অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৪

১৪

উজ্জয়িনী মহারানিবাগের রাস্তার পাশ দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছিল। আজ সকালের ফ্লাইটে ও দিল্লির বাড়িতে এসেছে। এসেই কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইচ্ছে থাকলেও কোথাও একা যাওয়ার স্বাধীনতা ওর নেই, সারাক্ষণ প্রহরীর মতো বাবার নিযুক্ত করা প্রহরীরা ও না চাইলেও পাহারা দিয়ে যাবে। বাধ্য হয়েই ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, তারপর একটা বড়ো মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছে চুপিসারে। ড্রাইভারকে বলে এসেছে সিনেমা দেখবে। সিনেমা দেখার জন্য কম করে আড়াই তিন ঘণ্টা ড্রাইভার এমনিই অপেক্ষা করবে, তারপর যতক্ষণে খোঁজখবর শুরু করবে, ততক্ষণে ও অনেক দূরে চলে যাবে।

ভয়ে, টেনশনে ওর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছিল। এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে হল, কাজটা ও ঠিক করছে তো? পরক্ষণেই একটা বেপরোয়া ভাব এসে ওকে ছুঁয়ে দিল, আলবাত ঠিক করছে! যারা আঠেরোটা বছরেও ওকে একটু শান্তি দিতে পারল না, ওকে বুঝতে পারল না, তাদের এত দাবিই-বা কীসের? সাবধানে রাস্তাটা ক্রস করে উজ্জয়িনী ভাবল।

দিল্লি। ওর জন্মভূমি। আঠেরো বছর আগে এখানেই ও জন্মেছিল। তবে আদৌ বাবামায়ের ভালোবাসার ফসল ছিল কি না কে জানে। জন্মভূমি হলেও ও বিশেষ কোনো টান অনুভব করে না শহরটার প্রতি। আসলে দিনের পর দিন এত একাকীত্ব, এত মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে ওকে, সেগুলো যেন মনে পড়ে যায়। এই শহরের যেটুকু ওর ভালো লাগে, সেটা হল, বিশাল বিশাল রাস্তাঘাট, আর ওপরে দু-পাশ থেকে তোরণের মতো করে ছাওয়া গাছ, পুরো আকাশটা যেন ঢেকে মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখন ওর অতদিকে খেয়াল নেই। একা একা হাঁটলেও তীব্র এক ভয়মেশানো মাদকতা ওকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখছিল, বাবার চেনা লোকের অভাব নেই, কেউ যদি ওকে দেখতে পেয়ে যায়?

সানগ্লাসটাকে ভালো করে চোখে এঁটে নিয়ে ওড়নাটাকে ভালো করে ঢেকে ও চলতে লাগল। এবারে ও প্রায় আটমাস পরে বাড়ি এল।

বাড়ি বলতেই অবশ্য মেয়ে হোস্টেল থেকে ফিরলে বাবা মায়ের যে হাসিখুশি মুখ সম্বলিত মুখ, দারুণ সব রান্না চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সে সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই ওর কপালে জোটেনি, ইন ফ্যাক্ট কোনোদিনই জোটে না।

বাবা মা কেউই ছিলেন না, বাবার একজন কর্মচারী এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি নিয়ে এল। বাবা নাকি বিদেশে, আর মা বেরিয়েছেন কোথাও।

ওর বাবা শুধু যে দিল্লির একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী তাই নয়, শাসক দলের সাংসদও। সারাদিনই নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন তিনি। মা ব্যস্ত তাঁর কিটি পার্টি আর এন জি ও, শপিং এসব নিয়ে।

মেয়েকে আনতে যাওয়ার সময় তাঁদের কোথায়?

সাংঘাতিক প্রাচুর্যে মোড়া দিল্লির একটা অত্যন্ত অভিজাত এলাকায় প্রচুর চাকরবাকর সমেত বিশাল একটা অট্টালিকা। তার সামনে মালির হাতে সযত্নে বেড়ে ওঠা বাগান, একপাশে গ্যারাজ অখার অন্দরমহলের সর্বত্রই দামি সামগ্রী আর বহুমূল্য শৌখিনতার ছাপ। বাড়ি বলতে এইটুকুই বোঝে ও।

বরং বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেঘালয়ে পড়তে গিয়ে বাবা মায়ের রোজকার অশান্তি, তিক্ততা থেকে ও মুক্তি পেয়েছে। শিলং-এর ওর ওই ছোট্ট সুন্দর ঘরটাই যেন এখন ওর পৃথিবী। ঘরের মধ্যেই থাক, বা সামনের গলফের মাঠটায়, কিংবা একটু হেঁটে যদি চলে যায় গমগমে জমজমাটি পুলিশবাজারে, নিজের মধ্যে যেন হারিয়ে যেতে পারে ও, বন্ধুহীন হয়েও সম্পূর্ণ নতুনভাবে আবার বেঁচে থাকার রসদ পায়, যেটা দিল্লি এলে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।

সেইজন্য ও বাড়ি আসতেও চায় না। কিন্তু, কিছু করার নেই। এমন একেকটা সময় আসে, যখন ইচ্ছে থাকলেও শিলং-এ থাকবার উপায় নেই। সেমেস্টার শেষ হলেই বাবা মা ফোন করে এমন করে যে সেই মুহূর্তে গলে যায় ও।

কিন্তু কোনোবারই এসে অন্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আগেরবারে ছুটিতে যখন এসেছিল, প্রথম তিন থেকে চারদিন বাবা মা চুপচাপই ছিল, খুব উৎফুল্ল না হলেও একসঙ্গে ডিনারটুকু করছিল ওরা, বিশাল ওই ডাইনিং-এ মাত্র তিনজন খেতে বসলে কেমন ফাঁকা ফাঁকাই লাগে।

বিশাল ঝাড়বাতি, প্রকাণ্ড ড্রয়িং-এ নাগেশ সিং-এর পূর্বপুরুষদের বহুমূল্য সব তৈলচিত্র, মেহগনি, হাতির দাঁতের তৈরি আসবাব, এত কিছুর মাঝে তিনজনকে মনে হয় গিলে খেতে আসে বাড়িটা। তবু টুকটাক কথাবার্তা চলছিল উজ্জয়িনীর পড়াশোনা, কলেজের কথা এইসব। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাবা মা-র সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে, সেটা ও শিলং-এ থেকেও বুঝতে পেরেছে।

ওকে ছোটো থেকে মানুষ করা বুয়া চুপি চুপি ফোনে বলেছে বাবার অফিসের এক মহিলা নাকি এর জন্য দায়ী। কস্তুরী তাঁর নাম।

কৌতূহলে তারপর থেকে ও যখনই ইউটিউবে বাবার ভাষণ শুনেছে, তখনই পাশে সেই মহিলাকে থাকতে দেখেছে। এমনকী, অনেক সময় বাবার অনুপস্থিতিতে মিডিয়ার মুখপাত্র হিসেবেও বক্তব্য রেখেছেন ওই মহিলা, ইন্টারনেটে দেখেছে ও।

উজ্জয়িনীর আঠেরো বছর মাত্র বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই ও যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে বাবা মা-র ঝগড়া, অশান্তি, কাদা ছোড়াছুড়ি দেখতে দেখতে, বাড়ির বাকি গোটা দশেক সারাক্ষণের কাজের লোকগুলোর মতোই এখন দেখেও না দেখার ভান করে ও নির্বিকারভাবে চলে যায় নিজের ঘরে। মনে পড়ে ছোটোবেলায় কত কাঁদত, একবার বাবাকে গিয়ে বোঝাত, একবার মাকে গিয়ে, দু-জনের কেউই বুঝত না, উলটে ওকে, একটা অবোধ শিশুকে সালিশি রেখে তিক্ত তর্ক করে যেত দু-জনে।

একটা ব্যাপার ওর কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, এরা এত বছর ধরে ঝগড়া করছে, অশান্তি করছে, একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ হয়ে লোক হাসাচ্ছে, তবু এরা ডিভোর্স করে না কেন? কোথায় যেন পড়েছিল ও একবার, জন্তুর মতো একসঙ্গে থাকার চেয়ে মানুষের মতো আলাদা থাকা অনেক ভালো। কিন্তু এরা সেটা মনে করে না। বাবার যদি সত্যিই অফিসের ওই মহিলার প্রতি দুর্বলতা জন্মে থাকে, মাকে ডিভোর্স দিয়ে সুন্দর একটা জীবন তিনি শুরু করতেই পারেন, কিন্তু তিনি তা করবেন না।

মা-ও বলা ছাড়বেন না। স্বামীর এই সম্পর্ক মানতেও পারবেন না, আবার ছেড়েও যাবেন না।

মাঝখান থেকে উজ্জয়িনীর মরে যেতে ইচ্ছা করে।

বিশ্বাস করতে ওর সত্যিই কষ্ট হয় এরা একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল!

উজ্জয়িনীর হঠাৎ খেয়াল হল, যে দোকানটার সামনে দাঁড়ানোর কথা, তার সামনে এসে পড়েছে। কিছুটা টেনশনে হোক, কিছুটা-বা আবহাওয়ার কারণে, ও বেশ ঘামছিল।

আজকের দিনটা ওর কাছে বেশ স্পেশাল।

গত কয়েক মাস ধরে যার সঙ্গে ও নিয়মিত কথা বলে আসছে, যে এতদিন ধরে ওর ডিপ্রেশনের সময় একটুও বিরক্ত না হয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অকুণ্ঠভাবে, তার সঙ্গে ওর আজ সামনাসামনি দেখা হবে। হোক বয়স একটু বেশি, এমন করে উজ্জয়িনীর দুঃখ কষ্টগুলোকে কে আগে এত ভালো অনুভব করেছে?

এমনিতে খুব একটা বেশি সাজে না ও, কিন্তু পৈতৃক সূত্রে পাওয়া খাঁটি রাজপুত রক্তের সৌজন্যে এমনিই চেহারায় এমন একটা আভিজাত্য আছে যাতে লোকে দু-বার ফিরে তাকায় ওর দিকে। ওর অকালপক্ব মস্তিষ্কের মতো অন্তত শরীরটাও ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, সে ঠিক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বেড়ে উঠছে, এইজন্য ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ দেয় ও।

একটা হালকা গোলাপি রঙের চিকনের সালোয়ার কামিজ পরেছে ও আজ। চুলটাকে যত্ন কর বেঁধেছে চুড়ো করে। ভোরের ফ্লাইটের ধকলে কিছুটা ক্লান্তি এলেও উত্তেজনায় সেই ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে উজ্জয়িনী।

আঠেরো বছর বয়সটা যেন শুঁয়োপোকার খোলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে ওঠার আগের পর্যায়, প্রজাপতির রূপ তখনও ঠিকমতো পরিস্ফুট হয় না, অথচ শুঁয়োপোকাতে আটকে থাকতেও মন চায় না!

শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল উজ্জয়িনী, মুখোমুখি চিনতে পারবে তো! জামার রং থেকে শুরু করে আরও বিবরণ যদিও দেওয়া আছে, তবু।

আর চিনতে পারলেও যদি ফোনের গলার আওয়াজের মতো উজ্জয়িনীকে ভালো না লাগে? যদি মোহ কেটে যায় এক লহমাতেই? কী করবে ও তাহলে? নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল বেশ।

কাঁধে কার একটা হাত পড়তেই ও চমকে পেছনে তাকাল, আর ওপাশের পুরুষকণ্ঠ খুব নরম অথচ গাঢ়ভাবে বলে উঠল, ‘উজ্জয়িনী! একটু দেরি হয়ে গেল। এত জ্যাম!’

ও আর সোজাসুজি তাকাতে পারল না, হালকা বাদামী রঙের শার্ট আর সমুদ্রনীল জিনস কি না সেটা ভেরিফাই করারও আর প্রয়োজন নেই ওর, ওই গলা ও ঘুমন্ত অবস্থাতেও বুঝি চিনতে পারবে! বরং কোথা থেকে ওর স্বভাব-বহির্ভূত একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করছিল ওকে।

খানিক আড়ষ্টভাবে ও বলল, ‘না, দেরি কোথায়! ঠিক আছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *