৩৮
প্রজাতন্ত্র দিবসের সন্ধ্যাবেলা ওরা সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহে আগ্রা পুলিশের হেডকোয়ার্টারে একদম খাস কমিশনারের চেম্বারে বসে ছিল। রুদ্র, প্রিয়ম, সুরঞ্জন, ইনস্পেকটর নাহুম খান, প্রফেসর বেগ, নাগেশ সিং, তাঁর স্ত্রী সুজাতা সিং, সবাই রয়েছেন। ড ব্রিজেশ মাথুরও আসছেন একটু পরেই।
এখানে শুধু নেই অঘোরেশ, ওঁকে পুলিশের তরফে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা হওয়াটা সত্যিই প্রয়োজন। তাঁকে বার বার বোঝানো হচ্ছে তাঁর স্ত্রী বহুদিন আগেই মারা গেছেন। তবু জীবনের এই একটামাত্র অন্ধকার অধ্যায় তাঁকে মাঝেমধ্যেই টেনে নিয়ে যায় হ্যালুসিনেশনে, সেখান থেকে তাঁকে এবার বেরোতেই হবে।
নাগেশ সিং-এর দিল্লির বাড়ি থেকে সেই আসল মুদ্রাটা উদ্ধার করা হয়েছে, দিল্লি শহরের বাইরের দিকে অবস্থিত সন্তান দলের অফিসও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়েছে সেখান থেকে। ওই দলের কয়েকজন কর্মীকে ইতিমধ্যেই সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগে আর গুল মহম্মদকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কবীর যে চক্রের সাহায্যে পুরোনো পুথির কপি জোগাড় করত, তার একটা বড়োসড়ো দালাল চক্র ধরা পড়েছে লখনৌতে। ওয়াসিম কীভাবে বিদেশি অ্যান্টিক টিমের সঙ্গে এই চক্রের কনট্যাক্ট করিয়েছিল, ধরা পড়ে দলের পাণ্ডা জেরায় সব জানিয়েছে।
সকালে গিয়েই সন্ধের মধ্যে দিল্লি থেকে আবার ফেরত এসেছে এন আই এ-র জুনিয়র ইনভেস্টিগেশন অফিসার ভগতবীর সিং। দিল্লি থেকে এসে পৌঁছেছেন পুলিশ কমিশনার তাজ মহম্মদও।
নিয়ে আসা হয়েছে উজ্জয়িনীকেও। নাগেশ সিং-এর একমাত্র বিস্ময় প্রতিভাসম্পন্ন অষ্টাদশী কন্যা। তারুণ্যে সদ্য পা দিলেও সে যেন এখনও কিশোরী, বাবার সঙ্গে জড়সড় হয়ে বসে বাবার হাত চেপে ধরে রয়েছে।
কয়েক ঘণ্টা আগে সেই তিনশোবার দেখা স্বপ্নটা প্রথমবারের জন্য সত্যি হয়ে এসেছিল ওর জীবনে। বাঁশের দরমর সেই ঘরের পেছনেই বয়ে চলছিল যমুনা নদী। হিংস্রোন্মাদ কবীর, কস্তুরী বা ওদের কোনো লোক কিছু খেয়াল করার আগেই রাতের অন্ধকারে যখন আগুপিছু না ভেবে নিজেকে সেই স্বপ্নের মতো ফেলে দিয়েছিল যমুনা নদীতে, তখনও কোথায় কীভাবে যাবে কিচ্ছু ভাবেনি ও, পাগলের মতো শুধু সাঁতার কেটে গিয়েছে ক্লান্ত দেহে। হাত পা বার বার বিদ্রোহ করতে চেয়েছে, ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়া টেনে ধরতে চেয়েছে ওর রাশ, কেড়ে নিতে চেয়েছে ওর জীবনীশক্তি।
তবু ও থামেনি। জীবনের প্রথম প্রেমের প্রতারণাই যেন ওকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। বহুবার দেখা সেই স্বপ্নের মতোই যেন পেছন থেকে শুনতে পেয়েছে কিছু নরপশুর খেপা চিৎকার। তারপর কখন যে ডাঙায় গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে ও নিজেই জানেনা।
আজ এই ঠান্ডা ঘরে বসে উজ্জয়িনী ভাবছিল, গতজন্মের সেই হতভাগ্য মেয়েটার সঙ্গে এই জন্মে ওর কত মিল!
শুধু পার্থক্য একটাই, শত চেষ্টাতেও সেদিন সে বাঁচেনি, আর উজ্জয়িনী জিতে ফিরে এসেছে জীবনের মূল স্রোতে।
ও নিজের মনেই একটা ঝাঁকুনি দিল মাথায়। না! ও আর কোনোদিনও ওই স্বপ্নটা দেখবে না, ওর কাছে যে ওর বাবা মা দু-জনেই আছে এখন, ভয় কীসের?
দু-পাশে দুটো বটগাছের মতো বসে থাকা বাবা মা-কে দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল উজ্জয়িনী।
নাগেশ সিং মেয়ের পাশেই অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে আছেন মাথা নীচু করে। একটু বাদেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানি, অবৈধভাবে অস্ত্রসংগ্রহ, মানুষ খুনে মদতের মতো ভারী ভারী সব অপরাধ তাঁর মাথায়। কিন্তু তবু তাঁর যেন একটুও ভয় নেই। স্থিতধী ঋষির মতো ঋজুভাবে বসে আছেন তিনি।
একটু আগে বিশ্ব শান্তিসম্মেলনের সমস্ত অতিথি তাজমহল ঘুরে এসেছেন। বিশেষ কারণে শুধু তাঁদের যাওয়াটা দুপুর একটা থেকে পিছিয়ে বিকেল চারটে করা হয়েছিল। তার মধ্যেই বম্ব ডিফিউজাল স্কোয়াডের অফিসাররা সবকটা বম্ব ডিফিউজ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে বের করা হয়েছিল কবীরের মৃতদেহও। কবীর কোনো সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে অ্যান্টিক পাচার করত এদেশে, তাই নিয়ে এখন এন আই এ-র অফিসাররা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
ডি জি সাহেব মি অমূল্য ত্রিবেদী হাসিমুখে রুদ্রর দিকে তাকালেন, ‘আজ আপনিই বলুন। আপনিই তো আসল কাণ্ডারি, আপনার মুখ থেকেই সবাই শুনতে চায়।’
রুদ্র মৃদুস্বরে প্রতিবাদ করল, ‘না না, আমি কী করলাম! আসল কাজ তো করেছেন ইনস্পেকটর নাহুম খান, ভগতবীর সিং এঁরাই। আমি তো শুধু ছেঁড়া সুতোগুলোকে জোড়া লাগিয়েছি, তাও সকলের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হত না।’
অদূরে বসে থাকা প্রফেসর বেগ যেন ঈষৎ কেঁপে উঠলেন।
রুদ্র হাসল, ‘কবীর খানের আড়ালে যারা রয়েছে তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। প্রফেসর বেগ যতই বলুন যে প্রমাণ লোপাটের জন্য, আমার মন বলছিল, শুধু শিবমন্দির আছে কি নেই, সেই প্রমাণ লোপাটের জন্য ওরা এত কাণ্ড করবে না। নিশ্চয়ই ওদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আজ সকালে কথায় কথায় ভগতবীর সিং যখন আমাকে বললেন যে দিনকয়েক আগেই প্রচুর টাকার বেআইনি আর্মস সাপ্লাই হয়েছে দিল্লিতে, তখনও কিছু মনে হয়নি। তারপর যখন নাগেশ সিং-এর বিশ্বসম্মেলনের উদ্দেশ্যটা চিন্তা করলাম, তখন মনে হল, আরে! এই সম্মেলন হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কাদের হবে? যারা বেআইনিভাবে কোটি কোটি ডলারের আর্মস যুদ্ধে কিংবা দেশের ভেতরের গণ্ডগোলে সাপ্লাই করে। এই ছয় জোড়া দেশের দু-দিকেই এরা ক্রমাগত অস্ত্র সাপ্লাই করে যায়, আর দু-তরফকেই সর্বস্বান্ত করে এরা ফায়দা লোটে। কাজেই এই চুক্তির ফলে সবচেয়ে বেশি লস হবে তাদের।’
‘ঠিক।’ মি অমূল্য ত্রিবেদী মাথা নাড়লেন, ‘ভিক্টর বিলগাইনার। নব্বইয়ের দশকের পৃথিবীকাঁপানো আর্মস ডিলার। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জঙ্গিদের আর্মস সাপ্লাই করে রাতারাতি বিলিওনেয়ার হয়ে গিয়েছে। দুনিয়া জানত দু-হাজার পনেরো সালের একটা প্লেন ক্র্যাশে সে মারা গিয়েছিল। কিন্তু আসলে তা নয়, সারা পৃথিবীর ছোটোবড়ো আর্মস ডিলারদের একত্রিত করে গোপনে একটা অ্যাসোসিয়েশন খুলে ফেলেছিল বিলগাইনার। নিজে হয়েছিল তার দণ্ডমুণ্ড প্রেসিডেন্ট।’ মি ত্রিবেদী থামলেন।
‘কোথায় সেই অফিস?’ সুরঞ্জন বললেন।
মি ত্রিবেদী বললেন, ‘আমরা ইন্টারপোলে খবর নিয়েছি, ইটালির একটা দ্বীপে ওদের অ্যাসোসিয়েশনের অফিস, সেখান থেকে ও চালনা করে গোটা পৃথিবীতে চলা অস্ত্রর কালোবাজারকে। বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে কেনাবেচা চলে, যাতে সহজে কোথাও ট্র্যাক না করা যায়। ভারতে ওর এজেন্ট ছিল দিল্লির ওয়াসিম, এ ছাড়া টার্কির একটা লোক, তার নাম আল হাকিম। ওয়াসিম দিল্লিতে নিজের দল চালাত, তাদের দিয়েই খুচরো কাজগুলো করাত। কবীর খানকে ওই সুড়ঙ্গে মেরে এসেছিল ওয়াসিমই। ওকে চালনা করত আল হাকিম। দুবাইকে বেস করে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক এমনকী দূরের ইজরায়েল প্যালেস্টাইন অবধি ছিল ওর হাত। দু-জনকেই আমাদের এন আই এ-র সিনিয়র অফিসার মনোজ বশিষ্ঠ আজ ধরেছেন। বিলগাইনারের হদিশ এবার ইন্টারপোল করবে। আমরা সব বিশদে জানিয়েছি।’
ভগতবীর সিং বলল, ‘আজ সকালে দিল্লির রেডলাইট এরিয়া থেকে মুঙ্গেরের একটা ডিলারও ধরা পড়েছে, অঘোরেশ ভাটের বাড়িতে ওয়াসিমের অর্ডার পেয়ে ওই মুন্না শেখের লোকই আর্মস ফেলে এসেছিল। পুরো গ্যাংটাকে ধরা হয়েছে। কলকাতা, আসাম, ঝাড়খণ্ডেও কানেকশন রয়েছে ওদের। এটা এন আই এ-র একটা বড়ো সাফল্য।’ ও হাসিমুখে রুদ্রকে বলল, ‘এইজন্যও আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
প্রিয়মের খটকা এখনও যাচ্ছিল না, ‘কিন্তু পুরো ব্যাপারটার পেছনে যদি বিশ্ব সম্মেলনের ওই লোকগুলোকে মারাই উদ্দেশ্য হবে তাহলে তো অন্য কোথাও মারতে পারত, এত ঝামেলার কী ছিল?’
‘তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না।’ রুদ্র বলল, ‘ভগতবীর সিং-এর আনা ভিক্টর বিলগাইনার সম্পর্কে পুরো এনকোয়ারি ফাইলটা পড়ে দ্যাখো। টার্কি পুলিশের যে ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, তাদের হেড অফিস আংকারা থেকে প্রতি মাসে একটা করে বুলেটিন বেরোয়, ফাইলে দ্যাখো, ওই বুলেটিনে আর্টিকলটা রয়েছে। ভিক্টর বিলগাইনার যে বেঁচে আছে, সেটা ওই আর্টিকলেই প্রথম সন্দেহ করেছেন টার্কির একজন ইনভেস্টিগেশন এজেন্ট। বিলগাইনার এখন নিজে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র পাচারের সঙ্গে যুক্ত নেই, সে পুরো অবৈধ বাজারটার গডফাদার হিসেবে কাজ করছে।’ রুদ্র ফাইলটা প্রিয়মের দিকে এগিয়ে দিল, ‘আর আল হাকিম গত দু-বছর ধরে ওদের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল। ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের মধ্যে গাজা আর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অঞ্চল নিয়ে গণ্ডগোল চলছে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে, এই গোটা সময়টায় দু-দিকেই আর্মস সাপ্লাই করে প্রচুর পয়সা কামিয়েছিল এই আল হাকিম। তারপর এখন বিলগাইনারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। ওরা ইন্ডিয়ার খুচরো ডিলারগুলোকে দলে টানতে চেয়েছিল। মাওবাদী জঙ্গি, কাশ্মীর, আসাম এই সব কিছুর কল্যাণে আমাদের দেশের কালোবাজারি অস্ত্রব্যাবসাও খুব পিছিয়ে নেই, তাই এত বড়ো উপমহাদেশে নিজেদের ঘাঁটি গাড়তে চেয়েছিল ডিলারদের হাত করে। একুশ কোটি টাকার মাল কেনাটা তারই প্রথম ধাপ, তাই তো মি ত্রিবেদী?’ রুদ্র ডি জি সাহেবের দিকে তাকাল।
‘একদম তাই।’ ডি জি সাহেব মাথা নাড়লেন, ‘দিনের পর দিন যত শান্তিচুক্তিই হোক না কেন, বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বেশিরভাগ যুদ্ধবাজ দেশের সরকারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের মদত দিয়ে আসছে, এইজন্যই এদের শ্যাডো মার্কেট হু-হু করে বাড়ছে। অনেক বড়ো বড়ো রাজনৈতিক মাথা রয়েছে এর পেছনে। আগ্রার এই বিশ্ব সম্মেলনে আরও অনেক জোড়া শত্রুদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু এসেছে মোটে ছ-জোড়া। কিন্তু এই যে শান্তিচুক্তির ফলে বারোটা দেশ সমস্তরকম সংঘর্ষের পথ বন্ধ করে দিলে ওদের মার্কেট বিরাট ধাক্কা খাবে, সেই কারণেই ওরা এই প্ল্যানটা করে সমস্ত অতিথিকে মারতে চেয়েছিল। তাতে এক ঢিলে তিনটে পাখি মারা যেত। একটা হল, নিজেদের পাঠানো প্রতিনিধিরা এইভাবে নাশকতার বলি হলে সেই যুদ্ধবাজ দেশগুলো যুদ্ধবন্ধের চুক্তি তো দূর, কোনোরকম সমঝোতায় আর যেতে রাজি হত না, উলটে সংঘর্ষ আরও বেড়ে যেত। আর এখন সব দেশের কাছেই যে ধরনের মারণাস্ত্র রয়েছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়, তাতে কোটি কোটি মানুষ মরত, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হত, দেশগুলো সর্বস্বান্ত হত, আর প্রতিবারের মতো এবারেও এই ধরনের আর্মস ডিলাররা মৃত্যুর বিনিময়ে কোটিপতি হত। দ্বিতীয় কারণ হল, তাজমহল উড়ে গেলে ভারতে হিন্দু মুসলমান রায়ট বেধে যেত, গোটা দেশে একটা সাংঘাতিক অরাজকতা তৈরি হত, এমনকী দেশের গদিও উলটে যেতে পারত। আর শেষ কারণ হল, তাজমহলের মতো টুরিস্ট প্লেসে এত বড়ো বিপর্যয়ের পরে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে যেত, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রসংঘ, কেউ তখন ভারতের পাশে থাকত না, অনেক দেশ বিভিন্ন ধরনের চুক্তি বাতিল করত, বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষ লজ্জাজনক জায়গায় চলে যেত।’ মি ত্রিবেদী দম নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন, ‘এত বড়ো নিন্দার থেকে আপনি আপনার দেশকে বাঁচিয়েছেন ম্যাডাম!’
রুদ্র কথা ঘোরাল, ‘ওরা যে কল স্পুফ করে অঘোরেশের নামে ভুয়ো ফোন করেছিল, সেটাই মনে হয় একমাত্র ভুল চাল ছিল ওদের। কবীরের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে ওদের মনে হয়েছিল নাগেশ সিং, প্রফেসর বেগ আর অঘোরেশ একসঙ্গে কাজ করছেন। তাই অভিযোগের তির অঘোরেশের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া গেলে নাগেশ সিং-এর ওপর এই কাণ্ডের জন্য খুব সহজেই দোষারোপ করা যাবে। ফলে ওদের সন্ত্রাসবাদ ঘুরে যাবে সাম্প্রদায়িক হিংসার দিকে।’ ও নাগেশ সিং-এর দিকে তাকাল, ‘কিন্তু, আপনি হঠাৎ ছাব্বিশে জানুয়ারি সকালে তাজমহলের সত্যি উন্মোচনের মতো পোস্টার দিলেন কেন? তখনও তো প্রফেসর বেগ সুড়ঙ্গের মুখ বের করতে পারেননি।’
নাগেশ সিং ধীর গলায় বললেন, ‘কস্তুরী বুদ্ধি দিয়েছিল। বলেছিল ওর এক পরিচিত আছে যার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবে, সে অঙ্কে এতই তুখোড়, যে ওই মুদ্রার মর্মোদ্ধারে সময় নেবে না। আয়ারল্যান্ড যাওয়ার আগে তাই ওর কথাতেই দলকে পোস্টার ছাপাতে বলে চলে যাই। ভেবেছিলাম এসে কস্তুরীর ওই চেনা লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তার আগেই উজ্জয়িনীর এই ঘটনায়…!’
রুদ্র কাঁধ নাচাল, ‘পুরো ব্যাপারটাই নিপুণভাবে পরিকল্পিত!’
নাগেশ সিং প্রথম থেকেই উজ্জয়িনীর হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বিহ্বল হয়ে বসেছিলেন, এখন আস্তে আস্তে বললেন, ‘কস্তুরী মেয়েটা এত বড়ো ফাঁদ আমি বুঝতে পারিনি!’
‘বিশ্ব সম্মেলনের আপনি প্রধান পুরোধা ছিলেন বলে এমনিতেও আপনি ওদের আক্রোশের মেন টার্গেট ছিলেন, তার ওপরে আপনাকে ফাঁসানোর আরও বড়ো অস্ত্র ছিল একে আপনি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা, আবার আপনি রাজা জয়সিংহের বংশধরও, যার কাছ থেকে শাজাহান তেজোমহালয় অধিগ্রহণ করেছিলেন বলে দাবি করছেন প্রফেসর বেগ, তাই আপনার ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেয়ে সোজা আর কী হতে পারে? একদিক থেকে কস্তুরীকে সেক্রেটারি বানিয়ে গোপন কথা বের করা, অন্যদিকে উজ্জয়িনীকে …!’ উজ্জয়িনীর দিকে তাকিয়ে রুদ্র কথাটা গিলে নিল, নরমভাবে হাসল, ‘যা হয়েছে ভুলে যান, মি সিং! আদালত আপনাকে যা-ই শাস্তি দিক, তারপরেও আপনার জীবন থাকবে। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করুন।’
নাগেশ সিং মাথা নীচু করে ফেললেন।
অত বড়ো অভিজাত মানুষটির এমন ভগ্নদশায় সবারই যেন খারাপ লাগছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাগেশ সিং বললেন, ‘কী হবে, হিন্দু না মুসলিম, এইসব করে। সবাই তো আমরা মানুষ, বলুন!’
‘আলবাত!’ নাহুম খান এতক্ষণে কথা বললেন, ‘এইসব ধর্মের অজুহাতে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করলে বাইরের শত্রুরা কেমন সুবিধা নেয়, দেখলেন তো? যে দেশ যুদ্ধবাজ, সেই দেশকে ওই আর্মস ডিলাররা উসকোয়, যে দেশ নিজেদের মধ্যেই হিন্দু মুসলিম নিয়ে লড়াই করে, রাজনৈতিক স্বার্থে দাঙ্গা বাধায়, শত্রু দেশ সেই ঝামেলার সুযোগ নিয়ে নিজের শক্তি বাড়িয়ে চলে। এই ঘটনা থেকে শুধু আমাদের মতো পুলিশদেরই নয়, প্রতিটা মানুষের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
‘একদম ঠিক বলেছেন মি খান।’ রুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলল, ‘মানুষ ভুলে যায় আগের মাবনতা, আগে দেশ, পরে ধর্ম। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত যে এত বড়ো সাংঘাতিক চক্রান্ত বাতিল করা গেছে তার জন্য আমাদের দেশের পুলিশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল।’
সবাই হাসছিলেন। শুধু একজন বাদে।
প্রফেসর নিজামুদ্দিন বেগ। তিনি থেকে থেকে কেঁপে উঠছিলেন, বিড়বিড় করছিলেন, ‘শিবলিঙ্গটা কেউ খুঁজল না! জানা গেল না মাটির নীচে কী রয়েছে!’
রুদ্র বুঝতে পেরে ড বেগের বৃদ্ধ হাত জড়িয়ে ধরল, ‘তাজমহল আমাদের দেশের গর্ব, স্যার! এই অসাধারণ স্থাপত্য দেখতে সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা ভারতে আসে। এটা অবিকৃত রাখাটাই তো আসল কথা! কে বানিয়েছিল, হিন্দু না মুসলিম, কী ছিল, মন্দির না মসজিদ, এইসবের ওপরে উঠে আমরা না হয় এটাই ভাবি যে এটা বানিয়েছিল কোনো ভারতীয়? ভারতীয় হয়েই গর্বে যত্নে আগলে রাখি একে অশুভ শক্তির হাত থেকে, সেটাই তো আসল দেশকে ভালোবাসা। তাই না আঙ্কল?’
প্রফেসর বেগ চুপ করে রইলেন।
রুদ্র বলল, ‘আর আপনাকে আর কী বলব, সবই তো একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে, যিনি আল্লাহ, তিনিই শিব, তিনিই যিশু। সবই মানুষের মনের বিশ্বাস। সব ধর্মই ভালোবাসতে শেখায়। কিন্তু মানুষ সেগুলোর অপভ্রংস করে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। আগে তো মানুষকে ভালোবাসার ধর্ম বলুন, পরে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান!’
প্রফেসর বেগ ছলছল চোখে রুদ্রর হাতটা চেপে ধরলেন।
ঘণ্টাখানেক পর রুদ্র আর প্রিয়ম বাইরে বেরিয়ে এল। প্রিয়মের মাথাটা এখন অনেকটা ফুরফুরে লাগছিল। হঠাৎ মনে পড়তে বলল, ‘ওহ, তোমাকে বলা হয়নি। বাড়ি থেকে তোমার মা ফোন করেছিলেন। তোমার ব্রাঞ্চের অফিসার অমিত না কে, তোমাকে ফোনে না পেয়ে ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। তোমার হেড অফিস থেকে চিঠি এসেছে, ইনভেস্টিগেশন শেষ, তুমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছ। জয়েন করতে বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
রুদ্র হাসল, মৃদু মাথা নাড়ল দু-দিকে।
প্রিয়ম বুঝতে পারল না, ‘আমি তো পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে এলাম, এই ক-দিন ছুটিতেই থেকে যাও না, প্লিজ!’
রুদ্র এবার একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে স্বামীর দিকে তাকাল, ‘অফিস আমি আর জয়েন করব না, প্রিয়ম। ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। কাল গিয়ে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে আসব।’
‘মানে?’ প্রিয়ম হতবাক, ‘রেজিগনেশন? কী বলছ তুমি?’
‘হ্যাঁ।’ রুদ্র বলল, ‘এই কয়েকদিন অনেক ভেবে দেখলাম। জীবনে টাকা, বিত্ত, বিলাসিতা, কোনো কিছুই সম্মানের চেয়ে বড়ো নয়। যে চাকরিতে এতদিন নিজের সব কিছু উজাড় করে দিলাম, সেখানেই যখন কোনো প্রমাণ ছাড়া এত বড়ো অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হল, সেই চাকরি আমি করব না।’
‘চাকরি করবে না?’ প্রিয়ম হাঁ, ‘কী করবে তাহলে?’
‘দেখি কী করি!’ রুদ্র হাত দুটো উলটে পেছনের দিকে ছড়িয়ে দিল, ‘চাল ডাল আলুর দোকান দিতে পারি, ট্যাক্সি চালাতে পারি।’ দূরের আকাশের দিকে তাকাল ও।
প্রাচীন শহর আগ্রার আকাশে তখন সন্ধে নেমে এসেছে।
অস্তমান সূর্যের সমান্তরালে একে একে পাখিরা ফিরছে ঘরে, তাদের কলকাকলি রাস্তার যান্ত্রিক আওয়াজ ছাপিয়ে যেন রুদ্রর কানে এসে প্রবেশ করছিল।
রুদ্র অস্ফুটে বলল, ‘আবার পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যেতেও পারি!’
.
সহায়ক গ্রন্থ/ তথ্যসূত্র তালিকা
1. The Complete Taj Mahal and the Riverfront Gardens of Agra, Ebba Koch
2. The Taj Mahal Is A Temple Palace, P N Oak
3. Taj Mahal: The True Story, P N Oak
4. The Baburnama: Memoirs of Babur, Prince and Emperor, Babur
5. The Baburnama: Memoirs of Babur, Prince and Emperor (Modern Library Classics), W M Thackston Jr
6. Travels in India, vol 1 & 2, Jean-Baptiste Tavernier
7. Mughal India, Giles Tillotson
8. Taj Mahal: Passion and Genius at the Heart of the Moghul Empire, Diana Preston, Michael Preston
9. A Teardrop on the Cheek of Time: The Story of the Taj Mahal, Diana Preston, Michael Preston
10. The Mughal Empire, John Richards
11. The empire of the great Mughals, Annemarie Schimmel
12. Taj Mahal, Giles Tillotson
13. Shah Jahan & the Story of the Taj Mahal, Julia Marshall
14. Taj: A Story of Mughal India, Timeri N Murari
15. Shah Jahan: The Rise and Fall of the Mughal Emperor, Fergus Nicoll
16. The Mughal Harem, K S Lal
17. Beloved Empress Mumtaz Mahal, Nina Epton
18. Taj Mahal Agra & Fatehpur Sikri, Subhadra Sen Gupta
19. Studies in Mughal History, Ashvini Agrawal
20. The Great Mughals and Their India, Dirk Collier
21. The Shadow World: Inside the Global Arms Trade, Andrew Feinstein
22. The Arms Bazaar: From Lebanon to Lockheed, Anthony Sampson
23. The Small Arms Trade: A Beginner’s Guide, Dan Smith and Rachel Stohl
24. Arms Trade and Economic Development: Theory, Policy and cases in Arms Trade offsets (Routledge Studies in Defence and Peace Economics), Jurgen Brauer, Paul Dunne
25. Agra: The Architectural Heritage by Lucy Peck
26. History of the Lodi Sultans of Delhi and Agra, Abdul Halim
27. The Iraq War Reader: History, Documents, Opinions, by Christopher Cerf
28. Pigeonhole Principle, Jesse Russell, Ronald Cohn
29. Introduction to Combinatorics, by Martin J Erickson
30. রহস্যের তাজমহল, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
31. সাহিত্যের তাজমহল, পূর্ণেন্দু পত্রী
32. লা-জবাব দেহলি অপরূপা আগ্রা, নারায়ণ সান্যাল
33. https://www.stephen-knapp.com/true-story-of-the-taj-mahal.htm
34. http://veda.wikidot.com/taj-mahal-hidden-rooms
35. https://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/asia/india/12027696/Was-the-Taj-Mahal-originally-an-ancient-Hindu-temple.html
36. https://www.wiwigo.com/blog/the-mystery-sealed-doors-mahal/
37. https://topyaps.com/secrets-taj-mahal
38. https://johnnicholsonofindia.wordpress.com/illustrations/the-mys-tery-and-real-tragedy-of-the-taj-mahal/
39. http://www.krishnapath.org/photographic-evidence-taj-mahal-a-ve-dic-temple/
40. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-41813339
41. http://samsinhablog.blogspot.com/2014/09/taj-mahal-hindu-tem-ple-evidence.html
42. http://agniveer.com/tag-mahal-shiva-temple/
43. https://hinduismsanatan.wordpress.com/2017/10/14/tajmahal-origi-nal-hindu-temple-converted-to-musoleum-facts-of-distorted-history/
44. https://vishnupedia.blogspot.com/2013/03/hidden-facts-about-taj-mahal-tejo.html
45. http://www.harekrana.de/taj-mahal/tejo-mahalaya.html
46. http://dekhofamily.com/entertainment/mysterious-locked-rooms-inside-the-taj-mahal-were-you-can-not-go/
47. https://www.youtube.com/watch?v-3fxwYPSFECo
48. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S036013237000273
49. https://www.ijsr.net/archive/v3i12/U1VCMTQzMjI=.pdf
50. https://www.researchgate.net/publication/222512493_Fractal_geometry
51. https://curatorhall.wordpress.com/2015/05/10/architecture-of-the-kha-juraho-temples/
52. http://www.academia.edu
ইত্যাদি।