অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩০

৩০

রুদ্র বলল, ‘নাগেশ সিং-কে ফোন করা হচ্ছে! কেন?

নাহুম খান কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। সব ব্যাপারগুলো এমনভাবে ঘটছে, মাথার মধ্যে পুরো জট পড়ে যাচ্ছে। নাগেশ সিং এখন আবার মেয়ের সেফটির জন্য পুলিশের মদত চাইছেন না।’ ইনস্পেকটর ঘড়ি দেখলেন, ‘সাড়ে তিনটে বাজে। দেখি আপাতত থানায় গিয়ে অঘোরেশ ভাটের মুখ থেকে ড বেগ সম্পর্কে কিছু খোঁজ বের করতে পারি কি না! পনেরো বছর হয়ে গেল চাকরি করছি, এরকম ঘ্যাঁট পাকানো খিচুড়ির দশা কোনোদিনও হয়নি। কী করছি, কেন করছি, কিছুই বুঝতে পারছি না!’

রুদ্র বলল, ‘আর ন-টা বাজতে কিন্তু আর মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বাকি। ওইদিকটা খেয়াল রেখেছেন তো?’

নাহুম খান বললেন, ‘এস পি সাহেব তো বললেন তাজমহলের গেট থেকে পুরো ক্যাম্পাস একেবারে জেড প্লাস সিকিউরিটিতে মুড়ে দিয়েছেন, সেই কাল বিকেলের ওই বিশ্ব সম্মেলনের অতিথিদের শুধু ঢোকানো হবে, বাকি টুরিস্ট ঢোকানো বন্ধ থাকবে।’

প্রিয়ম বলল, ‘ওহ, ওই সম্মেলনেরও তো ওই নাগেশ সিং-ই উদ্যোক্তা, না?’

নাহুম খান মুখে একটা বিরক্তির ভঙ্গি করলেন, ‘হ্যাঁ, এদিকে নাগেশ, ওদিকে অঘোরেশ, মাঝখানে তাজমহল না শিবমন্দির, মহাদেব আমাকে তিনদিক থেকে পাগল করে দিচ্ছেন!’

প্রিয়ম সমব্যথীর ভঙ্গিতে হাসল। ভদ্রলোক পুলিশ হলে কী হবে, রসবোধ আছে। নাগেশ আর অঘোরেশ দুটোই শিবের নাম, মাধ্যমিকে পড়া সমার্থক শব্দ মনে পড়ে গেল ওর।

নাহুম খান বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ রুদ্র পিছু ডাকল, ‘এক মিনিট, মি খান!’

নাহুম খান পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

রুদ্র বলল, ‘যদি কিছু না মনে করেন, আমরা আপনার সঙ্গে থানায় যেতে পারি?’

‘আমি তো থানায় যাচ্ছি না।’ নাহুম খান বললেন, ‘আমি যাচ্ছি হেডকোয়ার্টারে, সেখানেই অঘোরেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সব কর্তারা এখন মিটিং-এ ব্যস্ত সেখানে।’

প্রিয়ম রুদ্রকে বলল, ‘সেখানে গিয়ে কী করবে এখন?’

‘আমার অঘোরেশবাবুকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করার আছে।’ রুদ্র বলল, ‘ড বেগ নিখোঁজ হওয়ার সময়ের সবকটা মিডিয়া কভারেজ পড়লাম, সেই ব্যাপারেই।’ ও নাহুম খানের দিকে তাকাল, ‘যদি আপনারা পারমিশন দেন।’

রুদ্র, প্রিয়ম, নাহুম খান আর সঙ্গে একজন কনস্টেবল মিলে যখন আগ্রা পুলিশের সদর দপ্তরে পৌঁছোল, তখন পূর্বদিকে আকাশ সবে লাল হতে শুরু করেছে। সূর্য তখনও ওঠেনি, কিন্তু তার রক্তিম আভায় সবাইকে জানাচ্ছে আসন্ন আগমনবার্তা।

অঘোরেশকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছিল, সেখানে ওদের মতো বাইরের লোককে ঢুকতে দেওয়ার কোনো কথাই নয়। কিন্তু আজকের ব্যাপার সবই অন্যরকম, সাধারণ পুলিশকর্তাদের থেকে আজ এখানে বেশি খাতির দিল্লি থেকে আসা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির ডি জি মি ত্রিবেদী আর দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের ডেপুটি কমিশনার মি মেহরোত্রার। ভগতবীর সিং আগেই এসে রুদ্রর ব্যাপারে বলে রেখেছিলেন, কাজেই রুদ্র আর প্রিয়মকে ঢুকতে দেওয়া হল।

অঘোরেশ দু-জন হাবিলদারের পাহারায় একটা লম্বা টেবিলের এক কোনায় বসে ছিলেন, রাতজাগা চোখ মুখ, চুল উশকোখুশকো।

রুদ্র ঘরে ঢুকে প্রথমে কিছু বলল না, অঘোরেশের পাশের চেয়ারটায় চুপ করে বসে পড়ল, তারপর নরম গলায় বলল, ‘আঙ্কল, আপনি বলেছিলেন নিজামুদ্দিন বেগের একজন সহকারী ছিল, গবেষণায় ড বেগকে সে সাহায্য করত। তাঁকে আপনি চিনতেন?’

অঘোরেশ ধীরে ধীরে মাথা তুললেন, ‘হ্যাঁ, একটা ছেলে ছিল। কবীর খান।

অঙ্কের ছাত্র, ও-ই নিজামুদ্দিনকে অ্যাসিস্ট করত।’

রুদ্র নাহুম খানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুলিশ তাকে সেইসময় কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি?’

নাহুম খান বললেন, ‘আমি ওই কেসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার কে ছিল দেখছি।’

অঘোরেশ মাথা নাড়লেন, ‘নিরুদ্দেশ হওয়ার সময় তো কবীর আর কাজ করত না, ও হঠাৎই ছেড়ে দিয়েছিল।’

‘কবে ছেড়েছিল একটু মনে করতে পারবেন?’

‘আমার সঙ্গে তো অতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না।’ অঘোরেশ মনে করার চেষ্টা করলেন, ‘তবে যখন নিজামুদ্দিনের বাড়িতে ঝামেলা শুরু হল, তার পরে পরেই ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ আমাকে নিজামুদ্দিন ফোনে বলেছিল, একা মানুষ, সব দিক থেকে উঠতে পারছে না।’

‘নিজামুদ্দিন বেগ আপনাকে নাগেশ সিং বলে কারুর নাম বলেছিলেন?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।

‘না তো!’ মাথা নাড়লেন অঘোরেশ।

রুদ্র, প্রিয়ম আর নাহুম খান অঘোরেশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মি ত্রিবেদীর ঘরে এসে নাহুম খান ফোন নিয়ে এগিয়ে এলেন রুদ্রর দিকে, ‘ফোনে জগদীশ পাণ্ডে রয়েছেন, তিনিই ড বেগের কেসটার তদন্ত করেছিলেন। আপনি কথা বলে নিন।’

রুদ্র ফোনটা নিয়ে জানলার পাশে চলে গেল। প্রায় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল, ভ্রূ দুটো কুঁচকোনো, গম্ভীর মুখে ও বসল।

প্রিয়ম আর নাহুম খান বসেছিলেন ঘরের একপাশে, মি ত্রিবেদী কথা বলছিলেন অন্য এক ইনস্পেকটরের সঙ্গে। রুদ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে এল নাহুম খানের দিকে, ‘আমাকে একবার নাগেশ সিং-এর সঙ্গে কথা বলাতে পারেন?’

‘সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, ম্যাডাম।’ নাহুম খান জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, ‘নাগেশ সিং দুঁদে রাজনীতিবিদ। মিডিয়া ওঁর মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর নিউজ কভার করছে। এই সময় একজন সাধারণ মানুষ হয়ে আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দিকে প্রশ্ন আসবে। এমনিতে আপনাকে এখানে আনতে আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে…।’

‘বুঝেছি। উনি কোথায় এখন?’ রুদ্র বলল।

নাহুম খান কিন্তু কিন্তু করলেন, ‘উনি একটু আগে আগ্রা এসে পৌঁছেছেন। ভগতবীর আছেন ওখানে।’

‘ভগতবীর সিংহের সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে?’ রুদ্র নাছোড়বান্দা।

নাহুম খান বিরক্ত চোখে একবার তাকালেন, তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে ডায়াল করে ফোনটা এগিয়ে দিলেন।

রুদ্র ফোনটা নিয়ে চলে গেল ঘরের এক কোণে, প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কথা বলতে লাগল।

প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর ফোনে খুটখাট করতে শুরু করল, অবশেষে ইশারায় ঘড়ি দেখাল, ‘আর কতক্ষণ?’

রুদ্র ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলল। তারও প্রায় দশ মিনিট বাদে এসে ফোনটা নাহুম খানের হাতে দিয়ে বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি করুন। এক্ষুনি তাজমহলে যেতে হবে।’ রুদ্র বলল।

‘তাজমহল? এখন? নাহুম খান কিছু একটা রিপোর্ট লিখছিলেন, মাঝপথে থমকে গেলেন, ‘তাজমহলে আপনি কোনোভাবেই যেতে পারবেন না কিন্তু ম্যাডাম! ওখানে আজ নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। পুলিশের লোকেরাও ওখানে আজ সবাই ঢুকতে পারবে না। কোনোভাবেই আপনাকে ওখানে ঢোকানো…।’

‘জানি।’ রুদ্র হাত তুলে থামিয়ে দিল, ‘ক-টা বাজে?’

প্রিয়ম ঘড়ি দেখল, ‘সাড়ে পাঁচটা।’

‘ছ-টার মধ্যে বেরোতে হবে মি খান।’ রুদ্র সোজা তাকাল নাহুম খানের দিকে, প্রতিটা মুহূর্ত এখন ভীষণ দামি।’

ভগতবীর সিং এসে দাঁড়িয়েছিলেন এর মধ্যেই। রুদ্রর গলায় এমন কিছু ছিল যা নাহুম উপেক্ষা করতে পারলেন না, নীচু গলায় ভগতবীরকে নাগেশ সিং-এর কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আ-আমি ওপরমহলে বলে দেখছি কী করতে পারি।’

রুদ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে কোনো একটা ছবি খুলল, তারপর টেবিলে পড়ে থাকা একটা নোটপ্যাড তুলে নিয়ে তাতে ছবি আঁকতে লাগল খসখস করে।

আঁকা শেষ করে ছবিটা মেলে ধরল ও, ‘তাজমহলের এই স্কেচটা প্রফেসর বেগ কাগজে লিখেছিলেন। তাতে উনি এইভাবেই তাজমহলের নীচের তিনটে তলাকে ৫, ৬ আর ৭ নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন।’ রুদ্র ছবিতে আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘এই ৫ আর ৬ নম্বর ফ্লোরটা হল ওই বাইশটা ঘর নিয়ে, যেগুলোর দরজায় নিরেট গাঁথনি তুলে শাজাহান চিরকালের জন্য প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষ করে দেখুন তাজমহলের ১ নম্বর লেখা তলা, অর্থাৎ যেখানে মুমতাজের কবর শায়িত রয়েছে, সেখান থেকে কিন্তু গোপন সুড়ঙ্গপথ রয়েছে ওই বন্ধ করে দেওয়া ৫ নম্বর তলায় যাওয়ার। আবার, এই ৫ আর ৬, দুটো তলারই নীচে যে শেষ ৭ নম্বর তলাটা রয়েছে, তা থেকে সুড়ঙ্গপথ গিয়ে মিশেছে ডান দিকের যমুনা নদীতে।’

‘তো? মানে এর সঙ্গে আগ্রায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কী সম্পর্ক?’ নাহুম খান রীতিমতো পারপ্লেক্সড।

‘সম্পর্ক এটাই যে,’ রুদ্র উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এই এতগুলো ঘর বা নদীতে চলে যাওয়া সুড়ঙ্গ শাজাহানই বানিয়েছিলেন না ওই চান্দেলা রাজা তা নিয়ে মাথাব্যথার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল, আপনাদের পুলিশ কমিশনারেট বা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি যতই তাজমহলের ভেতরে পুলিশ বসিয়ে মাছি গলতে না দিক, মাছি হয়তো ইতিমধ্যেই গলে গেছে, আর সেটা বাইরে থেকে নয়, ভেতর দিয়ে।’

৭ নম্বর তলা

‘মানে!’ মি ত্রিবেদী চোখ সরু করলেন।

‘এই দেখুন।’ রুদ্র ত্রিবেদীর সামনে ছবিটা মেলে ধরল, ‘তাজমহলের ক্যাম্পাসে প্রবেশ না করেও কিন্তু সুড়ঙ্গের মাধ্যমে সরাসরি ৭ নম্বর তলায় প্রবেশ করা সম্ভব। ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি সুড়ঙ্গের একটা পথ যমুনা নদী থেকে এসে ঢুকছে তাজমহলের একদম নীচে। এই সুড়ঙ্গের অন্য মুখটা কোথায়, সেটা যদি জানা যায়, তাহলে চারশো বছরের এই পুরোনো রাস্তা দিয়ে তাজমহলের একদম ভেতরে চলে আসা কিন্তু কোনো ব্যাপারই নয়।’

নাহুম খান চিন্তিতমুখে মি ত্রিবেদীর দিকে তাকালেন।

রুদ্র বলে চলল, ‘নিজামুদ্দিন তাঁর গবেষণার ব্যাপারে মোট উনিশটা কিস্তি লিখেছিলেন কাগজে। আমি সবকটাই ইন্টারনেটে পড়লাম। প্রতিটা যদি পর পর পড়েন, খেয়াল করবেন যে, উনি প্রতিটা তথ্যের মধ্যে যেন একটা কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এবং প্রতি সপ্তাহেই সেটা নিয়ে একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন যে তাঁর কাছে এমন কোনো প্রমাণ রয়েছে যেটা হবে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে জলজ্যান্ত প্রমাণ। শেষ সপ্তাহে তিনি লিখেছিলেন যে অন্তিম অর্থাৎ কুড়ি নম্বর কিস্তিতে তাজমহলে যে একটা প্রাচীন অঙ্ক লুকিয়ে আছে তিনি সেটা প্রমাণ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার আগেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।

‘আমার মনে হচ্ছে তাজমহল যে অতীতে মন্দির ছিল, সেই ব্যাপারে কোনো জলজ্যান্ত প্রমাণের ইঙ্গিতই ড বেগ দিতে চেয়েছিলেন। আর সেটা কেউ চায়নি, তাই প্রফেসর বেগকে কিডন্যাপ করা হয়।’ প্রিয়ম বলে উঠল।

রুদ্র মুখ খোলার আগেই দরজা দিয়ে একজন মানুষ ঢুকলেন ভেতরে, সঙ্গে ভগতবীর সিং। মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় সম্ভ্রান্ত কেউ, আভিজাত্য শরীরের প্রতিটা অংশ থেকে ফুটে বেরোচ্ছে।

কেউ কিছু পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই রুদ্র আলতো হেসে বলল, ‘প্রফেসর বেগকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন গুরুজি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *