অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩৬

৩৬

‘এইরকম একটা মুদ্রা নিজামুদ্দিন পেল কোথায়?’ ড ব্রিজেশ মাথুর ফোনে প্রশ্ন করলেন।

‘উনি নাকি খাজুরাহোর ওখানে এক্সক্যাভেশনে পেয়েছিলেন।’ রুদ্র বলল, ‘সেই মুদ্রা দিয়েই যমুনার এপাশের মেহতাববাগ থেকে ওপাশে তাজমহলের নীচে পৌঁছোনো যায়।’

ড মাথুর মুহূর্তে উত্তেজিত, ‘জাইলস টিলোটসনের একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম, তাজমহলের আগে সেখানে রাজা মানসিংহের একটা ছোটো প্রাসাদ ছিল। তুমি কাল বলার পরে আমি পড়াশুনো করলাম, শুধুমাত্র এই কারণেই আবদুল হামিদ লহরী বাদশাহনামাতে ওই জায়গাটাকে ”মঞ্জিল-এ-রাজা-মানসিং” লিখে গিয়েছিলেন। হতেই পারে মানসিংহই ওই সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন। পরে তাজমহল বানানোর সময় শাজাহান আর সেটা নষ্ট করেননি।’

রুদ্র ফোন রাখার আগে ড মাথুর বললেন, ‘শোনো, তুমি আমাকে কিন্তু যা হচ্ছে কিন্তু জানিয়ো।’

দূরে মেহতাববাগের সাজানো গোছানো বাগানের পাঁচিল দেখা যাচ্ছে, এদিকে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেদ করে টেলিফোনে নাহুম খানের চিৎকারে আশপাশে দু-একটা পাখি এ গাছ থেকে ও গাছে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

‘হ্যালো আস্তিক, হ্যালো! কথাটা কেটে কেটে যাচ্ছে … হ্যালো, হ্যাঁ … তারপর? ওকে, তোমরা বেরোও, আমি আসছি … হ্যাঁ, স্যারকে বলো এদিকে সব ঠিক আছে, হ্যাঁ … হ্যালো …!’

নাহুম খান প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বলে ফোন রাখলেন, ‘চলুন, অনেক হয়েছে গুপ্তধনের খোঁজ করা। আর কিছুতেই দেরি করা যাবে না। ওদিকে কেস পুরো হেপাটাইটিস বি হয়ে গেছে। গুরগাঁওতে আজ যে বাচ্চা ছেলেটা নাগেশ সিং-এর স্ত্রীর হাত থেকে টাকা নিতে এসেছিল সে কবীরেরই নাম বলেছে, এদিকে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে যে বাড়ি দেখিয়েছে তার মধ্যে পাওয়া গেছে কস্তুরী শর্মাকে। ওকে কবীর ওখানে ফিট করে এসেছিল টাকাটা নেওয়ার জন্য। পুলিশ অতর্কিতে হামলা করায় শ্রীমতী পেছন দিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিলেন, শেষমেষ পারেননি।’

‘কস্তুরী শর্মাটা কে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।

‘নাগেশ সিং-এর তরুণী সেক্রেটারি।’ নাহুম খান ফিচেল হাসলেন, ‘তাঁর জন্যই নাকি নাগেশ সিং-এর ডিভোর্স হয় হয় অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীং।’ পরক্ষণেই মুখটা সিরিয়াস করে ফেললেন, ‘মানে ভগতবীর বলছিল আর কি!’

‘তার মানে একদিকে কস্তুরী নাগেশ সিং-এর সেক্রেটারি হয়ে কাজ করছিল, অন্যদিকে কবীর খান নাগেশ সিং-এর মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফাঁসিয়ে কিডন্যাপের তাল কষছিল।’ রুদ্র বলল।

‘আরে, বললাম না … সিম্পল অ্যাবডাকশনের কেস, পেনাল কোড ৩৬২, একদম চোখ বুজে সাত বছরের হাজত বাস, চলুন চলুন… অনেক দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যেই!’ নাহুম খান বললেন, ‘এখনও মেয়েটার কোনো ট্রেস পেলাম না।’

‘মানে আপনি বলছেন তাজমহলে কোনো কিছু অ্যাটাক-ফ্যাটাক নয়, কবীর আর কস্তুরী মিলে উজ্জয়িনীকে কিডন্যাপ করে পাতি টাকা আদায় করতে চেয়েছে?’ রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল।

‘আবার কী!’ নাহুম খান কাঁধ নাচালেন, ‘মেইন কনসার্ন ছিল আগ্রার ওইসব পোস্টার, সেও নাগেশ সিং-এর কীর্তি। ভালো মজা, যে ভিক্টিম সে-ই আবার ক্রিমিনাল!’ নাহুম খান হাসলেন।

‘তাহলে কবীর খান এক মাস ধরে কর্পোরেশনের প্রকল্পের সুপারভাইজার হয়ে এতগুলো সুড়ঙ্গের পথ খুঁজল কেন? কেনই-বা নাগেশ সিং-কে উজ্জয়িনীর বিনিময়ে প্রফেসর বেগকে আনতে বলল?’ রুদ্র প্রশ্ন করল।

‘ওফ, আপনি ম্যাডাম দেখছি পুলিশের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য ব্যাঙ্কের লোকগুলো একটু সন্দেহবাতিক হয় বটে, সোজা কথাকেও বাঁকা করে ধরে, ছেলে বাপের চেক নিয়ে গেলেও প্রশ্ন করে।’ নাহুম খান বললেন, ‘আরে বাবা, কবীর খান প্রফেসর বেগের কাছে কাজ করত। ওইসব লেখায় ঝামেলা শুরু হলে শিবলিঙ্গ থেকে থাকলে তা ধ্বংস করার জন্যই হোক, বা, প্রমাণ লোপাটের জন্য অন্য দল প্রফেসরকে অ্যাপ্রোচ করল কাজ বন্ধের জন্য। প্রফেসর ঘাড় ধরে বের করে দিলেন, ওরা কবীরকেও টোপ দিল, কবীর আর কস্তুরী একদিকে নাগেশ সিং-এর থেকে টাকা আদায়, অন্যদিকে এইসব খোঁড়াখুঁড়ি করতে লাগল। শেষমেষ এত সুড়ঙ্গ খুঁজে কিছুই পেল না, উলটে পুলিশ আসছে টের পেয়ে পালাল। সিম্পল অ্যান্ড স্ট্রেইট হিসাব, ম্যাডাম!’ নাহুম খান হাসলেন, ‘চলুন, চলুন। আরও দেরি হলে আমার চাকরিটাই যাবে এবার, আমাকেও একশো দিনের কাজে ঢুকে পড়তে হবে তাহলে। আজ দুপুরে তাজমহলে ভি ভি আই পি ভিজিট রয়েছে আবার, সেদিকটাও তদারক করতে হবে।’

মেহতাববাগকে ঘিরে থাকা গোটা জঙ্গলটায় প্রায় একশো পুলিশকে কড়া পাহারায় বসিয়ে নাহুম খানের জিপ রওনা দিল।

কেউ কোনো কথা না বললেও সবাই ভেতরে ভেতরে যেন ছটফট করছিল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রিয়ম বলল, ‘আজ তাজমহলে কী আছে? কারা আসছে?’

‘ও বাবা, এতক্ষণ তো আসল লোকই ছিলেন সঙ্গে, তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন তো!’ নাহুম খান বললেন, ‘বারোটা ঝগড়ুটে দেশ আসছে। মানে দেশের প্রতিনিধি আর কি।’

‘ঝগড়ুটে দেশ মানে?’ প্রিয়ম সত্যিই বুঝতে পারল না।

‘ওহ, আপনি তো সদ্য এসেছেন, তাই জানেন না। কয়েকদিন ধরে আগ্রায় আর কোনো খবর আছে নাকি এ ছাড়া? বারোটা দেশকে ইনভাইট করা হয়েছে, যারা দিনরাত জোড়ায় জোড়ায় ঝগড়া করে। যেমন উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া, চীন-তিব্বত, ইরান-ইরাক, সিরিয়া-টার্কি, ব্রিটেন-আর্জেন্টিনা। আরও একটা জোড়া আছে… কী যেন।’ নাহুম খান মনে করার চেষ্টা করছিলেন, ‘ওহ, নিজেদেরই ভুলে গেছি, ভারত আর পাকিস্তান। আমেরিকাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সঙ্গে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে, কিন্তু ওঁদের পায়া ভারী, আসবেন না।’

‘এইসব দেশ কী করবে আগ্রায়?’ প্রিয়ম বলল।

‘এদের প্রত্যেক জোড়াকে নাম দেওয়া হয়েছে পিস কাপল, মানে হল গিয়ে শান্তির জুটি। প্রত্যেকে এখানে শান্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে, যাতে ভবিষ্যতে এঁরা কখনো একে অন্যের উদ্দেশে যুদ্ধ বা আক্রমণ না শুরু করে। নাগেশ সিং এই সম্মেলনের মূল আহ্বায়ক। ওঁদের এই অস্ত্রবিরতির দাবিতে একটা দলও আছে। নাগেশ সিং-এর বক্তব্য, এর ফলে এইসব দেশের যুদ্ধের খরচবাবদ প্রচুর টাকা বেঁচে যাবে যেটা ভালো কাজে লাগানো যাবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের নামও উজ্জ্বল হবে।’

‘বাহ! প্রশংসনীয় উদ্যোগ তো!’ প্রিয়ম বলল, ‘এই নাগেশ সিং লোকটা সাদায় কালোয় মেশানো একটা আশ্চর্য ক্যারেকটার!’

‘হ্যাঁ, ভালো উদ্যোগ তো বটেই, চুক্তি হবে কাল। ভারতের বিদেশমন্ত্রীও আসবেন। কিন্তু আজ দুপুর একটায় ওইসব দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে তাজমহলে আমাদের স্বরাষ্ট্রসচিব একটা ভিজিট করবেন, ওই সবাইকে ঘুরিয়ে দেখাবেন আর কি। বুঝতেই পারছেন কীরকম লেভেলে সিকিউরিটির আয়োজন করতে হচ্ছে!’ নাহুম খান রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন, ‘সেখানে ম্যাডাম যখন বললেন ওরা ভেতর দিয়ে আক্রমণ করবে, সত্যিই কমিশনার সাহেব থেকে শুরু করে আমরা সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন একটু রিল্যাক্সড লাগছে।’

রুদ্র কিছু বলল না, ও বার বার লাইনগুলো আওড়াচ্ছিল, ‘রাজার দশজন রানি, কিন্তু তাদের ন-টি ঘর। এ কেমন নীতি?’

‘কিন্তু, রাজা পরমাদ্রিদেবের দশজন রানি ছিল, এমন কোনো ইঙ্গিত ইতিহাসে নেই। আর তা ছাড়া চান্দেলা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে তার রানিদের জন্য ঘর কম পড়বে, এ-ই বা কেমন কথা?’ প্রফেসর বেগ বললেন।

‘শেষ তিনটে শব্দই-বা কী বলছে?’ নাহুম খান বললেন, ‘দ্বন্দ্বমণ্ডলম কপাটসন্ধিকর্ণ।’

‘দ্বন্দ্বমণ্ডলম কথাটার মানে কী?’ প্রিয়ম বলল, ‘দ্বন্দ্ব মানে তো ঝগড়া, সেই আগেকারদিনের রাজারাজড়ারা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন না?’

‘মণ্ডল মানে কোনো চক্র বা অঞ্চল। কোনো সমষ্টি বা গোষ্ঠীকেও মণ্ডল বলা হয়।’ প্রফেসর বেগ বললেন।

‘তার মানে ঝগড়ার চক্র? মানে যে গোষ্ঠী বা গ্রুপ ঝগড়া করে?’ প্রিয়ম বলল, ‘উহ, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। একে তো মাথাব্যথা, তার ওপর এইরকম অদ্ভুত ধাঁধা।’

রুদ্র উত্তর না দিয়ে পড়ল, ‘তারপর কপাটসন্ধিকর্ণ।’

‘কপোতসন্ধিকর্ণ … কপোত মানে পায়রা না? সন্ধি মানে মিটমাট করে নেওয়া। ওহ বুঝেছি! কপোত কপোতীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব মানে ঝগড়া করল, তারপর রণে ভঙ্গ দিয়ে কপোত কপোতীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।’ প্রিয়ম ঝলমলে মুখে রুদ্রর দিকে তাকাল, ‘সব স্বামীদের যা ধর্ম আর কি!’

‘আর কর্ণ?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।

‘মহাভারতের কর্ণ নাকি বলো তো?’ প্রিয়ম মাথা চুলকোল।

‘ধ্যাৎ!’ রুদ্র রেগেমেগে মুখ ঘুরিয়ে নিল, ‘তা ছাড়া কথাটা কপাটসন্ধি, কপোতসন্ধি নয়।’

‘কপাট মানে তো দরজা, যাহ!’ প্রিয়ম মাথা চুলকোতে লাগল।

‘কপাটসন্ধি প্রাচীন বেদে প্রাথমিক ক্যালকুলেশনকে বলা হত। কথাটার আক্ষরিক অর্থ হল দরজা ও চৌকাঠের সংযোগস্থল, সেখান থেকেই প্রাচীন টোলে গণনা শিক্ষা দেওয়া হত।’ অঘোরেশ বললেন।

নাহুম খান এবারে আর গাড়ির সামনে বসেননি, পেছনে ওদের সঙ্গেই বসেছিলেন, একটু এগিয়ে বসে হেলান দিয়ে চোখটা বুজে ফেললেন তিনি, ‘ওফ বাবা, কাল থেকে একটা ধকল গেল বটে! শালা আজ আমার অফ ছিল, পুরো দিনটাই খালাস।’ কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না তিনি, আবার তাঁর ফোন বাজতে শুরু করল, ‘আবার কে রে বাবা … হ্যালো! হ্যাঁ বলো …কী? সে কী!’

নাহুম খান পরক্ষণেই তাঁর আয়েশ করে বসে থাকা ভুঁড়িটাকে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, ‘মাই গড! নাগেশ সিং-এর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া গেছে।’

‘কোথায়?’ রুদ্র অবাক হয়ে গেল।

‘যমুনা নদীর ওই পাড়ে, মানে তাজমহলের দিকের একটা ঘাটে, কাদায় জলে মাখামাখি অবস্থায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল। স্থানীয় লোকেরা দেখতে পেয়ে ওই থানায় খবর দেয়, তারপর এখন আমি খবর পেলাম।’

‘নদীতে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল কেউ?’ প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল।

‘মেয়েটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। প্রচুর জল ঢুকেছে পেটে। হসপিটালে ভরতি।’ নাহুম খান বললেন।

‘নাগেশের মেয়ে তো খুব ভালো সাঁতারু। আমাকে নাগেশ বলেছিল, প্রচুর প্রাইজ পেয়েছে সাঁতারে। জলে ডোবা তো ওর পক্ষে সহজ নয়।’ প্রফেসর বেগ বললেন।

‘দেখি গিয়ে আগে।’ নাহুম খান বললেন, ‘যাক, মেয়েটাকে যখন পাওয়া গেছে, কবীর খানকে ঠিক বের করে ফেলব। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক, এ পিঠ বা ও পিঠ, হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসব আগ্রাতে।’ নাহুম খান হাতের মুঠি পাকালেন।

‘গাড়ি ঘোরান।’ রুদ্র বলল।

নাহুম খান বেশ জোশে কথাগুলো বলছিলেন, রুদ্রর অস্বাভাবিক কর্কশ কণ্ঠে একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘কিছু বললেন?’

‘এক্ষুনি গাড়ি ঘোরান।’ রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকাল, সাড়ে ন-টা।

‘কোথায় ঘোরাব? মানে কোথায় যাব? কী বলছেন বলুন তো?’ নাহুম খান কিছুই বুঝতে পারছেন না।

‘বারোটা দেশের জনপ্রতিনিধি দুপুর একটায় তাজমহলে আসবেন বললেন, তাই না?’ রুদ্র বলল, ‘যদি তাদের সবাইকে বাঁচাতে চান, তাজমহলকে বাঁচাতে চান, ইমিডিয়েটলি গাড়ি ঘোরান মেহতাববাগের দিকে!’

সবাই ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে রুদ্র বলল, ‘রাজার দশটা রানি, কিন্তু ন-টা ঘর। এটা কোনো সাংসারিক তথ্য নয়। এটা একটা অঙ্ক!’ প্রিয়মের দিকে তাকাল ও, ‘প্রিয়ম, বুঝতে পারছ না? তার মানে ন-টা ঘরের মধ্যে একটা ঘর এমন হতেই হবে, যেখানে দুটো রানি থাকবে।’

প্রিয়ম কিছু বুঝতে পারছিল না, কিন্তু শেষ বাক্যতে চমকে উঠল, ‘Pigeon Hole Principle!’

‘কী বলছেন আপনারা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ নাহুম খান চটে গেলেন, ‘কী বলতে চাইছেন বুঝিয়ে বলবেন কি?’

প্রিয়ম মনে মনে কী চিন্তা করছিল।

‘আমি বলছি।’ প্রিয়ম বলল, ‘পিজিয়ন হোল থিয়োরি বা পায়রার খোপ তত্ত্ব অঙ্কের একটা বিখ্যাত মতবাদ। জার্মান একজন গণিতজ্ঞ … কী যেন নাম।’ প্রিয়ম কিছুক্ষণ মনে করে বলল, ‘পিটার গুস্তাভ ডিরিকল। তিনি ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই থিয়োরিটা আবিষ্কার করেন। এর মানে হল, চারটে পায়রার খোপে পাঁচটা পায়রাকে রাখতে হলে একটা খোপে দুটো পায়রাকে রাখতেই হবে।’

‘তা চারখানা খোপ থাকলে আর পাঁচটা পায়রা থাকলে একটা খোপে দুটো পায়রাকে রাখতে হবে, সে তো জানা কথাই! এটা থিয়োরি কী করে হল?’

‘বলছি।’ রুদ্র বলল, ‘রাজার দশটা রানি, কিন্তু ন-টা ঘর। তার মানে, একটা ঘরে একটা রানিকে বেশি থাকতে হবে।’ ও মুহূর্তে নকশাটা খুলল, ‘এখানে আমরা ঘর মানে ভাবছি ওপরের ন-টা প্রকোষ্ঠকে, তা কিন্তু নয়। ওটা বিভ্রান্ত করতেই দেওয়া হয়েছে। শেষ লাইনটা লক্ষ করো।’

দ্বন্দ্বমণ্ডলম কপাটসন্ধিকর্ণ।

‘কপাটসন্ধিকর্ণ। গোটা অঞ্চলকে কর্ণ বরাবর ভাগ করো।’

রুদ্র নকশায় বড়ো করে দাগ টানল।

‘কর্ণ বরাবর গোটা চন্দ্র উদ্যানকে ভাগ করে যে চারটে প্রকোষ্ঠ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে লক্ষ করো, একমাত্র ডান দিকের, অর্থাৎ, যমুনা নদীর দিকের প্রকোষ্ঠটায় চারটে সুড়ঙ্গ, বাকিগুলোতে তিনটে করে। তার মানে ওই প্রকোষ্ঠের যে চারটে সুড়ঙ্গ, তার মধ্যে যেকোনো একটা আসল।’ রুদ্র বলল।

‘কোনটা?’ প্রফেসর বেগ বললেন।

‘এবার প্রথম শব্দটা দেখুন। দ্বন্দ্বমণ্ডলম। দ্বন্দ্ব মানে যেমন ঝগড়া, তেমনই দ্বন্দ্ব মানে বিপরীত, অর্থাৎ উলটোদিক। মণ্ডল মানে অঘোরেশজি বললেন চক্র, চক্র মানে বৃত্ত মানে কোনো সার্কল।’ রুদ্র হাঁপাচ্ছিল, ‘তার মানে বিপরীতদিকের বৃত্ত। ওই ডান দিকের প্রকোষ্ঠে বৃত্তের ওপর সুড়ঙ্গ একটাই রয়েছে।’

‘তার মানে…!’ বিস্ময়ে উত্তেজনায় প্রফেসর বেগ কাঁপতে শুরু করলেন।

‘ওই ডানদিকের সুড়ঙ্গের কেন্দ্রই আসল সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ। তাজমহলের মধ্যে আসলে এই Pigeon Hole Theory-র কনসেপ্ট লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন সেই অনামা গণিতজ্ঞ। জানি না তিনি শাহাজানের সমসাময়িক না রাজা মানসিংহের না ওই চান্দেলা রাজার!’ রুদ্র বলেই ঠোঁট কামড়াল, ‘তবু সব ক্রেডিট পশ্চিমের।’

‘তাই তো দেখছি!’ নাহুম খান বললেন, ‘পাই থেকে শুরু করে এইসব অঙ্কের থিয়োরি, সবই তো আমাদের দেশে অনেক আগে আবিষ্কার করা হয়েছে তাহলে!’

রুদ্র মাথা নাড়ল, চিন্তিতমুখে বলল, ‘কিন্তু, ওই গোল বৃত্ত কি এখন আর আছে?’

প্রফেসর বেগ আবেগে রুদ্রর হাতটা চেপে ধরলেন, কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘গোল জায়গা আছে তো! মেহতাববাগের একদম সামনে যমুনা নদীর পাড়েই বাঁধানো একটা ভাঙাচোরা গোল জায়গা আছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *