অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২২

২২

এয়ারপোর্টে নামার পর সিকিউরিটি চেক, বেল্ট থেকে লাগেজ নিতে নিতে প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল। নাগেশ একা ট্র্যাভেল করলে চেষ্টা করেন হ্যান্ড লাগেজেই ছোটো করে সব নিয়ে নিতে, যাতে পরে এই সময় নষ্টটুকু না হয়। কিন্তু কস্তুরী সঙ্গে রয়েছে, ওর বিশাল ট্রলির জন্য এবার অপেক্ষা করতেই হবে।

অগত্যা নাগেশ একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, একইসঙ্গে ফোন চেক করছিলেন। শেষ পাঠানো ইমেল অনুযায়ী আটটা দেশের প্রতিনিধিই এসে পড়েছেন, বাকিরাও আজকালের মধ্যেই এসে পড়বেন। দিল্লির সবচেয়ে বড়ো হোটেলে আপাতত ওঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নাগেশের মাথায় এখন অনেক দায়িত্ব। একে এই বিশ্বসম্মেলন, উজ্জয়িনীর জন্মদিন, তার ওপর তাঁর পার্টির সঙ্গে সমান্তরাল হিন্দুদলের কাজ। অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতা ভোটব্যাঙ্কের জন্য মনভোলানো যে কথাই বলে থাকুক না কেন, তিনি বরাবরই গর্বের সঙ্গে বলে থাকেন তিনি হিন্দু।

আর বলবেন নাই-বা কেন? তিনি স্বয়ং রাজা জয়সিংহের বংশধর। এই দেশটা আগে তো হিন্দুরাজাদের অধীনেই ছিল, সেই মহম্মদ ঘোরীর আক্রমণের আগে পর্যন্ত। তারপর একে একে কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, আলাউদ্দিন খলজি, ইব্রাহিম লোদি হয়ে মুঘল সম্রাটরা এসে দেশটাকে ধর্ষণ করেছে, গুঁড়িয়ে দিয়েছে অপূর্ব সব মন্দির। হিন্দুরা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে সেই সুলতান, বাদশাহদের পরামর্শদাতা, অমাত্যতে। নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে হিন্দু কন্যাকে বিয়ে দিয়েছে সুলতানের সঙ্গে, তরোয়ালের খোঁচায় পুজো ছেড়ে ধরেছে আজান।

ঠিকমতো দেখতে গেলে ভারতের নিরানব্বই শতাংশ মুসলমান আসলে রূপান্তরিত হিন্দু। কিন্তু এই কথাটা তিনি একবার প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, তারপর সে কী হাঙ্গামা, বিরোধী দল চেঁচাতে লাগল তিনি নাকি দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার মতো কথা বলেছেন।

এই হল ভারতবর্ষ!

হিন্দুরা নিজেরাই লোককে সচেতন না করলে কারা করবে? এভাবে তো গোটা ধর্মটাই একদিন লুপ্ত হয়ে যাবে!

ঠিক এইসময় ফোনটা আসতে নাগেশের চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। বাড়ির প্রধান কেয়ারটেকার দীনেশ ফোন করছিল, কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্যই হোক, বা অন্য কোনো যান্ত্রিক গোলযোগে, কিচ্ছু শোনা গেল না।

নাগেশ দু-চারবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করে বললেন, ‘দীনেশ, আমি লাগেজ নিচ্ছি, বেরিয়ে গাড়িতে উঠে ফোন করছি। অফিস থেকে গাড়ি এসে গেছে এয়ারপোর্টে, তোমায় পাঠাতে হবে না।’

দ্বিতীয় ফোনটা কেয়ারটেকার দীনেশ করল কস্তুরীকে। কস্তুরী সবেমাত্র কনভেয়ার বেল্ট থেকে ওর একটা লাগেজ পেয়েছে, আরেকটার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল, ফোনে কথাটা বলেই ও উদ্ভ্রান্তভাবে ছুটে এল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নাগেশের দিকে।

‘কী হয়েছে? পেয়েছ তোমার ট্রলি?’ নাগেশ জিজ্ঞেস করলেন।

কস্তুরী প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল, তারপর বলেই ফেলল, ‘স্যার, উজ্জয়িনীকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

.

দিল্লি পুলিশের হেডকোয়ার্টার। ইন্দ্রপ্রস্থ মার্গের বিশাল কম্পাউন্ডে নিজের সুবিশাল চেম্বারে বসে ছিলেন পুলিশ কমিশনার তাজ মহম্মদ।

গোটা দিল্লি পুলিশের সর্বেসর্বা তিনি। দিল্লি পুলিশ দিল্লি সরকারের অধীনে নয়, স্বয়ং ভারত সরকার দিল্লি পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে। আগে এটা পাঞ্জাব পুলিশের অন্তর্গত ছিল, স্বাধীনতার পরে আলাদা হয়েছে। এখন সমগ্র দিল্লি পুলিশের মধ্যে প্রায় একশো পঁচাশিটা পুলিশ স্টেশন রয়েছে, যাদের নিয়ন্ত্রণ করছে বাষট্টিটা সাবডিভিশন। সুবিশাল এই বাহিনী ছাড়াও রয়েছে পাঁচটা স্পেশাল ইউনিট, যার মধ্যে স্পেশাল সেল অন্যতম। এই স্পেশাল ইউনিটগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের পরিধি শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ নয়, দিল্লিকে কেন্দ্র করে গোটা দেশেরই অপরাধ দমনের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।

আর এই ইউনিটেরই ডেপুটি কমিশনার এখন তাজ মহম্মদের উলটোদিকে বসে আছেন, সঙ্গে রয়েছেন ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির ডিরেক্টর জেনারেলও। কোনো এক জরুরি ব্যাপারে দু-জনেই একসঙ্গে এসেছেন।

কমিশনার তাজ মহম্মদ ওঁরা কী বলেন শোনার জন্য অপেক্ষা করলেও ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলেন। কাল প্রজাতন্ত্র দিবস, এইসময় তাঁর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হিসেবে স্বরাষ্টমন্ত্রকে থাকার কথা। কাল প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা সবাই রিপাবলিক ডে-র প্যারেডে উপস্থিত থাকবেন, প্রায় ২৫টি রাজ্য এবার ট্যাবলো নিয়ে অংশগ্রহণ করবে। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, তিনি আজই সস্ত্রীক এসে পৌঁছেছেন রাজধানীতে। পুলিশের সর্বময় কর্তা হিসেবে তাজ মহম্মদের তাঁর সঙ্গেও আজ একবার দেখা করতে যাওয়া উচিত ছিল।

বেয়ারা এসে দু-গ্লাস শরবত দিয়ে গেল। উলটোদিকের দু-জন এসে নিয়মমাফিক স্যালুট ছাড়া এখনও কোনো কথা বলেননি, গ্লাসের দিকে দৃকপাতও করেননি। দু-জনেই যেন ভীষণ চিন্তিত।

তাজ মহম্মদ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে বাঁ-দিকের ফর্সা চশমাপরা ভদ্রলোক এবার কথা বলে উঠলেন, ‘স্যার, আগের মাসের মিটিং-এ আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, আমি পবন মেহরোত্রা, স্পেশাল সেলের ডেপুটি কমিশনার। আর ইনি’, ডান দিকে বসে থাকা অপেক্ষাকৃত রোগা মানুষটির দিকে নির্দেশ করলেন, ‘এন আই এ-র ডি জি মি অমূল্য ত্রিবেদী।’

তাজ মহম্মদ সাহেব সোজা হয়ে বসে এবার ভ্রূ কুঁচকোলেন, ‘মি মেহরোত্রা, আমি তো আপনাকে ভালোভাবেই চিনি, পরিচয় দেওয়ার কোনো দরকার নেই। বলুন কী হয়েছে, আগ্রা গিয়েছিলেন কেন? কিছু সিরিয়াস ব্যাপার?’

মি মেহরোত্রা একবার মি ত্রিবেদীর দিকে তাকালেন, মি ত্রিবেদী ইশারায় জানালেন মেহরোত্রাই শুরু করুন।

‘স্যার, এখনও কিছু হয়নি। কিন্তু আপনাকে প্রিভেন্টিভ মেজার নিতে অনুরোধ করছি।’

‘কী হয়েছে?’ তাজ মহম্মদ আবার জিজ্ঞেস করলেন।

মি মেহরোত্রা বললেন, ‘পরশু রাতে আমি দিল্লিতে ছিলাম, আমাদের সদর দপ্তরে একটা ফোন আসে, একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নাকি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন অর্থাৎ আগামীকাল তাজমহল উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষছে।’

‘তাজমহল উড়িয়ে দেওয়ার? হিন্দুত্ববাদী সংগঠন?’ তাজ মহম্মদ অবাক হলেন, ‘কেন?’

‘ফোনে বলা হয়েছিল, ওই সংগঠন প্রচার চালাচ্ছে তাজমহল সম্রাট শাজাহানের বানানো মুমতাজের স্মৃতিসৌধ নয়, তাজমহল আসলে প্রায় আটশো বছর আগে এক শিবমন্দির ছিল, পরে সুলতানি যুগ চালু হতে সেটাকে হিন্দু রাজারা প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। শাজাহান নাকি ওই প্রাসাদকেই জোর করে অধিগ্রহণ করে দেওয়ালে কোরানের বাণী উৎকীর্ণ করে মুমতাজের সমাধিতে পরিণত করেন।’

‘এরকম একটা লেখা কোথায় যেন রিসেন্টলি পড়েছিলাম!’ তাজ মহম্মদ মনে করতে চেষ্টা করছিলেন, ‘কোন একটা কাগজে।’

‘নিজামুদ্দিন বেগ বলে একজন ইতিহাসের প্রফেসর লিখেছিলেন এক-দেড়মাস আগে, স্যার। আশ্চর্যের কথা তিনিও একমাস ধরে নিখোঁজ।’ মি ত্রিবেদী বললেন, ‘তো, ওই ফোনেই বলা হয় যে ওই সংগঠন নাকি অনেকবার সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে তদন্ত শুরু করার জন্য, কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সে-ব্যাপারে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয়নি। তাই ওরা নিজেরাই এখন তাজমহল খুঁড়ে মাটির ভেতর লুকিয়ে রাখা সেই শিবলিঙ্গ বের করে জনসমক্ষে আনতে চায়। ওদের পাণ্ডা আগ্রা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের এক প্রাক্তন প্রফেসর, ড অঘোরেশ ভাট।’

তাজ মহম্মদ বললেন, ‘অঘোরেশ ভাট!’

‘হ্যাঁ স্যার!’ ত্রিবেদী বলে চললেন, ‘এর পেছনে বিদেশি কোনো চক্রও মদত দিচ্ছে এবং তারা প্রচুর টাকা অঘোরেশ ভাটকে পাঠিয়েছে। আমরা ফোনে পাওয়া ইনফরমেশন অনুযায়ী খোঁজ লাগাই আর দেখি যে সত্যিই সেদিন প্রায় দেড় কোটি টাকা অঘোরেশ ভাটের একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে।’

‘তারপর? ওই লোককে পাওয়া গেছে?’

‘আমাদের ফোর্স চেষ্টা করছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের আগ্রা সেকশনের অফিসার নাহুম খানকে দেওয়া হয়েছে দায়িত্ব। ঠিকানা পেয়ে গেছে, সম্ভবত আর কিছুক্ষণের মধ্যে ধরে ফেলবে।’ মেহরোত্রা ঘড়ি দেখলেন, ‘কিন্তু স্যার, যেহেতু এটা একটা সংগঠনের ব্যাপার, আর চব্বিশ ঘণ্টাও নেই ছাব্বিশ তারিখ শুরু হতে, আমার মনে হয় তাজমহলের সিকিউরিটি প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।’

‘কাল প্রজাতন্ত্র দিবস, এমনিই ওখানে সিকিউরিটি বেশি থাকবে। তবু আপনি এক কাজ করুন,’ তাজ মহম্মদ ঝুঁকে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরালেন, ‘রিজার্ভ থেকে লোক নিয়ে চলে যান, আমি জয়েন্ট কমিশনারকে বলে দিচ্ছি, পুরো তাজমহলের আশপাশ যেন কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে মুড়ে ফেলা হয়।’

মেহরোত্রা বললেন, ‘কিন্তু পরশু দিন তো আগ্রায় ওই কনফারেন্সটা আছে, পিস কাপল মিট। সাংসদ নাগেশ সিং কনভেনার, বারোটা দেশের ডিফেন্স সেক্রেটারি আসছে, কাল বিকেলে অতিথিদের নিয়ে তাজমহল পরিদর্শনের কথা আছে।’

‘ক্যানসেল করে দিন।’ তাজ মহম্মদ তর্জনী তুলে আদেশ করলেন, ‘ইমিডিয়েট বেসিসে ক্যানসেল করুন। গেস্টদের পরে তাজমহল দেখাতে নিয়ে গেলেও চলবে। আমি কথা বলছি ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গে।’

‘কিন্তু স্যার, মিটটা তো পরের দিন আগ্রার এক অডিটোরিয়ামে হবে, কিন্তু তার আগে সব দেশের অতিথিদের নিয়ে তাজমহলে কালকের ওই বন্ধুত্বপূর্ণ ভিজিটটা এই মিটের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অনেকদিন ধরে প্রোমোশনও চলছে ইভেন্টটার।’ মেহরোত্রা এবার কাতরভাবে বলে উঠলেন, ‘আর এখন বাতিল করলে সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর কথা উঠবে, আমরাও এসক্যালেশন খেতে পারি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা স্যার, কাল রাত থেকে সারা আগ্রা শহরের প্রতিটা রাস্তায়, পাঁচিলে শয়ে শয়ে পোস্টার পড়ে গেছে।’

‘পোস্টার? কীসের পোস্টার? ওই কনফারেন্সের?’ তাজ মহম্মদ হতবাক হয়ে গেলেন, ‘সরকারি একটা মিটিং-এর পাবলিক প্লেসে পোস্টার পড়বে কেন?’

‘না স্যার, ওই পোস্টার নয়।’ মেহরোত্রা পুলিশকর্তা হলেও নরম স্বভাবের মানুষ, কমিশনার সাহেবের মুহুর্মুহু প্রশ্নে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ছিলেন, এবার হাতে ধরা পাতলা কাগজের মোড়কটা খুলে সামনে ধরলেন, ‘এই দেখুন, স্যার! কোনো নাম নেই, লোগো নেই, কিচ্ছু নেই।’

২৬ জানুয়ারি সকাল বেলা সাড়ে তিনশো বছরের এক মিথ্যে সরিয়ে পবিত্র সত্য উন্মোচন করব আমরা, প্রমাণ করব তাজমহল ছিল এক শিব মন্দির ‘তেজো মহালয়’।

প্রমাণ করব মুসলিমদের মিথ্যাচারণ।

মুসলিমদের প্রতারণার মুখোশ টেনে খুলে দেব আমরা।

তৈরি থাকুন।

দুনিয়ার হিন্দু এক হও।

‘এটার মানে কী? এইরকম সাম্প্রদায়িক পোস্টারে সারা আগ্রা ছেয়ে গেছে?’ কমিশনার সাহেবের কপালে এতক্ষণে সত্যিকারের চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল।

‘হ্যাঁ, স্যার। কাদের কাজ এটা, কিছুই জানা যাচ্ছে না, কিন্তু এই নিয়ে গোটা শহরেই ইতিমধ্যে গুলতানি শুরু হয়েছে। তার মধ্যে আগ্রার প্রভাবশালী বিধায়ক মুজাফফর খান ওয়াইসির একদম কাছের বন্ধু গুল মহম্মদ খুন হয়েছে আজ ভোরে। গুল মহম্মদের নিজেরও আগ্রায় ভালো প্রভাব ছিল। মাসখানেক আগে ওই নিজামুদ্দিন বেগ নামের প্রফেসর যখন এই একই ব্যাপারে লিখেছিলেন কাগজে, প্রধানত ওই গুল মহম্মদই তার দলবল নিয়ে ভাঙচুর চালিয়েছিল।’ মি মেহরোত্রা বললেন।

‘আগ্রার মোট জনসংখ্যার বারো পার সেন্ট মতো মুসলিম হলেও তারা খুব এককাট্টা, এখনও অবধি কোনো রায়ট আগ্রায় না লাগলেও এই নিয়ে তাদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেছে, গুল মহম্মদ খুন, তারপর এই পোস্টারে হিন্দুদের শত্রু ভাবতে শুরু করেছে তারা। এখন স্যার, অঘোরেশ ভাটই যে ওই দলের পাণ্ডা তেমন তো কোনো প্রমাণ হাতে পাইনি আমরা, হাতে সময় শুধু আজ সারারাত। এর মধ্যে আমরা যদি ওই দলের আর কাউকে ধরতে না পারি, তার ওপর তাজমহল ভিজিটও ক্যানসেল করে দিই, আমরা ওদের কথায় খুব ভয় পেয়ে গেছি, সেটাই প্রমাণ হবে না কি? আবার একটা ফ্রেন্ডলি মিটিং-এ কড়া নিরাপত্তাটাও ভালো দেখাবে না বিদেশিদের কাছে।’ মি ত্রিবেদী বোঝাতে চেষ্টা করলেন।

‘হুঁ, সেটা ঠিক!’ কমিশনার সাহেব থুতনিতে হাত রেখে ভাবতে শুরু করলেন, ‘আপনি কথাটা ভুল বলেননি। আবার শুধু একটা উড়ো ফোনের ভিত্তিতে আমরা অঘোরেশ বলে লোকটাকে অ্যারেস্টও করতে পারি না, তাতে ওর দলের লোকেরাও দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি শুরু করে দিতে পারে। তার চেয়ে কাল ওই কনফারেন্সের যেমন আয়োজন চলছে চলুক, আমরা আমাদের তরফ থেকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার আয়োজন করি, কি বলেন?’

‘রিপাবলিক ডে উপলক্ষে এমনিই রিজার্ভে লোক কম থাকবে।’ মি মেহরোত্রা বললেন।

‘হোক, তবু কাল একদম জেড প্লাস ক্যাটিগোরির সিকিউরিটিতে মুড়ে দিতে হবে তাজমহল। বিকেলে ওই মিট শুরুর আগে তুলে নেওয়া হবে। যদি মাইল্ড কোনো অ্যাটাক করার চেষ্টাও হয়, সেটাও এই পোস্টারের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। আমি কোনো রিস্ক নেব না। কথা বলে নিচ্ছি এখনই। আর ওই অঘোরেশ লোকটাকে ধরে যতটা পারা যায় ইনফরমেশন কালেক্ট করুন।’ তাজ মহম্মদ ফোন করলেন, প্রায় মিনিট পাঁচেক একে ওকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ফোনটা রেখে তাকালেন, ‘এ ছাড়া আর কিছু খবর আছে?’

‘আরেকটা ব্যাপার আছে, স্যার। কলকাতা থেকে খবর এসেছে, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মহেশতলা মিউনিসিপ্যালিটির কাঁকুলি বলে একটা গ্রাম থেকে আফতাব হুসেন নামে একটা দর্জিকে কাল ধরা হয়েছে। লোকটা বাইরে কাপড় সেলাইয়ের ব্যাবসা করলেও ভেতরে ভেতরে প্যারালালি অস্ত্র পাচারের ব্যাবসা চালাত, প্রায় একশোটা পাইপগান, কুড়িটা ৯ কিলোমিটারের পিস্তল, আটটা ডাবল ব্যারেলড বন্দুক পাওয়া গেছে ওর বস্তির ঘর থেকে।’ মি ত্রিবেদী নোটবুক দেখে বলে চলছিলেন, ‘আশি রাউন্ড অ্যামিউনিশন, দশটা মোবাইল ফোন আর প্রায় চল্লিশ হাজার টাকাও ছিল তার সঙ্গে। তো, তাকে ভালোমতো জেরার পর সে বলেছে তার দুটো পার্টনার আছে, একজন ওর পাশের জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা দিয়ে বাংলাদেশে মাল সাপ্লাই করে, তার নাম মহম্মদ আসলাম। আর আরেকজনের নাম শেখ হাসান, সে মুঙ্গের থেকে মাল পাঠায়।’

‘তো?’ তাজ মহম্মদ বুঝতে পারছিলেন না অ্যাডিশনাল ডি জি সাহেব এই ছিঁচকে আর্মস সাপ্লায়ারের খবর কেন এত বিশদে তাঁকে দিচ্ছেন, এটা তো ওখানকার এস পি-ই হ্যান্ডল করতে পারেন!

‘আফতাব হুসেন বলেছে, ও পনেরো দিন আগে একুশ কোটি টাকার অর্ডার পেয়েছিল দিল্লি থেকে। ওর প্রায় পাঁচ বছরের ধান্দা এটা, অত টাকার বরাত পাওয়ার পর বাংলাদেশ আর মধ্যপ্রদেশ থেকে মাল আনিয়ে দিল্লি সাপ্লাই করেছিল।’ মি ত্রিবেদী বললেন।

‘একুশ কোটি! দিল্লি থেকে? পার্টির নাম বলেছে?’

‘প্রথমে বলছিল না। কাল রাতে থার্ড ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। তারপর বলেছে। টাকা নাকি পুরোটা ক্যাশে দিয়েছিল, এখন তার খোঁজ নিয়ে জেরা চলছে।’

‘কে পার্টি? কী নাম?’ তাজ মহম্মদ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন।

মি ত্রিবেদী এক মুহূর্ত থামলেন, তারপর বললেন, ‘ভিক্টর বিলগাইনার!’

তাজ মহম্মদের ভ্রূ দুটো অনেকখানি ওপরে উঠে আবার নেমে এল, কিন্তু চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে রইল, ‘মানে? কোন বিলগাইনার?’

মি ত্রিবেদী কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘আপনি যার কথা ভাবছেন আমরাও তার কথাই ভাবছি। মুম্বাই অ্যাটাকের সময়ে শেষ ওকে দেখা গিয়েছিল মার্কেটে।’

‘কিন্তু বিলগাইনার বেঁচে আছে নাকি?’ তাজ মহম্মদ উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লেন।

‘জানি না স্যার, হয়তো বড়ো কোনো অ্যাটাকের সম্ভাবনা রয়েছে শিগগিরি। সেজন্যই আমি দেরি না করে আপনার কাছে এসেছি। আপনার ফোর্সের সাহায্য চাই আমার।’

ঠিক এই মুহূর্তে মি মেহরোত্রার কাছে একটা ফোন এল, কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ‘স্যার, আরেকটা খবর আছে।’

‘আবার কী?’ কমিশনার সাহেবকে স্পষ্টতই দিশেহারা দেখাচ্ছিল।

‘স্যার, রুলিং পার্টির সাংসদ বিজনেস টাইকুন নাগেশ সিং, ওই যিনি পিস কাপল মিটটা অর্গানাইজ করছেন, ওঁর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

তাজ মহম্মদ এবার সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেলেন, একসঙ্গে এতগুলো বিপদে কী করবেন বুঝতে না পেরে জোরে জোরে সামনের বেলটা বাজিয়ে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *