অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৪

২৪

প্রিয়ম আর পূরবী দু-জনেই উদবিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছিলেন। এখন রাত প্রায় ন-টা। ঘণ্টাখানেক আগে আর থাকতে না পেরে পূরবী ফোন করেছিলেন রুদ্রকে, যদিও বলেননি যে প্রিয়ম এসেছে। রুদ্র ফোনে জানিয়েছিল জরুরি একটা কাজে ও আর বাবা আটকে গেছে, ফিরতে একটু রাত হবে।

প্রিয়মের উচ্ছ্বাস অনেকক্ষণ হল উবে গেছে, ও এখন ফ্রেশ হয়ে বসে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না।

রাগও উঠছে রুদ্রর ওপর, চিন্তাও হচ্ছে।

রতন কাজ শেষে চলে গেছে, পূরবী রান্নাবান্না সেরে কিছুক্ষণ প্রিয়মের সঙ্গে বসে গল্প করলেন, তারপর টিভি চালিয়ে বসলেন। সিরিয়াল তাঁর চিরকালের অসহ্য, এমনিতে দেখার সময়ও পান না, ইচ্ছেও হয় না, একটা পুরোনো সিনেমা দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর দুম করে রিমোটটা অফ করে দিয়ে বললেন, ‘রুদ্রর কথা তো ছেড়েই দাও, তোমার বাবার আক্কেলটা কী বলো তো? সেই কখন বেরিয়েছে, ফেরার আর নাম নেই! আজ নতুন একটা শহরে এসেই কী এত কাজ রে বাবা!’

প্রিয়ম বই ছেড়ে উঠে মাঝে মাঝেই ব্যালকনিতে যাচ্ছিল, কোনো গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে কি গলির মুখে? ও লক্ষ করল এই কমপ্লেক্সটার এই একটা মুশকিল, ব্যালকনি থেকে খুব একটা ভালো দেখা যায় না, সামনে বাচ্চাদের খেলার পার্ক থাকায়। ও মনে মনে ঠিক করল, ওরা দু-জনেই যখন আবার কলকাতায় ফিরে যাবে, আর ফ্ল্যাট নয়, একটা বড়ো খোলামেলা বাড়ি তৈরি করবে, সেই বাড়ির সামনে পেছনে থাকবে অনেকটা করে বাগান, তাতে বড়ো বড়ো গাছ।

প্রিয়মের স্বপ্ন বোনা শেষ হল না, বাইরে কলিং বেল বাজল। দু-বার পর পর, তারপর একটু থেমে আরও একবার।

দরজা খুললেন পূরবী। প্রিয়মের শেখানো মতো স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘এত দেরি হল কেন? কী হয়েছে?’ তারপর অঘোরেশের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন। ‘এ কী! ইনি!’

রুদ্রর বুকের ভেতরটা যেন এক লহমায় পাঁচগুণ বেগে ওঠানামা করছিল। একদিকে সুরঞ্জন অঘোরেশকে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, যেকোনো মুহূর্তে নাহুম খান এসে পড়বেন। আর অন্যদিকে আনন্দে ওর মনটা একাকার হয়ে যাচ্ছে।

সত্যিই, প্রিয়ম আজও নিজের রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখল। আজ পর্যন্ত রুদ্রকে ও কখনো সারপ্রাইজ দিতে পারেনি, এত বিপদের মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল রুদ্রর। কাল থেকে এরকম ফোন বন্ধ না রেখে এর চেয়ে যদি রুদ্রর সঙ্গে ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলত, তাহলে রুদ্রর কোনো সন্দেহই হত না, ইমেলও চেক করতে যেত না।

বুদ্ধুরাম আর কাকে বলে! বেচারা সেই কোথা থেকে আসছে রুদ্রকে সারপ্রাইজ দেবে বলে, আর রুদ্র আগেই জেনে গেল। এখন নির্ঘাত ভেতরের ঘরে লুকিয়ে আছে।

ওর ইচ্ছে হল উল্কার চেয়েও বেশি গতিতে উড়তে উড়তে গিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রিয়মকে। কতদিন পরে ও ওর প্রিয়মকে দেখবে। যতই ভিডিয়ো চ্যাটে দেখুক, তাতে কি আর নিশ্বাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, না ভালোবাসার অনুভূতি ভালোভাবে পাওয়া যায়!

ও প্রাণপণে নিজেকে সম্বরণ করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘বাবা, তোমায় সব বলছে মা। আগে ওঁকে সোফায় বসাও, বসিয়ে জল দাও!’

পূরবীর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল প্রচণ্ড অপ্রসন্ন হয়েছেন। রাগত চোখে একবার নিজের স্বামীর দিকে তাকালেন, তারপর রুদ্রকে বললেন, ‘তুই হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যা একবার।’

অঘোরেশ ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়।

রুদ্র বাথরুমে গিয়ে প্রায় আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে ফ্রেশ হয়ে বেরোল, বেরিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে একটা পেপারব্যাক খুলে শুয়ে পড়ল। নাহুম খান যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবেন, তখন রোমান্সের দফারফা হয়ে যাবে।

বেচারা এতদূর থেকে বউকে সারপ্রাইজ দিতে এল, এইটুকু ভালোলাগা প্রিয়ম ডিজার্ভ করে। যতই রুদ্র ধরে ফেলুক, চেষ্টা তো করেছে!

প্রথম কিছুক্ষণ মনে হল, ওর বুকের ভেতরের শব্দটা এতটাই জোরে হচ্ছে যে, বাইরের ঘর থেকেই বুঝি শোনা যাবে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় যেন মনে হচ্ছে ওর দারুণ জ্বর এসে গেছে।

ঠিক সাড়ে সাতচল্লিশ সেকেন্ডের মাথায় পেছন থেকে চোখটা কেউ চেপে ধরল। ভাষা বুঝতে কখনো অসুবিধা হয় না। রুদ্রর চোখের ওপর প্রিয়মের হাতের সেই স্পর্শ যেন সেটাই মনে করাল ওকে। আর সেই ভাষা জেনেও না জানার অভিনয় করাটা যে কী কঠিন!

প্রিয়ম কি মনে করে এত দূরে রয়েছে বলে ওর স্পর্শও রুদ্র ভুলে যাবে?

রুদ্র যে নরম্যালি অভিনয় করবে, ‘এ আবার কী, মা! ছাড়ো!’ সেটাও যেন গলা দিয়ে বেরোচ্ছে না, শুধু প্রিয়ম শব্দটাই নাছোড়বান্দা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে।

অনেক কষ্টে অস্ফুটে ও শুধু দুর্বলভাবে বলতে পারল, ‘কে… মা?’

প্রিয়ম হাতটা সরিয়ে বাঁ-পাশ থেকে ঝুঁকে এল ওর দিকে।

অদ্ভুতভাবে রুদ্র অনুভব করল ওর অভিনয় করার কোনো দরকারই পড়ছে না, বিস্ময় ঠিকরে পড়ল ওর চোখ-মুখ থেকে সহজাতভাবে, চোখ দুটো অজান্তেই বড়ো বড়ো হয়ে গেল, ‘প্রিয়ম!’

প্রিয়ম ওকে জড়িয়ে ধরল, ‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো! আর তুমি বল আমি সারপ্রাইজ দিতে জানি না।’

আনন্দে রুদ্রর চোখে জল চলে এসেছিল। ও কিছু বলতে পারল না, শুধু জড়িয়ে ধরল প্রিয়মকে। এই আশ্রয়টা ওর নিজের জন্য বড্ড দরকার এখন!

প্রিয়ম বলল, ‘কত কাণ্ড করে এতদূর থেকে এলাম বউকে সারপ্রাইজ দেব বলে, এদিকে এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে বসে আছি এতক্ষণ ধরে।’ রুদ্রর মুখটা তুলে ও কাছে আনল, ‘কী হয়েছে বলো তো? আমি তো তখন থেকে এই ঘরেই লুকিয়ে বসে আছি, বাইরে কে এসেছে?’

রুদ্র যে কথাটা সকাল থেকে বাবা মা-কে বলবে বলবে করেও বলতে পারছিল না, সেটা এবার বলে ফেলল, ‘প্রিয়ম! তুমি এসেছ কী ভালো যে হয়েছে!’ এতক্ষণের দুশ্চিন্তাটা জলের ফোঁটা হয়ে গড়িয়ে পড়ল এবার ওর চোখ দিয়ে।

‘কী হয়েছে?’ প্রিয়ম অবাক হয়ে গেল।

রুদ্র ঝড়ের গতিতে কাল থেকে ঘটে চলা সব ঘটনা বলে যেতে লাগল, ওর সাপপেনশন, আগ্রা শহরে ছেয়ে যাওয়া পোস্টার, কীভাবে বাবা আর ও জড়িয়ে পড়ল এর মধ্যে, অঘোরেশ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগি, কিন্তু একইসঙ্গে এত কিছু তথ্য গবেষণা করে বের করেছেন, সব একটানা বলে থামল। মুখে একরাশ দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করছে ওর, ‘ইনস্পেকটর নাহুম খান এখুনি আসছেন। অঘোরেশজিকে বাড়ি নিয়ে এসে আমি কি কিছু ভুল করলাম প্রিয়ম?’

.

নাগেশ সিং বাড়ি ঢুকে কোনোদিকে তাকাননি, উদ্ভ্রান্তের মতো ফোন করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। পাশে বাড়ির কেয়ারটেকার, ম্যানেজার, কয়েকজন ড্রাইভার সব একে একে দাঁড়িয়ে।

স্ত্রী সুজাতা বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছেন একটু দূরের সোফায়, মুখ চোখ ফোলা ফোলা, চুল অবিন্যস্ত।

প্রকাণ্ড বসার ঘরটায় একটা থমথমে পরিবেশ।

শেষ ফোনটা রেখে নাগেশ গর্জে উঠলেন, ‘দীনেশ, কে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল ওকে?’

একটু দূরেই কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা উর্দি পরা অল্পবয়সি ড্রাইভারটা এগিয়ে এল এদিকে। তার মুখ-চোখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে।

ম্যানেজার দীনেশ ওর দিকে ইশারা করে বললেন, ‘স্যার, রমেশ নিয়ে গিয়েছিল।’

নাগেশ কড়া চোখে রমেশের দিকে তাকালেন, ‘পুরো ঘটনাটা ডিটেইলে বলো। একটা কিছু বাদ দিলে শুধু তোমাকে নয়, তোমার সারা ফ্যামিলিকে হাজতে পুরে রাখব সারাটা জীবন!’

‘স্যার!’ রমেশ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আজ সকালে আমার ডিউটি ছিল। আমিই দীনেশজির সঙ্গে গিয়ে উজ্জয়িনী মেমসাবকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসি। বাড়ি আসার পরে দীনেশজি বেরিয়ে যান অফিসে। আমি গাড়ি মুছছিলাম, আধ ঘণ্টা পরেই হঠাৎ মেমসাব এসে বললেন তিনি সিনেমা দেখতে যাবেন।’

‘তুই জানিস না যে মেমসাবকে একা কোথাও ছাড়া হয় না?’ দীনেশ ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন।

রমেশ অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে ফেলল, ‘আমি বলেছিলাম মেমসাবকে। কিন্তু উনি বললেন যে ওই সিনেমাটা ওঁকে দেখতেই হবে। আমি তাই আর কিছু বলতে পারিনি সাব!’ সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডামজিও সেই সময় বাড়িতে ছিলেন না, তাই আমি কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি।’

‘তারপর?’ নাগেশ তীক্ষ্নস্বরে প্রশ্ন করলেন।

‘তারপর উনি যেতে যেতে কারুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন।’

‘কী কথা বলছিল?’

‘আজ্ঞে সাব, ইংরেজিতে বলছিলেন তো, আমি অতটা বুঝতে পারিনি।’ রমেশ আবার মাথা নীচু করল।

‘ননসেন্স! তারপর কী হল?’ নাগেশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন ক্রমশ।

‘তারপর শপিং মলের সামনে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে আমি বললাম যে কী সিনেমা দেখবেন বলুন, আমি টিকিট কেটে আনছি। কিন্তু উনি বললেন যে প্রথমে কিছুক্ষণ শপিং করবেন, তারপর সিনেমা দেখবেন, টিকিট নিজেই তখন কেটে নেবেন। আমি যেন চার পাঁচ ঘণ্টা কোথাও ঘুরে আসি।’ রমেশ গড়গড় করে বলে যেতে লাগল, ‘তবু আমি কোথাও যাইনি সাব, ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর পাঁচ ঘণ্টা হয়ে যেতে দীনেশ স্যারকে ফোন করি।’

‘ক-টা বাজে তখন?’ নাগেশ বললেন।

এবার দীনেশ উত্তর দিলেন, ‘রমেশ আমাকে ফোন করে ঠিক বিকেল চারটের সময়। আমি সবে লোক পাঠাচ্ছি, তার পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফোনটা আসে, স্যার।’

‘তোমার মোবাইলে এসেছিল?’ নাগেশ জিজ্ঞেস করলেন।

এবার দূরে বসে থাকা সুজাতা মুখ খুললেন, ‘না। বাড়ির টেলিফোনে। আমি ধরেছিলাম।’

নাগেশ উদগ্রীব হয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এই সময় অতিকায় লিভিং রুমে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন দিল্লি পুলিশের অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না। আমরা শপিং মলটার সিসিটিভি ফুটেজ ট্র্যাক করছি।’

নাগেশ উত্তর না দিয়ে ড্রাইভার রমেশের দিকে তাকালেন, ‘সত্যি কথা বলো, তুমি কি পাঁচ ঘণ্টা ধরে মলের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলে?’ গর্জে উঠলেন তারপরে, ‘জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব একটাও মিথ্যা কথা বললে!’

‘স্যার, আমি পার্কিং লটে গাড়িটা রেখেছিলাম, তারপর মলের সামনে এসে বেঞ্চে বসে মোবাইলে গেম খেলছিলাম, মা কি কসম!’ রমেশ বলল, ‘একবার শুধু পাশের চায়ের দোকানে চা খেকে গিয়েছিলাম, ওই সময়েও মেমসাব বেরোলে আমার ঠিক চোখে পড়ত।’

নাগেশ কটমট করে রমেশের দিকে তাকালেন, তারপর বশিষ্ঠকে বললেন, ‘ওই মলটার তিনটে এগজিট গেট আছে, এই উজবুক ড্রাইভারটা সেটা জানে না, আপনি সবক-টা এগজিটের সিসিটিভি চেক করতে বলুন।’

‘ইয়েস, স্যার!’ বশিষ্ঠ মাথা নাড়লেন, তারপর সুজাতার দিকে তাকালেন, ‘ম্যাডাম, আরেকবার যদি প্লিজ বলেন কী হয়েছে, তাহলে আমাদের তদন্তে খুব সুবিধা হয়।’

সুজাতার চোখ মুহূর্তে জলে ভরে এল, তবু তিনি প্রাণপণে শক্ত থাকার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘ও যখন বেরিয়েছে আমি তখন ছিলাম না। ও এখানকার একটা লোকাল বেকারির কেক খুব ভালোবাসে, আমি তাই নিজেই পছন্দ করে কিনতে গিয়েছিলাম। ফেরার পরে গীতা, আমাদের একজন কাজের মেয়ে, বলল, উজ্জয়িনী এসেই জামা পালটে বেরিয়ে গেছে, আমি ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম ওর ট্রলিটা খোলা, সেটা বেশ খালি, ছড়ানো-ছেটানো রয়েছে। আমি ওকে ফোন করলাম, কিন্তু পেলাম না। তার কিছুক্ষণ পরেই ফোনটা এল।’ সুজাতা এক মুহূর্ত দম নিলেন, ‘বলল, মেয়েকে যদি জ্যান্ত ফেরত পেতে চান, তাহলে পঞ্চাশ লাখ টাকা লাগবে। কাল ঠিক সকাল ন-টায় রিজেন্ট সিনেমা হলের সামনে পাঁচশো টাকার নোটে পুরো টাকাটা নিয়ে চলে আসবেন। আপনি একটা আসবেন। টাকা হ্যান্ডওভার হয়ে যাওয়ার পর আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবেন, তারপর ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্ট চলে যাবেন। পরের দিন সকালে মেয়েকে বাড়িতে পেয়ে যাবেন। অন্য কোনো লোককে বা পুলিশকে যদি দূরে কোথাও ফিট করে রাখেন, মেয়ের লাশ পাওয়ার জন্য রেডি থাকবেন।’ শেষ বাক্যটা বলতে বলতে সুজাতা কেঁদে ফেললেন।

‘রিজেন্ট সিনেমা হল!’ নাগেশ ভ্রূ কুঁচকে ইনস্পেকটর বশিষ্ঠর দিকে তাকালেন। দিল্লিতে কয়েকশো সিনেমা হল আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই এখন মাল্টিপ্লেক্সের দৌরাত্ম্যে বন্ধ। তবু তিনি এখানেই মানুষ, এই নামে কোনো সিনেমা হল আছে কি না খেয়াল করতে পারলেন না, ‘সেটা কোথায়?’

‘গুরগাঁওয়ের দিকে।’ বশিষ্ঠ বললেন।

‘গুরগাঁও!’ নাগেশ চমকে উঠলেন, ‘তার মানে উজ্জয়িনীকে ওখানে নিয়ে চলে গেছে?’

‘সেটা নাও হতে পারে।’ মনোজ বশিষ্ঠ মাথা নাড়লেন, ‘হয়তো আপনার মেয়ে এখানেই কোথাও আছে, কিন্তু র‍্যানসম কালেক্ট করাটা এখানে ঝুঁকির হয়ে যাবে বলে গুরগাঁও থেকে নিচ্ছে। কাল ছাব্বিশে জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের জন্য গোটা দিল্লি শহরেই টাইট সিকিউরিটি রয়েছে, গুরগাঁওয়ের দিকটা একটু হলেও কম। তার ওপর’, ইনস্পেকটর হাত নাড়লেন, ‘আপনাদের সাতাশ তারিখের সম্মেলনটার জন্য হেভিওয়েট সব গেস্টরা রয়েছেন শহরে। সেইজন্যই পুলিশি কড়াকড়ি রয়েছে। তাই মনে হয় দিল্লিতে টাকা আদায়ের ঝুঁকিটা নেয়নি।’

‘হুঁ! এমনই কড়াকড়ি, ভর দুপুর বেলা একটা জলজ্যান্ত মেয়ে রাস্তা থেকে উবে গেল! এই তো আপনাদের ডিপার্টমেন্টের কাজের নমুনা!’ নাগেশ গজগজ করছিলেন।

মনোজ বশিষ্ঠ কথাটা বিনাবাক্যব্যয়ে হজম করলেন। যদিও তিনি এখন এন আই এ-র হয়ে কাজ করছেন, তবু নাগেশ সিং এখন দিল্লি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ওই আগ্রার সম্মেলনের জন্য আরও বেশি করে আলোচনায় আছেন ক-দিন। সেই কারণেই ওর মেয়ের এই ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করার জন্য কমিশনার তাজ মহম্মদ স্যার বিশেষ অনুরোধ করেছেন মনোজকে।

কিন্তু এই সাংসদ কি তাঁকে একটা সাধারণ পুলিশ ভেবেছেন? মনোজ মনে মনে রুষ্ট হলেও মুখে বললেন, ‘স্যার, কিছু যদি না মনে করেন, একটা কথা বলি। আপনি আসার আগেই আমি আপনার ওই ড্রাইভারের জবানবন্দি নিয়ে গেছি। ওর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে যে-ই আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে থাকুক, তাকে আপনার মেয়ে চেনেন।’

‘ইমপসিবল!’ নাগেশ বিরক্তিতে নরম সোফার গদিতে ঘুসি মারলেন, ‘উজ্জয়িনী এখানে কাউকেই তেমন চেনে না, বাড়ি থেকে ওকে কখনো একলা বেরোতে দেওয়া হত না, দিল্লিতে ওর কোনো বন্ধু নেই।’

‘আপনার পরিচিতও তো কেউ হতে পারে। বাবার বন্ধুস্থানীয়, উজ্জয়িনী সেই বিশ্বাসে চলে যেতে পারে।’ মনোজ বোঝাতে চেষ্টা করলেন, ‘নব্বই শতাংশ কিডন্যাপিং-এ পরিচিত লোক ইনভলভড থাকে। কারণ শপিং মলের যে এগজিট দিয়েই বেরোক, জায়গাগুলো মোটামুটি জনবহুল, জোর করে কিডন্যাপ করতে গেলে ধস্তাধস্তি হবে, কারুর-না-কারুর চোখে পড়বেই। আমরা শপিং মলের কর্মী থেকে শুরু করে বাইরে সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এমন কিছু কেউ দেখেনি। আর তা ছাড়া…।’ মনোজ আবার কিন্তু কিন্তু করলেন, ‘আপনার মেয়ে যে সময় সিনেমা দেখবে বলে ঢুকেছে ভেতরে, ওই সময়ে কোনো মুভিও চলছিল না। তাই হতে পারে ও কারুর সঙ্গে দেখা করতেই গিয়েছিল, না হলে বাড়ি আসার সঙ্গেসঙ্গেই তাড়াহুড়ো করে বেরোবে কেন? ম্যাডাম তো বলছেন যে ও ড্রেস বদলে ট্রলি থেকে কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়েছে।’

নাগেশ আর কিচ্ছু বলতে পারলেন না। নিজের মেয়ে হলেও আজ অবধি উজ্জয়িনীকে বাবা হয়ে বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। এখানে ও কাকেই-বা চেনে যে এভাবে দৌড়োবে? একেই ছোটো থেকে অন্তর্মুখী, ওর মনের মধ্যে কী চলছে বোঝা অসম্ভব, তার ওপর এত বড়ো বিপর্যয়!

মনোজ বশিষ্ঠ আরও বললেন, ‘উজ্জয়িনীর ফোনও সুইচড অফ, শেষ লোকেশন দেখাচ্ছে ফরিদাবাদের কাছাকাছি বল্লভগড়ে।’

নাগেশ আর ভাবতে পারলেন না, ধরা গলায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে আই জি সাহেব আর স্পেশাল সেলের কমিশনারের কথা হয়েছে মি বশিষ্ঠ! আপনি প্লিজ যে করে হোক আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনুন। এমনিতেই ও আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা…।’ স্থান কাল পাত্র ভুলে পার্লামেন্টের দুঁদে সাংসদ আর্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘আমি টাকার জোগাড় করছি। কালই চলে যাব টাকা নিয়ে।’

সুজাতা বহুদিন পর এবার স্বামীর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকালেন, ‘না। আমাকে যেতে বলেছে। তাই আমিই যাব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *