২৬
ভগতবীর সিং অস্ফুটে বললেন, ‘মাই গড! এরকম অ্যান্টিক বই …এটা তো ইন্টারন্যাশনাল চুরি! বিরাট চক্র আছে এর পেছনে। এখুনি জানাতে হবে দিল্লিতে!’
অঘোরেশ মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন সোফায়, মুখ একদিকে ঈষৎ বেঁকে গেছে, চোখ অর্ধ-উন্মীলিত রেখে তিনি কিছু একটা অস্ফুটে বিড়বিড় করছেন, কেউ শুনতে পাচ্ছে না।
রুদ্র এবার নরম গলায় বলল, ‘বুঝতেই পারছেন আঙ্কল, আপনার বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটা অভিযোগই গুরুতর, আপনি যদি এখনও পুরোটা খুলে না বলেন, তাহলে আপনার রিসার্চ আর এক পা-ও এগোবে না, কারণ এতগুলো দোষের আসামি হিসেবে এঁরা আপনাকে জেলে পুরবেন।’
ভগতবীর সিং বললেন, ‘আপনার ইমেল আইডিটা বলুন তো। ট্র্যাক করে দেখি কোন আইপি অ্যাড্রেসে অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠিয়েছিলেন আপনি।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, এদের ওইভাবে হবে না।’ নাহুম খান চড়া গলায় বললেন, ‘থানায় নিয়ে গিয়ে ডোজ দিলেই…!’
অঘোরেশ যেন নাহুম খানের কথাটা শুনতেই পেলেন না, কেমন অপার্থিব দৃষ্টিতে তাকালেন রুদ্রর দিকে তাঁর চোখে জল।
আহত গলায় বললেন, ‘তুমি আর সুরঞ্জন, তোমরা আমার বাড়ি থেকে আমাকে এইজন্যই নিয়ে এলে এখানে, না?’
‘আমরা আপনাকে না নিয়ে এলে আপনি এতক্ষণে কোনো গুমঘরে বন্দি হয়ে থাকতেন আঙ্কল!’ রুদ্র অধৈর্য গলায় বলল, ‘আমি এখনও আপনাকে বলছি সব কিছু খুলে বলতে।’
অঘোরেশ জামার হাতা দিয়ে চোখটা মুছলেন, তারপর গলাটা সাফ করে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, ‘বেশ। আর কী বলব বলো।’
‘আপনি দিল্লি থেকে আজ সকালে ফিরেছেন, দিল্লিতে কোথায় গিয়েছিলেন?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
অঘোরেশ ঈষৎ কাঁপা গলায় বললেন, ‘দিল্লি যাইনি। গিয়েছিলাম লখনৌ। আমাকে বলা হয়েছিল দিল্লি হয়ে ফিরতে। তাই… !’
‘কে বলেছিল?’ নাহুম খান প্রশ্ন করলেন।
‘এক সপ্তাহ আগে ওই বিদেশি সংস্থা থেকে একটা ফোন আসে, বলা হয় আমার গবেষণার ব্যাপারে একটা দারুণ এভিডেন্স দেওয়া হবে, আমি যেন চব্বিশে জানুয়ারি রাতে লখনৌর বড়া ইমামবড়ার গেটে অপেক্ষা করি।’ অঘোরেশ ঢোঁক গিললেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনারা কারা? নাম বলেনি, শুধু বলেছিল নিজামুদ্দিনকেও ওরাই সোর্স সাপ্লাই করত।’
‘কি দিল আপনাকে?’ রুদ্র বলল।
‘কাল রাত দশটার সময় বড়া ইমামবড়ার গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, শুনশান জায়গায় হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এসে দিয়ে গেল। তারপর বাস ধরে দিল্লি আসি, সেখান থেকে আজ সকালে আগ্রা।’ অঘোরেশ কাঁধের ঝোলা থেকে একটা খাম বের করলেন, তার ভেতর থেকে বের করে আনলেন কয়েকটা ছবি।
প্রিয়ম অঘোরেশের পাশেই বসেছিল, ঝুঁকে দেখল একটা পাথরের বিভিন্ন কোণ থেকে নেওয়া বেশ বড়ো মাপের কয়েকটা ছবি, ছবিতে সেই পাথরের ওপর অনেক কিছু খোদাই করা। ও বলল, ‘এটা কি কোনো প্রাচীন লিপি?’
অঘোরেশ মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ। এটার নাম বটেশ্বর শিলালিপি। লখনৌ মিউজিয়ামে এটা রাখা আছে। সেটারই ছবি এগুলো। মিউজিয়ামে এমনিতে এটার কোনো ছবি কেউ তুলতে পারে না।’
‘তার মানে মিউজিয়ামেরই কারুর কাজ এটা!’ নাহুম খান বিড়বিড় করলেন।
সুরঞ্জন বললেন, ‘বটেশ্বর এদিকেই, না? কোথায় যেন পড়েছি এই শিলালিপির নাম।’
‘তুই তো পড়বিই। তোদের আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিশিয়াল জার্নাল ‘এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা’-র প্রথম খণ্ডেই এটা সম্পর্কে বিশদে লেখা আছে।’ অঘোরেশ লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে ছবিগুলো সামনের টেবিলের ওপর সাজিয়ে বললেন, ‘১৯০০ সালে জেনারেল কানিংহাম বটেশ্বরের একটা ঢিবিতে খননকার্য চালানোর সময় এই শিলালিপিটা খুঁজে পেয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই লিপিতে লেখা রয়েছে, ১১৫৫ সালে সম্রাট পরমাদ্রিদেব শিবের উদ্দেশে যমুনা নদীর তীরে দুটি মন্দির স্থাপন করলেন, একটা শিবের, অন্যটি বিষ্ণুর।’
‘পরমাদেব কে? কোথাকার রাজা ইনি?’ প্রিয়ম জিজ্ঞেস করলো।
‘পরমাদেব নয়, পরমাদ্রিদেব। তিনি ছিলেন জেজকভুক্তির চান্দেলা বংশের রাজা। জেজকভুক্তি এখন মধ্যপ্রদেশের মধ্যে পড়বে। চান্দেলা বংশের বিখ্যাত রাজারা ছিলেন যশোবর্মণ, বিদ্যাধর, ধঙ্গ। খাজুরাহোর বিখ্যাত মন্দিরগুলো ওঁদের সময়েই বানানো। পরমাদ্রিদেব তাঁদের উত্তরপুরুষ।’ অঘোরেশ ছবিগুলোর দিকে তাকালেন, ‘এই লিপিতে মোট চৌত্রিশটা স্তবক আছে, যেগুলো আমার আগে অনেকবার পড়া আর্কিয়োলজিকাল সার্ভের ওই জার্নাল থেকে, তবু এই ছবি থেকে আরও একবার পড়ে শোনাচ্ছি পঁচিশ, ছাব্বিশ আর চৌত্রিশ নম্বর স্তবকটা।’ অঘোরেশ একটা ছবিকে চোখের কাছে নিয়ে এলেন, ‘১২১২ বিক্রম সংবত তারিখে, আশ্বিন মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে সম্রাট পরমাদ্রিদেব যমুনা নদীর তীরে দুটি শ্বেতশুভ্র মন্দির নির্মাণ করালেন, একটি ভগবান বিষ্ণুর, অন্যটি মহাদিদেব শিবের। দুটোই অনিন্দ্যসুন্দর, বিশেষত দ্বিতীয় মন্দিরটিতে অধিষ্ঠিত হয়ে দেবতা এত প্রসন্ন হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর হিমালয় নিবাস কৈলাসে ফিরে যাওয়ার কথা আর ভাবেননি।’
‘এ থেকে কী প্রমাণ হল?’ নাহুম খান হাত নাড়লেন, ‘কোনো হিন্দু সম্রাট কোনো সাদা শিবমন্দির তৈরি করতে পারেন না? তার মানেই কি সেটা তাজমহল?’
অঘোরেশ যেন শুনতেই পেলেন না নাহুম খানের কথাগুলো, তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘ক্যালে নামের এক ইতিহাসবিদ লিখে গেছেন, ১২১২ বিক্রম সংবত ছিল চান্দেলা রাজাদের সময় গণনার বছর, এখনকার ক্যালেন্ডারে হিসেব করলে সময়টা হবে ১১৫৫ বা ১১৫৬ সাল। বিষ্ণু ও শিবের জন্য সম্রাট পরমাদ্রিদেব যে দুটো মন্দির যমুনা নদীর উভয় তীরে বানিয়েছিলেন, পরে উপর্যুপরি মুসলিম আক্রমণে সেগুলো কলুষিত হয়। সেইসময় হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। কোনো বিচক্ষণ মানুষ মুসলিম আক্রমণ থেকে বাঁচাতে মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে লেখা এই শিলালিপিটা ওই ঢিবির মধ্যে লুকিয়ে রাখেন।’ অঘোরেশ এবার মুখ তুললেন, ‘এই লিপিতে মন্দির দুটোর অবস্থান, পারস্পরিক দূরত্বও লেখা রয়েছে। যদি পরীক্ষা করেন, দেখতে পাবেন, ওই একই দূরত্বে যমুনা নদীর দুই তীরে অবস্থান করছে শিবমন্দির তাজমহল আর বিষ্ণু মন্দির ইতমদ-উদ-দৌলার কবর, যেটার সঙ্গে তাজমহলের সাদৃশ্যে অনেকে বেবি তাজও বলে থাকেন।’
‘ইতমদ-উদ-দৌলাটা আবার কে?’ প্রিয়ম রুদ্রর কানে ফিসফিস করল, ‘উফ! সব গুলিয়ে যাচ্ছে! যতই মাধ্যমিকের পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর ইতিহাসমুখো হব না, তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে সেই ইতিহাসই আমার আর পিছু ছাড়ছে না।’
রুদ্র শুনতে পেল না, ট্যাবে ও তখন বুঁদ হয়ে ইতমদ-উদ-দৌলার কবর আর তাজমহলের অবস্থান দেখছে। ড মাথুরকে আরও একবার বিরক্ত করতে হবে।
সুরঞ্জনই রুদ্রর হয়ে উত্তরটা দিলেন, ‘জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুরজাহানের বাবা মির্জা ঘিয়াস বেগের কবর আছে ওখানে। মির্জা ঘিয়াস বেগ সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির ছিলেন। তাজমহলের মতো ওটাও পুরো সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’ অঘোরেশ বললেন, ‘১১৫৫ সালের ওই শিবমন্দিরই হল তেজোমহালয়। যেটার অপভ্রংশ হল তাজমহল। মুমতাজের আসল নাম ছিল আরজুমান্দ বানু। মুমতাজের নামে স্মৃতিসৌধ হলে মুমতাজমহল হতে পারে, শুধু তাজমহল হবে কেন! ১২০০ সাল নাগাদ মহম্মদ ঘোরি ভারত আক্রমণ করেন, মুসলিম শাসন শুরু হয়। তখন তেজোমহালয় দখল করে সেটাকে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে মুসলিমরা। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর সম্রাট বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করেন। তখন বাবর এই প্রাসাদটা দখল করেন। তারপর হুমায়ুন সিংহাসনে বসলে একের পর এক পরাজয় ঘটতে থাকে। ১৫৩৮ নাগাদ তেজোমহালয় আবার জয়পুরের হিন্দু রাজপরিবারের দখলে চলে যায়। তারপর সম্রাট আকবর ক্ষমতায় এলেও এটা আর দখল করেননি কারণ জয়পুর রাজপরিবারের ভগবান দাস আর মানসিংহ ছিলেন আকবরের পরম বিশ্বস্ত সেনাপতি, ওঁদের সঙ্গে আকবরের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তারপর প্রাসাদ যখন মানসিংহের উত্তরপুরুষ জয়সিংহের অধীনে, তখনই শাজাহান এটা দখল করেন।’
‘রিডিকিউলাস!’ নাহুম খান এবার জোরে হেসে উঠলেন, ‘আপনি এমনভাবে বলছেন যেন ১১৫৫ সাল থেকে শাজাহানের সময় পর্যন্ত বসে আপনি পুরোটা দেখেছেন!’
‘আমি বলছি না।’ অঘোরেশ শান্তভাবে বললেন, ‘ইতিহাসবিদ ক্যালে-ই এটা বলে গেছেন তাঁর বইতে।’
‘ওরকম অনেক ইতিহাসবিদই এরকম বিতর্কিত বই লিখে নজরে পড়ার চেষ্টা করেছেন, ওটা কোনো প্রমাণ হল?’ নাহুম খান বললেন, ‘আমি নিজে ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। এরকম পরোক্ষ নথি দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না। প্রপার এভিডেন্স চাই।’
এবার সুরঞ্জন বললেন, ‘দেখুন, ইতিহাস কিন্তু সবসময় চাক্ষুষ প্রমাণের ভিত্তিতে চলে না। অনেকরকম ফ্যাক্টর থেকে একটা উপসংহারে আসতে হয় ঐতিহাসিক আবিষ্কারের সময়। এটা সায়েন্স নয়, যে সব কিছু অঙ্কের ইন্ডাকশন পদ্ধতিতে সোজাসাপটা প্রমাণ করা যাবে। আর প্রপার এভিডেন্স কথাটা খুব আপেক্ষিক। ইতিহাসে অনেক কিছুই অনুমান করতে হয়, তবে সেটা অবশ্যই লজিক্যাল অনুমান। তবু তো মধ্যযুগ থেকে আমরা শিলালিপি পাই, রাজাদের জীবনচরিত পাই, বিদেশি পর্যটকদের লেখা ট্রাভেলগ পাই। কিন্তু একদম প্রাচীন যুগের এক্সক্যাভেশনের সময় তো এসব তেমন পাওয়াই যায় না। সেক্ষেত্রে ইতিহাস দাঁড়িয়ে থাকে তিনটে স্তম্ভের ওপর, এপিগ্রাফি, প্যালিয়োগ্রাফি আর আর্কিয়োলজি। প্রাচীন হরফ বা শিলালিপিতে আঁকা ছবি থেকে তখনকার মানুষের পোশাক-আশাকে ধরন, তাদের পেশা, সমাজে মেয়েদের অবস্থান, তারা কোন ঠাকুরের উপাসক ছিল, এরকম অনেক কিছু বলা যায়। সেগুলোও কিন্তু একধরনের এভিডেন্স।’
‘কীরকম?’ নাহুম খান জিজ্ঞেস করলেন।
‘যেমন,’ সুরঞ্জন উদাহরণ দিলেন, ‘মহেঞ্জোদারো যখন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কার করলেন, সাইট থেকে পাওয়া সিলগুলোর ছবি থেকে তখনকার মানুষজনের গায়ের অলংকার দেখে এটা পর্যন্ত বের করা গিয়েছিল, সিন্ধুসভ্যতায় কী কী ধাতুর প্রচলন ছিল, তারা যে পশুপতি বলে এক ঠাকুরের উপাসক ছিলেন সেটাও ওই সিল পরীক্ষা করেই বের করা হয়। আলাদা করে তো কোথাও লেখা ছিল না যে ওরা কোন ঠাকুরের আরাধনা করত, এভাবে সিল দেখে বোঝা হয়েছিল। এভাবেই টুকরো টুকরো তথ্য জুড়ে ইতিহাস হয়। তাই প্রপার এভিডেন্স বলে কিন্তু ইতিহাসে কিছু হয় না!’
‘কে বলল প্রপার এভিডেন্স নেই?’ অঘোরেশ তেরচা চোখে তাকালেন, ‘তাজমহল নাকি তৈরি হয়েছে ১৬৩১ থেকে ১৬৫৩, এই বাইশ বছর ধরে। ডাহা মিথ্যা কথা! তাজমহলের ওই প্রাসাদ, দু-পাশের লাল বেলেপাথরের তৈরি দুটো সিমেট্রিক্যাল সৌধ, সব আরও পাঁচশো বছর আগে তৈরি, ১৬৩১-এ মুমতাজের মৃত্যুর পর শাজাহান শুধু তাজমহলের গায়ে কোরানের বাণীগুলো খোদাই করান।’
‘তাজমহলের দেওয়ালে খোদাই করা আল্লাহ-র নিরানব্বইটা নামের কথা বলছেন?’ নাহুম খান বললেন।
‘হ্যাঁ। শাজাহান সংস্কৃত লিপিগুলো মুছে ফেলেন। তাজমহলে ঢোকার প্রবেশপথে বিশাল দুটো পাথরের হাতির মূর্তি ছিল, যা যেকোনো হিন্দুপ্রাসাদে থাকত, সেই হাতি দুটোকে গুঁড়িয়ে দেন। টমাস টুইনিং নামে একজন ইংরেজ ইতিহাসবিদ লিখে গেছেন সেই হাতির কথা। আর এতসব কাণ্ডগুলো জনসাধারণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য পুরো জায়গাটার চারপাশে ইট দিয়ে কয়েক মানুষ উঁচু বিশাল এক পাঁচিল তুলে দেন, সেইজন্যই টাভার্নিয়ার তাঁর ভ্রমণপঞ্জিতে লিখে গিয়েছিলেন যে ইট দিয়ে পাঁচিল তোলার খরচ সবচেয়ে বেশি ছিল। কুড়ি বাইশ বছর পর যখন সেই ইটের পাঁচিল ভাঙা হয়, ইটের ওপাশ থেকে তাজমহল আবার দৃশ্যমান হয়, তখন গোটা একটা প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাজমহল শাজাহানই বানিয়েছিলেন।’ অঘোরেশ বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, ‘আরও প্রপার এভিডেন্স চান? আরও প্রপার?’ ঝোলা থেকে তড়িদ গতিতে একটা ডায়েরি বের করে তার ভাঁজ থেকে একটা মলিন ফটোকপি বের করলেন, ‘এই দেখুন! ১৬৫২ সালে বাবাকে ফার্সি ভাষায় লেখা ঔরঙ্গজেবের দুটো চিঠির কপি। একটা নাম ”আদাব-ই-আলমগিরী”, আরেকটার নাম ”ইয়াদগার-ই-আলমগিরী”।’
‘কী লেখা আছে এতে?’ নাহুম খান জিজ্ঞেস করলেন।
‘শাজাহান তখনও সিংহাসনে, ঔরঙ্গজেব, দারাশুকো এবং অন্যান্য ছেলেরা আঞ্চলিক শাসনকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। ১৬৫২ সালে ঔরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের শাসনভার দেওয়া হয়, তিনি দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার সময় ঠিক করেন, আগ্রায় মায়ের সমাধিটা দেখে যাবেন। সেখানে গিয়ে বাবাকে ওই দুটো চিঠি লেখেন।’ অঘোরেশ চোখ পিটপিট করলেন, ‘১৬৫২ সালে ঔরঙ্গজেবের তাজমহলে গিয়ে কী দেখার কথা?’
নাহুম খান বিড়বিড় করতে লাগলেন, ভগতবীর সিং বলে উঠলেন, ‘তখন তো তাজমহল সবে তৈরি হয়েছে, একদম ফিনিশিং টাচ চলার কথা।’
‘ঠিক বলেছেন।’ অঘোরেশ বললেন, ‘এবার শুনুন, ঔরঙ্গজেব কী বলছেন।’ অঘোরেশ কাগজ থেকে পড়তে লাগলেন,
‘আমি মহরম মাসের তিন তারিখে আকবরাবাদ (অর্থাৎ আগ্রা) এসে পৌঁছে রাত্রিযাপন করলাম। পরের দিন শুক্রবার পবিত্র কবরে গেলাম মাকে শ্রদ্ধা জানাতে। স্মৃতিসৌধটা মজবুত অবস্থাতেই আছে। কিন্তু গম্বুজের উত্তরভাগে দুই-তিন জায়গায় ছিদ্র হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে জল পড়ে। দ্বিতীয় তলার কিছু বাসকক্ষ, চারটি ঝুলবারান্দা, কিছু গুপ্তকক্ষ এবং সাততলার ছাদও ভিজে গিয়েছে। এসব আমি সাময়িক মেরামত করিয়েছি।
কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, পরবর্তী বর্ষায় গম্বুজ, মসজিদ ও জমায়েতখানার কী দশাই-না হবে। আমার মনে হয় ইট পাথর সুরকি দিয়ে ভালো করে মেরামত করলে প্রাসাদগুলো অবক্ষয়ের হাত থেকে রেহাই পাবে। আশা করি পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশ দেবেন।
শনিবার আমি যুবরাজ দারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। আজ আট তারিখে আমি ঢোলপুরের কাছাকাছি রয়েছি।’
‘এটা সত্যিই ঔরঙ্গজেবের লেখা?’ অঘোরেশ থামতে-না-থামতেই নাহুম খান প্রশ্ন করলেন।
‘এটা তো আসল চিঠির কপি মাত্র। আপনি দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভসে গিয়ে দেখতে পারেন, ওখানে আসল চিঠি দুটো সযত্নে রক্ষিত আছে।’ অঘোরেশ বললেন, ‘এবার বলুন, যে প্রাসাদ সবেমাত্র তৈরি হয়েছে, তার এরই মধ্যে ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ার মতো দুর্দশা হয় কী করে! এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে যে শাজাহান পাঁচশো বছরের পুরোনো তেজোমহালয়কে অধিগ্রহণ করেছিলেন বলেই সেটা মেরামতের প্রয়োজন হয়েছিল।’
সবাই চুপ করে বসে ছিল। ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা। বাইরে গভীর রাত, কিন্তু কারুর চোখেই ঘুম নেই। পূরবী এরই মাঝে একবার এসে প্রত্যেককে কফি দিয়ে গেছেন।
প্রিয়মের চোখ জুড়ে আসছিল, কতক্ষণ প্লেনে ট্রাভেল করেছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু পুরো ঘটনাটা যেন ওকেও আস্তে আস্তে সম্মোহিত করে ফেলেছে।
‘এরকম আরও অনেক ছোটোখাটো অবজারভেশন আছে। যেমন তাজমহলের ওপরের যে গম্বুজটা, তার চুড়োটা।’ অঘোরেশ বললেন।
‘গম্বুজের চুড়োয় তো চাঁদ তারা, আমাদের ইসলামিক চিহ্ন!’ নাহুম খান বললেন।
‘ভালো করে দেখবেন, চাঁদ তারা তো আছেই, তার ওপর একটা জলের ঘটে মুড়ে রাখা আম্রপল্লব আর নারকেলও রাখা আছে।’ অঘোরেশ বললেন।
‘তাজমহলের প্রবেশপথের চারপাশেও লাল পদ্মফুল আর ত্রিশূলের আকৃতিতে খোদাই করা কাজ।’
‘মুসলিম কবরস্থানে কবরকে কেউ প্রদক্ষিণ করে না। কিন্তু টুরিস্টদের তাজমহলে চারপাশ প্রদক্ষিণ করার প্রভিশন রয়েছে, যেমন শিবলিঙ্গের চারপাশে থাকে। এমনকী প্রধান প্রবেশপথের ওপরে নহবতখানা রয়েছে, কোনো কবরস্থানে নহবত দেখেছে কেউ কখনো?’ অঘোরেশ নিজের মনেই বলে যাচ্ছিলেন।