৩৭
জানুয়ারির ঠান্ডা মেখে যমুনা নদীর পাড়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহতাববাগ।
শাজাহানের সাধের উদ্যান। শোনা যায় সম্রাট শাজাহান তাঁর প্রিয়তমার বিশ্রাম স্থল তাজমহলের একদম কেন্দ্রীয় অক্ষরেখায় এই মেহতাববাগে বানাতে চেয়েছিলেন নিকষ কষ্টিপাথরে তৈরি কালো তাজমহল। চেয়েছিলেন সেই কালো তাজে থাকবে সম্রাটের নিজের সমাধি। দু-পাশে দু-জনের সমাধি, মাঝখান থেকে অনন্তকাল ধরে বয়ে চলবে নীল যমুনা, বিরহের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে, মাঝখান দিয়ে থাকবে ব্যর্থ প্রেমের চিহ্ন, বহন করবে একটা মর্মর সাঁকো।
কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তাঁকে বন্দি হতে হয় পুত্র ঔরঙ্গজেবের হাতে। আর কৃষ্ণ তাজ বানানোর স্বপ্ন তাঁর অসম্পূর্ণই রয়ে যায়।
ইনস্পেকটর নাহুম খান একটা কাজের কাজ করেছিলেন, গাড়িতে আসার সময়েই হেড অফিসে এই দিককার হালহকিকত জানিয়ে রেখেছিলেন। ফলে এ এস আইয়ের অনুমতির প্রয়োজন পড়ল না, ওদের পরিচয় পেয়েই গেট খুলে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
রুদ্র, প্রিয়ম, ইনস্পেকটর নাহুম খান, অঘোরেশ এমনকী প্রফেসর বেগও যতটা সম্ভব দ্রুতবেগে ছুটছিলেন একদম যমুনা নদীর পাড়ে। নাহুম খান বললেন, ‘সবচেয়ে বড়ো কথা, ওই জায়গাটায় যেতে গেলে মেহতাববাগের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, দু-পাশের জঙ্গল দিয়েও আরামসে যাওয়া যায়।’ কথাটা বলে তিনি রুদ্রর দিকে তাকালেন, ‘আপনি কিন্তু দারুণ বের করলেন পুরো মানেটা! উহ, আরেকটু হলেই কবীরের দল বের করে ফেলেছিল আর কি!’
‘বের করেনি আপনি জানলেন কী করে?’ রুদ্র তীক্ষ্নচোখে তাকাল, ‘কবীর খান আগের সবকটা সুড়ঙ্গের হদিশ বের করেছে, এটার কপি ওর কাছে না থাকলেও ও দেখেছিল আগে। শত্রুপক্ষকে কখনো বোকা ভাববেন না।’
ঠিক আধ মিনিট পরেই জায়গাটায় প্রথম পৌঁছোলেন ড বেগ, তারপরই দারুণ একটা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হায় আল্লা!’
রুদ্রর সন্দেহই ঠিক। মেহতাববাগ পেরিয়ে সেই ভাঙাচোরা গোলাকার জায়গা, একদম গা দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী, ওপারেই গলানো সোনার মতো রোদ ঝলমল করছে তাজমহল। গোলাকার জায়গাটার চারপাশ ভেঙেচুরে এখন আর সম্পূর্ণ বৃত্তাকার নেই, কালের নিয়মে ধুয়ে গেছে নদীর জলে। তবু গোটা জায়গায় ঠিক কেন্দ্রবিন্দুটা খোঁড়া, জঙ্গলের অন্য গর্তগুলোর মতো স্ল্যাব চাপা দেওয়া নেই, বরং হাঁ-মুখের মতো খোলা, ভেতরের এবড়োখেবড়ো সিঁড়িটা চোখে পড়ছে সবার।
এই সেই সুড়ঙ্গ!
দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে পড়ে আছে, অথচ কেউ দেখতে পায়নি।
‘কবীর প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। টাকার লোভে ও আজ দেশের ইতিহাসকেও বেচে দিল!’ কাঁপতে কাঁপতে গর্তের পাশে বসে পড়লেন ড বেগ, ‘সব প্রমাণ এর মধ্যে নিশ্চয়ই লোপাট হয়ে গেছে।’
‘আমার তা মনে হচ্ছে না ড বেগ। আপনি শান্ত হোন। কবীর কোথায় সেটাই আমি ভাবছি। ওর ওপরে যারা রয়েছে তাদের উদ্দেশ্য যদি আরও বড়ো কিছু হয় …!’ রুদ্র নিজের মনেই বকছিল। পাশে নাহুম খান উত্তেজিতভাবে ফোন করছিলেন হেড কোয়ার্টারে।
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা। আর ঠিক দেড় ঘণ্টা বাদে তাজমহলে প্রবেশ করবেন মান্যগণ্য সমস্ত দেশপ্রতিনিধিরা।
নাহুম খান লোকটা একটু বেশি বকাবকি করলেও কাজে একশো শতাংশ খাঁটি। কুড়ি মিনিটের মধ্যে একধরনের বিশেষ পোশাক পরা দল চলে এল, বিদ্যুতের গতিতে তারা ঝপাঝপ এক ধরনের বিশেষ মাস্ক পরে নিল মুখে, পিঠে ঝুলিয়ে নিল ছোটো ছোটো সিলিন্ডার, একটা বড়ো দড়িতে প্রায় সাত-আটজন নিজেদের চেনের মতো বেঁধে নিয়ে নামতে লাগল সুড়ঙ্গের ভেতরে। এঁরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কম্যান্ডো, মাড পেনিট্রেশন, ইকো-সাউন্ডার, আন্ডার ওয়াটার মেটাল ডিটেক্টরের মতো সমস্ত অত্যাধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে এঁদের সঙ্গে।
ততক্ষণে দু-পাশের জঙ্গলে মোতায়েন পুলিশের বেশিরভাগ চলে এসেছে এখানে, উত্তেজনা, ফিসফাসে ভরে উঠছে জায়গাটা। পুলিশের ছোটোবড়ো কর্তারাও অনেকেই চলে এসেছেন এর মধ্যে।
ছয়জনের টিম যখন নেমে গেছে, তখন রুদ্র ঢোঁক গিলে নাহুম খানের দিকে তাকাল, ‘আচ্ছা, আমরা নামব না?’
‘পাগল নাকি আপনি?’ নাহুম খান চোখ পাকালেন, ‘কতশো বছরের পুরোনো সুড়ঙ্গ কে জানে, কী আছে ভেতরে, কত বিষাক্ত গ্যাস … নাহ! আপনি আমার চাকরিটা না খেয়ে ছাড়বেন না দেখছি।’
‘না ওঁদের যেতে দাও নাহুম।’ রুদ্র চমকে তাকিয়ে দেখল কখন এন আই এ-র ডি জি সাহেব মি অমূল্য ত্রিবেদী এসে দাঁড়িয়েছেন, ‘এই অপারেশনে থাকাটা পুলিশ না হয়েও ওঁদের অধিকার।’
‘স্যার, আপনি!’ মুহূর্তে স্যালুট ঠুকলেন নাহুম খান, ‘কি-কিন্তু স্যার, ভেতরে যদি কোনো পয়জনাস গ্যাস …!’
‘কেন, মাস্ক পরিয়ে অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট দিয়েই পাঠাও, স্পেশাল ফোর্সের লোকেদের বলে দাও ওদের যেন এসকর্ট দিয়ে নিয়ে যায়।’ মি ত্রিবেদী বললেন।
রুদ্র আর প্রিয়ম যখন কাঁপা কাঁপা হাতে মাস্ক আর জামার ওপরেই মহাকাশে যাওয়ার মতো একধরনের ট্র্যাকসুট পরছে, পিটে ততক্ষণে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার।
নাহুম খান এসে বললেন, ‘এই মাস্কগুলোয় কী বিচ্ছিরি গন্ধ! কেমন গা গুলিয়ে আসছে।’
রুদ্র অবাক হয়ে গেল, ‘এ কী, আপনিও মাস্ক ড্রেস পরেছেন, আপনিও নামবেন নাকি!’
‘এক যাত্রায় পৃথক ফল করে কোনো লাভ আছে ম্যাডাম?’ আগের পাঁচজন নেমে গিয়েছিল আগেই, বাকি তিনজন কম্যান্ডো দাঁড়িয়ে ছিল ওদেরই অপেক্ষায়, দড়িতে নিজেদের বেঁধে নিয়ে রুদ্র প্রিয়ম আর নাহুম খান নামতে শুরু করলেন সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে। প্রথমে তিনজন কম্যান্ডো, তারপর ওরা তিনজন।
সুড়ঙ্গের ভেতরটা স্যাঁৎসেঁতে, নাক-মুখ মাস্কের ভেতর থাকায় রুদ্র কোনো গন্ধ পেল না, কিন্তু স্যাঁৎসেঁতে ভাবটা অনুভব করতে পারছিল। এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি চলে গেছে প্রায় পঞ্চাশ ধাপ, ওরা খুব সাবধানে নামছিল। একটা ধাপ মিস হলেই যে কোথায় গিয়ে পড়বে কেউ জানে না।
সিঁড়িটা শেষ হতেই আর নীচের দিকে নয়, সমান্তরালভাবে একটা সরু রাস্তা, সরু গোল গর্তের মতো মুখে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। শিখিয়ে দেওয়া মতো রুদ্র মাস্কের ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল।
পেছন থেকে প্রিয়ম কিছু একটা বলে চলেছিল, রুদ্র কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। এবার প্রিয়ম ইশারা করে বোঝাল, ‘আমরা কি আর এখান থেকে ফিরতে পারব?’
রুদ্র ইশারায় বুড়ো আঙুল ওপরদিকে তুলে দেখাল, ‘নিশ্চয়ই পারবে।’
প্রিয়মের পেছনে থাকা নাহুম খান বুড়ো আঙুল দেখে কী বুঝলেন কে জানে, তিনি দুটো বুড়ো আঙুল একসঙ্গে নাড়ালেন।
রুদ্র বুঝতে পারছিল ওরা এবার মাটির তলা দিয়ে যমুনা নদীটাকে পুরোটা অতিক্রম করবে। উত্তেজনায় ওর হাতের আঙুলগুলো ধীরলয়ে কাঁপছিল। বিদেশে নদীর তলার রাস্তায় ও হেঁটেছে, কলকাতাতেও তো গঙ্গার নীচ দিয়ে রাস্তা হচ্ছে শুনেছে, কিন্তু এইরকম কয়েকশো বছরের পুরোনো আদিম সুড়ঙ্গ দিয়ে হাঁটার উত্তেজনা আলাদা।
আচ্ছা, কবীর খান কি এখনও ভেতরে রয়েছে? নাকি ওদের আসার আগেই কাজ হাসিল হয়ে গেছে?
পায়ের নীচটা কিছুটা নরম মাটির হলেও হাঁটতে খুব অসুবিধা হচ্ছে না, হাতের লাঠিটা চেপে ধরে ওরা হাঁটছিল। আচ্ছা সাপখোপও তো থাকতে পারে এত পুরোনো সুড়ঙ্গে? কথাটা মনে হতেই ভয়ে রুদ্রর শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল। পরক্ষণেই ও নিজেকে বোঝাল, ওর শরীরের একটা অংশও বাইরে অনাবৃত নেই, পুরোটাই একটা ট্র্যাকসুটে ঢাকা, তাই সাপ বা বিছের ভয় পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
প্রায় পনেরো মিনিট ওরা ধীরে ধীরে সমতল সুড়ঙ্গটা পার করল। সমতল অংশ শেষ হতেই মাস্কের টর্চের আলোয় আবার ওপরে ওঠার সিঁড়িটা ওরা পরিষ্কার দেখতে পেল। অর্থাৎ ওরা মাটির তলা দিয়ে যমুনার এপারে চলে এসেছে, প্রফেসর বেগের গবেষণা নির্ভুল হলে ওরা এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজাসুজি প্রবেশ করবে তাজমহলের সবচেয়ে নীচের তলায়।
উত্তেজনায় রুদ্রর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমের কুচি বয়ে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরুর করার আগেই সামনে থাকা তিনজন কম্যান্ডোর একজন ওদের পেছনে চলে এল গার্ড হিসেবে। ওরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। নামার মতোই এখানেও প্রায় পঞ্চাশ ধাপ ওঠার পর একটা শক্ত গরাদে একদম ওপরে থাকা কম্যান্ডোর মাথা আটকে গেল।
রুদ্র নীচ থেকে আন্দাজে বুঝতে পারল, ওপরের গরাদটা বন্ধ। গরাদটা শতাব্দীপ্রাচীন, কিন্তু তালাটা নিশ্চয়ই নয়, ও মনে মনে ভাবল। কবীর ছেলেটার বুদ্ধির প্রশংসা আরও একবার না করে ও পারল না।
কিন্তু তাতে অসুবিধা কিছু হল না। কম্যান্ডোদের সঙ্গেই থাকে ছোটো গ্যসকাটার, নিখুঁত পারদর্শিতায় প্রথম কম্যান্ডো গরাদটা কেটে ফেলল দশ মিনিটেই, তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেল ওপরে।
রুদ্র প্রিয়ম আর ইনস্পেকটর নাহুম খান যখন উঠলেন, ততক্ষণে ভেতরে টাইমার সেট করা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বম্বগুলোর ক্রমাগত বিপবিপ করা লাল আলোয় ধাঁধিয়ে যাচ্ছে ওদের চোখ।
ভয়ে নিজেদের অজান্তেই কেমন কাঁপুনি ধরে যাচ্ছিল ওদের, সামনের সেট করা বম্বগুলো যে ঠিক একটার সময় ওপরে তাজমহলে অতিথিরা ঢুকলেই ফেটে গিয়ে তছনছ করে দেবে সব কিছু, সেটা বুঝতে ওদের একটুও বেশি সময় লাগল না।
কম্যান্ডোরা এই ধরনের বিপদ সামলাতে সিদ্ধহস্ত, উল্কার গতিতে একজন কম্যান্ডো গর্ত দিয়ে নেমে গেল নীচে।
এক মুহূর্তের জন্য রুদ্রর মনে হল, যদি বম্ব ডিফিউজ করার লোক আনতে আনতে বম্বগুলো ফেটে যায়? একসঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বারোটা দেশের প্রতিনিধি? কী হবে তখন? স্নায়ুর ওপর প্রাণপণে চাপ রাখতে ও প্রিয়মের হাতটা চেপে ধরল। সঙ্গেসঙ্গে প্রিয়মের হাতের ঝাঁকুনিতে মুখ ফেরাল ও, মুখোশের আড়াল থেকে প্রিয়ম পাশেই কিছু একটা দেখাবার চেষ্টা করছে ওকে।
রুদ্র অবসন্ন শরীরে এগিয়ে এল, একটা আয়তাকার ছোটো ঘর, তাতে এই টাইমবম্বগুলো ছাড়া রয়েছে একটা বেদি, ওর ওপাশে কি তাহলে সত্যিই প্রফেসর বেগের কথা অনুযায়ী কিছু রয়েছে?
সেটাই কি প্রিয়ম দেখাতে চেষ্টা করছে? সত্যিই কি শিবলিঙ্গ রয়েছে? নাকি পুরোটাই কষ্টকল্পনা, তাজমহল শাজাহানই বানিয়েছিলেন, জায়গাটা ছিল রাজা রাজা মানসিংহের!
আধা আলো আধা অন্ধকারে পা ফেলল ও, আর তখনই দেখতে পেল।
একটা টাটকা মৃতদেহ। গুলিতে ছিন্নভিন্ন। পাশে পড়ে রয়েছে আধভাঙা মাস্ক। মুখের ওপর দিয়ে কেউ পাশবিক নিষ্ঠুরতায় আড়াআড়ি ছুরি চালিয়েছে, তবু আজ ভোরেই পুলিশের হেড কোয়ার্টারে দেখা ছবিটা চিনতে পারল ও।
কবীর খান।
একটা চাপা নিশ্বাস বের হয়ে এল ওর মুখ থেকে। ছেলেটা বুদ্ধিতে আচ্ছা আচ্ছা বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত, শুধু নিজের দোষে সব হারাল। টাকার লোভে দেশের এত বড়ো ক্ষতি করার শাস্তি তাহলে কবীর খান ওর ওপরমহল থেকেই পেয়ে গেল!