২৩
অটো হু হু করে ছুটছে যমুনা নদীর পাশ দিয়ে, ওপাশে রাতের তাজমহল ঝলমল করছে যেন হাজার নক্ষত্রের মতো। জানুয়ারি মাসের কনকনে হাওয়া অটোর ফাঁক দিয়ে ঢুকে যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে ওদের তিনজনকে। সুরঞ্জন গায়ের শালটা মাথায় চাপা দিয়ে বসে আছেন। অঘোরেশ মাঝখানটায় বসে গুটিসুটি মেরে রয়েছেন, বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখেছেন তাঁর ঝোলাটা।
রুদ্র চুপচাপ বসে বসে অঘোরেশ ভাটের যুক্তিগুলো ভাবছিল। সত্যিই কি তাজমহল কোনো মন্দির ছিল? কিন্তু সত্যিই যদি এত বড়ো কারচুপি হয়ে থাকে, কেউ টের পেল না?
ওর হঠাৎ মনে পড়ল ড ব্রিজেশ মাথুরের কথা। অত বড়ো ঐতিহাসিক এটাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন যখন, তখন নিশ্চয়ই তারও কিছু পালটা যুক্তি আছে। কিন্তু সেগুলো জানা যাবে কী করে?
রুদ্র নিঃশব্দে সুরঞ্জনের গায়ে টোকা দিতেই সুরঞ্জন ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’
রুদ্র ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আস্তে কথা বলতে বলল, ‘বাবা, তুমি ড ব্রিজেশ মাথুরকে চেনো তো?’
সুরঞ্জন বললেন, ‘ওমা, অত বড়ো হিস্টোরিয়ান, আর ওঁকে চিনব না?’
‘আরে ওই চেনা বলছি না, ব্যক্তিগতভাবে চেনো কি?’ রুদ্র বলল, ‘ওঁর সঙ্গে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পারলে খুব ভালো হত। অনেক কিছু জানা যেত।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘আগে যখন এ এস আই-তে ছিলাম, তখন পরিচয় ছিল। ওঁর অফিসের ফোন নম্বর ছিল। কিন্তু এখন…!’ পরক্ষণেই কী মনে হতে বললেন, ‘তবে সতীশের সঙ্গে ওঁর সম্ভবত এখনও যোগাযোগ আছে। দাঁড়া, সতীশকে একটা হোয়াটসঅ্যাপ করি।’
রুদ্র বাবাকে তড়িঘড়ি ট্যাব অন করতে দেখে মনে মনে হেসে ফেলল। যাক, বাবাকে জন্মদিনে ট্যাব উপহার দেওয়াটা সার্থক হয়েছে।
তাজমহলের দিকে তাকিয়ে রুদ্রর মনটা আবার হু হু করে উঠল। মাত্র দু-দিনের মধ্যে একের পর এক ঝড় বয়ে চলেছে ওর ওপর দিয়ে। অফিসের ব্যাপারটা এখনও কিছু ফয়সালা করে উঠতে পারল না, এদিকে উটকো এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল।
এইসময় সবচেয়ে বেশি যাকে দরকার ছিল, সে-ই কত দূরে, এমনকী কথাটুকু বলার উপায় নেই। ওর হঠাৎ মনে পড়ল আজ বিকেলে প্রিয়মের অফিসে ওর ফোন করার কথা ছিল, তাড়াহুড়োয় একদম ভুলে গেছে। কথাটা মনে পড়তেই ও আবার ফোন করল, কিন্তু এবারেও সেই ‘নট রিচেবল’ টোন।
হঠাৎ কী মনে হতে ও ফোন থেকেই প্রিয়মের ইমেল অ্যাকাউন্ট খুলল। হতে পারে প্রিয়ম ওর থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে, কিন্তু কোনো ব্যাপারেই দূরত্ব আসতে দেয়নি দু-জনের কেউই। এখনও দু-জনের জীবনই দু-জনের কাছে খোলা পাতা। তাই রুদ্রর সব কিছুর পাসওয়ার্ড যেমন প্রিয়ম জানে, তেমনই প্রিয়মেরটাও ওর মুখস্থ।
হিমেল হাওয়ায় হাত যেন জমে যাচ্ছে, তারই মধ্যে আঙুলের ঘষায় শয়ে শয়ে মেল পার করতে লাগল রুদ্র। না, কাল সকাল থেকে সব ইমেলই অদেখা অবস্থায় পড়ে আছে। কাল সকাল থেকে কি তাহলে না ফোন, না ইমেল, কোনোকিছুই দেখার সময় পায়নি প্রিয়ম?
কিন্তু কেন? নেটওয়ার্কের এত সমস্যা? সেক্ষেত্রে প্রিয়মের কি উচিত ছিল না বুথ, অফিস বা অন্য যেকোনো জায়গা থেকে রুদ্রকে একবার ফোন করে ব্যাপারটা জানানো?
এত ঝামেলার মধ্যেও রুদ্রর রাগে নাকের পাটা ফুলছিল। হঠাৎ একটা ইমেলে এসে চোখটা আটকে গেল ওর।
একটা এয়ারটিকিট। গতকালের।
লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে আগ্রার ফ্লাইটের।
পুরো ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই একটা খুশির তুবড়ি যেন দুম করে ফেটে গেল রুদ্রর মনের মধ্যে, মুহূর্তে সব দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে আনন্দে ভরে উঠল মনটা।
প্রিয়ম আগ্রা আসছে!
আনন্দের চোটে ও বাড়িতে ফোন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মোবাইলের স্ক্রিনে নাহুম খানের মুখ ভেসে উঠল। এই এতক্ষণে ভদ্রলোক ফোন করছেন, ‘হ্যাঁ, বলুন?’
রুদ্র ঝড়ের গতিতে বলতে লাগল, ‘আপনাকে কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি। শুনুন, আমি অঘোরেশ ভাটকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছি, আপনি এখুনি ওঁর বাড়ি যান। যেকোনো মুহূর্তে ওই বাড়িতে হামলা হতে পারে, হয়তো এর মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।’
‘মানে?’ বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে নাহুম খানের গলা শোনা গেল, ‘আপনি অঘোরেশকে পেলেন কোথায়?’
রুদ্র ফোনে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে ব্যাপারটা বর্ণনা করল, তারপর বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা বড়ো গণ্ডগোল হচ্ছে মি খান। অঘোরেশের পক্ষে এত বড়ো প্ল্যান করাটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না আমার, আপনাকে আমি অনেকবার ফোন করেছি, পাইনি। আমার বাবা অঘোরেশ ভাটের কলেজ জীবনের বন্ধু, আজ সকালে আগ্রা আসার সময় বাবার সঙ্গে দেখা হয় ট্রেনে। তারপর দুপুরে উনি বাবাকে ফোন করে দেখা করতে বলেন, ”জরুরি দরকার” বলে। আমি যখন বাবার সঙ্গে এসেছিলাম তখনও আমি জানতাম না যে উনিই অঘোরেশ ভাট।’
‘কিন্তু, আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওঁকে?’ নাহুম খান চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাই গড! আপনি আর আপনার বাবা-ই তার মানে এতক্ষণ অঘোরেশ ভাটের বাড়িতে ছিলেন? আমার লোক আপনাদের কথাই বলেছে। শুনুন ম্যাডাম, আপনি এভাবে একজন ক্রিমিনালকে নিয়ে পালাতে পারেন না! আপনাকেও কিন্তু অ্যারেস্ট করা হবে।’
রুদ্র মুখ দিয়ে বিরক্তির একটা আওয়াজ করল, কলকাতা হোক কি আগ্রা, পুলিশের লোক মানেই যেন কনভেনশনের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না।
অঘোরেশ ভাটের জানলায় উঁকিঝুঁকি মারা লোকটা তার মানে নাহুম খানেরই ফিট করে রাখা পুলিশের লোক। ওরা পেছন দিয়ে পালাচ্ছে বুঝে ও-ই তার মানে বেল বাজিয়েছিল!
নাহুম খানকে রুদ্র অন্যরকম ভেবেছিল। ও বলল, ‘কিন্তু মি খান! অঘোরেশজি কিন্তু আমাদের একবারও বলেননি যে উনি বা ওঁর আদৌ যদি কোনো দল থেকে থাকে, তারা তাজমহলে হামলার চেষ্টা করছে। উনি শুধু ওঁর রিসার্চ নিয়েই মত্ত ছিলেন মনে হচ্ছে।’
‘তাহলে সারা আগ্রায় রাতারাতি তাজমহল নিয়ে ওই পোস্টার কারা সাঁটল? আর দেড় কোটি টাকাই-বা ওঁর অ্যাকাউন্টে রাতারাতি ঢুকল কীভাবে? আমাদের কাছে খবর আছে এদের পেছনে কোনো বিদেশি চক্র টাকা ঢালছে, যাদের উদ্দেশ্য ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো। একে ওইরকম উসকানিমূলক পোস্টার, তার ওপর এত অস্ত্রশস্ত্র, আর বারো ঘণ্টাও দেরি নেই ছাব্বিশ তারিখ শুরু হতে।’ নাহুম খান চিৎকার করছিলেন, ‘আপনি কোথায় শিগগিরি বলুন। এখন আর একটুও দেরি করা যাবে না। আমাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তে রায়টে ছারখার হয়ে যেতে পারে গোটা শহর।’
‘আরে বলছি তো, চেঁচাচ্ছেন কেন!’ রুদ্র বলল, ‘আমি আর বাবা ওঁকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। আপনি আসুন। কিন্তু তার আগে অঘোরেশের বাড়ি যান। ওখানে হামলা হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে, ওঁর স্ত্রী অসুস্থ, ওঁকে দেখুন।’
‘কার স্ত্রী?’ এত জোরে খেঁকিয়ে উঠলেন নাহুম খান, রুদ্রর মনে হল কানটা বুঝি ফেটে যাবে।
‘অঘোরেশ ভাটের মিসেসের কথা বলছি আমি। উনি অসুস্থ, হামলাকারীরা ওঁর ক্ষতি করতে পারে!’ রুদ্র অঘোরেশের কান বাঁচিয়ে কথাগুলো বলল। তবে অঘোরেশ শুনছেন বলে মনে হল না, অটোয় ওঠার পর থেকেই মাথাটা একদিকে হেলিয়ে বসে রয়েছেন।
ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
নাহুম খান চেঁচালেন, ‘আরে তিনি ইহলোকে থাকলে তো কেউ ক্ষতি করবে!’
‘মানে? ইহলোকে থাকলে মানে? ওঁর স্ত্রী ভেতরের ঘরে শয্যাশায়ী রয়েছেন।’ রুদ্র কানের মধ্যে ফোনটাকে আরও জোরে চেপে ধরল। নাহুম খানের কথা ও কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘বাহ, ভালোই মুরগি করেছে আপনাদের। অঘোরেশ ভাট সম্পর্কে সব ইনফরমেশন এসে পৌঁছেছে আমাদের কাছে। ওঁর ইউনিভার্সিটির এক কলিগই সব জানিয়েছেন আজ। উনি কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের লোক। বিয়েও করেছিলেন ওই সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে। ১৯৯০ সালে ওঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হতে কিছুদিনের জন্য তাঁকে কাশ্মীরে রেখে আগ্রায় ফিরেছিলেন কাজে। অঘোরেশ চলে আসার পরেই কাশ্মীরে গণ্ডগোল শুরু হয়। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে তার অনেকদিন আগে থেকেই জিহাদ শুরু হয়েছিল, আর সেইসময় হিজাব-উল-মুজাহিদিন নামে একটা উগ্রপন্থী দল পুরো জায়গাটাকে দখল করে কাশ্মীরে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা হিন্দুদের তাড়াতে শুরু করল। প্রাণভয়ে ওখানকার হিন্দুরা পালাতে শুরু করেন। সেইসময় অগণিত হিন্দুকে খুন করা হয় ওখানে।’ নাহুম খান এতটা টানা বলে হাঁপাচ্ছিলেন, ‘তার মধ্যে অঘোরেশের পূর্ণগর্ভা স্ত্রী, বাবা, মা-ও ছিলেন। জঙ্গিরা কাউকে রেহাই দেয়নি।’
রুদ্র চমকে উঠে আড়চোখে তাকাল অঘোরেশের দিকে, ‘কী বলছেন!’
নাহুম খান বললেন, ‘তারপর থেকেই নাকি অঘোরেশের মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। মুসলমানদের প্রতি প্রচণ্ড একটা ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল ওঁর মনে। প্রথম প্রথম ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করলেন, তারপর রোগের প্রকোপ আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। স্ত্রী জীবিত না থাকতেও সহকর্মীদের কাছে গিয়ে গল্প করতেন আজ স্ত্রী অমুক রান্না করেছেন, তমুক কথা বলেছেন। কর্তৃপক্ষ দু-বার শো-কজও করেন বিভিন্ন বিতর্কিত কথা বলার কারণে। তারপর নিজে থেকেই দুম করে একদিন চাকরি ছেড়ে দেন।’
‘কিন্তু, আমরা বাইরের ঘরে বসেছিলাম, উনি ভেতরের ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তর্ক করছিলেন, নিজের কানে শুনেছি!’ রুদ্রর শরীরে কেমন কাঁপুনি দিচ্ছিল।
‘আরে, ওঁর কলিগরা জানিয়েছেন উনি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগি। এমনিতে ঠিক থাকেন, কিন্তু মাঝেমধ্যেই বিগড়ে যান। তখন মৃত স্ত্রীর সঙ্গে নিজেই কথা বলেন, নিজেই ঝগড়া করেন।’ মুহূর্তে গলার স্বর চড়ালেন নাহুম খান, ‘এরকম একটা সাংঘাতিক অসুস্থ ক্রিমিনালকে নিয়ে আপনি চলে গেলেন, চিন্তা করুন একবার আমার অবস্থাটা!’
নাহুম খানকে দেখতে না পেলেও রুদ্রর মনে হল উনি রাগে দাঁত কিড়মিড় করছেন।
‘আচ্ছা আপনি আমার ফ্ল্যাটে চলে আসুন!’ কথাটা বলে রুদ্র অঘোরেশের দিকে তাকাল, ভদ্রলোক এখন আবার জেগে উঠেছেন, নিজের মনেই বিড়বিড় করছেন। ভয়ে ওর ভেতরটা কেমন করে উঠল, ‘আপনি এখুনিই চলে আসুন মি খান!’
উত্তেজনার বশে ও কি আদৌ ঠিক করল কাজটা?
রুদ্র শুধু অস্ফুটে অটোওয়ালাকে বলতে পারল, ‘ভাইয়া, থোড়া জোর চালাইয়ে!’