১৭
দুপুর পেরোতে-না-পেরোতেই অঘোরেশের আবার ফোন এল সুরঞ্জনের কাছে।
পূরবী তখন খেয়ে উঠে একটা বই নিয়ে বসেছেন। কমপ্লেক্সের মধ্যে হওয়ায় মেন রোডের মোটামুটি কাছে হলেও গাড়িঘোড়ার কোলাহলটা এখানে খুব একটা এসে পৌঁছোয় না, মোটামুটি নিরিবিলিই বলা চলে। সুরঞ্জন বসে একটা পুরোনো ইংরেজি সিনেমা দেখছিলেন। সুরঞ্জনই ট্যাবে করে নিয়ে এসেছিলেন, গ্রেগরি পেকের পুরোনো মুভির দারুণ কালেকশন আছে ওঁর কাছে। কয়েক মাস আগে জন্মদিনে রুদ্র এখান থেকে ট্যাবটা পাঠিয়েছিল সুরঞ্জনকে উপহার হিসেবে। তারপর থেকেই সুরঞ্জন ট্যাবটাকে যতরকমভাবে পারা যায়, ব্যবহার করে চলেছেন।
আসলে ট্যাবটা পেয়ে সুরঞ্জন ভারি খুশি হয়েছেন। কোথাও গেলেই বইয়ের ভারে ব্যাগ আর ভারী হবে না। পাতা উলটে বুকমার্ক করার ঝামেলা নেই, পুরোনো কোনো কিছু দেখতে গেলে শুধু শব্দটা লিখে সার্চ করলেই চট করে বেরিয়ে যায়। অনেক ভালো ভালো সিনেমা মেমারি কার্ডে লোড করে রাখা যায়। পুরোনোপন্থীরা যে যা-ই বলুক, সুরঞ্জন এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলোকে ইতিবাচকভাবেই নেন। পুরোনোকে সরিয়ে নতুন আসবেই। প্রযুক্তি, মানসিকতার পরিবর্তন তো সভ্যসমাজের অগ্রগতির পরিচায়ক, সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরোনোমাত্রেই ভালো, এই ধারণা আঁকড়ে থাকলে তো মানুষ আজও প্রস্তর যুগেই পড়ে থাকত!
অঘোরেশ এবার আর মিসড কল দিলেন না। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাঁর গমগমে গলা সুর করে ভেসে এল, ‘হ্যালো, লিটল বুদ্ধা!’
সুরঞ্জন হিন্দিতেই বললেন, ‘বল। কখন পৌঁছোলি বাড়ি? সকালে ফোন করলাম তোর মিসড কল দেখে, তুললি না তো!’
অঘোরেশ বললেন, ‘ওসব পরে হবে, শোন, তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা আছে, খুব আর্জেন্ট।’
সুরঞ্জন একটু থমকে গেলেন। সকালেও অঘোরেশ এই কথাটাই বলছিলেন বটে। কিন্তু, আজ ভোরে ট্রেনে দু-জনের দেখা হওয়াটা তো নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। চল্লিশ বছর আগেকার বন্ধুকে কি এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার থাকতে পারে?
সুরঞ্জনের মনে পড়ে গেল, পূরবী অঘোরেশকে খুব একটা পছন্দ করেননি। আগ্রায় থাকার পরিকল্পনা মোটামুটি মাসখানেকের, তার মধ্যে অঘোরেশ আসা-যাওয়া শুরু করলে পূরবী যে আদৌ খুশি হবেন না, তা সুরঞ্জন বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু পুরোনো বন্ধুকে সোজাসুজি কিছু বলতে ভদ্রতায় বাধে।
তার ওপর সত্যিই হয়তো অঘোরেশের কিছু প্রয়োজন আছে। কোনো কিছু সমস্যার জন্য দোলাচলে রয়েছে সে, পরামর্শের জন্য বার বার ফোন করছে।
সুরঞ্জন বললেন, ‘কী কথা?’
‘আমি ইতিহাসের একটা খুব বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি, এমন কিছু সত্য আবিষ্কার করেছি যেগুলো দিল্লির মসনদ কাঁপিয়ে দিতে পারে। সেই ব্যাপারেই তোর সঙ্গে একটু ডিসকাস করতে চাই। তুই চাইলে আমার সঙ্গে কাজও করতে পারিস, তোর মতো বিচক্ষণ লোক আমার দরকার।’
সুরঞ্জন অবাক হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ‘বেশ তো, আয় না আজ বিকেলে আমাদের এখানে। ঠিকানাটা বলব?’
অঘোরেশ বললেন, ‘না না, তোর বাড়ি যাব না, ব্যাপারটা একটু সিক্রেট। তুই বরং একটা কাজ কর। আমার বাড়ি চলে আয়। এখুনি আয় না!’
সুরঞ্জন ফোনটা চেপে ধরে রুদ্রর দিকে তাকালেন। রুদ্র উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। সুরঞ্জন ভাবলেন পূরবী বই পড়ছেন পড়ুন, বসেই তো আছেন, বাপ মেয়ে মিলে পুরোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে এলেই হয়!
সুরঞ্জন আর আপত্তি করলেন না। অঘোরেশের কথা শুনে ব্যাপারটায় বেশ কৌতূহল হচ্ছে, পূরবী অসন্তুষ্ট হতে পারেন ভেবে ওঁকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে কিন্তু কিন্তু করছিলেন, অঘোরেশের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাবটা তাঁর ভালোই লাগল।
অঘোরেশ বললেন, ‘সদরবাজার চিনিস তো? ধুলিয়াগঞ্জে? তোর আসার দিক থেকে সদর বাজারের আগেই বালুগঞ্জে আমার বাড়ি। তুই এক কাজ কর, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়, আমি একদম বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব।’
সুরঞ্জন বললেন, ‘না না, ঠিক আছে। আমার মেয়েকেও নিয়ে যাচ্ছি, তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ও তো মোটামুটি সবই চেনে এখানে।’
ফোনটা রাখতে রুদ্র একটু অনিচ্ছার ভঙ্গিতে বলল, ‘এই তো এলে তোমরা, এখন আবার কোথায় যাবে? তোমার সঙ্গে আমার একটা ব্যাপারে একটু আলোচনা ছিল।’
পূরবী শুনতে পেলে রাগারাগি করবেন, সুরঞ্জন রুদ্রকে ইশারায় আস্তে কথা বলতে বললেন, ‘এসে শুনছি না হয়। এখন চল না! কলেজ লাইফের বন্ধু, বার বার ডাকছে। কী করে না বলি বল তো! একটু বাদেই চলে আসব না হয়! তোর মাকে কিছু বলতে হবে না।’
আধ ঘণ্টা বাদে বাবা মেয়ে বেরিয়ে পড়ল। শীতের দুপুর, তবু রোদের তেজ ভালোই রয়েছে। অটোয় উঠে রুদ্র কোতূহল থেকেই ফোন করল নাহুম খানকে, ‘ধরতে পারলেন?’
‘নাহ!’ নাহুম খানের হতাশ গলা পাওয়া গেল ওপাশ থেকে, ‘বাড়ি তালা মারা। আশপাশে জিজ্ঞাসা করলাম, বলল পাগলাটে বুড়ো, কখন আসে, কখন যায় কোনো ঠিকঠিকানা নেই। আমি এখন আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে এসেছি, যদি আরও কিছু খোঁজ পাওয় যায়!’
‘ওকে। ধরতে পারলে জানাবেন। আর কোনোরকম হেল্প লাগলেও ফোন করবেন।’ রুদ্র ফোন রেখে দিল, ‘বাবা, তোমার এই বন্ধু কোন কলেজে পড়ান?’
‘আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে।’ সুরঞ্জন বললেন।
রুদ্র চুপ করে গেল। অঘোরেশ ভাটও তো ওখানেই পড়াতেন, ভালোই হবে, বাবার এই বন্ধুর কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য পেলেও পাওয়া যেতে পারে। একই বিষয় যখন, নিশ্চয়ই চিনবেন।
বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। দয়ালবাগ থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলেন, তারপর রাকবগঞ্জ থানা পেরিয়েই অঘোরেশের সুবিশাল দেহটা রাস্তার ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। আশ্চর্য, সেই সকালের পোশাকই এখনও ওর পরনে, বাড়ি গিয়ে কি জামাটাও ছাড়েনি?
ওঁর দাড়ির দিকে চোখ যেতে পূরবীর কথা মনে পড়তেই সুরঞ্জন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে একটু দূরত্ব রেখে চলতে লাগলেন।
অঘোরেশ কোনো কথা বললেন না, রুদ্রর দিকে একবার তাকিয়েই চলতে শুরু করলেন। সুরঞ্জন আর রুদ্র পিছু নিল।
এই বালুগঞ্জ অঞ্চলটা বেশ অভিজাত এলাকার মধ্যেই পড়ে, বেশ ফাঁকা ফাঁকা খোলামেলা প্লটের ওপর একটা করে বাড়ি, সামনে পেছনে ছোটো জায়গাও আছে, অনেকটা সল্টলেকের মতো।
অঘোরেশের বাড়িটাও তেমনই, একটেরে একতলা বাড়ি, দেখে বোঝা যায় একসময় বেশ যত্ন নিয়ে করা হয়েছিল বাড়িটা। সামনে ছোট্ট একফালি লন, যদিও নিয়মিত দেখভালের অভাবে বড়ো বড়ো আগাছা জন্মে গেছে তাতে। সামনের একদিক গ্যারাজ, আর অন্যদিক দিয়ে ঢোকার রাস্তা।
অঘোরেশ পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। রুদ্র আশপাশটা ভালো করে দেখছিল, গোটা গলিটা নির্জন। শুধু একটা কুকুর অলসভাবে শীতের রোদে ঘুমোচ্ছে। দূরে একটা চায়ের গুমটি, দুপুর বলে সেটা মনে হয় বন্ধ। সেখানে একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। আর কেউ কোথাও নেই।
বাড়িতে ঢুকে ডাইনিং হলে এসে সুরঞ্জন বেশ চমকে গেলেন। বাড়ির তুলনায় ডাইনিংটা বেশ বড়ো, অন্য ঘরগুলো হয়তো আকারে ছোটো হবে। কিন্তু ডাইনিং-এ বসার কোনো আসবাব নেই তেমন, ঘরের এক কোণে একটা সোফা সেট উলটিয়ে রাখা রয়েছে, জায়গার সাশ্রয় করতে যেমন করে রাখা হয়। আর পুরো ফ্লোর জুড়ে একটা পুরোনো জীর্ণ হয়ে যাওয়া কার্পেটের ওপর স্তূপাকৃতি বই। সেগুলোও অবিন্যস্তভাবে সাজানো, কেজি দরে বই বিক্রি করার সময় যেমন অনাদরে ফেলে রাখা হয়, ঠিক তেমনভাবেই হেলায় পড়ে রয়েছে রাশি রাশি বই।
পুরো ঘরটায় একটা সোঁদা পুরোনো গন্ধ! রুদ্র আড়চোখে বাবার দিকে একবার তাকিয়েই নজর ফেলল বইগুলোর দিকে।
সবই প্রায় ইতিহাসের বই।
সুরঞ্জন বেশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন, ‘কী রে? বইয়ের আলমারি নেই নাকি বাড়িতে? এরকমভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রেখেছিস?’
অঘোরেশ মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘যাদের সবসময় লাগে, তাদেরকে বার বার জায়গা পালটিয়ে বিরক্ত করি না, তার চেয়ে যেমন আছে তেমনই থাক। বোস এখানে’, ঝুঁকে পড়ে বইগুলোকে একদিকে সরাতে সরাতে বললেন অঘোরেশ, ‘তোদের জন্য আমি একটু কফি করে আনি। আমিও তোদের সঙ্গেই বাড়ি ঢুকছি, সকালে স্টেশনে নামার পর থেকে অনেকগুলো কাজ ছিল।’
কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে গোটা ঘরটা, তার মধ্যে অঘোরেশ কাছে এলেই সেই বিশ্রী নোংরা গন্ধে নাক বুজে আসছিল। সুরঞ্জনের মেজাজটা তেতো লাগছিল। না এলেই পারতেন! পূরবী ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। মনে মনে ঠিক করলেন, আধ ঘণ্টার মধ্যেই উঠে পড়বেন এখান থেকে।
অঘোরেশ ভেতরে যাওয়ার পরেই সুরঞ্জন রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলেন, ‘অঘোরেশটা সত্যিই মনে হচ্ছে খ্যাপাটে হয়ে গেছে রে! দুম করে না এলেই ভালো হত!’
রুদ্র তীক্ষ্নচোখে সামনের বইগুলো দেখছিল, প্রথমে বাবার কথাটা যেন শুনতে পেল না, ‘উঁ? কী বলছ?’
সুরঞ্জন পুনরাবৃত্তি করতে যাওয়ার আগেই ও বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকাল, ‘কী নাম বললে? কী নাম তোমার এই বন্ধুর?’
সুরঞ্জন রুদ্রর আকস্মিক প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে গেলেন, ‘বললাম তো, অঘোরেশ। অঘোরেশ ভাট।’
রুদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে কিছু বলতে গেল, তার আগেই ভেতরের ঘরে অথচ দৃঢ় গলায় কথাবার্তা শুনতে পেল ওরা দু-জনে। অঘোরেশ যেন কাউকে কফি বানাতে বলছেন, এবং ওইপক্ষ থেকে সম্ভবত না-বাচক কথা শুনে অঘোরেশ একটু উঁচু গলায় উষ্মা প্রকাশ করছেন, একতরফাই চলছে বাকবিতর্ক।
সুরঞ্জন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, যদিও অঘোরেশ নিজে কিছু বলেননি, তবু ওর চালচলন দেখে তিনি ভেবেছিলেন অঘোরেশ বিয়ে-থা করেননি। সুরঞ্জনের জন্য কফি বানাতে বলছেন বলেই কি ওর স্ত্রীর এত অসন্তোষ?
খুব বিব্রত হয়ে সুরঞ্জন মেয়েকে বললেন, ‘কী রে, চেঁচামেচি হচ্ছে নাকি বল তো? গিয়ে দেখব ভেতরে?’
রুদ্র যেন শুনতেই পেল না, ও ততক্ষণে নাহুম খানের মোবাইলে চেষ্টা করছে, কিন্তু এই বদ্ধ ঘরের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
সুরঞ্জন দেখলেন রুদ্রর চোখ-মুখ যেন পালটে গেছে, মুখে ঘোরাফেরা করছে একরাশ উদবেগ।
সুরঞ্জন বলতে গেলেন, ‘কী হয়েছে তোর? এরকম করছিস কেন? কাকে ফোন করলি?’
তার আগেই রুদ্র চাপা গলায় বলল, ‘যে করে হোক, একে এখন আটকে রাখতে হবে বাবা, তোমায় পরে সব বলছি! এখন কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। পুলিশ ডাকছি এখুনি!’
‘পুলিশ!’ সুরঞ্জন অবাক হয়ে চুপ করে গেলেন। একবার ভাবলেন ভেতরে গিয়ে দেখবেন, তারপর ভাবলেন সেটা ঠিক ভদ্রতার দিক থেকে সমীচীন হবে না। আবার হুট করে অঘোরেশকে না বলে চলেও যাওয়া যায় না। ওদিকে রুদ্র ফোনে খুটখাট করে যাচ্ছে, কথা বলতে গেলেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলছে। বাধ্য হয়ে তিনি সামনে রাখা বইগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলেন।
ধুলোমাখা বইয়ের সারির মধ্যে বেশিরভাগই ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসের বই। মুঘল সময়ের জীবনযাত্রা, সাধারণ মানুষ, শিক্ষা এসবের ওপর বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা বই। এর মধ্যে কিছু বই সুরঞ্জন নিজেও পড়েছেন। শাজাহানের সময় ভারতে আসা ব্যবসায়ী টাভারনিয়েরের লেখা, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী, আরও বেশ কিছু পুরোনো বইয়ের ইংরেজি ভার্সান দেখতে পেলেন তিনি। কিন্তু সেগুলোর ওপরের পুরু ধুলোর প্রলেপ দেখে তাঁর আর হাত দিতে ইচ্ছে হল না।
বরং এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে একটু দূরে জানলার পাশে একটা নীচু টুলের ওপর রাখা একটা জিনিসের দিকে তাঁর চোখ চলে গেল। সিল্ক কাপড়ের ওপর জানলার বাইরে দিয়ে নরম রোদ এসে জিনিসটা চকচক করছে বলেই বোধ হয় চোখ পড়ল ওদিকে।
সুরঞ্জন উঠে এসে জিনিসটা হাতে নিলেন। লম্বায় দেড় ফুটের কিছু বেশিই হবে, চওড়ায় প্রায় এক ফুট সিল্কের কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটা বস্তু।
সুরঞ্জন ওপরের মলাটটা খুললেন। মোটা এক ধরনের শক্ত কাগজের একটা বই। প্রতিটা পৃষ্ঠার চারপাশটা সোনালি রঙের ডিজাইন দেওয়া বর্ডার। সুরঞ্জনের অভিজ্ঞ চোখ দেখেই বুঝে নিল এটা কোনো পুরোনো পাণ্ডুলিপি। বর্ডারের ডিজাইনটাও চিনতে পারলেন তিনি, এই ধরনের গোল্ড আরবি ডিজাইন দিয়ে আগে বই বানানো হত।
সুরঞ্জন চোখ সরু করে জরিপ করতে লাগলেন, যতদূর মনে পড়ছে, এই ডিজাইনটা সতেরো আঠারো শতকে খুব চলত, পার্সি কাজ।
রুদ্র উঠে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, সড়াৎ করে যেন বাইরের পাঁচিল থেকে কেউ একটা সরে গেল। ও সঙ্গেসঙ্গে হাততিনেক দূরে পাশের জানলাটায় গেল, কিন্তু পাল্লাটা খুলল না, সামান্য ফাঁক করে দেখল ওই চায়ের গুমটিতে বসে থাকা চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটা সরে যাচ্ছে বাড়ির পাঁচিলের পাশ থেকে, যদিও তার দৃষ্টি এইদিকেই।
রুদ্রর ভ্রূ কুঁচকে গেল, কী হচ্ছে কেসটা? এই বাড়িটার ওপর কেউ নজর রাখছে?
অন্যমনস্কভাবে ও বাবার দিকে তাকাল, ‘কেন ওসব ঘাঁটছ?’
সুরঞ্জন শুনতেই পেলেন না, তিনি সাবধানে বইটার পাতা উলটোলেন এবং মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একটা দুর্ধর্ষ তেলরঙে আঁকা ছবি প্রথম পাতাতেই, ছবিটা দেখেই তিনি চিনতে পারলেন, চোদ্দো শতকের সেই দুনিয়া কাঁপানো স্বৈরাচারী মোঙ্গল যোদ্ধা তৈমুর লং। মাথায় সেই চৈনিক মুকুট, পরনে যুদ্ধের পোশাক। ছবিটার নীচে ছোটো ছোটো হরফে কিছু লেখা। এক নজরে সেগুলো উর্দু মনে হলেও সুরঞ্জন বেশ চিনতে পারলেন, এটাকে বলা হয় ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফি, একধরনের পার্সি-আরবি মেশানো হরফ যেটা মধ্যযুগে সম্ভ্রান্ত পরিবারে লেখার জন্য খুব প্রচলিত ছিল।
পুরো পাণ্ডুলিপিটাই অসাধারণ সমস্ত হাতে-আঁকা ছবিতে ভরতি, সঙ্গে ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফিতে প্রচুর লেখা রয়েছে। বেশিরভাগ ছবিই রাজদরবারের, হাতিঘোড়া সহযোগে সম্রাটের আড়ম্বরপূর্ণ শাসনকালের ছবি, ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ি উপত্যকায় যুদ্ধজয়ের ছবি, এ ছাড়াও আরও একটা পোর্ট্রেট দেখার সঙ্গেসঙ্গে সুরঞ্জন চিনতে পারলেন। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাজাহান।
সন্দেহটা অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে ঘনীভূত হচ্ছিল, অবশেষে আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কর্তা নিশ্চিত হলেন।
‘এই বইটার নাম বাদশাহনামা, পার্সি উচ্চারণে পাদশাহনামা আর আরবি উচ্চারণে বাদশাহনামা। শাজাহানের সভাসদ আবদুল হামিদ লহরীর লেখা শাজাহানের জীবনচরিত। এটা অরিজিন্যাল পাণ্ডুলিপি!’ সুরঞ্জন ফিসফিস করে বললেন রুদ্রকে, ‘প্রায় চারশোর কাছাকাছি বছরের পুরোনো!’
রুদ্র চাপা গলায় বলল, ‘এটা এঁর কাছে এল কী করে?’
দরজার কাছে একটা মৃদু শব্দ হতে সামনে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই সুরঞ্জনের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। রুদ্রও সেদিকেই তাকাল চমকে উঠে।
দরজার কাছে কফির কাপ হাতে অঘোরেশ দাঁড়িয়ে। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সুরঞ্জনের হাতে ধরা পাণ্ডুলিপিটার দিকে।