৩৩
নিজামুদ্দিন বেগ গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলছিলেন না। নাগেশ ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘প্রায় এক মাস বাইরের কারুর সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ পর্যন্ত করেননি, শুধু আমাদের ওই দলীয় কর্মীর ঠিক করে দেওয়া কাজের লোক ছাড়া। মাঝে মাঝে শুধু আমার সঙ্গে কথা হত। তাই একটু চুপ করে রয়েছেন। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’
নাহুম খান বলেছিলেন, ‘মুদ্রাটা?’
‘সেটা উনি আমাকে এখনও বলেননি।’ নাগেশ সিং কাঁধ নাচিয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন। নীচুস্বরে বলেছিলেন, ‘উজ্জয়িনীরও কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।’
রুদ্র কাগজে কপড়ে পড়েছিল ড বেগের বয়স পঞ্চান্ন, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সত্তর কিংবা তারও বেশি। সাদা পশমের মতো একরাশ চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা মাথায়, তোবড়ানো গালের ওপর অন্তত মাস দুয়েকের না কাটা সাদা দাড়ি বেড়ে ওঠে কেমন দার্শনিকের মতো দেখাচ্ছে। রোগা হাতের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, তিরতির করে কাঁপছে আঙুলগুলো।
গাড়ি যমুনা নদীর ব্রিজের ওপর উঠতেই রুদ্র বলল, ‘ড বেগ, আপনার সহকারী কবীর খান নাগেশ সিং-এর মেয়েকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আরও কিছু অভিসন্ধি আছে তার, যেটা আমরা বুঝতে পারছি না। আপনি কি কিছু জানেন?’
কবীরের নামটা শোনামাত্র যেন সূক্ষ্ম একটা কাঁপুনি খেলে গেল প্রফেসরের মুখে, রুদ্রর চোখ সেটা এড়াল না। কিন্তু মুখে তিনি কিছু বললেন না।
রুদ্র অস্থির হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল, আটটা পনেরো, আর মাত্র কিছুক্ষণ!
‘এই যে আপনার বন্ধু অঘোরেশজি।’ আঙুল তুলে দেখাল রুদ্র, ‘এঁকেও ওরা কিডন্যাপ করত। ওঁর নাম করে পুলিশের কাছে উড়ো ফোন গেছে যার বিন্দুবিসর্গ অঘোরেশজি জানেন না। আপনি কী বলবেন, কেন ওরা এগুলো করছে?’
প্রফেসর একইভাবে বসে রইলেন, রুদ্রর মুখ থেকে বেরোনো শেষ বাক্যটা শুনে চোখ বুজে হেলান দিলেন সিটে।
নাহুম খান মুখ দিয়ে বিরক্তির একটা শব্দ করে বিড়বিড় করলেন, ‘এই বিজ্ঞানী-ঐতিহাসিকগুলোমাত্রই ছিটগ্রস্ত হয়! আমরা মরছি আর উনি ধ্যান করে যাচ্ছেন।’
গাড়ি আবার ছুটছে নদীর ওপর দিয়ে, দূরের তাজমহল এখন কুয়াশার রহস্য থেকে বেরিয়ে অনেকটাই অনাবৃত, এদিকে গাড়ি থেমে গেল হঠাৎ। সেদিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল, ‘আর একদমই সময় নেই। কী হল? সিগনাল তো নেই এখানে!’
সামনে জ্যাম লেগে গেছে, এই সকাল বেলাতেই। নাহুম খান উঁকি মেরে দেখলেন, ‘মড়া যাচ্ছে কবরখানায়।’ চোখ বুজে বিড়বিড় করলেন কিছু, ‘ইন্না ইলাহী ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউ!’
প্রিয়ম ফিসফিস করল রুদ্রর কানে, ‘আমাদের বলো হরি’র মতো কিছু বলল বোধ হয়, বুঝলে!’
রুদ্রর এই অবস্থাতেও একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উদয় হল মনে, ‘আচ্ছা, আমরা তো মরে গেলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। আপনাদের তো মাটিতে কবর দেয়, এত কবর দেওয়ার জায়গা কী করে পায় খ্রিস্টান বা মুসলিম দেশগুলো, তাই ভাবি!’
‘কেন এখন তো বছরের চুক্তি করে কবর দিতে হয় বাইরে শুনেছি।’ নাহুম খান ক্রমাগত হাত নাড়ছিলেন ডান দিকে, গাড়িটা বাঁ-দিকে টার্ন নেবে। বললেন, ‘আমরা তো মরার পর তবু শান্তিতে ঘুমোতে পারি ম্যাডাম, রেস্ট ইন পিস কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। আপনারা তো জ্যান্ত অবস্থাতেও জ্বলছেন, মরার পরেও জ্বলবেন!’
রুদ্র মুখ টিপে হাসল। কথাটা নাহুম খান মন্দ বলেননি। এই ইনস্পেকটরটার সঙ্গে যতই ও মিশছে, কঠিন বর্ম ভেদ করে যেন এক বিচিত্র মানুষের সন্ধান পাচ্ছে।
সত্যি, ধর্ম ধর্ম করে মানুষ কেন লড়ে? কোনো ধর্মই কি খারাপ নাকি! সব ধর্মই শান্তির কথা বলে, একেকটা ধর্ম একেকভাবে। কিন্তু মাঝখান থেকে ধর্মের ষাঁড়গুলো ঝামেলা পাকায়!
নাহুম খান ঝুঁকে এলেন, ‘ওহ, ‘ওহ, আপনাকে বলা হয়নি, এইমাত্র ফোন এসেছিল। ওই কবীরের খোঁজ পাওয়া গেছে। কর্পোরেশন থেকে মেহতাববাগের পাশের জঙ্গলটা সংস্কার চলছে, ওই স্বচ্ছ ভারত অভিযান আর কি! অনেক মজদুর কাজ করছে, কবীর তাদেরই তদারকি করে। আমি অলরেডি ফোর্স পাঠাতে বলে দিয়েছি, আমরা ডিরেক্ট এখন ওখানেই যাব।’
রুদ্র বলল, ‘এটাই আশা করেছিলাম। প্রফেসর বেগ বলেছিলেন যে অজস্র সুড়ঙ্গ যমুনা নদীর নীচ দিয়ে গিয়ে তাজমহলের নীচে পৌঁছেছে। কবীর লোকটা জঙ্গল পরিষ্কারের নাম করে সুড়ঙ্গ খুঁজছে।’ ও দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু এর পেছনে কবীর একা থাকতে পারে না। অনেক বড়ো কোনো মাথা রয়েছে যারা কবীরকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছে। আমার মনে হয় আপনি শুধু ফোর্স ডাকা নয়, মি ত্রিবেদীর মতো বড়োকর্তাদেরও ব্যাপারটা জানিয়ে রাখুন।’
নাহুম খান রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটার গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করলেন, তারপর ফোনে হাত দিলেন। অঘোরেশ দু-একবার নিজে থেকে প্রফেসর বেগের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন, কিন্তু প্রফেসর বেগ কোনো সাড়াশব্দ করলেন না।
প্রিয়ম বলল, ‘আমি একটা কথা ভাবছিলাম। মি সিং ওঁ থেকে ৭৮৬-র ইভোলিউশনের যে থিয়োরি দিলেন, তাতে মিরর সিমেট্রির প্রয়োগ ছিল। আটশো বছরের পুরোনো জ্যান্ত অঙ্ক বলতে কি মিরর সিমেট্রিই বোঝাচ্ছে? শিবপুরাণে তো বলাই ছিল, আগ্রায় থাকা জ্যোতির্লিঙ্গ শিবমন্দিরটা মিরর সিমেট্রি আকারে তৈরি। মিরর সিমেট্রিতে একটা কোনো জ্যামিতিক প্যাটার্নের দুটো ভাগ একে অন্যের আয়না হয়, ঠিক যেমন তাজমহলের, বাঁ-দিক আর ডান দিক দুটোই একইরকম, এই একই ফান্ডা দিয়ে মানুষের রূপের সৌন্দর্যও ব্যাখ্যা করা যায়।’
নাহুম খান ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন, ‘জ্যামিতির প্যাটার্ন দিয়ে মানুষের রূপ?’
‘হ্যাঁ।’ প্রিয়ম অনেকক্ষণ বাদে নিজের পছন্দের বিষয় পেয়ে নড়েচড়ে বসল, ‘সাধারণত আমরা সুন্দর তাঁদেরই বলি যাঁদের শারীরিক সৌষ্ঠব বা মুখের আকৃতি সিমেট্রিকাল আর আনুপাতিক হয়। এই কনসেপ্টটাকে অঙ্কের গোল্ডেন রেশিয়ো-র সঙ্গেও কানেক্ট করা যায়। অনেক বিজ্ঞানী হলিউডের নামি অভিনেতা-অভিনেত্রীর মুখ নিয়ে এই পরীক্ষা করেছেন। যেমন চোখ থেকে ঠোঁটের দূরত্ব আর মুখের উচ্চতার অনুপাত যদি ৩৬% হয়, তবে তাকে সুন্দর বা সুন্দরী বলা যায়। কিংবা দুই চোখের মধ্যের দূরত্ব আর মুখের প্রস্থের অনুপাত যদি ৪৬% হয়, তবে সেই মানুষ সুন্দর হবে।’
‘আপনি কত জানেন মশাই!’ নাহুম খান হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘মানুষের রূপের মধ্যেও অঙ্ক!’
‘হ্যাঁ, আর এই সিমেট্রিকাল অনুপাতের জন্যই তাজমহলও এত সুন্দর লাগে আমাদের…।’ প্রিয়ম কথা শেষ করতে পারল না, ওর হাতে মুহুর্মুহু টোকায় পাশে তাকিয়ে দেখল প্রফেসর বেগ ওর হাতে টোকা দিচ্ছেন।
প্রিয়ম কৌতূহলী গলায় কিছু বলার আগেই ড বেগ ফ্যাসফেসে গলায় বলে উঠলেন, ‘একটা সুড়ঙ্গ আছে। ওই আয়না আর বাস্তবের মাঝামাঝি দিয়ে। তুমি বের করতে পারবে?’