অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৬

পুরোনো দিল্লির যে ঘিঞ্জি গলিটা এঁকেবেঁকে এসে আজমেরি গেটের দরজার পাশে মিশে গেছে, ঠিক সেইখানটায় এসে পিচিক করে একদলা থুতু ফেলল মুন্না। ওর সারা শরীরে, চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। গোটা রাত ধরে ট্রেনের সাধারণ কামরায় একরকম বলতে গেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে, শেষে ঘণ্টাখানেক একটু বসে ঝিমোতে পেরেছিল, তাতে ক্লান্তিটা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়ে যেন পা দুটোকে টেনে ধরছে।

শরীরের জড়তাটা একটা ঝটকা মেরে কাটিয়ে নিতে চেষ্টা করল ও, তারপর পায়ে পায়ে এগোল সামনের দিকে। এই তবে দিল্লির বিখ্যাত জি বি রোড! পাশের একটা ঝলমলে দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে চেষ্টা করল, কী লেখা আছে যেন? মুন্না থমকে দাঁড়িয়ে বানান করে পড়ল, গার্সটিন ব্যাস্টিয়ন রোড। বাপ রে, কী খটোমটো নাম! নির্ঘাত কোনো সাহেবের নামে।

এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, ওই খটোমটো নামওয়ালা সাহেবও কি এই পাড়ায় আসত নাকি?

আসার আগে শাকিল বলেছিল, ‘কলকাতার সোনাগাছি তো গেছিস, জি বি রোড হল দিল্লির সোনাগাছি। কিন্তু এখানে ঝড়তিপড়তি পাবি না, টপ ক্লাস মাল সব। পুরো আজমেরি গেট থেকে লাহোরি গেট অবধি সোজা চলে যাবি ভাই, দু-পাশে কত চাই, পাঁচশোর ওপর বাড়ি, সকালটায় নীচে সব লোহার পার্টসের দোকান, রাতে দেখবি সামনের ওই দরজাগুলোতেই সব সার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ মুন্না খুব উৎসাহ পাচ্ছে এমনভাবে বলেছিল, ‘কিন্তু রেট সাধ্যের মধ্যে হবে কি?’

‘আব্বে, তুই শাকিলের ভাই আর তোর হবে না? কী বলছিস!’ শাকিল ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বলেছিল, ‘জি বি রোড শুরু করেই সোজা হাঁটবি, পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখবি দিকে একটা সাইকেল সারানোর দোকান, তার গা দিয়ে সরু গলি আছে, ওটা দিয়ে সোজা ঢুকে যাবি, যে গোলাপি বাড়িতে ধাক্কা খাবি, ওটা চাঁদনির বাড়ি, সোজা দেখা করে আমার নাম বলবি। বলবি তুই শাকিলের ভাই, ব্যস! আর দেখতে হবে না। চাঁদনির হাতে ঝক্কাস সব মাল আছে, তোর সেটিং হয়ে যাবে পুরো!’ শাকিল জোরে চোখ টিপেছিল।

হ্যাঁ, দোকানটা দেখতে পাচ্ছে মুন্না, সামনে সার দিয়ে সব সাইকেল পড়ে আছে, দেখতে পাচ্ছে তার পাশ দিয়ে ঘিনঘিনে গলিটাও। কিন্তু ও ঢুকল না। ঘড়িতে এখন সন্ধে সাড়ে ছ-টা। আগে ওর কাজটা মিটুক। ফেরার পথে চাঁদনির সঙ্গে দেখা করে রাতটা কাটিয়ে গেলেই হবে।

সবে সন্ধে নেমেছে বলেই হয়তো, দু-পাশে সার দিয়ে হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোর সামনের দরজাগুলোতে এখনও ভিড় জমেনি। রাস্তার আলোয় পুরো গলিটাকেই কেমন যেন সিনেমার মতো ঝলমলে লাগছে। কাছেপিঠে চড়া সুরে একটা চটুল হিন্দি গান বাজছে।

মুন্না একটু দাঁড়াল, ওই তো দূরে গুলশন পান সেন্টার। ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাছে এগিয়ে গেল গুটিগুটি, ধীরেসুস্থে সিগারেট কিনল একটা, পাশের দড়ি থেকে আগুন নিয়ে জোরে একটা টান দিল, ‘খুচরো তো নেই ভাই, দু-হাজারের নোট!’ মোলায়েম স্বরে কথাটা হাতে ধরা গোলাপি নোটটা এগিয়ে দিল ও।

এই নোট কি বাজারে চলবে? গান্ধীজির মুখে ধ্যাবড়া পেনসিলে আঁকিবুকি।

পানওয়ালা একটা গালাগাল দিতে গিয়েও বিরক্তির ভাব করে থেমে গেল, ওর নোটটার দিকে আলতো তাকিয়ে নীচের দিকে নিস্পৃহভাবে সুপুরি থেঁতো করতে করতে বলল, ‘কী নাম?’

মুন্নাও নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘মুঙ্গের থেকে আসছি। দেখা করব। বলা আছে।’

প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর এ গলি সে-গলি ঘুরে শেষ পর্যন্ত যখন একটা ঘরে গিয়ে বসতে বলা হল মুন্নাকে, ততক্ষণে এই ঠান্ডাতেও ও ঘেমেনেয়ে উঠেছে। নীলচে নিয়নের আলোতে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে সেখান থেকে কিছুক্ষণ জল খেল ও, তারপর সোজা হয়ে বসে মনে মনে সাজিয়ে নিল কী বলবে। বন গাঁয়ে আসলে ও শিয়ালরাজা, এত বড়ো ব্যাপারে এসে আদতে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার।

বাইরে এবার আরও চড়া লয়ে সফটওয়্যারে বিকৃত করা রিমেক গান শুরু হয়েছে। এখান থেকে খুব একটা দেখা না গেলেও এটা যেহেতু দোতলা, নীচের মেয়েলি হাসাহাসি কানে আসছিল মুন্নার। মন উচাটন হলেও কিছু করার নেই। এবার হাতে পয়সা বেশি নেই, একদিনের নোটিশে দিল্লি আসতে হয়েছে, রাতটা ওই শাকিলের চাঁদনির কাছে ম্যানেজ করতে পারলে কিছুটা টাকা বাঁচবে।

হঠাৎ দরজার কাছে একটা ছায়ামূর্তির আগমনে ও চমকে তাকাল। এই ঘরে আসার আগে তিন পর্বে দফায় দফায় ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এটা কি ফাইনাল দফা?

সামনে এসে যে লোকটা ওর মুখোমুখি বসল, তাকে দেখে ও দমে গেল। হাইট মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ ফুট হবে, উচ্চতার সঙ্গে বিসদৃশ হয়ে পেটের থেকে অনেকটা বেরিয়ে থাকা ভুঁড়িটায় আরও বেঢপ দেখাচ্ছে গোটা শরীরটা। গায়ের রংটা বেশ ফর্সা, কিন্তু কেমন যেন বাদামি। লোকটার ঊর্ধ্বাঙ্গে এই ঠান্ডাতেও শুধু একটা টি শার্ট, আর নীচে খাকিরঙা প্যান্ট। হাতে একটা আপেল।

পেছন পেছন আরও দুটো লোক এসে লোকটার দু-পাশে দাঁড়াল। হাবভাব মাছের গন্ধ পাওয়া সতর্ক হুমদো বেড়ালের মতো। বডিগার্ড নির্ঘাত।

সামনের সোফায় বসে লোকটা ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপভাবে তাকাল, তারপর বলল, ‘মনসুর পাঠিয়েছে? কী চাই?’

এমন চেহারা থেকে এরকম গম্ভীর স্বর বেরোতে মুন্না একটু থমকে গেল, তবে তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। অনেক মহড়া দিয়ে এসেছে সে, আসল সময়ে সব পণ্ড করার বান্দা সে নয়। একবার এত বড়ো দাঁওটা মারতে পারলে এবারের ইলেকশনের টিকিট ওর বাঁধা। হাত কচলে দেঁতো হেসে বলল, ‘মনসুর ভাইয়া আমাকে খুব ভালোভাবে চেনেন। আমি মুন্না শেখ। বিহারের মুঙ্গের থেকে আসছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে।’

‘ওহ, তুমিই সেই মুঙ্গেরের বাদশা?’

লোকটা কি ওকে বিদ্রূপ করছে? করলে করুক, এখন এইসব ছোটোখাটো খোঁচা গায়ে মাখলে মুন্নার চলবে না।

‘হে হে কী যে বলেন হুজুর!’ মুন্না কান-এঁটো-করা হাসি দিল একটা।

‘না সত্যি!’ লোকটা বেশ সিরিয়াস মুখে ওর দিকে তাকাল, ‘আমি মুঙ্গের সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি। শুধু ইন্ডিয়া নয়, নেপাল বাংলাদেশেও মুঙ্গেরের মাল নাকি সাপ্লাই হয়। একটা পিছিয়ে থাকা রাজ্যের অখ্যাত শহরে রাতারাতি এত বড়ো সেট আপ তৈরি হল কী করে?’

‘রাতারাতি কী বলছেন হুজুর!’ মুন্না হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘দু-শো বছরের পুরোনো আমাদের মুঙ্গেরের এই ব্যাবসা। ইংরেজরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ওখানে কার্ট্রিজ বন্দুক বানানোর কারখানা খোলে। তারপর দেশ স্বাধীন হল। বাষট্টি সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তো সরকারকে সব চারশো দশ বোরের মাসকেট বন্দুক সাপ্লাই দিয়েছিল মুঙ্গের অর্ডিন্যান্স কারখানাই।’

‘বটে? তুমি তো বেশ পড়ালেখা জানা লোক দেখছি!’ লোকটা বেশ চমৎকৃত হয়েছে মনে হল।

‘জ্বি না, স্যার।’ মুন্না লজ্জায় হাত কচলাচ্ছিল, ‘আসলে বাপ ঠাকুরদার তো এই ব্যাবসা, ছোটো থেকে এই গল্প শুনছি। তারপর সরকার দুম করে ওই কারখানা তুলে দিল আর মুঙ্গেরের হাজার হাজার লেবার পথে বসল। তারপর সবাই কী আর করবে, পেট তো চালাতে হবে! কাজ বলতে তো বন্দুক, বানানোটাই জানত তারা। তখন নিজেদের বাড়িতেই ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ, কারখানা, এইসব খুলে ফেলল। আমার ঠাকুরদাও তাই করেছিল। সেই থেকেই আর কি আমাদের ব্যাবসা…!’

‘কী কী বানাও তোমরা?’ লোকটা মোবাইলে কিছু দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল।

‘জ্বি, আগে তো শুরু হয়েছিল দিশি কাট্টা বন্দুক দিয়ে, এখন ছয় মিলিমিটারের পিস্তল, কারবাইন, এ কে ৫৬, এ কে ৪৭, সবরকমই বানাতে পারে আমাদের লোকেরা।’

‘ফরটি সেভেন?’ লোকটা যেন অবাক হল, ‘বটে? এম ১৬-ও বানাও?’

মুন্না মাথা চুলকোল, ‘এজ্ঞে, ওটা এখনো হয় না। এ কে ৪৭ এর রোল সাবমেশিনগানের মতোই, অল্প পার্টস, ৩০ ক্যালিবারের বুলেট, স্টপিং পাওয়ারও বেশি। এম ১৬-এর প্রচুর পার্টস, খুলতে জুড়তে অনেক ঝামেলা, তার ওপর ২২ ক্যালিবারের বুলেট, পাওয়াও একটু মুশকিল। আমাদের এ কে ৪৭ দেখতে হয়তো খুব সুন্দর হয় না, কিন্তু কাজে একদম বড়িয়া!’

‘হুম।’ লোকটা আপেলে একটা মস্ত কামড় বসাল, ‘দাম কীরকম হয়?’

মুন্না এতক্ষণে উৎসাহ পেয়ে নড়েচড়ে বসল, ‘হুবহু স্মিথ ওয়েসনের যে মডেল বলবেন, বানিয়ে দেব, দাম তিরিশ থেকে এক-এর মধ্যে হয়ে যাবে স্যার!’

‘ফরটি সেভেন কত করে?’

‘ওটা পাঁচ থেকে ছ-লাখ পড়ে যাবে। কার্বাইন যদি নেন, দুয়েতেই দিয়ে দেব।’

‘একটা শটের পিস্তল?’

মুন্না দমে গেল, ‘ওটা তো বাচ্চা ছেলেদের বন্দুক। একটাই বুলেট ফায়ার করতে পারবে।’

লোকটা সরু চোখে ওর দিকে তাকাল।

‘বাঁ-পাশের লম্বা দাড়িওলা লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠল, ‘যা জিজ্ঞেস করছে উত্তর দে!’

‘পাঁচশোর মধ্যে হয়ে যাবে।’ মুন্না মিনমিন করল, ‘তবে কোথাও ডেলিভারি করতে গেলে হাজার দুয়েক পড়ে যাবে। রাস্তায় পুলিশ, ড্রাইভারদের খাওয়াতে হবে তো!’

‘গ্রেনেডের স্টক কেমন আছে?’

‘হয়ে যাবে স্যার!’

‘ফুল পেমেন্টের কত দিনের মধ্যে ডেলিভারি দিতে পারবে?’

এমনিতে তো পঞ্চাশ পারসেন্ট অ্যাডভান্স দিতেই লোক গাঁইগুঁই করে, ভোটের আগে যা একটু জোর খাটানো যায়। আর এ প্রথমেই ফুল পেমেন্ট করে দেবে? আনন্দে মুন্নার চোখ চকচক করে উঠল, ‘জ্বি, সিঙ্গল শট পিস্তল হলে একটা বেলা বড়োজোর! মাল তৈরিই থাকে, শুধু আনার যা সময়।’

‘বহোত খুব!’ লোকটা এবার ওর দিকে বেশ সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাল, ‘তা, মনসুর কী বলেছে, আমি তোমার থেকে মাল নেব? আমার সব ডিটেইলস আছে তোমার কাছে?’

মুন্না এবার কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ‘না, মানে আপনি মনসুর ভাইয়ার চেনা, ডিটেইলস আমরা তো তেমন রাখি না, টাকা পেলেই…!’

‘যদি আমি পুলিশ হই? ফাঁদ পেতে পুরো স্টকটাই তোমার সিজ করে দিই?’ লোকটা বেশ মজার চোখ করে কথাটা বলল।

মুন্না এবার ঢোঁক গিলল। অনেকক্ষণ ধরেই আনতাবড়ি প্রশ্ন চলছিল, এবারেরটা একেবারে ইয়র্কার! এটা খেলার সাধ্যি মুন্না শেখের নেই।

লোকটা উঠে দাঁড়াল, একটা ঢেকুর তুলে বলল, ‘কাস্টমার সবসময় যাচাই করে নেবে। টাকা দিলেই মাল দেব, এই প্রিন্সিপল তোমার ব্যাবসায় চলে না। বুঝেছ?’

মুন্না ঘাড় দোলাল, ‘জ্বি।’

লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পাশের লম্বা কুর্তা পরা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওয়াসিম তোমার সঙ্গে বসছে। ও তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। কাল সকালের মধ্যেই চাই। মাল আমরা কিনব, কিন্তু এখানে ডেলিভারি নেব না।’

মুন্না শুনে পুলকিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, শেষ বাক্যটা শুনে ও অবাক হয়ে তাকাতে গেল লোকটার দিকে। যাচ্চলে, এখানে ডেলিভারি নেবে না তো আবার কোথায় নেবে!

কিন্তু লোকটা ততক্ষণে পর্দা সরিয়ে ওর দৃষ্টিশক্তির বাইরে চলে গেছে। ওয়াসিম মেরুন-রঙা সিল্কের কুর্তা গুটিয়ে বসেছে সোফার ওপর। কুর্তার পকেট থেকে কালো মতো যেটা উঁকি দিচ্ছে, সেটা যে আগ্নেয়াস্ত্র, তা আর্মস ডিলার মুন্না এতদূর থেকেও হলফ করে বলতে পারে। এই লোকটাকে দেখেই মনে হয় ঠান্ডা মাথায় কাউকে খুন করতে এর চোখের একটা পাতাও কাঁপে না।

মনসুর ভাইয়া সাবধান করে দিয়েছিল বিশাল বড়ো পার্টি বলে। বলেছিল, ‘মুন্না, ঠিকমতো ডিল করতে পারলে যা ইনকাম করবি, সারাজীবন চাইলে বসে খেতে পারবি।’

আপেল খাওয়া লোকটা কে? গায়ের রং দেখে মনে হয় জি বি রোডের এই এঁদো গলিটা যেন ওর জায়গা নয়। হিন্দিটাও অন্যরকম।

কী মতলব ওর? পোড় খাওয়া আর্মস ডিলার মুন্না শেখ এই ঠান্ডাতেও কেমন যেন ঘামতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *