অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ৩

আগ্রার কমলানগরে কাইলা দেবীর মন্দিরের পাঁচিল বেয়ে যে ছায়ামূর্তিগুলো চুপিসারে সবুজ দোতলা বাড়িটায় একে একে ঢুকে পড়ছিল, তারা আজও কিছু একটা খুঁজতে এসেছিল।

এখন এই বাড়িতে কোনো লোক নেই, তাই দরজা ভাঙাভাঙিরও প্রয়োজন নেই। দোতলার বারান্দা দিয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটায় একটা লোহার সরু তার জাতীয় কিছু দিয়ে চাপ দিতেই সেটা মৃদু আর্তনাদ করে খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে ওরা ঢুকে পড়ল ভেতরে।

দলটা সতর্কতার জন্য আলো তেমন জ্বালায়নি, সরু লেজার আলোর মতো এক ধরনের তীক্ষ্ন অথচ চাপা আলোয় পাগলের মতো ঘরের প্রতিটা কোণ তন্নতন্ন করে দেখছিল। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন, তার মধ্যে একজন নেতৃস্থানীয়। দোতলার তিনটে ঘরই আঁতিপাঁতি করে খোঁজা হয়ে যেতে নেতাগোছের লোকটা হতাশ গলায় কাউকে ফোন করে ফিসফিস করল, ‘সব খুঁজলাম। কিচ্ছু নেই।’

ওপাশ থেকে কেউ গর্জে উঠল, ‘আলবাত আছে। ভালো করে না খুঁজে হাত তুলে দিস না, প্রফেসরের শোবার ঘরের দেরাজটা দ্যাখ!’

এপাশের নেতা মিনমিন করল, ‘সবই দেখেছি। কোথাও কিচ্ছু নেই। এই নিয়ে তিনবার খুঁজে গেলাম। তুমি বসকে একটু বুঝিয়ে বলো। পুরোনো কিছু ডায়েরি পড়ে আছে, সেগুলো কি নিয়ে যাব?’

ওপাশ বলল, ‘ধুর শালা! কতবার বলছি একটা গোল মুদ্রা, বড়ো মাপের কয়েনের মতো। এক কথা একশোবার হ্যাজাস কেন?’

এপাশের লোকটা আবার অন্যদেরকে ইশারায় বলল ভালো করে খুঁজতে, তারপর ফিসফিস করল, ‘কোনো গুপ্তধন-টনের সঙ্কেত নাকি বলো তো মুদ্রাটা? কাল বলছিলে কী সব ফর্মূলা লেখা আছে? কীসের ফর্মূলা?’

ওপাশের লোকটা খিঁচিয়ে একটা গালাগাল দিয়ে উঠল, ‘তোকে কবরে পাঠাবার। না বকে ভালো করে খোঁজ।’

‘যাহ বাবা! না বললে বুঝব কী করে কোন জিনিসটার কথা বলছ? দেরাজটা খুলেছি। এখানে তো অনেকরকম মুদ্রা দেখতে পাচ্ছি গো!’ এপাশের নেতা একটা ছোট্ট চাল দিল।

দেরাজটা আসলে এখনও খোলাই যায়নি। তালা মারা, ভাঙতে হবে।

ওপাশের লোকটা এবার একটু থমকে গেল। সতর্ক গলায় বলল, ‘একটা কালো রঙের মুদ্রা। তার ওপর এক পিঠে কিছু হরফ লেখা, সংস্কৃতে। অন্য পিঠে ছবি।’

‘আহা, সে তো আগেও বলেছ, কিন্তু এর পেছনের গল্পটা না জানলে কী করে খুঁজি?’ এদিকের নেতাটা মাতব্বরি ভঙ্গিতে বলল।

ওপাশের লোকটা ভ্রূ কুঁচকে কিছু ভাবল, তারপর বলতে লাগল, ‘সংক্ষেপে বলছি। আজ থেকে হাজার বছর আগে মধ্যভারতের জেজকভুক্তিতে চান্দেলা রাজারা প্রায় পাঁচশো বছর রাজত্ব করেছিল। যশোবর্মণ, কীর্তিবর্মণ এইসব রাজাদের নাম শুনেছিস?’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ দলের ছেলেগুলো সিঁড়ি বেয়ে ইতিমধ্যেই নেমে গেছে একতলায়, এদিকের লোকটা এবার একটা ধুলো-পড়া চেয়ারে বসে পড়ল, ‘জেজুভুকু… ক-কী বললে?’

‘এখন যেটা বুন্দেলখণ্ড, মানে উত্তরপ্রদেশের নীচ আর মধ্যপ্রদেশের ওপর দিক মিলিয়ে জায়গাটা, সেটাকেই তখন জেজকভুক্তি বলত। চান্দেলা বংশের রাজারা খুব শক্তিশালী ছিল, ওঁদের হিন্দু বেদে লেখা চন্দ্রবংশের উত্তরাধিকারী বলা হত। গুর্জর, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট, পারমার এইসব রাজাদের সঙ্গে চান্দেলা রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। বার বার গজনীর সুলতান মামুদের আক্রমণে এই সাম্রাজ্যের ক্ষতি হতে থাকে। শেষ রাজা পরমাদ্রিদেবের সময়ে কুতুবউদ্দিন আইবক পুরোপুরি এদের শেষ করে দিয়েছিল, তারপর ভারতে সুলতান রাজ শুরু হয়। বুঝলি কিছু?’

‘বাপ রে, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে গো! ইতিহাসে আমি একেবারেই কাঁচা ছিলাম তো!’ এপাশের লোকটা ঘরের চারপাশে আলোটা ফেলতে ফেলতে বলল, ‘তার সঙ্গে এই বুড়োর সম্পর্ক কী? বুড়ো কি ওই চাঁদু বংশের কেউ?’

‘আগে চুপ করে শোন যা বলছি। এদিকে যমুনা নদী থেকে ওদিকে নর্মদা নদী পর্যন্ত ছিল এদের সাম্রাজ্য। বেশিরভাগ চান্দেলা রাজারা ছিল শিবের ভক্ত আর সেইজন্য দারুণ সব মন্দির বানাত। খাজুরাহোর মন্দিরগুলো ওদেরই বানানো। গেছিস?’ ওপাশের গলা বলল।

এদিকের লোকটা এবার লজ্জা পেল, ‘কেন যে দুঃখ দাও এসব বলে, হেব্বি রাগ হয় মাইরি এইজন্য। ওইসব অসভ্য ছবি দেখতে গিয়ে কী করব? বিয়েই তো করিনি এখনও! মোবাইলে দেখেছি, সে একেবারে রগরগে…।’

ওপাশের লোকটা এবার দাঁত কিড়মিড় করল, ‘শালা, দুইয়ের নামতা না জানা পাঁঠাকে বসেছি ক্যালকুলাস শেখাতে! ছবির গল্প রাখ। খাজুরাহোতে মোট পঁচাশিটা মন্দির ছিল, এখন মাত্র পঁচিশটা আছে। ওইসব ছবি যেগুলো বলছিস, সেগুলো ছাড়াও খাজুরাহো মন্দিরের আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটাই ওই বুড়ো প্রফেসর আবিষ্কার করেছিলেন।’

‘কী বৈশিষ্ট্য?’

‘প্রতিটা মন্দিরের ভেতরের কাজ, একেকটা শিলার ডিজাইন, এমনকী দুটো মন্দিরের মধ্যে যে দূরত্ব, প্রতিটার মধ্যে লুকিয়ে আছে একেকটা করে দুরূহ অঙ্কের তত্ত্ব, যার বেশিরভাগই এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সেইগুলো সাংকেতিকভাবে লেখা ছিল কিছু শিলালিপিতে, ওইগুলো ডিকোড করাই ছিল ওই বাড়িতে আমার কাজ। শুধু খাজুরাহোই নয়, প্রতাপেশ্বর, অজয়গড়, কালিঞ্জর, কাণ্ডরীয় মহাদেব মন্দির, ওদের সব ভাস্কর্যেই চান্দেলা রাজারা লুকিয়ে রাখত একেকটা জটিল গাণিতিক কনসেপ্ট। ঘটে ঢুকল কিছু?’

‘অঙ্ক লুকিয়ে রাখত মানে? অঙ্ক কি মিষ্টি নাকি যে পিঁপড়ে এসে খেয়ে যাবে?’

‘তখন মুসলিমরা ঘন ঘন আক্রমণ করছে ভারতে, তাদের থেকে প্রাচীন অঙ্কগুলোকে সুরক্ষিত রাখা ছিল উদ্দেশ্য।’

‘অঙ্ক মানে কী? এক, দুই, তিন, চার এই সংখ্যাগুলো? এগুলোকে লুকিয়ে রাখত? কেন?’

‘ধুর শালা, অঙ্ক মানে বোঝাতে চাইছি জটিল কোনো থিয়োরি মানে জ্যামিতি। মিশরের স্টেপ পিরামিডের ছবি দেখেছিস? ফারাও জোসারের সমাধি?’

‘পিরামিডের ছবি দেখেছি। এখন সেটা স্টেপ কাট না লেয়ার কাট জানি না।’

‘অপোগণ্ড! অত হাজার বছর আগে কোনো ক্রেন নেই, বিদ্যুৎ নেই, অত বড়ো বড়ো পাথরগুলোকে ওইভাবে মিশরীয়রা একটার ওপরে একটা সাজিয়ে যে পিরামিড বানাত, সেটা জ্যামিতি প্রয়োগ করে।’

‘আচ্ছা। তার সঙ্গে এই বুড়ো আর ওই চাঁদু রাজাদের কী সম্পর্ক সেটাই শুধু বুঝছি না।’

ওপাশের লোকটা এবার বিরক্তির শ্বাস ফেলল, ‘আমাদের বৈদিক জ্যামিতির প্রাচীন গ্রন্থ বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে এই পিরামিডের গঠনের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে।’

‘বল কী মামা!’ এপাশের লোকটার চোখ ছানাবড়া, ‘মিশর থেকে এসে ওরা আমাদের বেদের ক্লাস করে গিয়েছিল?’

ওদিকের লোকটা এবার বিরক্তিতে খিঁচিয়ে উঠল, ‘এরকম লোফারদের মতো মামা বলে ডাকবি না। বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে একটা শ্মশান চিতা বানানোর জ্যামিতিক প্রসেস দেওয়া আছে, স্টেপ পিরামিড ওই শ্মশানচিতার নকল। শুধু তাই নয়, পিথাগোরাসের ওই অতিভুজের যে বিখ্যাত উপপাদ্য, সেটাও বৌধায়ন শুল্ব সূত্রতে লেখা আছে।’

‘বুঝলাম। কিন্তু এখন তাহলে কী খুঁজতে এসেছি এখানে? ওই সূত্র?’

ওপাশের লোকটা বেড়ালের মতো সতর্ক হয়ে গেল হঠাৎ, ‘একটা মুদ্রা, তার ওপরে অনেক আঁকিবুকি কাটা। শেষ চান্দেলা রাজা পরমাদ্রিদেবের সময়কার। তাতে লুকিয়ে আছে ওইরকমই একটা অঙ্কের থিয়োরি।’

‘সেটাও খাজুরাহো মন্দিরের?’ এদিকের লোকটা জিজ্ঞেস করল।

‘না।’ ওপাশ থেকে ভেসে এল, ‘এই আগ্রারই একটা মন্দিরের।’

‘আগ্রার মন্দির? কোন মন্দির গো?’ এপাশের লোকটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফোনটা পিঁ পিঁ শব্দে কেটে গেল হঠাৎ।

এপাশের লোকটা সামান্য ঠোঁট কামড়ে ধরল। স্মার্টফোনের অটো-রেকর্ড অপশনটা তার কাজ ঠিকমতোই করেছে।

লোকটার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। একটু আগের গোটা কথোপকথনটা স্টোরড হয়েছে ফোনের মেমারিতে এক হাতে লেজার লাইটটা নাচাতে নাচাতে রেকর্ডটা বের করে লোকটা মুহূর্তে ফরোয়ার্ড করে দিল কোথাও একটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *