অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৪

ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির দিল্লির হেড অফিসে আজ হেভিওয়েট মিটিং। বিশাল ডিম্বাকৃতি টেবিলের লম্বা দিকটায় রয়েছেন ডিরেক্টর জেনারেল মি অমূল্য ত্রিবেদী তাঁর মাথার ওপরেই পেছনের প্রকাণ্ড দেওয়ালে বসে রয়েছেন গান্ধীজি একপাশে পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা।

মি ত্রিবেদীর দু-পাশে সার দিয়ে বসে রয়েছেন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র ইনভেস্টিগেটিং অফিসাররা সবাই।

২০০৮ সালের মুম্বাইতে তাজ হোটেলে বিধ্বংসী অ্যাটাকের পর সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে এক্সক্লুসিভলি মোকাবিলা করার জন্য ভারত সরকার ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি নামে এই ডিপার্টমেন্ট তৈরি করেছিল। এই এজেন্সির কার্যকলাপের ওপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সবসময় নজর রাখে আর কোনো রাজ্যের মধ্যে তদন্ত চালানোর জন্য এদের সেই রাজ্য সরকারের অনুমতির দরকার পড়ে না।

ভগতবীর সিং বলে নতুন জয়েন করা তরুণ পাঞ্জাবি অফিসারটা কিছুটা নার্ভাস হয়ে গিয়ে বোধ হয় ঘামছিল। আগে সে দিল্লি পুলিশের সাবইনস্পেকটর ছিল, কিন্তু দু-বছরেই ভালো কাজ করায় তাকে এই সম্মানজনক দপ্তরে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে দেড়মাস হল। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই এই বিভাগে সুযোগ পাওয়ায় ও ভীষণভাবে খুশি, কিন্তু একইসঙ্গে টেনশনও হচ্ছে। ডেপুটেশনে আসার আগে এক সপ্তাহের জন্য আগ্রায় নিজের বাড়িও ঘুরে এসেছে, নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সে এখন টগবগ করছে বলতে গেলে।

মিটিং এখনও শুরু হয়নি, সাইলেন্ট মোডে মোবাইলে ভগতবীর নিউজ চ্যানেলের আজকের আপডেটগুলো একনজরে দেখে নিচ্ছিল।

খবরের মাঝে নিজের শহর দেখলে সবারই চোখ সেখানে আটকে যায়, তেমনই একটা খবরে ওর চোখ আটকে গেল। আগ্রার একমাস আগে আক্রান্ত হওয়া সেই প্রফেসর আজও নিখোঁজ, অথচ তাঁর বাড়িতে নাকি এখনও প্রায়দিনই রাতদুপুরে পাঁচিল টপকে লোকের আনাগোনা চলছে।

লিঙ্কটা খুলে ও চোখ বোলাতে লাগল বিশদ খবরের ওপর। ভদ্রলোক নিখোঁজ হওয়ার পর প্রথম দশদিন পুলিশি প্রহরা ছিল বাড়ির ওপর, তারপর উঠিয়ে নেওয়া হয়। তদন্তেও কোনো প্রোগ্রেস নেই, অথচ পাড়ার লোক নিয়মিত লোকজনের আনাগোনার অভিযোগ করছে। জায়গাটা কমলানগরে, ওর বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়।

হঠাৎ সামনে ‘গুড ইভনিং জেন্টলমেন!’ শুনতে পেয়েই ভগতবীর তড়িঘড়ি ফোনটা বন্ধ করে সামনে তাকাল।

এন আই এ-তে আসার পর এটাই ওর প্রথম অফিশিয়াল মিটিং। এই দপ্তরের কর্মদক্ষতা সারা দেশের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে এখন সুপরিচিত। ছিঁচকে চুরি ডাকাতি, রাহাজানি নয়, এই বিভাগের উদ্দেশ্য হল দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর কড়া নজর রাখা। সন্ত্রাসবাদ, বর্ডার পেরিয়ে স্মাগলিং, নারী এবং শিশুপাচার চক্র, ড্রাগ সাপ্লাই, বেআইনি অস্ত্র সাপ্লাই, এইসব ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করা।

আর এই ব্যাপারেই আজ দপ্তরের সিনিয়র ইনভেস্টিগেশন অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ ওদের মতো জুনিয়রদের একটা প্রেজেন্টেশন দেবেন।

ডিজি সাহেব মি ত্রিবেদী আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং-এর শুভ সূচনা করলেন, ‘তোমাদের মতো পনেরোজন ইয়ং ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আমাদের ডিপার্টমেন্টের সম্পদ। আশা করব সিনিয়রদের মতোই তোমরাও এই দপ্তরের ঐতিহ্য সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিনিয়র অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ তোমাদের কিছু বলবেন।’

প্রাথমিক নিয়মনীতি, আলাপপরিচয় মিটলে মি বশিষ্ঠ উঠে দাঁড়ালেন। এই মুহূর্তে তিনি দিল্লি পুলিশের সবচেয়ে দক্ষ অফিসারদের মধ্যে একজন। এখন ডেপুটেশনে এন আই এ-র হয়ে কাজ করছেন। আগের বছরেই ইন্টারপোলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দু-জন কুখ্যাত মুজাহিদিন জঙ্গিনেতাকে ধরায় প্রধানমন্ত্রী এই নিষ্ঠাবান অফিসারটিকে পুরস্কৃত করেছেন। বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু শরীর টানটান। নির্মেদ চেহারায় কোথাও এখনও বয়স একটুও থাবা বসাতে পারেনি। গালের কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি মি বশিষ্ঠের ব্যক্তিত্বকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভগতবীর মুগ্ধ চোখে দেখছিল। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, ছোটো থেকে হিন্দি সিনেমায় পুলিশ অফিসারের রোল করা অ্যাকশন হিরোদের দেখে ওর পুলিশ হওয়ার শখ হয়েছিল। সে-শখ পূরণ হলেও এখনও অবধি কোনো চ্যালেঞ্জিং অ্যাসাইনমেন্ট ও পায়নি। তবে একবার যখন এই দপ্তরে ঢুকতে পেরেছে, নিশ্চয়ই পাবে! একদিন সেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে মি বশিষ্ঠের মতো পুরস্কার নেবে, মনে মনে ভাবল ও।

মি মনোজ বশিষ্ঠ উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাডিশনাল ডিজি সাহেবকে স্যালুট করলেন, তারপর ঋজুভাবে এগিয়ে গেলেন সামনের প্রোজেক্টরের দিকে। ল্যাপটপে বসে থাকা কম্পিউটার অপারেটরকে নির্দেশ করলেন স্লাইড শুরু করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর অন্ধকার হয়ে প্রোজেক্টরের আলো দেওয়ালের প্রোজেকশন স্ক্রিনকে আলোকিত করে ফেলল।

মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে কোনো গৌরচন্দ্রিকা না করেই মি বশিষ্ঠ শুরু করলেন, ‘যে ব্রোশিয়োরটা দেওয়া হয়েছে আপনারা নিশ্চয়ই সেটা পড়েছেন। দিল্লিতে বেআইনিভাবে বেড়ে চলা অস্ত্রব্যবসাই আমার আজকের বিষয়। খুব সম্প্রতি একটা বিরাট ডিল হয়েছে এই শহরেই, আমাদের ইনফরমার খবর এনেছে।’ বশিষ্ঠ সামান্য থামলেন, ‘আগে জানিয়ে রাখি আর্মস সাপ্লাই এখন গোটা পৃথিবীতেই একটা ভয়াবহ লাভজনক ব্যাবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করে আমেরিকা, তারপর রাশিয়া আর চীন। কিন্তু সেটা বৈধ উপায়ে। বেআইনি অবৈধ আর্মস ডিলার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে চলেছে, সেটা শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই।’ মি বশিষ্ঠ প্রোজেক্টরের দিকে তাকিয়ে রিমোটের বোতাম টিপলেন।

মুহূর্তে একটা পরিসংখ্যান, গ্রাফ সমেত স্লাইড স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘তারপর একে একে পৃথিবীতে যত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৮-এর আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধ, ১৯৬০-এর কঙ্গো ক্রাইসিস, আশির দশকের ইরান ইরাকের লড়াই, নব্বই সালের গালফ যুদ্ধ, এত হাজার হাজার ছোটোবড়ো যুদ্ধে লাখ লাখ লোক মারা গেছে, হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা হয়েছে, কিন্তু এই আর্মস ডিলারদের ব্যাবসা ততই ফুলেফেঁপে উঠেছে।

‘পৃথিবী কেঁপে গেছে এইরকম সব বিলিওনেয়ার আর্মস ডিলারদের নৃশংসতায়। তেমনই দু-একজন পৃথিবীখ্যাত আর্মস ডিলারদের সঙ্গে আগে সংক্ষেপে আপনাদের পরিচয় করাই।’

প্রোজেকশন স্ক্রিনে এবার টাকমাথা গোলগাল এক প্রৌঢ়ের সাদাকালো ছবি ফুটে উঠল।

‘আদনান খাস্তোজ্ঞি। আশির দশকের কুখ্যাত আর্মস ডিলার। সৌদি আরবের মক্কায় জন্ম, ১৯৬০ সালে আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে সৌদি সরকারের আর্মস সাপ্লাই ডিলে ব্রোকারি দিয়ে শুরু করেছিল। তারপর বিখ্যাত সব যুদ্ধে দু-পক্ষকেই লক্ষ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ করে গেছে। একাধিকবার ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তছরুপ, আর্থিক কারচুপি রুখতে সুইজারল্যান্ডের মতো ট্যাক্স হ্যাভেনে টাকা সরিয়ে দেওয়া, বেআইনিভাবে অনেক ধরনের অস্ত্র সাপ্লাই করা, এইরকম নানা অভিযোগে বহুবার অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। মারা গেছে গত বছরের জুন মাসে।’

‘এইরকম সারা পৃথিবীর পুলিশকে পাগল করে দেওয়া কুখ্যাত আর্মস ডিলার আরও কিছু আছে।’

এবারেও স্ক্রিনে ভেসে উঠল আর এক গোলগাল টাক।

‘সার্কিস সোঘানালিয়ান। ফ্লোরিডার একজন আর্মস ডিলার, যাকে মার্চেন্ট অফ ডেথ বলা হয়। আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের সে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র সাপ্লায়ার ছিল। লোকটা সাদ্দাম হুসেনের ইরাককেও লক্ষ লক্ষ ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় বিভিন্ন জঙ্গি দল, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডরের মতো ছোটো ছোটো ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো সবাই ছিল সার্কিসের একচেটিয়া কাস্টমার। গালফ যুদ্ধের সময় ওর জেল হয়। এও মারা গেছে ২০১১ সালে, সাত বছর হল।’

‘স্যার!’ ভগতবীর স্কুলের ক্লাসরুমের মতো হাত তুলল, পরক্ষণে ভুল বুঝতে পেরে নামিয়েও নিল, ‘একটা প্রশ্ন ছিল।’

বশিষ্ঠ স্যার হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন একটানা বলে, জল খাচ্ছিলেন বোতল থেকে, ইশারায় ভগতবীরকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে বললেন।

‘স্যার, এই আর্মস ডিলাররা এত আর্মস পেত কোথা থেকে? মানে রিভলভার, পিস্তল, রাইফেল এগুলো তৈরি কারা করত? বৈধভাবে অস্ত্র সাপ্লাই করতে গেলে তো অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বা গান শেল ফ্যাক্টরি থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু এরা কোথা থেকে পেত?’

‘গুড কোয়েশ্চেন।’ বশিষ্ঠ স্যার বললেন, ‘এমনিই অনেক দেশের কাছে প্রচুর উদবৃত্ত অস্ত্র পড়ে থাকে। ধরো, কোনো একটা বড়ো যুদ্ধ শেষ হল কিংবা সন্ধি প্রস্তাবে লড়াই বন্ধ হয়ে গেল, সেক্ষেত্রে আর্মসের যে বিশাল ইনভেন্টরি সেটাকে বৈধভাবেই বিক্রি করে দেওয়া হয় গলিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বৈধভাবে কেনা অস্ত্রগুলো নিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বিক্রি করা হয় কালোবাজারে, যে দেশ যুদ্ধ করার জন্য ছটফট করছে, তাকেও মোটা দরে বিক্রি করে দেয় ডিলাররা। কোটি কোটি টাকার খেলা চলে এর মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার নিজেই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সবচেয়ে বেশি নিলামে যে বিড করল, তাকে সেল করে দেয়। আর বন্দুক জিনিসটা দীর্ঘস্থায়ী।’ বশিষ্ঠ সামান্য হাসলেন, ‘আমি একশো বছরের পুরোনো রাইফেলও চালিয়েছি। সুতরাং একটা যুদ্ধ শেষের পর এইভাবেই আর্মসগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও পরবর্তী কোনো যুদ্ধে চলে যায় ঠিক। এটাকেই বলে শ্যাডো মার্কেট। এটা ক্যান্সারের মারণ কোষের মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।’

ভগতবীর মাথা নাড়ল।

‘তা ছাড়া অনেক দেশীয় জায়গাতেও গোপনে আর্মস তৈরি করা হয়, যেমন ধরো আমাদের দেশেই, বিহারের মুঙ্গের বা মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া। এইসব অঞ্চলে আগে সরকারের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি ছিল, সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই জায়গায় শ্রমিকরা লুকিয়ে-চুরিয়ে অস্ত্র বানাতে শুরু করে। ওইসব জায়গায় তুমি যদি যাও প্রায় প্রতিটা বাড়িতে লেদ মেশিন দেখতে পাবে। ওখান থেকেই এখন সারাভারতে আর্মস সাপ্লাই প্রচুর বেড়ে গেছে। দামও কম, ঝক্কিও কম।’

ডিজি মি ত্রিবেদী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন, এবার বললেন, ‘মনোজ, কালকের ব্যাপারটা বলো।’

‘ইয়েস স্যার!’ বশিষ্ঠ মাথা নাড়লেন, ‘কাল পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রাম থেকে একটা লোককে ধরা হয়েছে যে পেশায় দর্জি, কিন্তু তলে তলে মুঙ্গেরের এক ডিলারের সঙ্গে যোগসাজশ করে আর্মস সাপ্লাই করছিল কয়েক বছর ধরে। বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশেও নাকি ওর মাল গেছে। সেই লোক জেরায় বলেছে যে এক সপ্তাহ আগে ও এবং আরও কিছু ডিলার মিলে মোট একুশ কোটি টাকার আর্মস সাপ্লাই করেছে দিল্লিতে একটা পার্টির কাছে। পেমেন্ট পেয়েছে দফায় দফায়। পার্টির নাম হিসেবে বলেছে বিলগাইনার।’

বশিষ্ঠ আবার থামলেন, সবকটা তরুণ মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে চেষ্টা করলেন নয়তো, ‘নামটা কি কারুর চেনা লাগল?’

সবাই নির্বাক, মাথা নাড়ল দু-পাশে। এই নাম কেউ শোনেনি।

‘ভিক্টর বিলগাইনার নব্বইয়ের দশকের পৃথিবীকাঁপানো আর্মস ডিলার ছিল। টার্কির লোক, কিন্তু বারো থেকে তেরোটা ভাষা অনর্গল বলতে পারত। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জঙ্গিদের আর্মস সাপ্লাই করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছিল, সেটা ১৯৯১ সাল। ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল পর্যন্ত ওর কার্যকলাপে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আল কায়দার সঙ্গেও লোকটার যোগাযোগ ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার, ও এত ধরনের মেক আপ করতে পারত, ওর আসল চেহারা এখনও অবধি কেউ জানে না।

‘বিলগাইনার শিক্ষিত লোক, নিজে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়েছে, ইন্টারপোল পর্যন্ত নাজেহাল হয়ে গেছে ওকে ধরতে।’ বশিষ্ঠ টানা বলে যাচ্ছিলেন, ‘লোকটা মুম্বাইতেও এসেছে বহুবার, মুম্বাই আর দুবাইয়ের মাফিয়া সার্কেলে ওর ছিল হরদম যাতায়াত। কিন্তু দু-হাজার পনেরো সালের একটা প্লেন ক্র্যাশে সে মারা যায় বলে খবর, যদিও কোনো প্রমাণ নেই। তা ছাড়া ভিক্টর বিলগাইনারের মতো লোকেরা দেড়শো-দুশো কোটির ডিল করে, এত কম টাকার ডিল কেন সে করবে? করলে ভারতেই-বা এসে করতে যাবে কেন?

‘তাহলে?’ একজন অফিসার বলে উঠল।

‘তাহলে এটাই যে, হয় বিলগাইনার নিজে অথবা কেউ বা কারা বিলগাইনারের নাম ব্যবহার করে মার্কেটে নেমেছে। কিন্তু যারা একুশ কোটির মাল কেনে, তারাও ফেলনা লোক নয়, আর কেন কিনেছে, সেটাও একটা প্রশ্ন। এখন কোথাও কোনো বড়ো যুদ্ধ তেমন চলছে না। তাহলে এত আর্মস কেন লাগছে হঠাৎ? তাও দিল্লিতে?’

বশিষ্ঠ যেন ভগতবীরের দিকেই তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন, ‘তাহলে কি সামনেই কোনো গণ্ডগোল পাকাতে চলেছে যেটা আমরা এখনও ট্র্যাক করতে পারছি না?’

ভগতবীর কী বলবে ভেবে পেল না, এমন সময় বশিষ্ঠের ফোন বেজে উঠল, এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে হুঁ-হাঁ করে তিনি ফোন রেখে ডিজি সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে নীচুস্বরে কিছু বললেন।

ভগতবীর লক্ষ করল, বশিষ্ঠের কথা শুনতে শুনতে ত্রিবেদী স্যারের ভ্রূ সামান্য কুঁচকে গেল, মাথা নাড়তে লাগলেন অল্প, তারপর কিছুক্ষণ আলোচনা করে সামান্য বিরতি নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘আগ্রায় একটা আর্জেন্ট মিশনে আগ্রা পুলিশ আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্স চাইছে। একজন ইয়ং অফিসারকে পাঠাব আমি। কে যেতে চাইছ?’

প্রশ্নটা শেষ করার পর দু-সেকেন্ডও কাটল না, ভগতবীর উৎসাহে হাত তুলে ফেলল।

 নিজের শহরে অ্যাসাইনমেন্টের কথা শুনলে কার না মন নেচে ওঠে?

হাত তুলেই ওর খেয়াল হল অন্যরা ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।

ধুস, উত্তেজনায় যে কী হয় ওর, এখানেও বাচ্চাদের মতো খালি বার বার হাত তুলে ফেলছে!

কিন্তু হাত নামিয়ে ফেলার পরেও ডিজি সাহেব ওর দিক থেকে চোখ সরালেন না, বেশ প্রসন্ন গলায় বললেন, ‘গুড! আগ্রা শহরে কিছু অদ্ভুত পোস্টার পড়েছে। তুমি এই ডেমনস্ট্রেশনটা শেষ হলে মি বশিষ্ঠর সঙ্গে যাবে, উনি তোমায় সব বুঝিয়ে দেবেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *