১১
চাঁদনি মেয়েটা ভালোই। রাতে মোটা মোটা খানপাঁচেক রুটি আর তড়কা খেতে দিয়েছিল মুন্নাকে। সঙ্গে ঝাল ঝাল লঙ্কা আর কাঁচা পেঁয়াজ। বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে মুন্না শুয়ে পড়েছিল। রোশনি বলে একটা মেয়ে বেশ ঘুরঘুর করছিল ওর আশেপাশে, হয়তো চাঁদনিই বলে দিয়েছিল, কিন্তু মুন্না বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। একে এত ক্লান্ত ছিল, শরীর চলছিল না, মনে হচ্ছিল কখন ঘুমোতে পারবে, তার ওপর প্রথম রাতেই কোথাও গিয়ে হ্যাংলামি করা ও পছন্দ করে না, কেমন যেন তাতে নিজেকে খেলো দেখায়। পেমেন্টটা পাক, তারপর ওসব হবে’খন।
সকালে উঠে বাথরুমের কাজ সেরেসুরে এসে ও বেশ মৌজ করে চাঁদনির ঘরের বাইরের খাটিয়াটায় বসে একটা সিগারেট ধরাল। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে, ঘড়িতে সাড়ে আটটা, অথচ কুয়াশায় ছেয়ে রয়েছে চারপাশ। মস্ত একটা ধোঁয়া ছেড়ে মুন্না ফোন করল, ‘শোন, ভালো অর্ডার পেয়েছি। আড়াইশো পিস কাট্টা…!’
ওপাশ থেকে ফজলুল কী বিড়বিড় করল।
মুন্না একটা গালাগাল দিয়ে জোরে ধমক দিল, ‘শালা, এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস নাকি? আমি এখানে কাজে এসে খেটে মরছি, আর তুই…!’
মিনিটপাঁচেক কথা বলে মুন্না গজগজ করতে করতে ফোন রাখল। এই ওর একটা সমস্যা, মুঙ্গেরের সব ব্যাবসাদার ওর ভয়ে কাঁপলে কী হবে, ঠিকমতো সেকেন্ড ম্যান ও এখনও তৈরি করতে পারল না। ফজলুল, আনসার, জিয়াউল এরা সবাই বিশ্বাসী, মুন্নার জন্য ওরা জানও দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু মুন্নার অবর্তমানে পুরো ব্যাবসাটাকে ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে পারার ক্ষমতা ওদের নেই। নেই চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বুদ্ধিও। একটু ঢিলে দিলেই তাই ফাঁকি মারে।
যাই হোক ও অর্ডার যখন দিয়ে দিয়েছে, ফজলুল দিল্লিতেই রয়েছে, মাল পাঠিয়ে দেবে।
হঠাৎ কী মনে পড়তে ও আরেকটা ফোন করল, ‘কে হাসান? মুন্না বলছি। কলকাতা থেকে সন্তান দলের মাল এল?’
‘মন্টু বলে ছেলেটা আনছে ওস্তাদ!’
‘কোথা দিয়ে? হাওড়া?’ মুন্না শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘নাহ! কলকাতা স্টেশন। লোক কম থাকে, ট্রেনও বেশি চলে না।’
মুন্না মনে মনে খুশি হল। হাসান ছেলেটা কথা বলে কম, কিন্তু বুদ্ধি আছে মোটামুটি। ফজলুলের মতো দুমদাম কাজ করে না, মাথাটাও ঠান্ডা। সেইজন্য কলকাতার দায়িত্বটা মুন্না হাসানকে দিয়েছে। কলকাতার কিছু জায়গায় এখন ছোটো ছোটো ঠেক খুলছে ওরা, মুঙ্গের থেকে রেগুলার লোক পাঠানো হচ্ছে, তারা গিয়ে শেখাচ্ছে, আস্তে আস্তে ওখানকার প্রোডাকশন বাড়বে, তখন ব্যাবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে।
কলকাতায় ডিম্যান্ড বরাবরই বেশি, তখন আর মুঙ্গের থেকে পাঠানোর ঝক্কিও থাকবে না। আর কলকাতা স্টেশনকে করিডোর বানানোর অনেক সুবিধা, ওখানে পুলিশের নজরদারি কম, তার ওপর বাংলাদেশের ট্রেন যায়, ওদিকেও মাল সাপ্লাইয়ের সুবিধা। প্রতিটা কামরার টয়লেটের ভেতরে ব্যাকপ্যাকে পার্টসগুলো আলাদা আলাদা করে রেখে আনা হচ্ছে, রেল পুলিশের সাধ্য কী ধরে! ধরলেও ওই পার্টস অ্যাসেম্বল করার ক্ষমতা ওদের বাপের সাধ্য নয়। ও আরও কিছু কথা বলে হৃষ্টচিত্তে ফোন রেখে দিল।
জি বি রোড এখন সবে জাগছে। বাইরের রাস্তা দিয়ে অটো ছুটছে কর্কশ শব্দে, দূরে কোথায় ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং। এই সকাল বেলা মুন্নার মনটা ফ্রেশ থাকে। আজও তেমনই রয়েছে।
দিল্লিতে শেষবার ও এসেছিল মাসকয়েক আগে, এই ঢং ঢং ঘণ্টাটা ওকে মনে পড়িয়ে দিল সেদিনের কথা।
সেবার ও আর হাসান একসঙ্গেই এসেছিল।
দিল্লির বাইরের দিকে একটা সুবিশাল বাগানবাড়ি, ওদের রীতিমতো চিরুনিতল্লাশি করে ঢোকানো হয়েছিল একটা ছোটো ঘরে। সেই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া প্রকাণ্ড একটা হল ঘর, তার ঠিক মাঝখানে একটা সাদা গদি পাতা, তার ওপরে বসে ছিল একটা টকটকে ফর্সা লম্বা লোক, তার পরনেও শ্বেতশুভ্র ধুতি, নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গ, কপালে একটা লাল তিলক।
লোকটার সামনে বসে ছিল প্রায় কুড়ি পঁচিশটা ছেলে, প্রত্যেকেরই পরনে সাদা ধুতি, খালি গা। একঝলক তাকালেই বোঝা যায়, এখানে কোনো গুরু-শিষ্য পড়াশুনোর ক্লাস চলছে।
হাসান ফিসফিস করে বলেছিল, ‘এ কোথায় এসে পড়লাম রে মুন্না! শালা মন্দির-টন্দির নাকি?’
মুন্না কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিল। বাইরের এই ঘর থেকে ভেতরের কথাবার্তা সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল।
লোকটার সামনে বসে থাকা একটা ছেলে বলল, ‘গুরুজি, আপনার কথামতো আইটি সেলের কাজ আমরা ঠিকমতো চালাচ্ছি। কিন্তু ইন্টারনেটে খুব ব্যঙ্গবিদ্রূপ হয় গোরু নিয়ে।’
‘গোরু নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ! মানে?’ লোকটা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল।
‘মানে, অনেকে লেখে, হিন্দু সন্তান দল বলে গোরু আমাদের মা। মানুষের মা কখনো গোরু হতে পারে? তাহলে আমরাও কি গোরু? আমাদের বাবা কি ষাঁড়? এইসব বলে!’ ছেলেটা ইতস্তত করে বলল, ‘আরও নোংরা নোংরা ইঙ্গিত শুনতে হয়, আমরা কী জবাব দেব বুঝতে পারি না।’
লোকটা সামান্য হেসে অন্য সবার দিকে তাকাল, ‘তোমাদের মনেও কি এই একই প্রশ্নের উদয় হয়েছে?’
সবাই নিরুত্তর, কিন্তু নীরবে ঘাড় নাড়ল অনেকে।
‘বেশ।’ লোকটা চোখ বন্ধ করল, ‘আমরা আমাদের দেশকেও মা বলি। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী। দেশ মানে তো মাটি, তাহলে মাটি কি আমাদের মা? এখানে মা বলতে তো জন্মদাত্রী মায়ের কথা বোঝানো হয়নি, দেশমাতৃকা বলতে বোঝানো হয়েছে যে মা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। গোরুর তাৎপর্যও সমাজে সেটাই ছিল।’
‘কীরকম?’ একটা ছেলে প্রশ্ন করল।
‘আমাদের দেশ চিরকালই কৃষিভিত্তিক, প্রাচীনকাল থেকে চাষবাস আর পশুপালনই প্রধান পেশা সমতলবাসীদের। চাষের জমিতে লাঙল টানত একটা গোরু, তারপর গোরুর দুধ, ঘি, মাখন তৈরি করা হত প্রতিটা ঘরে। চাষের সার আর রান্নার জ্বালানির জন্য তারা গোবর ব্যবহার করত। একটা গৃহস্থ পরিবারে গোরু থাকা মানে এতগুলো দিক দিয়ে তাদের সমৃদ্ধি ঘটত। তাই সেই আঙ্গিক থেকেই গোরুকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করা শুরু হয়।’ লোকটা থামল, ‘শুধু প্রাচ্যেই নয়, মিশরীয়রা সব পশু বলি দিত গোরু ছাড়া। তা ছাড়া, তোমরা খেয়াল করবে, এখনও কোনো পুজো বা যজ্ঞে গোত্র জিজ্ঞাসা করা হয়। গোত্র মানে গোরুর পাল। ভারতবর্ষের শুধু নয়, প্রাচ্যের অজস্র প্রসঙ্গের সঙ্গে গোরু ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এমনকী বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের গৌতম নামটিও গৌ অর্থাৎ গোরু এবং উত্তম এই দুটো শব্দ নিয়ে গঠিত। তোমরা জানো, একটা সময় গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতারও মনে করা হত। তাই, দেশ যেমন আমাদের আশ্রয়দাতা মা, তেমনই গোরু আমাদের সমৃদ্ধকারী মা।’
ছেলেগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মুন্না আর হাসানও। ঠিক ভুল যাই বলুক, লোকটার বাচনভঙ্গি অসাধারণ।
ছেলেগুলোর পাঠ সম্ভবত শেষ, তারা গুরুজিকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এইবার বোধ হয় ঢোকার জন্য মুন্নাদের ডাকা হবে।
একটা ছেলে এগিয়ে এল, সামান্য কুণ্ঠিতস্বরে লোকটাকে বলল, ‘গুরুজি, এই সপ্তাহের শেষ তিনদিন আসতে পারব না, গোয়াতে আমাদের একটা সভার আয়োজন করা হয়েছে।’
‘সেকী! তুমিও সেই গোয়ালাদের জায়গাতেই যাবে কেন!’ কপট হেসে লোকটা ভ্রূ তুলেছিল।
বিস্মিত ছেলেটা মাথা নাড়ল, ‘গুরুজি, গোয়ালা নয়, গোয়া।’
লোকটা তখন মৃদু হেসেছিল, ‘গোয়া-র উল্লেখ মহাভারতেও আছে, তখন এর নাম ছিল গোবরাষ্ট্র, অর্থাৎ গোয়ালাদের দেশ। ইন্টারনেটে যারা এঁড়ে তর্ক করে, তাদের এগুলো বুঝিয়ে বোলো।’ কথাটা শেষ করেই ডান হাতটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সামনে তুলেছিল লোকটা, ‘তোমার যাত্রা শুভ হোক!’
.
পাশেই কারুর খুক খুক করে কাশির শব্দ শুনে মুন্না বর্তমানে ফিরে এল, দেখল রোশনি বলে সেই ছিনেজোঁকের মতো লেগে থাকা মেয়েটা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখে স্পষ্ট আহ্বানের ডাক। এই সাতসকালেই কাজল-টাজল পরে রেডি।
মুন্না আলগোছে মেয়েটার সারা শরীরের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল, মন্দ না। ঠিকমতো সব চুকেবুকে গেলে একে নিয়ে দু-তিনদিন ফুর্তি করাই যায়। পেমেন্ট তো আজ বিকেলেই পেয়ে যাচ্ছে। তারপর বলে দেওয়া জায়গায় ডেলিভারি করতে পারলেই মুন্নার কাজ শেষ। ফজলুলকে বলা আছে, দুটো চৌকস আনকোরা মুখ পাঠাচ্ছে সঙ্গে, যারা মালটা রেখে আসবে।
সঙ্গে অবশ্য মুন্নাও থাকবে।
কোথায় যেন ঠিকানাটা?
মুন্না কুকুরছানাকে তু তু করার মতো করে মুখটা ছুঁচোলো করে মিচকে হেসে রোশনির গাল দুটো টিপে চায়ের কাপটা হাত থেকে নিল। এত কাছে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে কেমন পাকা আনারসের মতো গন্ধ। উগ্র রঙের সালোয়ার কামিজটা আঁটোসাঁটো হয়ে চেপে বসেছে শরীরে।
মুন্না পকেট থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করল। ওহ বাবা, কাল তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি, এ যে দিল্লিতেই নয়। ফজলুলকে ফের ফোন করতে হবে তো!
ভালো করে দেখতে গিয়ে গরম চায়ের কিছুটা চলকে পড়ল লেখাটার ওপর, ধেবড়ে দিল সামান্য জায়গা। তবু ঠিকানার শুরুতে ‘অঘোরেশ ভাট’ আর ঠিকানার শেষের ‘আগ্রা’ লেখাটা অক্ষত অবস্থায় যেন জ্বলজ্বল করতে লাগল।