি দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার হয়ে কাজটা করে দিলে মাফ করেও দিতে পারি।’

‘বুঝলাম,’ বলল রানা। ‘উপযুক্ত লোক আপনার নেই।’

‘ভুল বুঝেছ,’ নির্বিকার চেহারায় হাসির সামান্য আভাস দেখা দিল। ‘আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য একজন লোক।’

‘তা হলে? নিজের দলের কাউকে জড়াতে চাইছেন না?’

এ কথার সরাসরি উত্তর দিল না লুকা ব্রুনার। বলল:

‘আমাকে খুশি করো, রানা, হয়তো প্রাণে বাঁচবে।’ দীর্ঘ আঙুল দিয়ে কিবোর্ডে ট্যাপ করল কিছুক্ষণ। রানার দিকের স্ক্রিনে মুভিং ইমেজ ফুটতেই শুকনো গলায় বলল, ‘আজ দুপুরে ওআরএফ২ টেলিভিশন এটা টেলিকাস্ট করেছে।’

রিপোর্টারের পরনে ভারী কোট। মাথায় ফারের হ্যাট। তুষারপাতের ভেতর অনর্গল কথা বলছে সে। তার পেছনে আগুনে পোড়া ধূসর পাথরের কিছু দালান। কালো কয়লা হয়ে যাওয়া কাঠের বিম ও কলাম থেকে ধোঁয়া উঠছে। এখানে- ওখানে ধিকিধিকি আগুন। একটা উঠানে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় জ্বলজ্বলে আলো নিয়ে কিছু ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। সাংবাদিকের মাথার ওপরে আকাশে ভাসছে দুটো রেড ক্রস আঁকা সাদা হেলিকপ্টার।

বাড়িঘর এতই বাজেভাবে বিধ্বস্ত, জায়গাটা চিনতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল রানার।

ওর চোখে চাপা আতঙ্ক দেখছে লুকা ব্রুনার। নিঃশব্দে হেসে হাড্ডি-সর্বস্ব আঙুলে টিপে রিমোট কন্ট্রোলের ভলিউম বাড়িয়ে দিল সে।

‘আগুনে পুড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে আশ্রম। মারা গেছেন পঁচিশজন ডোমিনিকান নান। ধারণা করা হচ্ছে, ফায়ারপ্লেস বা চুলো থেকেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এই নিদারুণ ঘটনা জানার পর সাধারণ মানুষ দাবি তুলেছে: যেন কঠোরভাবে মেনে চলা হয় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধি। এই বিষয়ে…’

আপনি থেকে তুমিতে সম্বোধন নামিয়ে জানতে চাইল রানা, ‘লিয়া আর বাচ্চা মেয়েটার কী করেছ?’

আবারও রিমোট কন্ট্রোল টিপে স্ক্রিন কালো করল লুকা ব্রুনার। ‘ওই বিষয়ে আসছি। তোমার জন্যে কিছু দুঃসংবাদ আছে। আমার ভুল না হয়ে থাকলে… ওই দুর্ঘটনায় মারা পড়েন সুন্দরী গায়িকা এমিলিয়া বেকার।’

ঠোঁট বাঁকা করে হাসি চাপতে চাইল মাইক বুচার।

‘আমি চেয়েছিলাম তাকে জীবিত,’ বলল লুকা ব্রুনার। ‘মনে আশা ছিল স্বচক্ষে দেখব তাকে। কিন্তু পরে জানলাম তার কাছে বন্দুক ছিল। কেউ না কেউ ওই জিনিস চালাতে শিখিয়েছে। কাজটা কার তা জানি না।’ হাসল কাউণ্ট কোবরা। সাপের মতই জিভ বের করে চেটে নিল নিচের ঠোঁট। ‘আমার লোকের ওপর গুলি করেছিল। ফলে বাধ্য হয়ে পাল্টা গুলি করে তারা।’

বুকের ভিতর কী যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে, টের পেল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি একটা মিথ্যুক!’

জবাবে ব্রিফকেস থেকে বের করে ডেস্কে কী যেন রাখল লুকা ব্রুনার। কাঠের ওপর মৃদু আওয়াজ। ‘বলো তো, রানা, এই জিনিস চেনো কি না?’

ওটা সোনার লকেট। গায়ে মেখে আছে শুকিয়ে যাওয়া খয়েরি রক্ত।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে চওড়া হাসি দিল মাইক বুচার। ডেস্কের ওপর দিয়ে রানার দিকে লকেটটা ঠেলে দিল কাউণ্ট কোবরা। ‘আরও কাছ থেকে দেখো।’

কাঁপা হাতে লকেট নিয়ে ওটা দেখল রানা। জিনিসটার পেছনে খোদাই করা দুটো অক্ষর: এ. বি.। অর্থাৎ: এমিলিয়া বেকার।

‘খোলো ওটা,’ বলল লুকা ব্রুনার’।

বুড়ো আঙুল দিয়ে ছোট্ট ক্যাচ-এ চাপ দিতেই খুলে গেল লকেটের ডালা। ধক ধক করে পাঁজরে হৃৎপিণ্ডের বাড়ি টের পেল রানা। লকেটের ভেতরে চোখ যেতেই দপ্ করে নিভল ওর মনের সব আশা। বুঝে গেছে, সত্যিই বেঁচে নেই লিয়া। মুখোমুখি ওই দুই ছবি অ্যালেক আর ওদের বাবা-মার।

মাত্র একদিন আগেও ওই লকেট ঝুলতে দেখেছে রানা লিয়ার গলায়।

আস্তে করে লকেটের ডালা বন্ধ করে ডেস্কে রাখল রানা। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঢোক গিলল। শুকিয়ে গেছে গলা। কর্কশ স্বরে বলল, ‘এটা জোরালো কোনও প্রমাণ নয়।’

‘বেশ। ভেবেছিলাম তোমার কষ্ট বাড়াব না। তবে জেদাজেদি করছ যখন…’ কম্পিউটারের আরেকটা ‘কি’ টিপল লুকা ব্রুনার। স্ক্রিনে ফুটে উঠল লিয়ার ছবি।

নদীর তীরে ঝোপের ধারে পড়ে আছে। অস্বচ্ছ চোখে প্রাণের চিহ্ন নেই। মুখ ও বুকে চাপ চাপ রক্ত।

অবিশ্বাস নিয়ে পাথরের মত চেয়ারে বসে আছে রানা। ভাবতে পারছে না লিয়া নেই। অথচ, বেইমান চোখ বলছে, মিথ্যা নয় কাউন্ট কোবরার কথা। রানার বুকের ভেতর কে যেন চিৎকার করছে: ‘না! এটা হতে পারে না!’

এটাই সত্যি যে আর কখনও ফিরবে না লিয়া! অথচ, ওকে বলার জন্যে রানার মনে জমে আছে কত কথা!

কিছুই ভাবতে পারছে না রানা। চোখ বুজতেই চারপাশ থেকে চেপে এল নিকষ কালো কোনও গহ্বর।

সেই অন্ধকার কালোর ভেতর বলে উঠল কাউণ্ট কোবরা, ‘ভাল করে দেখে নাও, রানা। দেখো, মৃত্যুর পরেও মেয়েটা কত সুন্দর! তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। এরই ভেতর খেয়ে না থাকলে আজ রাতেই দেহটা ছিঁড়েখুঁড়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে হিংস্র জন্তুরা।’

হঠাৎ দাউ দাউ করে রানার বুকে জ্বলে উঠল ভয়ঙ্কর ক্রোধের সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখা। মুহূর্তে ওকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিল আগুনটা। ঝট করে চোখ মেলে কাউণ্ট কোবরাকে দেখল রানা।

চুপ করে ওকেই দেখছে লোকটা। ল্যাবোরেটরিতে ইঁদুর বা গিনিপিগের দিকে যেভাবে তাকায় বিজ্ঞানীরা।

হঠাৎই লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে ডেস্কের ওপর দিয়ে পিছলে এগোল রানা। বুড়ো হারামির গণার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে দু’হাত। প্রচণ্ড ঘুষিতে মেরুদণ্ডের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে তার কণ্ঠনালী। লোকটাকে খুন করার পর যা খুশি হোক, কিছুই যায় আসে না ওর। ছটফট করে শ্বাস আটকে ভীষণ কষ্টে মরুক কুকুরটা!

কিন্তু পিছনেই তৈরি হয়ে আছে মাইক বুচার। কাউন্টের কাছে রানা পৌছুবার আগেই ওর মাথায় খটাস্ করে নামল নাইন এম. এম. পিস্তলের বাঁট। বয়স হলেও সতর্ক লোক লুকা ব্রুনার। চকচকে শু পরা পায়ে মেঝেতে ঠেলা দিয়ে সুইভেল চেয়ার নিয়ে সরসর করে পিছিয়ে সরে গেছে রানার আওতার বাইরে। একইসময়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেছে আটজন গার্ড। খপ্ করে রানাকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিল চেয়ারে। হ্যাণ্ডকাফ দিয়ে দু’হাত আটকে দিল চেয়ারের দুই হাতলের সঙ্গে।

সুইভেল চেয়ার পিছলে আবারও ডেস্কের কাছে ফিরল কাউণ্ট। স্বাভাবিক চেহারায় টাই ঠিক করতে করতে বলল, ‘বুঝলাম, তোমার কাছ থেকে সভ্য আচরণ পাব না।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘তুমি জানোও না, খুন

হয়ে গেছ আমার হাতে।’

‘তা-ই?’ হাসল ব্রুনার। ‘ভুল বললে, রানা। আমরা তো এখনও খেলতে শুরু করিনি। স্লোভেনিয়ার ওই ঘটনায় বেঁচে গেছে একজন।’ কমপিউটারের কিবোর্ডে টোকা দিয়ে একটা ভিডিয়ো আনল সে।

ওদিকে চেয়ে ঝুলে গেল রানার কাঁধ।

মেয়েটা এমিলি

ওকে কিডন্যাপ করেছে ব্রুনারের লোক।

ছোট এক কুঠরিতে হাত-পা ডাক্ট টেপ দিয়ে আটকে কর্কশ এক ম্যাট্রেসের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে মেয়েটাকে। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা। ওকে খুব দুর্বল ও ভীত বলে মনে হলো রানার।

‘দেখছ লাইভ ওয়েবক্যামের ইমেজ,’ বলল লুকা ব্রুনার, ‘তুমি প্রমাণ চাইলে ই-মেইল করতে পারি। সেক্ষেত্রে দেখবে তোমার সামনেই কেটে নেয়া হবে ওর আঙুল। বলো, রানা, তাতে খুশি হবে তুমি?’

‘না, খুশি হব না,’ চাপা স্বরে বলল রানা। ‘আমি অন্যকিছু দেখতে চাই।

বাঙালি এজেন্টের চোখে অদ্ভুত আলো দেখছে কাউণ্ট কোবরা। সামান্য অস্বস্তি নিয়ে মৃদু হাসল সে। ‘তুমি আসলে নির্দেশ না মানার পর্যায়ে নেই, রানা। ভাল একটা প্রস্তাব দেব। ভাল করে ভেবে জবাব দেবে। তোমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে শুধু তুমিই নও, ওই মেয়েটাও বাঁচবে কি বাঁচবে না। সহজভাবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি?’

কিছুক্ষণ চুপ করে চোখ বুজে থাকল রানা। মনের আয়নায় দেখছে লিয়ার হাসিমুখ। আবারও যখন চোখ মেলল রানা, স্বাভাবিক হয়ে গেছে ওর হৃৎপিণ্ডের গতি। শ্বাস ফেলে নিচু গলায় বলল, ‘আমি শুনছি।’

‘তা হলে দেখো লোকটাকে চেনো কি না।’ এমিলির ইমেজ উধাও হতেই স্ক্রিনে এল সুদর্শন এক লোকের চেহারা। তার বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ। পরনে ভাল দরজির তৈরি সুট। মানুষটা আছে কোন ভিআইপি অনুষ্ঠানে।

‘আমি একে চিনি না,’ সত্যি কথাই বলল রানা।

তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখল কাউণ্ট কোবরা। বিশ্বাস করবে কি করবে না, ভাবছে। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা দোলাল। ‘ইউরোপের রাজনীতি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাও না, এম. আর. নাইন। ওই লোক এডি অ্যামন। হতে চাইছে ইইউ কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তোমার টার্গেট ওই লোক।’

‘আমি ভাড়াটে খুনি নই,’ বলল রানা।

‘কেন মিথ্যা বলছ? খুনের ট্রেইনিং আছে তোমার। মাত্র কয়েক দিন আগেও তুরস্কে পাঁচজন লোককে খুন করেছ ঠাণ্ডা মাথায়।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নাড়ল কাউণ্ট কোবরা। ‘তা ছাড়া, তোমাকে খুন করতে বলছি না। তুমি শুধু তাকে তুলে দেবে আমাদের হাতে। বাকি কাজ আমরাই করব।’

‘তা পারবে। তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই,’ বলল রানা। ‘আগেও তোমার পরিচালনায় দি অর্ডার অভ রা-র অসুস্থকর কীর্তিকলাপ দেখেছি।’

‘দি অর্ডার অভ রা!’ গাল কুঁচকে হাসল লুকা ব্রুনার। ঠোঁট প্রসারিত হতেই বেরোল ইঁদুরের মত ছোট ছোট হলদে দাঁত। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচরের দিকে। জবাবে ভেঙচি দেয়ার মত নোংরা হাসি হাসল মাইক বুচার।

মুখ থেকে হাসি মুছে গেল ব্রুনারের। ‘বহু বছর পর আবারও ওই পুরনো নামে ডাকা হলো আমাদেরকে। রানা, দি অর্ডার অভ রা আসলে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার পূর্বপুরুষ ডেরেক ব্রুনার তৈরি করেন ওই সংগঠন।’

‘তার ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখতে চাও, তাই না?’ বলল রানা, ‘আজকাল তোমার লোক খুন করার কাজে ব্যবহার করে আধুনিক বুলেট।’

‘খারাপ কিছু মানুষকে পৃথিবী থেকে বিদায় না দিয়ে উপায় নেই,’ বলল লুকা ব্রুনার। ‘তবে এডি অ্যামনের মত বিখ্যাত লোককে আমরা দেব বিশেষ রিসেপশন।

‘আনুষ্ঠানিক মৃত্যু,’ মন্তব্য করল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল ব্রুনার। ‘কিছু ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পালন করা সবসময় সবার জন্যে ভাল।’

‘কীভাবে মারবে তাকে?’ বলল রানা, ‘ভিডিয়োর ওই লোকের মত জিভ কেটে পেটে গেঁথে দেবে ছোরা? তোমাদের কী ক্ষতি করেছে এডি অ্যামন?’

জবাব দিল না লুকা ব্রুনার। নিষ্পলক চেয়ে রইল রানার চোখে। মুখে ফুটে উঠল বরফ-ঠাণ্ডা হাসি। স্বাভাবিক সুরে বলল, ‘যে ধরনের অপরাধ, তাতে তাকে বাঁচিয়ে রাখার আগ্রহ আমাদের নেই। যে-লোক বেশি কথা বলে, তার জিভ কেটে নেয়াই ভাল। তবে অ্যামনের বেলায় আমরা অন্য ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করব। তুমি তাকে ধরে আনলে নির্দিষ্ট এক জায়গায় তোমার কাছ থেকে তাকে বুঝে নেবে আমার লোক। এরপর অনুষ্ঠানটা হবে আজ থেকে দু’দিন পর।’ কিবোর্ডে টোকা দিল লুকা ব্রুনার। স্ক্রিন থেকে বিদায় নিল রাজনৈতিক নেতার ছবি। সেখানে ফুটল সুন্দর এক বাড়ির ইমেজ।

বাঁধের মত উঁচু জমিতে স্টিল ও কাঁচের তৈরি অত্যাধুনিক একটা বাড়ি। চারপাশে বিস্তৃত বাগান। পরিবেশটা খুব প্রশান্তিময়। আকাশ সুনীল, বাগানের ঘাস গভীর সবুজ। বাগানের পেছনে পাইনে ছাওয়া একের পর এক ঢেউ- খেলানো টিলা।

হ্যাণ্ডকাফে আটকে রাখা হয়েছে রানার দু’হাত। নাকের পাশে, ঠোঁটের কোণে লেগে আছে রক্ত। এখনও ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, সত্যিই নেই লিয়া। বাড়ি ও বাগানের দিকে চেয়ে ভাবল, বোধহয় পৃথিবীর নয়, ওটা স্বর্গের অংশ। একবার ওখানে গেলে কি ফিরে পাব লিয়াকে?

টাইপ করছে ব্রুনার। মনিটরে স্লাইড শো-র মাধ্যমে দেখা গেল বাড়ি, পাশে নীল লেক ও পেছনের সবুজ টিলা। শুরু হলো নানান ধরনের আর্কিটেকচারাল ডেটা।

‘ওই বাড়ি বেলজিয়ামের ব্রাসেল্স্ শহরে,’ বলল লোকটা। ‘স্ত্রী ও বাচ্চাদুটো আমেরিকায় আত্মীয়র বিয়েতে গেছে বলে, আগামী চারদিন ওই বাড়িতে একা থাকবে অ্যামন। নিজেও যেত, তবে কাজের চাপে যেতে পারেনি। তুমি তো দক্ষ কমাণ্ডো, ওই বাড়ি থেকে অনায়াসেই কিডন্যাপ করতে পারবে তাকে। আর এই কাজটা তোমাকে দিয়ে করিয়ে নেব বলেই এখনও তুমি বেঁচে আছ।’

কালো হলো স্ক্রিন। চেয়ারে হেলান দিল লুকা ব্রুনার। ‘তুমি সফল হলে বাচ্চা মেয়েটাকে পৌঁছে দেব ওর বাবার কাছে। নিজেও তুমি মুক্তি পাবে।’ ডানহাতে থুতনিতে তর্জনী দিয়ে হালকা টোকা দিল লোকটা। ‘তবে রাজি না হলে, বা বেইমানি করলে তোমার কাছে পৌঁছে যাবে মেয়েটার বিশেষ ভিডিয়ো। এরপর বাঁচবে না তুমি নিজেও। আশা করি বুঝতে পেরেছ আমার কথা? দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না আর।’

চুপ করে থাকল রানা।

আবারও বলল কাউণ্ট কোবরা: ‘ভাল করেই জানি তুমি কেমন ধরনের লোক। মুক্ত হলেই চাইবে আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে। আর সেজন্যেই মনে করিয়ে দিচ্ছি: চাইলে যে- কোনও সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পারি এমিলি বা ওর বাবাকে। শুধু তা-ই নয়, যে-কোনও জায়গায় তোমাকে খুঁজে নিতে আমার লাগবে মাত্র বিশ মিনিট। তুমি বেইমানি করলে তোমাকে পাঠিয়ে দেব তুরস্কে। তাতে খুশি হবে আমার কন্ট্যাক্ট।’

‘আমি ভাড়াটে খুনি নই,’ নিচু গলায় বলল রানা।

‘তাই নাকি?’ মুচকি হাসল কাউণ্ট কোবরা। ‘আমি তো শুনেছি, দুটো কিশোরী মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে কেড়ে নিয়েছ পাঁচজনের প্রাণ।’

‘ওই মেয়েদুটো ছিল নিরপরাধ,’ বলল রানা, ‘কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ চেয়েছিল লোকগুলো। সকাল-বিকেল ধর্ষণ করছিল। আমি সেটা ঠেকাতে চেয়েছি।’

‘ভাল কথা, তবে যাদের খুন করলে, তারা ছিল পুলিশ অফিসার। হয়তো বলবে, ওরা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। তবে তুরস্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট চায় না তারা বিদেশি কোনও এজেন্টের হাতে খুন হোক।’

‘জানতাম না যে, ওরা পচে যাওয়া পুলিশ অফিসার, বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে খুন করে খারাপ করিনি।’

সরু হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিল ব্রুনার। ‘হয়তো। তবে আমরা এখানে মতাদর্শ নিয়ে তর্কে বসিনি। মাথায় রেখো, তুরস্কের জেলখানায় তোমার জীবনটা হবে স্রেফ নরকবাসের মত। কোনও বিচার পাবে না। মুক্তি পাওয়ার উপায়ও নেই। আগামী চল্লিশটা বছর মহানন্দে কাটাবে মাটির নিচের একটা কুঠরিতে। এরপর হয়তো একদিন মুক্তি পেলে, ততদিনে তোমার বয়স অন্তত সত্তর। আমার কথাগুলো মনে গেঁথে নাও, রানা। আজ থেকে আমার মুঠোর ভেতর থাকবে তোমার প্রাণভোমরা। নির্দেশের বাইরে কিছু একটা করলেই খুন হবে।’

‘ভেবেচিন্তেই বড়শিতে আটকে নিয়েছ আমাকে,’ বলল রানা।

কথাটা শুনে মজা পেয়ে হাসল লুকা ব্রুনার। ‘স্বাভাবিক, আমাদের আছে দুই শ’ বছরের প্র্যাকটিস।’

শরীরের প্রতিটা পেশিতে ঢিল দিল রানা। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘কিন্তু আমাকেই কেন বেছে নিতে হচ্ছে?’

‘দুটো কারণে, বলল ব্রুনার। ‘প্রথমত, বডিগার্ডের অভাব নেই এডি অ্যামনের। আগেও তাকে খতম করতে চেয়েছি। তাতে খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছে সে। চারদিক থেকে তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে অন্তত পনেরো থেকে বিশজন প্রশিক্ষিত সশস্ত্র গার্ড। কাজেই গোপনে ওই লোকের বাড়িতে ঢুকতে পারবে, এমন কাউকে চাই। আর দ্বিতীয় কারণ: ঠিকই ধরেছ, তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের। তুমি ধরা পড়লে বা খুন হলে দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে লেখা হবে: মহান নেতা এডি অ্যামনকে হত্যা করতে গিয়ে মরেছে একজন নিয়ো-ফ্যাসিস্ট।’ মুচকি হাসল ব্রুনার। ‘আশা করি তোমাকে বলে দিতে হবে না, ধরা পড়লেও মুখ বুজে থাকবে। নইলে খুন হবে বাচ্চা মেয়েটা। অথবা তুমি যাবে তুরস্কের কারাগারে।’

‘ওর সঙ্গে বোধহয় আমারও যাওয়া উচিত,’ জানাল বুচার। লুকা ব্রুনারের পেছন থেকে রানাকে দেখছে সে। ‘মাসুদ রানা যে-কোনও সময়ে শয়তানি করতে পারে।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ব্রুনার। ‘দরকার নেই। আমার ধারণা: বাচ্চাটার কথা ভেবে লক্ষ্মী ছেলের মত সব নির্দেশ মেনে নেবে।’ চেয়ারে আরাম করে হেলান দিল সে। নিখুঁত তার পরিকল্পনা। এমন কিছুর জন্যে বহুদিন অপেক্ষা করেছে। এডি অ্যামন খুন হলে খুনের দায় চাপবে মাসুদ রানার ওপর। তারপর থেকে তাকে ব্যবহার করবে নিজেদের স্বার্থে। প্রয়োজনে এমিলি আর ওর বাবাকে আটকে রাখবে গোপন কোথাও। একেই বলে এক ঢিলে চার-পাঁচটা পাখি।

মাথা নিচু করে কী যেন ভাবছে রানা।

ওকে দেখে নিয়ে নিষ্ঠুর হাসল কাউণ্ট কোবরা। যতই ভাবুক, ফাঁদ থেকে বেরোবার উপায় নেই ওর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *