অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৮

২৫ জানুয়ারি, ২০১৮

এয়ারপোর্ট থেকে বুক করা ক্যাবটা যখন নিজামুদ্দিন স্টেশনে ঢুকল, তখন গতিমান এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে, অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে ঘন ঘন।

সুরঞ্জন তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে লাগেজগুলো নামিয়ে উৎফুল্ল মনে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হাঁটা লাগালেন।

ভোরবেলা বেরিয়ে কোথাও যেতে হলেই বরাবর মনের মধ্যে কেমন একটা রোম্যান্স চলে আসে সুরঞ্জনের, সকালের তাজা আলোয় সব কিছুকেই বড়ো সুন্দর মনে হয় তাঁর। পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গানের প্রথম দু-কলি শিস দিয়ে গেয়ে নিয়ে বেশ পরিতৃপ্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন তিনি।

পূরবীও একটা ট্রলি নিয়ে হাঁটছিলেন, কিন্তু ঢিমেতালে। সেই কাকভোরে বেরিয়ে দিল্লি আসার প্লেন ধরতে হয়েছে, তার ওপর কাল রাতে ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি। দিল্লি এয়ারপোর্টে নেমেই স্টেশনে হুড়মুড়িয়ে আসা, এক কাপ কালো কফি ছাড়া কিছু খাওয়াও হয়নি সকাল থেকে। পূরবীর কেমন একটা ঝিমঝিমে ভাব আসছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, কোথাও বসে মাথাটা একপাশে এলিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে। কিন্তু, সেটা তো এখন সম্ভব নয়। শরীর বিশ্রাম চাইলেও ট্রেন অপেক্ষা করবে না আর নিজের মনও সেটা চাইছে না। পূরবী সামনে ঝড়ের গতিতে হেঁটে চলা সুরঞ্জনের দিকে বেশ তির্যকভাবে তাকালেন। আনন্দের আতিশয্যে মানুষটা ভুলেই গেছে যে পেছনে কেউ রয়েছে। একটু কড়া গলায় ডাকতে গিয়েও সামলে নিলেন পূরবী।

থাক। জোর করে ক্লান্তিটাকে এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে সুরঞ্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার জন্য গতি বাড়ালেন পূরবী।

সুরঞ্জনের মুখে ক্লান্তির একদমই ছাপ নেই। একে মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় ফুটছেন গত কয়েকদিন ধরেই, তার ওপর বাইরে এসেছেনও অনেকদিন পর।

ভুটানের সেই দীর্ঘ নির্বাসনের পর প্রথম যখন কলকাতায় নিজের বাড়িতে এসেছিলেন, কিছুদিন কেমন যেন থম মেরে গিয়েছিলেন*। বাইরের পৃথিবীকে অতদিন বাদে ঠিক যেন আগের মতো আর সাবলীলভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই, তাঁদের যাবতীয় কৌতূহলের উত্তর দিতে গেলেই, একরাশ আড়ষ্টতা এসে গ্রাস করত তাঁকে। আর আত্মীয়স্বজন তো বটেই, প্রথম প্রথম মিডিয়ার আনাগোনাও লেগেই থাকত বাড়িতে। তাদের কতরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্ন! তার মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তদন্তের সহযোগিতাও করতে হত। পূরবী সেসব এক হাতে সামলেছিলেন। তারপর দু-বছর ধরে ধীরে ধীরে রুদ্র, প্রিয়ম আর পূরবীর সাহচর্যে কাটিয়ে উঠেছেন সেই ট্রমাটা।

তারপর থেকে সময় ভালোই কাটছিল। সকাল থেকে নিজের খেয়ালখুশি মতো বই নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা, পূরবী কলেজে বেরিয়ে গেলে কোনোদিন কলেজ স্ট্রিট, কোনোদিন নতুন কোনো প্রদর্শনী দেখা, কোনোদিন বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি, এই করেই কেটে যাচ্ছিল বেশ। মাঝেমধ্যে টুকটাক কাগজে বা পত্রপত্রিকায় লিখতেন নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে। শনি রবিবার হলেই রুদ্র আর প্রিয়ম চলে আসত, গল্প-আড্ডায় বেশ কেটে যেত দিনগুলো।

কিন্তু তারপর প্রথমে প্রিয়ম গেল বাইরে, তারপর হঠাৎ রুদ্ররও ট্রান্সফারের অর্ডার আসতে কেরিয়ার গ্রোথের কথা ভেবে খুশি হওয়া উচিত হলেও সুরঞ্জন মনে মনে দুঃখই পেয়েছিলেন বেশি।

রুদ্রকে ওর ব্যাঙ্ক হঠাৎ বদলি করে দিল উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে। এমনিতে ওদের নিয়মমাফিক তিনবছর অন্তর ট্রান্সফার হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এতটা দূরে হওয়াতে রুদ্রও প্রথমে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল।

ট্রেনে উঠে নিজেদের বসবার সিটটাও বেশ পছন্দ হয়ে গেল সুরঞ্জনের। এই ট্রেনটা নতুন চালু হয়েছে, বেশ বিদেশের কায়দায় প্রতিটা সিটের পেছনে আটকানো এল সি ডি টিভি, প্লেনের কায়দায় সুন্দর ডিজিটাল বোর্ড, লাগেজ রাখার লফট, কামরায় হাসিমুখে ঘোরাঘুরি করছেন হোস্টেসরা। এ ছাড়াও বিনোদনের আরও অনেকরকম উপকরণই মজুত। চওড়া জানলার পাশে বেশ জাঁকিয়ে বসলেন সুরঞ্জন, পূরবীর দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালেন, ‘দারুণ করেছে ট্রেনটা, বলো!’

সুরঞ্জনের হাবভাব সকাল থেকেই লক্ষ করছিলেন পূরবী, এবার হেসে ফেললেন, ‘হুঁ। মেয়েকে এগারো মাস বাদে দেখবে, তাই সব কিছু আরও সুন্দর লাগছে, তাই না! শুগারের ওষুধটা খেয়েছ না সেটাও ভুলে গেছ?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘খেয়েছি খেয়েছি। রুদ্র কি ফোন করেছিল?’

পূরবী খাবারের ব্যাগটা একটু সাবধানে রাখছিলেন পায়ের কাছে, ওটাকে ইচ্ছে করেই লফটে তোলেননি। প্রিয়মের মা কাল এসে একগাদা খাবার দিয়ে গেছেন রুদ্রর জন্য, সেইগুলো রয়েছে, প্রিয়মদের কল্যাণীর বাড়ির গাছের কিছু সবজিও ঠেলেঠুলে ঢোকানো আছে, এ ছাড়া রয়েছে কলকাতার সেরা সেরা কিছু মিষ্টির প্যাকেটও।

লফটে তুলে দিলে সব যদি মাখামাখি হয়ে যায়?

পূরবী দুই হাঁটুর মাঝে শক্ত করে ধরে রাখলেন। রুদ্র অবশ্য পইপই করে বারণ করেছিল এত কিছু জিনিস টেনে না নিয়ে যেতে। কিন্তু মেয়েটা দিনে অন্তত তিনবার করে অনুযোগ করে ওখানে নাকি ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় না, সারাদিন ছোলামটর খেয়ে খেয়ে ওর নাকি মুখ পচে যাচ্ছে!

মায়ের মন। এরপরও পূরবী এগুলো না নিয়ে কী করে যাবেন? একেই মেয়েটা ঘরগেরস্থালির কাজে কুঁড়ের বাদশা বললেও কম বলা হয়, খিদেয় পেট জ্বলে গেলেও খাবার নিজে নিয়ে খেত না। সেখানে একা একা থাকা, কী খাচ্ছে কে জানে! প্রিয়মও অতদূরে একা রয়েছে বটে, কিন্তু ও যথেষ্ট স্বাবলম্বী, নিজেরটুকু নিজে করে নিতে জানে। আর এই মেয়েটা নিজে তো কিছু শেখেইনি, যেটুকু শেখার কথা ছিল বিয়ের পর, সেটুকু তো দূর, প্রিয়ম ওর আরও বারোটা বাজিয়েছে লাই দিয়ে দিয়ে।

সুরঞ্জন তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দেখে পূরবীর ঘোর কাটল, বললেন, ‘না। সেই ভোরে দমদমে প্লেনে ওঠার আগে কথা হয়েছিল। তারপর থেকে ফোনে পাচ্ছি না। চিন্তার কিছু নেই, ও স্টেশনেই থাকবে।’

সুরঞ্জন পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন। স্মার্টফোন ব্যবহার করা শিখতে ওঁকে অন্তত বেগ পেতে হয়নি। দিব্যি টুকটাক দরকারি কাজ সারতে পারেন ফোনে। আর হাতিঘোড়া কিছু ব্যাপার তো নয়! আগ্রহ থাকাটাই বড়ো কথা। পূরবীর যেমন আগ্রহটাই নেই। না হলে যিনি কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক, তাঁকে রুদ্র প্রায় এক বছর ধরেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক শেখাতে পারল না! অনেক বোঝানো হয়েছে, কিন্তু পূরবী ওঁর পুরোনো ছোটো বোতাম টেপা ফোন নিয়েই খুশি।

সুরঞ্জন ডায়াল করতে যাবেন তার আগে দরজার কাছটায় কেমন একটা গোলমাল বেধে গেল। গোলমাল ঠিক নয়, উচ্চৈঃস্বরে কে যেন ইংরেজিতে গান জুড়েছে, তার মধ্যে মধ্যে কী সব বকছে আর উলটোদিকে এই কামরার হোস্টেসের মৃদু গলায় কথা শোনা যাচ্ছে।

আগে হলে সুরঞ্জন সঙ্গেসঙ্গে উঠে দেখতে যেতেন ব্যাপারটা কী। কিন্তু এই ক-বছরে আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ত স্মার্টনেসটা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

সুরঞ্জন পূরবীর দিকে তাকালেন।

পূরবী উলটোদিকে বসে আছেন, ফলে দরজার দিকটা ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছেন, চাপা গলায় বললেন, ‘তেমন কিছু না। এক ভদ্রলোক উঠছেন গান গাইতে গাইতে…।’

পূরবীর কথা শেষ হল না, হুড়মুড় করে সুরঞ্জনের গায়ে কী যেন এসে পড়ল। সুরঞ্জন চোখ তুলে দেখলেন এক ভদ্রলোক তাঁরই পাশের সিটটায় বসতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু পিঠের রুকস্যাকটা যে বেয়াদপভাবে পাশের জনের গায়ে বার বার ঠুকছে, সে-খেয়াল নেই। ভদ্রলোক তেরচা হয়ে বসে ওদিক ফিরে পায়ের জুতো নিয়ে কী-একটা করছেন, আর ওঁর রুকস্যাকের বাইরের ফিতে দুটো বিচ্ছিরিভাবে সুরঞ্জনের নাকে ঘষা খাচ্ছে।

নাকটা সরিয়ে নিলেন সুরঞ্জন, একটু সরে বসলেন বাঁ-পাশে জানলা ঘেঁষে, তাতেও বিশেষ সুরাহা হল না। রুকস্যাকটা মনে হয় কয়েক জন্ম কাচা হয়নি, কীরকম একটা গা-গুলোনো উৎকট গন্ধ ছাড়ছে সেটা থেকে, একসময়ের কালো রংটা প্রথমে মনে হয় ফ্যাকাশে ছাইরঙা হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর দিনের পর দিন নোংরা লাগতে থাকায় কীরকম রাস্তায় পড়ে থাকা পানের পিকের মতো ছোপ ছোপ হয়ে রয়েছে গোটা ব্যাগটা। দেখলেই বমি পাচ্ছে।

সুরঞ্জন একবার ভাবলেন, একটু ঠিক করে বসতে বলবেন। কিন্তু সেই সুযোগ পেলেন না, ওই পাশে ক্রমাগত গান গেয়ে চলেছেন আগন্তুক।

ছোট্ট এই কামরায় বাকি পাঁচ-সাতজন লোক, সবাই এদিকেই চেয়ে রয়েছে। কিন্তু তাতে ওই তরফে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। জোরে জোরে গান গাইতে গাইতে সুরঞ্জনকে খোঁচা মারতে মারতে নির্বিকার দুলে চলেছে লোকটা।

আগে সুরঞ্জনের ধাঁ করে মাথা গরম হয়ে যেত। এ আবর কী! ন্যূনতম ম্যানারিজম না জানা লোকদের দু-চক্ষে দেখতে পারেন না তিনি। নিজের সহবত বোধের অভাবের জন্য এরা পারিপার্শ্বিক মানুষদের বিরক্ত করে আনন্দ পায়। আগে হলে এতক্ষণে কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু এখন তিনি অনেক শান্ত, সংযত। জানলার দিকে আরেকটু সরে বসলেন তিনি। দুর্গন্ধে টেকা দায়, তবু নিজেকে বোঝালেন তিনি, দেড়-দু-ঘণ্টার ব্যাপার, শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ নেই। ওদিকে পূরবী চোখ বুজে হেলান দিয়ে রয়েছেন সিটে।

এরপর উঠল মস্ত একটা বাঘের মতো দেখতে কুকুর, সম্ভবত জার্মান শেফার্ড, সঙ্গে দু-জন পুলিশ, হালকা গর্জন করতে করতে পুরো বগিটা সরেজমিনে তদন্ত করে গেল সে। এখন নিরাপত্তায় বেশ কড়াকড়ি করেছে রেল, সুরঞ্জন ভাবলেন।

তারপরেই হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।

মিনিট দশেক পরেও সুরঞ্জনের দিক থেকে কোনোরকম অভিযোগ না পেয়ে বোধ হয় গন্ধমাদন পাহাড়টা নড়েচড়ে একটু সোজা হয়ে বসল। দুর্গন্ধটা যেন আরও প্রকট হয়ে করে নাকে এসে লাগল। সুরঞ্জন আড়চোখে দেখলেন, ফর্সা একটা বিশাল মাপের মুখ, কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফে প্রায় ঢেকে রয়েছে, চামড়ায় রোদে পোড়া ভাব স্পষ্ট। মাথার ঝাঁকড়া চুল ঠিকমতো আঁচড়ানোও নেই। বাঁ-গালে একটা বেখাপ্পা ধরনের বড়ো তিল। বয়স সুরঞ্জনের মতোই, অন্তত ছ-ফুট দু-ইঞ্চির বিশাল দশাসই চেহারা, গায়ে একটা কালো কোট, সেটাও যাচ্ছেতাই ধরনের নোংরা। কালো প্যান্টটাও কতকাল কাচা হয়নি ইয়ত্তা নেই। এই ধরনের লোক এরকম অভিজাত ট্রেনে খুবই বেমানান, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ কিছু বলছেন না।

বিরক্তি ঢাকতে সুরঞ্জন বাইরের দিকে চোখ ফেরালেন। দিল্লি শহর পেরিয়ে অনেকটা দূর চলে এসেছে ট্রেন। বেশ বলা হয়ে গেলেও এখানে এখনও কুয়াশার আলগা প্রলেপ রয়েছে রেল চত্বর পেরিয়ে দূরের বস্তি আর ল্যাম্পপোস্টগুলোয়। দূরের আবছা গ্রামগুলোয় সবে যেন ব্যস্ততা শুরু হয়েছে, এদিককার বাড়িগুলো যেন অনেকটা একই প্যাটার্নের, চৌকো খোপ খোপ ধরনের। জানলার সংখ্যাও খুব কম। আসলে এখানকার ওয়েদার চরমভাবাপন্ন, মানে যেমন গরম তেমনই ঠান্ডা। তাই এইসমস্ত সতর্কতা।

সুরঞ্জন একমনে দেখছিলেন, একবার চোখ ফিরিয়ে দেখলেন পূরবী ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ পকেটে ফোন বাজল। ওপাশে রুদ্র, ‘কোথায় তোমরা?’

সুরঞ্জন বললেন, ‘এই তো, আর হয়তো আধঘণ্টা মতো লাগবে।’

‘হুঁ। আমি এই বেরোচ্ছি। তোমাদের ঢোকার আগেই আমি স্টেশনে পৌঁছে যাব। নেমে ফোন কোরো কিন্তু!’

ফোনটা বন্ধ করে রাখতে রাখতে, বাবার মন তো, সুরঞ্জনের কেমন যেন মনে হল, রুদ্রকে কি একটু মনমরা লাগল।

পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি হতে ডান পাশে তাকিয়ে সুরঞ্জন একটু অবাক হয়ে গেলেন। গন্ধমাদন পাহাড়টা সোজা দৃষ্টিতে ওঁরই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো ঈষৎ ঢুলুঢুলু, ভারী চশমার ওপারে কেমন একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।

গভীরভাবে সেই দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে সুরঞ্জনকে।

অস্বস্তিতে সুরঞ্জন জানলার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু কেউ একজন তাকিয়ে রয়েছে এটা জানতে পারলে বার বার সেইদিকেই চোখ চলে যায়। সুরঞ্জন আবার তেরচা চোখে চেয়ে দেখলেন তাঁর দিকে কেমন কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রয়েছে লোকটা।

বাধ্য হয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে একবার বাথরুমে ঘুরে আসবেন ভাবছেন, কিন্তু উঠে এগোতে যেতেই চওড়া বলিষ্ঠ দুটো হাতের পাঞ্জা সজোরে আবার সুরঞ্জনকে টেনে বসিয়ে দেয় চেয়ারে।

এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সুরঞ্জনের। বিনা অনুমতিতে গায়ে হাত দিয়ে জোর করে বসিয়ে দেওয়া, এ আবার কী ধরনের অসভ্যতা? রেগে গিয়ে সুরঞ্জন ইংরেজিতে বেশ জোরেই বলে ফেললেন, ‘কী করছেন কী আপনি?’

বেশ জোরেই বলেছেন কথাটা, পূরবী চোখ খুলে তাকালেন।

গন্ধমাদনও প্রথমে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ একটা বিশাল অট্টহাস্য করে নিজের ভাল্লুকের মতো কোটসমেত সুরঞ্জনকে জড়িয়ে ধরল।

ঘটনার আকস্মিকতায় পূরবী আর সুরঞ্জন প্রাথমিকভাবে হকচকিয়ে গেলেও সুরঞ্জন মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু ওই দুর্গন্ধময় কোটের মধ্যে যে বিশাল বপুটা রয়েছে তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলেন না। গন্ধে বমি আসছিল তাঁর।

লোকটা সুরঞ্জনের ছটফটানিতে নিজের বাঁধনটা একটু আলগা করল, তারপর ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি হয়ে কেমন সুর করে করে হিন্দিতে বলল, ‘লিটল বুদ্ধার এখনও এত রাগ? অ্যাঁ? হা হা হা হা…!’

সুরঞ্জন ছাড়া পেয়ে নিজের বিস্রস্ত চেহারাটা ঠিকঠাক করছিলেন, লোকটার কথা শুনে মুখ তুলে বিস্ময়ে তাকালেন। লিটল বুদ্ধা? সুরঞ্জন ঠিক শুনেছেন?

লোকটার অট্টহাসি তখনও থামেনি। ওদিকে হোস্টেস মেয়েগুলো খাবারের ট্রলি নিয়ে এসে পড়েছে, ওদের খাবারগুলো টেবিলে সার্ভ করে চলে যেতেই লোকটা একটা প্লেট থেকে স্যান্ডউইচটা তুলে নিয়ে বিশাল একটা কামড় বসাল, তারপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, ‘কিছু মনে পড়ছে না লিটল বুদ্ধ? মৈত্রেয়ী হস্টেলের ৬ নম্বর রুম?’

সুরঞ্জন দ্বিধাগ্রস্তভাবে স্মৃতির গহ্বর হাতড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ লোকটার মুখের দিকে আরও একবার চোখ পড়তেই ওর বাঁ-গালের পেল্লাই কালো তিলটা সব অন্ধকারকে আলোকিত করে দিল আর সুরঞ্জন হুস করে বছর চল্লিশ আগে দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর করার দিনগুলোতে চলে গেলেন।

বিশাল চেহারা, বাঁ-গালে কালো তিল, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, কথায় কথায় হা হা করে হাসি, কালো জামা কালো প্যান্ট একজনেরই ট্রেডমার্ক ছিল।

অঘোরেশ। অঘোরেশ ভাট!

সুরঞ্জন বিস্মিতভাবে বললেন, ‘ব্ল্যাক পার্ল!’

………

* রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের ১ম উপন্যাস ঈশ্বর যখন বন্দি দ্রষ্টব্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *