অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৭

২৭

উজ্জয়িনী আবার সেই একই স্বপ্ন দেখছিল।

ওর দম আস্তে আস্তে আটকে আসছিল, বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা জলের স্রোতের চেয়েও যেন বেশি গতিতে লাবডুব লাবডুব করছিল। শরীরের নীচের অংশটা এতটাই ভারী মনে হচ্ছিল যে ও আর পা দুটোকে জলের মধ্যে নাড়াতে পারছিল না। জীবিত থাকার জন্য ওর একবার জলের ওপরে ভেসে উঠে শ্বাস নেওয়াটা খুবই দরকার, কিন্তু তাতে ওরা দেখতে পেয়ে যাবে। না! জলের ওপরে কিছুতেই ওঠা যাবে না। এদিকে মাথা ঝিমঝিম করছে, বুকের ভেতরে এত জোরে চাপ লাগছে যে মনে হচ্ছে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে…!

ও-ও কি ওর সই ফুলরেণুর কাছে চলে যাচ্ছে? চেষ্টা করেও পা দুটোকে আর নাড়াতে পারছে না কেন?

মৃদু আর্তনাদ করে ও জেগে উঠে ছটফটিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু একচুলও নড়তে পারল না। চোখ দুটো যেন অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে আছে, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, সব অন্ধকার।

ওহ! আবার সেই দুঃস্বপ্ন!

উজ্জয়িনী হাতের চেটো দিয়ে চোখ দুটোকে ভালো করে রগড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, উলটে হাত নাড়াতেই এক তীব্র যন্ত্রণায় ওর চোখে জল এসে গেল।

কী হয়েছে ওর? ওর কি সারা শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে?

নাকি ও মারা যেতে চলেছে?

আরও কিছুক্ষণ পর তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কাটতে উজ্জয়িনী বুঝতে পারল প্যারালিসিস নয়, ওর গোটা শরীরটাই আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে, আর সেই দড়ির তীক্ষ্নতা এতটাই, একটু নড়াচড়া করতে গেলেই যেন চামড়ার ওপর প্রায় কেটে বসছে ওটা।

প্রাথমিক ঘোরটা কেটে যেতেই ও ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। এটা কোথায় রয়েছে ও? সারা শরীরটা দুমড়ে-মুচড়ে বাঁধা রয়েছে, আধশোয়া অবস্থায় এইভাবে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা করছে ওর। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করতে করতে ও মনে করার চেষ্টা করতে লাগল, এভাবে এখানে ও কী করে এল?

করোলবাগের কাছ থেকে প্রেমিকের সঙ্গে উজ্জয়িনী গাড়িতে উঠেছিল। তারপর, তারপর কী হল?

যত গাঢ় অন্ধকারই হোক, কালোর একটা নিজস্ব ভাষা থাকে। চোখ কিছুক্ষণ সেই অন্ধকারে সয়ে গেলে অন্ধকার তার মধ্যেও সামান্য আলোর দিশা দেয়।

উজ্জয়িনী অনুভব করল, ও একটা অন্ধকার মিশমিশে ঘরের মধ্যে বসে আছে, সোঁদা একটা গন্ধে ভরে আছে গোটা ঘরটা।

অবসাদে মাথা যেন ভারী হয়ে আসছে, তবু ও আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল মনে করার। পরের দিন, হ্যাঁ, পরের দিন ওর আঠেরো বছরের জন্মদিন ছিল, সেদিন ও সাবালিকা হত আর বিয়ে করত, সেইজন্য আগের দিন প্লেনে করে চলেও এসেছিল… কোথা থেকে যেন? হ্যাঁ, শিলং-এর ফ্ল্যাট থেকে … ওরা ঠিক করেছিল পরের দিনই বিয়ে করবে… দিল্লির বাড়িতে বাবা-মা-র অশান্তি… দিনরাত খিটিমিটি… বিয়ে করে দু-জনে চলে যাবে অনেক দূর…!

মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের শিরাগুলো ফেটে ছলকে রক্ত বেরিয়ে পড়বে, তবু উজ্জয়িনী মনে করার চেষ্টা করছিল।

কাকে যেন বিয়ে করার কথা ছিল…? কবীর …হ্যাঁ, কবীরই তো! দু-মাস আগে ফোনে আলাপ হয়েছিল… ওকে কত ভালোবাসে, ওর কষ্টগুলো বোঝে… একটা হাইওয়ে …পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে গাড়ি …!

উজ্জয়িনীর শিরদাঁড়া দিয়ে হঠাৎ বরফের কুচি নেমে গেল। আধশোয়া বাঁকাচোরা শরীরটাকে কষ্ট হলেও ও একটু নাড়ানোর চেষ্টা করল। কবীর কোথায় গেল? গাড়িতে করে ওরা তো কবীরের বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিল, সেই রাতটা ওখানে থেকে পরের দিন সকালেই রেজিস্ট্রি ছিল। গাড়ি চালাচ্ছিল কবীরের আর এক বন্ধু। উজ্জয়িনীর খুব ঘুম পাচ্ছিল… দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি, কবীর একটা মিষ্টির প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছিল ওর দিকে।

আচ্ছা, কবীর কোথায় গেল? ওদের গাড়িটা কি কোনো বড়ো দুর্ঘটনায় পড়েছিল? কিন্তু শরীরে কোথাও কোনো চোট আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

ওকে এমনভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধল কারা? কেনই-বা বাঁধল?

কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন?

উজ্জয়িনী মুখ দিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদ করছিল, হঠাৎ টের পেল ও চিৎকারই করুক, বা আর্তনাদ, কোনোটাই ও শুনতে পাচ্ছে না, কারণ ওর মুখটা শক্ত কোনো টেপ দিয়ে বাঁধা।

আতঙ্কে ও হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

.

রাত প্রায় একটা। পূর্ণিমা রাতের শ্বেতপাথরের থালার মতো গোলাকার চাঁদের নরম ছটা এসে পড়েছে যমুনা নদীর জলে, সেই জলে চাঁদের পূর্ণ প্রতিবিম্ব ঝিকমিক করছে অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে। মেঘের দৌরাত্ম্যে মাঝেমধ্যেই সে লুকিয়ে পড়ছে নদীর পাড়ের শুভ্র ধবল আকাশছোঁয়া তাজমহলের পেছনে। তার অনুপস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়া নীলাভ ছটায় আরও মায়াময় দেখাচ্ছে তাজমহল।

সাধে কি উর্দু কবি শাধির লুধিয়ানভি লিখে গিয়েছিলেন,

তাজ তেরে লিয়ে ইক মজর-এ উলফৎ হি সহী

তুঝকো ইস ওয়াদি-এ রঙ্গিন সে অকীদৎ হি সহী

মেরী মেহবুব কাহি ওর মিলাকর মুঝসে!

অস্ফুটে কবিতাটা উচ্চারণ করতে করতে যে ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে তাজমহলের সমান্তরালের যমুনা নদীর এপাড়ের পরিত্যক্ত বাগানের রাশি রাশি গাছের মধ্য দিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে হেঁটে চলেছিল, সে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, সহস্র ব্যস্ততার মাঝেও এই নির্জন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে-থাকা একাকী তাজমহল যেন রহস্যঘেরা অবগুণ্ঠিতা নারীর মতো টানছে তাকে।

তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে যমুনা নদীর ঠিক ওই পাড়ে, আর তাজমহলের ঠিক উলটোদিকে মেহতাববাগের গায়ে লাগানো জঙ্গলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মেহতাববাগ, অর্থাৎ চাঁদের আলোর উদ্যান। একদম নদীর এপার আর ওপার। কাছাকাছি কোনো গাছে চাপা মিহি সুরে একটানা ডেকে চলেছে কোন রাতজাগা পাখি, সেই সুর এই পরিবেশকে যেন সত্যিই মুঘল যুগে নিয়ে যাচ্ছে। এই বাগান থেকে যতটা সুন্দর তাজমহলকে দেখা যায়, আর কোথাও থেকেই বুঝি এত মায়াময় লাগে না।

এত সুন্দর বিশাল বাগান, অথচ কী অবহেলিত! ও সরু চোখে পাঁচিলের ওপর দিয়ে পুরো বাগানটা জরিপ করল। এই বাগানের ডিজাইন হল বেহেস্তের চারবাগের মতো, কোরানেও এর উল্লেখ রয়েছে। অনেকটা লুডোর ছকের মতো চারদিকে চারটে বাগান, মাঝখান ‘ক্রস’ চিহ্নের মতো রাস্তা, আর একদম মধ্যিখানে ফোয়ারা। অনেকে মনে করে এইটুকুই মেহতাববাগ, কিন্তু তা নয়, পাশের এই যে পরিত্যক্ত আগাছা ভরা জঙ্গলটায় ও দাঁড়িয়ে আছে, এটাও শাজাহানের সময়ে পরিষ্কারের নাম করে এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসা গেছে।

ও আবার সামনের দিকে ফিরে তাজমহলের দিকে তাকাল।

বুড়ো প্রফেসরের হিসেব অনুযায়ী খাজুরাহো বা চান্দেলাদের অন্য রাজার মতো শেষ রাজা পরমাদ্রিদেবও এখানে কোনো একটা জটিল অঙ্ক লুকিয়ে রেখে গেছেন যার সমাধানের ওপারে রয়েছে অবিশ্বাস্য কিছু। সেই ‘অবিশ্বাস্য কিছু’টার জন্যই এত আলোড়ন, এত টাকার খেলা, এত রক্তারক্তি। বুড়ো যদি নিজের বস্তাপচা সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি না খেয়ে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেত, তাহলে অবশ্য এত কিছু হত না। কিন্তু সেটা কিছুতেই হল না, উলটে সঙ্গত দিল ওই মাথামোটা টাকা কুমির এম পি-টা। একদিকে হাঁটুর বয়সি মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করছে, অন্যদিকে নিজের বংশমর্যাদার লোভে পাগলা কুত্তার মতো লাফাচ্ছে।

নিজের মেয়ে তো গায়েব, লাফা এবার কত লাফাবি।

না হয় এখনও সেই মুদ্রাটা পাওয়া যায়নি, তবু সেই ফর্মূলার পথ আবিষ্কার করার ক্ষমতাও রাখে। আর সেইজন্যই তো ওরা এত বড়ো কাজে ওর মতো একজন আনকোরা ছেলেকে বেছে নিয়েছে। আফশোসে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করল ও, ইস! একবার যদি মুদ্রাটার ছবিও তুলে রাখত! ঠিক আছে, কী আর করা যাবে! আবছা যেটুকু মনে আছে, সেটাই ভরসা।

ওর চিন্তায় হঠাৎ ছেদ পড়ল। মেহতাববাগের অনেকটা অংশ এখন ইতিউতি ইচ্ছামতো বেড়ে ওঠা গাছে ঢেকে গেছে, সেই গাছের সারির ফাঁক দিয়ে কেউ এগিয়ে এসে ওকে নারীকণ্ঠে ডাকল, ‘কবীর!’

কবীর চমকে তাকাল। নারীমূর্তিটি আরও একটু এগিয়ে চাঁদের আলোয় ওর মুখোমুখি হল, অস্ফুটে বলল, ‘উজ্জয়িনী কোথায়?’

কবীর বলল, ‘ভেতরে আছে। কেন?’

নারীমূর্তি চাপাগলায় বলল, ‘ওর একটা ভিডিয়ো করতে হবে। নাগেশ সিং সম্ভবত পুলিশের সাহায্য নিচ্ছে, পুলিশের হেল্প নিলে যে ওকে জ্যান্ত পাওয়া যাবে না, সেটা কেঁদেকেটে বলাতে হবে ওকে দিয়ে। ইউটিউবে আপলোড করে দিলে নাগেশ সিং-এর হম্বিতম্বি বেরিয়ে যাবে।’

কবীর বাস্তবের মাটিতে ফিরে এল, মাথা নেড়ে বলল, ‘খবরদার না। ওসব করতে যেয়ো না। মুক্তিপণ হিসেবে কোনো টাকা নেওয়ার অর্ডার তো আমার নেই, শুধু মেয়েকে কিডন্যাপ করে নাগেশ সিংকে বিচলিত করে দিতে হবে, এমনই অর্ডার আছে। আমি নিজে থেকে ওই টাকাটা চেয়েছি। মিডিয়া ওই ভিডিয়ো নিয়ে লাফালাফি শুরু করলে টাকার কথা ফাঁস হয়ে যাবে। আর আমি কেস খেয়ে যাব।’

নারীমূর্তি বলল, ‘আচ্ছা, এরা ওই প্রফেসরকে নিয়ে কী করতে চাইছেটা কী বলো তো? মুখে তো বলছে ইতিহাসের স্বার্থে।’

কবীর পাত্তা দিল না, ‘মুখে ওরকম অনেকেই অনেক কিছু বলে। তুমিও তো ওই বুড়ো ভাব এম পি-টাকে কত প্রেমের কথা বল, সেগুলো কি তোমার মনের কথা?’

নারীমূর্তি এবার হাসল, কিছু বলল না।

‘এরা যেকোনো উপায়ে তাজমহলের ভেতরে ঢুকতে চাইছে এটুকু শুধু বুঝেছি।’ কবীর বলল, ‘আমি একটা কথাই বুঝি কস্তুরী, টাকা! আর সেইজন্যই এদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছি। বুড়ো প্রফেসর বেগ তো কিছুতেই রাজি হয়নি, ফালতু সেন্টিমেন্ট! আরে, আমি ধরো একটা বই বেচে মোটা টাকা পাচ্ছি, এখন বইটা কিনে ফেলার পর কাস্টমার সেটা পড়ল না কাগজ কেটে ঠোঙা বানাল তা নিয়ে আমি কেন মাথা ঘামাব?’

কস্তুরী হাসল, ‘বেচারা নাগেশ সিং একে তার আগ্রার সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত, তার মধ্যে তুমি আরেক বিপদের মুখে ঠেলে দিলে।’ কৃত্রিম সহানুভূতি ফুটে উঠল ওর চোখে-মুখে।

কবীর কস্তুরীর দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘ভালোয় ভালোয় পুরো ব্যাপারটা মিলে গেলে হয়!’

‘মিটবে মিটবে।’ পূর্ণিমা চাঁদের নরম আলোয় একে অপরকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কস্তুরী তার মনোলোভা হাসি হেসে ঈষৎ ঠোঁট ফোলাল, ‘তবে তুমি যে আমাকে একটুও ভালোবাসে না, তার অনেক প্রমাণ আছে।’

‘কী প্রমাণ?’ এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় কবীর খেই হারিয়ে ফেলল।

‘অনেক প্রমাণ!’ কস্তুরী রিনরিনে কণ্ঠে ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘এই কয়েক মাস ধরে আমি খালি মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছি, কেন করছি, কীসের জন্য করছি কিছুই জানি না।’ কবীরের হাত ছাড়িয়ে ও দূরে সরে যেতে উদ্যত হল, ‘তুমি আমাকে কখনো খুলে বলেছ পুরো ব্যাপারটা? খালি নাগেশ সিংকে এই বলতে হবে, এটা এই করতে হবে, ওখানে যেতে হবে, এরকম কাজের লোকের মতো ব্যবহার করো আমার সঙ্গে!’

‘কাজের লোক! তুমি যদি কাজের লোক হও, তবে আমার মনের মানুষটা কে শুনি? কার জন্য এত কিছু করছি আমি?’

নদীর তীরের জ্যোৎস্না চাঁদের আলোয় অতিসাধারণ নারীকেও অপরূপা লাগে, সেখানে কস্তুরী রীতিমতো সুন্দরী, তাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গের পরী যেন আচ্ছা আচ্ছা দুনিয়া কাঁপানো বীর সুন্দরী রমণীর সামনে ঘায়েল হয়েছেন, সেখানে কবীর তো সেদিনের ছোকরা।

কস্তুরীর গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে কবীরের চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল। ও প্রফেসর বেগের কাছে সহকারীর কাজ করছিল গত একবছর ধরে, কস্তুরীর সঙ্গে আলাপ তার ঠিক আগে আগেই। বলিউডে গিয়ে ফিলম লাইনে কিছুদিন চেষ্টাচরিত্র করার পর রণেভঙ্গ দেওয়া কস্তুরীর সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল একটা রেস্তরাঁয়, সেই থেকেই গড়ায় ঘনিষ্ঠতা।

কবীর নিজে লখনৌয়ের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। ছোটো থেকে ঘিঞ্জি গলির মধ্যে বড়ো হতে হতে একটা কথা সে সার বুঝে নিয়েছিল যে পড়াশুনো না করলে ওই নরক থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই। আর শুধু পড়াশুনোই নয়, জীবনে সফল হতে চাইলে চাই বুদ্ধি। পড়াশুনোয় মন্দ ছিল না, বিশেষ করে অঙ্কে মাথা খেলত দারুণ। গ্র্যাজুয়েট হয়েই চলে এসেছিল দিল্লিতে, এদিক সেদিক ঘুরছিল যদি কোথাও কিছু সুযোগ পাওয়া যায়। আর তখনই চোখে পড়েছিল সেই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটা, এক অধ্যাপকের ইতিহাস বিষয়ক গবেষণার জন্য অঙ্ক জানা সেক্রেটারি চাই। ডিগ্রিধারী অঙ্ক জানলে হবে না, অঙ্ককে ভালোবাসতে হবে। যোগাযোগ- ড নিজামুদ্দিন বেগ, কমলানগর, আগ্রা।

ইতিহাসের অধ্যাপক তাঁর গবেষণায় অ্যাসিস্ট করার জন্য কেন অঙ্ক জানা সেক্রেটারি চাইছেন, তখন ভেবেও কূল পায়নি ও। তবু সাতপাঁচ না ভেবে একটা আবেদনপত্র পোস্ট করে দিয়েছিল ওই ঠিকানায়। পরে অবশ্য কাজ করতে ঢুকে বুঝেছিল, প্রফেসর বেগের গবেষণায় অঙ্কের ভূমিকা কতটা বেশি। একেকটা করে শ্লোক, তার ভেতরে অদ্ভুত সমস্ত গাণিতিক তত্ত্ব।

আর কবীর যতই সেটা বুঝেছিল, ততই সন্ধান পেয়েছিল এক আশ্চর্য হাঁসের, যাকে ঠিকমতো কবোষ্ণ উষ্ণতায় রাখলে সারাজীবন কবীর সোনার ডিম পেতে থাকবে।

কস্তুরীর কথায় ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল, কস্তুরী বলছে, ‘বলবে না তো?’

মৃদু হেসে কবীর বলল, ‘প্রফেসর বেগ লিখলেন যে, পরের কিস্তিতে তিনি পেশ করতে চলেছেন অঘোঘ প্রমাণ। লিখলেন, তাজমহল বৈদিক জ্যামিতির সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ, তাজমহল নিজেই জ্যান্ত একটা উপপাদ্য, সেই উপপাদ্যের হাত ধরেই তিনি পৌঁছোবেন আটশো বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হিন্দুধর্মের উৎসের খোঁজে। তারপরেই তীব্র গণ্ডগোল শুরু হল বাড়িতে। মুসলিম একটা দলের নেতার গুন্ডারা যখনতখন হামলা করতে লাগল বাড়িতে। আমি আর প্রফেসর ছাড়া ওই বাড়িতে কেউ থাকত না। কাজকর্ম প্রায় লাটে ওঠার উপক্রম হল।’

‘তারপর?’ কস্তুরী বলল।

‘তারপর দুটো লোক একদিন দেখা করতে এল। তাদের দাবি শুনে প্রফেসর ভাগিয়ে দিলেন। সস্তা মূল্যবোধ আর কি! তারপর তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল, খবর পেয়েছিল প্রফেসর যতই রিসার্চ করুন, তাঁর অঙ্কের লোক আমিই। যে টাকাটা তারা আমায় অফার করল, তাতে পাঁচটা জেনারেশন পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেতে পারে।’

‘কী চাইল তারা টাকার বিনিময়ে?’ কস্তুরী বলল।

কবীর রহস্যময় হাসল, ‘ওই যে, জ্যান্ত অঙ্কটা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *