অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২০

২০

উজ্জয়িনী ঠোঁটে শরবতের স্ট্র নিয়ে মুগ্ধ চোখে ওকে দেখছিল। ঈষৎ বাদামি-রঙা একটা দামি শার্ট, আর নীচে সমুদ্রনীল জিনস। গালের দু-পাশ থেকে নরম ভেলভেটের মতো নরম দাড়ি এসে আলতোভাবে মিলে গেছে চিবুকে, সেখানে দাড়িটা যেন একটু বেশি গাঢ়। রোদে পুড়ে ফর্সা চামড়ায় একটা হলদেটে ভাব এসেছে। কে বলে ওর বেশি বয়স। এই ঠান্ডা ক্যাফেতে ঠিক মুখোমুখি বসে উজ্জয়িনীর কিছুতেই মনে হল না ওর বয়স সাতাশ আঠাশের বেশি হতে পারে। যদিও ও নিজেও বলেছিল ওর সাঁইত্রিশ বছর বয়স, সেখানে উজ্জয়িনীর মাত্র আঠেরো। উনিশ বছরের পার্থক্য। তা হোক, মনের পার্থক্য যে এক ইঞ্চিও নয়, তা উজ্জয়িনী জানে।

ও এটাও জানে, বাবা কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নেবেন না। উজ্জয়িনীকে ওর কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য সাদা কালো সব রাস্তাই প্রয়োগ করবেন।

তার ওষুধও তাই ও ভেবে ফেলেছে।

এই ঠান্ডাতেও রোদে এতটা হেঁটে আসার জন্য ওর কপালের ওপরটায় দু-এক বিন্দু ঘাম জমেছে। শার্টের দু-দিকের হাতা কনুই অবধি গোটানো। কনুইয়ের নীচ থেকে বেরিয়ে থাকা দুটো পেশিবহুল হাত দেখে উজ্জয়িনীর মুগ্ধতা যেন বেড়ে গেল।

ও মনে হয় বুঝতে পেরেছে উজ্জয়িনীর মনের কথা, মৃদু হেসে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে, ‘কী দেখছ বলো তো তখন থেকে? তুমি আমার দিকে এমন হাঁ করে চেয়ে থাকলে আমি তোমায় দেখব কী করে?’

উজ্জয়িনী এবার হেসে ফেলল, ‘ধ্যাত!’

ও বলল, ‘না সত্যিই উজ্জয়িনী! যবে থেকে তোমাকে চিনেছি জেনেছি, তবে থেকে আমার খালি একটা কথাই মনে হত, কবে তোমাকে কাছ থেকে দেখব। তোমার মনটা যেমন সুন্দর, নিষ্পাপ, তুমিও তেমনই সুন্দর।’

উজ্জয়িনী প্রচণ্ড এক ভালোলাগায় কথা বলতে পারছিল না। জ্ঞান হবার পর থেকে কেউ ওর সঙ্গে এত ভালো করে কথা বলেনি। সত্যিই ও সুন্দর? কই কেউ তো বলেনি! বাবা খালি চাপিয়ে দিয়েছে একের পর এক বিধিনিষেধ, এটা করা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, আর মা ব্যস্ত থেকেছে বাবার সঙ্গে ঝামেলায়, নিজের বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে। উজ্জয়িনী কী ভালোবাসে, উজ্জয়িনী কতটা একা, কখনো কেউ ভেবে দেখেছে? কখনো কোনো বন্ধুও হয়নি তেমন, ওর এই বিস্ময়শিশু খেতাবের জন্য দূর আকাশের তারা হিসেবেই সবাই দেখেছে ওকে, কাছে এসে বন্ধুত্ব, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে কেউ দেয়নি। ওর ভেতরের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা কেউ বোঝার চেষ্টাই করেনি। আর সেখানে ও উজ্জয়িনীকে কখনো বুঝতেই দেয়নি যে ও আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা, ওর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বুঝতে চেয়েছে ওকে, ভাগ করে নিয়েছে ওর ভেতরের দুঃখকষ্ট, যন্ত্রণা। তাই তো উজ্জয়িনী ওকে মনের সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে। দিনের পর দিন বাবা-মা-র ঝগড়া, ওর সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন সব খুলে বলেছে ওকে। তারপরও ও ওকে ছেড়ে যায়নি, উলটে ভরসার হাত যেন আরও জোরদার হয়েছে ওর।

সবচেয়ে বড়ো কথা, উজ্জয়িনীর যেমন বাবা থেকেও নেই, ওর সত্যি করেই বাবা-মা নেই, ছোটো থেকে হোমে মানুষ। দু-জনের এই শূন্যতাই হয়তো কাছে আসতে আরও সাহায্য করেছে।

সত্যিই, সামান্য রং নাম্বার থেকে মানুষের জীবন কত অন্যদিকে টার্ন নেয়!

উজ্জয়িনী লজ্জা ঝেড়ে ফেলল, সময় বেশি নেই, বাবার পরিচিত মানুষ সব জায়গায় রয়েছে, কোথাও কেউ একঝলক দেখে ফেললে মুশকিল হবে। আর তো মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা! এরই মধ্যে ওর একান্ত কাছে মানুষটা বিপদে পড়ুক, সেটা ও চায় না। ও ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘কাল আমার আঠেরো বছর পূর্ণ হচ্ছে।’

ও মিষ্টি করে হাসল, ‘জানি তো। আমার জয়ী কাল বিগ গার্ল হয়ে যাবে।’

উজ্জয়িনী এবার ঈষৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘আমার আর ও বাড়িতে থাকতে এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না, হাঁপিয়ে উঠছি আমি। কারুর আমার জন্য কোনো সময় নেই।’ একমুহূর্তের জন্য ও থামল, ‘তা ছাড়া এখন বাবা নেই। আয়ারল্যান্ড গেছে। কাল সকালের মধ্যেই ফিরে যাবে, এসে আদিখ্যেতা শুরু করবে, তখন আবার বেরোনো মুশকিল হয়ে পড়বে। কাল এমনিই ছাব্বিশে জানুয়ারি, রিপাবলিক ডে-র প্যারেড দেখতে হয়তো জোর করে নিয়ে যাবে আমায় এম পি প্যাভেলিয়নে, কিংবা জন্মদিন নিয়েও বাড়াবাড়ি করতে পারে। ওসব আমার বিশ্রী লাগে।’

‘বাবা এসে মেয়েকে ভালোবাসবেন, তাকে আদিখ্যেতা বলছ কেন জয়ী?’

‘থামো।’ মুহূর্তে উজ্জয়িনীর মুখ-চোখ শক্ত হয়ে উঠল, ‘ছোটো থেকে যারা একটা বাচ্চাকে সুস্থ শৈশবটুকু দিতে পারে না, তাদের ওসব মানায় না বুঝেছ!’

ও এবার বলল, ‘যাই হোক, ছাড়ো। তোমার বাবার একটা কনফারেন্স আছে না পরশু দিন? আগ্রাতে? কী-একটা পিস কাপল মিট না কী?’

‘হবে হয়তো, আমি জানি না ওসব।’ উজ্জয়িনী বলল, ‘তুমি কী করে জানলে?’

ও মিষ্টি করে হাসল, ‘তোমার বাবা এত বিখ্যাত মানুষ, জানব না? এত ভালো একটা উদ্যোগ নিয়েছেন! কাগজেই তো পড়লাম। যাই হোক।’ ও উঠে পড়ল, ‘চলো, আর দেরি তাহলে না করাই ভালো। তোমার কিছু জামাকাপড় কিনতে হবে তো?’

‘না, আমি মোটামুটি নিয়ে এসেছি।’ উজ্জয়িনী পাশে রাখা ব্যাগটার দিকে দেখাল, ‘কয়েকদিন পরে কিনলেও হবে।’ একটু থেমে ও বলল, ‘আচ্ছা, আমরা তো কালই রেজিস্ট্রি করছি, তাই তো?’

ও মুখে কিছু বলল না, শুধু এগিয়ে এসে উজ্জয়িনীর গালটা টিপে দিল। মুখে কিছু না বললেও ওর চোখে নীরব যে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছিল, তাতেই উজ্জয়িনীর মনটা আসন্ন অপার্থিব সুখের আশায় ভরে উঠল।

কালো অন্ধকার দিনগুলো শেষ, শিলং-এর ঘরে বসে বালিশ চেপে কাঁদা শেষ, এবার শুধু উজ্জ্বল আলো সামনে!

.

মুন্নাদের গাড়িটা আগ্রা ঢুকতে ঢুকতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। রাস্তায় বিশেষ কিছু ঝামেলা হয়নি, শুধু রাবুপুরা গ্রামের ধাবার পাশের সেই লোকটা যে আসলে জি বি রোডের সেই ওসমানেরই পাঠানো লোক, তা বুঝতে সময় লেগেছিল একটু। মুন্না তখন থেকেই নজরে রাখছিল, টোল পেরিয়ে আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার আসার পরেই যখন ওদের গাড়িটা আর লোকটার বাইকটা সমান্তরালে চলতে শুরু করল, তখন ড্রাইভারের উদ্দেশে মুন্না চেঁচিয়েছিল, ‘সাইড চেপে দাঁড়া তো একবার! এ’শালা বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। মতলবটা কী দেখি!’

ফজলুল বলেছিল, ‘দাঁড়াবে, না, জোরে বেরিয়ে যাবে? পুলিশের লোক হলে?’

মুন্না নামতে নামতে অশ্লীল একটা গালাগাল দিয়ে বলেছিল, ‘পুলিশ হোক আর পুলিশের দাদু, কিচ্ছু টের পাবে না, তুই চুপ করে বসে থাক।’

কিন্তু পরে যখন দেখে ওটা ওয়াসিমেরই লোক, তখন মুন্নার হুলিয়া ঘেঁটে যাওয়ার জোগাড়! শাল লোকই যখন পেছন পেছন দিল্লি থেকে পাঠাবি, তার হাতেই তো মুন্না ডেলিভারি করে দিতে পারত, এত কাণ্ড করে আগ্রা আসার কী দরকার ছিল?

আজ চোদ্দো বছর হয়ে গেল মুন্না এত পার্টিকে মাল সাপ্লাই করছে, এরকম আজব কাস্টমার কখনো পায়নি। গ্রামে শাকিল তাই বলে বেশি লোভ না করতে, ওখানে থেকেই ব্যাবসা করতে, মুঙ্গেরের শয়ে শয়ে লোক কি তাই করছে না? কিন্তু মুন্না শেখ বিহারের ওই ঘুপচি গ্রামে আটকে থাকার জন্য জন্মায়নি, তাই ওকে এসব রিস্ক তো নিতেই হবে।

যাই হোক, ওয়াসিমের ওই লোকটা আপাতত একটু দূরত্ব রেখে ওদের গাড়ির সামনে সামনে চলেছে। আগ্রা ঢুকে গেছে তাও মিনিট দশেক হল। মুন্না চোখ সরু করে একবার চারপাশটা দেখে নিল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ, ডেলিভারি করতে করতে আশা করা যায় সন্ধে নেমে যাবে। একটু অন্ধকার হলেই ভালো।

সামনের বাইকের লোকটা বড়োরাস্তা ছেড়ে আচমকা একটা গলিতে টার্ন নিল। মুন্নার নির্দেশমতো ওদের গাড়ির ড্রাইভারও সেই দেখাদেখি গলিতে ঢুকতেই ফজলুল চাপা গলায় বলল, ‘ঠিক যাচ্ছি তো ওস্তাদ?’

মুন্না খিঁচিয়ে উঠল, ‘আমি কি আগে থেকে দেখে গেছি নাকি যে আমায় জিজ্ঞেস করছিস? আমি কী করে জানব?’ মনে মনে আসলে ওরও বেদম টেনশন হচ্ছিল, এখনও মাল ডেলিভারির সময় বুকটা ধুকপুক করে, কেউ কোথাও ফলো করছে না তো? তার ওপর মাঝরাতে নির্জন রেললাইনের ধারে বা কোনো লকআউট হয়ে যাওয়া কারখানার পেছনে ডেলিভারি করা এক জিনিস, আর ভরসন্ধেবেলা বাড়িঘর, দোকানপাট, লোকজনে ভরতি ক্যাঁচরম্যাচর গলি দিয়ে মাল নিয়ে যাওয়া আরেক জিনিস। কেউ কিছু না খেয়াল করলেও ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়।

চাপাস্বরে মুন্না বলল, ‘শালা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বল তো? এ তো একদম ভদ্র পাড়া!’ পকেট থেকে কাল ওয়াসিমের দেওয়া ঠিকানাটা বের করল, গাড়ির মধ্যে অন্ধকার, তবু দু-পাশের দোকানের আলো থেকে অস্পষ্টভাবে আরও একবার পড়ল, ‘অঘোরেশ ভাট, ১৩, গোয়ালিয়র রোড, বালুগঞ্জ, আগ্রা।’

সিঙ্গল পিস নয়, এতগুলো পিসের ডেলিভারি বাড়িতে নেবে?

এই অঘোরেশ মালটা ভদ্র পাড়ায় বাড়ি করেছে, বাড়ির মধ্যে বসে ডেলিভারি নেবে নাকি? আজকাল যেমন অনলাইন শপিং হয়েছে, তেমন? হেব্বি রগড় তো!

মুন্না ফজলুলকে সেটাই বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চলন্ত গাড়ির জানলার পাশে কার মুখ দেখে চমকে তাকাল, দেখল সামনের বাইক নিয়ে এগোনো লোকটা এখন ওদের গাড়ির পাশে পাশে যাচ্ছে, চোখাচোখি হতেই বলল, ‘বাড়িটা প্রায় এসে গেছে, সামনে গিয়ে আমি দু-বার হর্ন বাজিয়ে বাঁ-দিকের গলি দিয়ে চলে যাব। বাড়ির দু-পাশে বেশ কিছুটা করে জঙ্গল আছে, ওয়াসিম ভাই যেমন বলেছে, তোমরা সেভাবে বাড়ির পেছনদিকে গিয়ে জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে আসবে।’

মুন্না চট করে একবার সামনে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কেউ দেখবে না তো? পাড়ার মধ্যে বাড়ি।’

‘কেউ দেখতে পাবে না। ওই বাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায়, আর আগাছা-ঝোপে ভরতি। দু-মিনিটে কাজ হাসিল হয়ে যাবে। আর বাড়ির পেছনদিকটা একদমই ফাঁকা। রাস্তা একদম পরিষ্কার।’

মুন্না ঢোঁক গিলল, ‘আর পেমেন্ট কিন্তু এখনও…!’ ওর কথা শেষ হল না, লোকটা মোটা দুটো বান্ডিল গাড়ির মধ্যে ছুড়ে দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *