অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৯

২৯

নাগেশ বেডরুমের প্রকাণ্ড পালঙ্কে শুয়ে ছিলেন। ঘুম নেই একফোঁটাও, একটু বাদেই উঠতে হবে আগ্রা যাওয়ার জন্য। ওপাশে সুজাতাও উশখুশ করছেন, বেশ বোঝা যাচ্ছে। নাগেশের কাছে এই নরম বিছানা যেন শরশয্যা হয়ে বিঁধছে। মেয়েটার কী অবস্থা কে জানে। দিল্লির একেই কুখ্যাতি সর্বত্র, বাবা হয়ে আগে খারাপের আশঙ্কাটাই মনে আসে বেশি।

আচ্ছা যে বা যারা উজ্জয়িনীকে কিডন্যাপ করেছে তাদের কি শুধুই টাকাটা উদ্দেশ্য? না, অন্য কিছু? নাগেশ সিং-এর বিত্তের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুরও অভাব নেই। ব্যাবসায়িক টানাপোড়েনে শত্রু তৈরি হয়েই যায়, তার সঙ্গে উল্কার গতিতে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান দলের মধ্যেই অনেকে ঈর্ষার চোখে দেখে, নাগেশ বেশ বুঝতে পারেন। কিন্তু সেই শত্রুতা এতটাও নয় যে সেটা এই পর্যায়ে পৌঁছোতে পারে।

একটু আগে ইনস্পেকটর বশিষ্ঠ ফোন করে শেষ খবর দিয়েছেন। সব থানা থেকে দাগি আসামিদের তুলে এনে জেরা চলছে, উজ্জয়িনীর ফোনে যেখানে শেষ টাওয়ার পাওয়া গেছে, সেখানেও তল্লাশি চলছে।

নাগেশের গলার কাছটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। মেয়েটা খেয়েছে তো? চোখের জল গড়িয়ে পড়ল বিছানায়, দুর্বল চিত্তে তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

আজ অনেকদিন পর সুজাতা আর নাগেশ একই বিছানায়।

না, সম্পর্কের কোনো উন্নতির জন্য নয়, উজ্জয়িনীর অপহরণ হওয়ার নিদারুণ দুঃসংবাদে জয়পুরের বাড়ি থেকে সন্ধেবেলা ছুটে এসেছেন নাগেশের অশীতিপর মা। একে নাতনির আশঙ্কায় বৃদ্ধা অধীর, তার মধ্যে নিজেদের সম্পর্কের ক্লেদ উন্মুক্ত করে আর মায়ের দুঃখ বাড়াতে চাননি নাগেশ।

ল্যান্ডলাইনে ফোনটা এবার এল নাগেশের জন্যই। দু-বার রিং হতেই আধশোয়া হয়ে নাগেশ ফোনটা রিসিভ করলেন, ‘হ্যালো!’

ওপাশ থেকে মিহি গলায় পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল, ‘পুলিশে খবরটা দিয়ে কি খুব ভালো করলেন?’

নাগেশ সঙ্গেসঙ্গে ফোনের দিকে তাকালেন, একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর ভেসে উঠছে কলার আইডেন্টিফায়ারে, দ্রুতগতিতে সামনে রাখা নোটপ্যাডে নম্বরটা টুকতে টুকতে বললেন, ‘কে কথা বলছেন?’

‘এই নম্বরটা পুলিশের কাছে দিয়ে কোনো লাভ হবে না মি সিং। এটা একটা বুথের নম্বর। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, মেয়েকে কি জ্যান্ত ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে নেই?’

নাগেশের সমস্ত পরাক্রম মুহূর্তে যেন খান খান হয়ে গেল, তিনি ভাঙা গলায় বললেন, ‘শুনুন, এরকম করবেন না। আপনারা … আপনাদের আমি টাকা দেব কালই। প্লিজ, আমার মেয়েকে ফেরত দিন।’

‘টাকা? আপনার কাছে টাকা কখন চাইলাম মি সিং?’ গলাটা যেন খুব অবাক।

‘মা-মানে? আমার স্ত্রী-ই তো বললেন যে টাকা নিয়ে কাল সকাল ন-টায়…!’

‘ওফ হো! সে তো আপনার স্ত্রীকে বলেছি, আপনার কাছে তো নয়। আপনি এত বড়ো মান্যগণ্য মানুষ, আপনার মেয়ের দাম কি শুধু ওই ক-টা টাকা?’

নাগেশ এবার দিশেহারা হয়ে গেলেন, ‘কী বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না?’

‘টাকাটা আপনার স্ত্রীর কাছে চেয়েছি। আপনার কাছে অন্য জিনিস চাই।’

‘কী- কী চান বলুন?’ নাগেশ কাতরস্বরে বলতে লাগলেন, ‘কী চান আপনারা?’

সুজাতা উঠে বসেছেন বিছানার ওপর, তাঁর মুখেও এখন ভয়ের ছায়া।

‘আমরা আপনাদের দুজনের জন্যই সিনেমা হলের প্যাকেজ রেখেছি স্যার!’

গলাটা মিষ্টি করে বলল, ‘কাল সকাল আটটায় যখন আপনার স্ত্রী গুরগাঁওয়ের রিজেন্ট সিনেমা হলের সামনে টাকাটা হ্যান্ডওভার করবেন, আপনিও ঠিক তখনই আগ্রার কৈলাস সিনেমা হলের সামনে আরেকজনকে আমাদের কাছে হ্যান্ডওভার করবেন, কেমন?’

‘আরেকজনকে আপনাদের কাছে হ্যান্ডওভার করব মানে? কাকে?’ নাগেশ হতবাক।

ওপাশের উত্তরটা শুনে এই ঠান্ডাতেও নাগেশ সিং কেঁপে উঠলেন। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে একের পর এক ফোন করতে শুরু করলেন। নীচু গলায় নির্দেশ দিতে লাগলেন পরপর।

.

রুদ্রর চোখ জ্বালা করছিল, মনে হচ্ছিল সোফাতে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু নাহুম আর প্রিয়ম, দু-জনের কারুর চোখেই ঘুম নেই। প্রিয়ম ইন্টারনেটে ড নিজামুদ্দিন বেগের সেই বিতর্কিত কলামগুলো একে একে খুলছে আর পড়ে শোনাচ্ছে।

ইনস্পেকটর নাহুম খান মুখে যতই হম্বিতম্বি করুন, তাঁরও ইতিহাসেই ভালোই আগ্রহ, মন দিয়ে শুনছেন নিজামুদ্দিনের লেখা পয়েন্টগুলো।

প্রিয়ম বলল, ‘নিজামুদ্দিন বলছেন, তাজমহল আসলে সাততলা একটা প্রাসাদ। তাজমহলের মার্বেল পাথরের যে কাঠামোটার উপরে চারটে মিনার রয়েছে, তার নীচেও কিন্তু লাল বেলেপাথরের আরও দুটো তলা রয়েছে।’

‘মানে, যখন আমরা তাজমহলে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠি, সেই সিঁড়ির পাশের তলাগুলো?’ নাহুম খান প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ, তাতে বাইশটা ঘর রয়েছে এবং সেই প্রতিটা ঘর থেকেই সুড়ঙ্গ চলে গেছে যমুনা নদীর দিকে। সেই বাইশটা ঘরের দরজাগুলো এখনও বাইরে থেকে দেখা যায়, কিন্তু শাজাহান সেই বাইশটা ঘরে ঢোকার সমস্তরকম দরজা বা প্রকোষ্ঠ ভরাট করে দিয়েছিলেন, ফলে ওই ঘরগুলোর ভেতরে কী আছে, তা জানার কোনো উপায় নেই। নিজামুদ্দিন দাবি করেছেন অবিলম্বে ইতিহাসের স্বার্থে ভারত সরকারের উচিত ওই ঘরগুলো খুলে তদন্ত শুরু করা।’ প্রিয়ম একটা ছবি জুম করে এগিয়ে দিলও, ‘এই দেখুন, এক দুই করে ভদ্রলোক মার্কও করে দিয়েছেন তলাগুলো।’

‘না, ভদ্রলোক অন্যায্য তো কিছু বলেননি!’ নাহুম খান ছবিটা দেখতে দেখতে মাথা দোলালেন, ‘সত্যান্বেষণের স্বার্থে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট যদি কেরালার পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের গোপন কুঠুরিগুলো খোলাতে পারে, তখন এক্ষেত্রেও তাজমহলের ওই ঘরগুলো খোলা উচিত! এতে তো অন্যায় বা কোনো ধর্মের অসন্তোষের কারণ নেই।’

‘সেটা আপনি বুঝছেন মি খান, যে দেশে আজও একটা গুজবে মানুষ মেরে ফেলা হয়, সেদেশের ক-জন সেটা বুঝবে?’ রুদ্র ক্লান্ত শরীরে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল, হাত বাড়িয়ে প্রিয়মের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল।

প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে রুদ্রর দিকে তাকাল, পড়ার মাঝে দুম করে টেনে নেওয়ার বদ স্বভাবটা রুদ্রর কোনোদিনই গেল না। ভ্রূ কুঁচকে ও টেবিল থেকে সুরঞ্জনের ট্যাবটা তুলে নিল। আড়চোখে শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকাল, তিনি আর কষ্ট করে বসে বসে ঘুমোচ্ছেন না, লম্বা সোফায় সটান হয়ে পড়েছেন অনেকক্ষণ আগেই।

‘ড বেগের দ্বিতীয় কিস্তির লেখাটা তো আরও মারাত্মক! আর এঁর লেখাগুলো অনেক বেশি যুক্তিবাদী, অঘোরেশের চেয়ে।’ প্রিয়ম পড়তে পড়তে বলল।

‘কীরকম বলুন?’

‘হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ভারতবর্ষে নাকি মোট চৌষট্টিটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ছিল।’

‘জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির আবার কোন ঠাকুরের মন্দির?’ নাহুম খান অবাক হলেন।

প্রিয়ম পড়ে চলেছিল, ‘জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল প্রাচীনকালের একধরনের বিখ্যাত শিবমন্দির, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী মোট চৌষট্টিটা এইরকম জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ছিল ভারতবর্ষে। কিন্তু হাজার বছর ধরে মুসলিম, তুর্কিরা এসে হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করেছে, ফলে এখন ভারতে এইরকম মন্দির রয়েছে মাত্র বারোটা। গুজরাটের সোমনাথ মন্দির, মধ্যপ্রদেশের মহাকাল মন্দির, উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ মন্দির, বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির, এগুলো সবই একেকটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির। তার মধ্যে সোমনাথ মন্দির তো আমরা জানিই, বহুবার ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, সোমনাথ মন্দির আমি গেছি।’ নাহুম খান মাথা দোলালেন।

‘আপনি গেছেন?’ প্রিয়ম বলল, ‘ঘুরতে?’

নাহুম খান একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ঘুরতে ঠিক নয়, ওই আর কি! তারপর বলুন।’

প্রিয়ম বলতে লাগল, ‘নিজামুদ্দিন বলছেন, প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র শিবপুরাণে এই সবকটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অবস্থান দেওয়া আছে, একদম অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ মেনে, সেই অনুযায়ী যদি ভারতের মানচিত্রে লুপ্ত মন্দিরগুলোকে ম্যাপ করা যায়, তাহলে তাজমহলের লোকেশনে একটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। আসলে তাজমহল ছিল নাগনাথেশ্বর মন্দির, শিবের গলায় পেঁচানো সাপ থেকে নাগনাথেশ্বর নামটা এসেছিল।’

‘নাগ-নাথ-ঈশ্বর, মানে সাপেদের যে রাজা, সেই রাজার ঈশ্বর!’ নাহুম খান স্বগতোক্তি করলেন।

প্রিয়ম ব্যাখ্যা করল, ‘আগ্রায় প্রাচীন কাল থেকেই জাট প্রজাতির মানুষ বসবাস করে আসছে, তারা মহাদেব শিবকে বলে তেজাজি। সেই তেজাজি থেকেই তেজ-মহালয়, সেই থেকে তেজো মহালয়, আজকের তাজমহল। নাগনাথেশ্বরের সেই শিবলিঙ্গ শাজাহান নির্মমভাবে ইতিহাসের অন্ধকারে নাকি লোপাট করে দিয়েছিলেন।’

‘এও তো সেই অঘোরেশের মতো জোর করে তৈরি করা যুক্তি হয়ে গেল।’ নাহুম খান বললেন, ‘অনার্সে পড়ার সময় পড়েছিলাম কোন এক ঐতিহাসিক বলেছেন ইটালির রোমে নাকি রামচন্দ্র গিয়েছিলেন, সেই থেকে নাম হয়েছে রোমা, সংস্কৃত শব্দ ভাটিকা থেকে নাকি ভাটিক্যান সিটি নাম হয়েছে! এগুলোর কোনো লজিক আছে! তাহলে তো অনেক কিছুই ওইরকমভাবে বলা যায়।’

‘না ড বেগ শুধু বলেননি, উনি যুক্তিও দিয়েছেন।’ প্রিয়ম বলল, ‘শিবপুরাণ বেদের একটা ভাগ যেখানে অঙ্ক ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রির দুরূহ সব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। শিবপুরাণের এই বৈদিক ম্যাথ, বিজ্ঞানচর্চা প্রমাণ করে দেয় যে পশ্চিমের দেশগুলোর হাজার বছর আগেই পূর্বে এই আবিষ্কারগুলো করা হয়েছিল। এমনকী, শিবপুরাণে মহাকাশচর্চা, অ্যানাটমির মতো মেডিক্যাল টপিকও রয়েছে।’ প্রিয়ম সংবাদপত্রের ড বেগের লেখাটা জুম করল, ‘এই দেখুন, রুদ্রম চমকম বলে একটা শ্লোক, এতে বিভিন্ন অণু পরমাণুর ফর্মেশন জটিল অঙ্ক দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আবার দেখুন, কীভাবে স্কোয়ার রুটের মতো পাটিগণিতও রয়েছে এখানে,

একা চ মে, তিশ্র চ মে, পঞ্চস চ মে, নব চ মে, একাদশ চ মে

ত্রয়োদশ চ মে, পঞ্চদশ চ মে, সপ্তদশ চ মে, নবদশ চ মে…।

‘কী বলছেন বলুন তো এগুলো?’ নাহুম খান হতবাক।

‘ওই তো, এই শ্লোকের মানে হল একের স্কোয়ার রুট এক, এক যোগ তিন হল চার, চারের স্কোয়ার রুট হল দুই…।’

‘বুঝেছি বুঝেছি, আর বলতে হবে না।’ নাহুম খান থামিয়ে দিলেন, ‘কিন্তু এর সঙ্গে তাজমহলের যুক্তি আসছে কীভাবে?’

‘শিবপুরাণে প্রায় এক লক্ষ শ্লোক রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে আর্কিটেকচারের গাণিতিক সমাধানও। তাজমহল যে জ্যামিতিক প্যাটার্নে তৈরি, সেটা হল মিরর সিমেট্রি। খেয়াল করলে দেখবেন, পুরো তাজমহলেও এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য রয়েছে, মাঝামাঝি লম্বভাবে কাটলে দুই ভাগ যেন একে অন্যের আয়না, আবার চারদিকের যেদিক থেকেই দেখা যাক, তাজমহলকে একইরকম দেখাবে। এটাকে ইউক্লিড ডিয়োমেট্রিতে বলে মিরর সিমেট্রি। অথচ সেটারও ব্যাখ্যা শিবপুরাণে রয়েছে, শ্লোকটা পড়ে শোনাব?’

‘না না।’ নাহুম খান হাত নাড়লেন, ‘এমনিই বলুন না।’

প্রিয়ম বলল, ‘আচ্ছা, তার পরের শ্লোকেই বলা আছে একটা জ্যামিতিক প্যাটার্নে ভারতের প্রতিটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অবস্থান করছে, সেই হিসেব দিয়ে ক্যালকুলেশন করে ড বেগ এখনকার প্রতিটা জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরকেই ঠিক জায়গায় পেয়েছেন, আরও অনেকগুলো পয়েন্ট পেয়েছেন, যেগুলোয় ধ্বংস-হয়ে-যাওয়া মন্দিরগুলো ছিল বলে উনি অনুমান করছেন। সেই পয়েন্টগুলোর মধ্যে এই আগ্রাও একটা।’

রুদ্র বিড়বিড় করল, ‘সবই খালি অনুমান!’

প্রিয়ম ম্যাপটা দেখিয়ে শ্লোকটা বলতে লাগল,

সৌরাষ্ট্র সোমনাথম চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুনম

উজ্জয়িন্য মহাকালম ওমকারাম মামালেশ্বরম

পরল্যাম বৈদ্যনাথ চ দাক্ষিণ্যম ভীমা শঙ্করম…।

‘উহ, থামুন না মশাই!’ নাহুম খান চটেমটে বললেন, ‘এই শালা সংস্কৃত ভাষাটা জনেউ থেকে গ্র্যাজুয়েশনে জ্বালিয়ে মেরেছিল আমায়।’

রুদ্র বলল, ‘জনেউ তো উত্তরপ্রদেশে পৈতেকে বলে জানি!’

‘আপনার গ্র্যাজুয়েশনে সংস্কৃত ছিল?’ প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল, ‘সংস্কৃত নিয়েছিলেন কেন?’ তারপরেই নাহুম খানের বলা প্রথম শব্দটার প্রতি ওর নজর পড়ল, হতবাক হয়ে ও বলল, ‘পৈতে! মানে?’

নাহুম খান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বাবা মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। জনেউ তো হবেই। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে ফারহিনের প্রেমে পড়লাম। তখন রক্ত গরম, বাবাকে গিয়ে সোজা বললাম বিয়ে করতে হলে ওকেই করব। বাবাও ধার্মিক ব্রাহ্মণ মানুষ, বললেন বেরিয়ে যাও। আমিও এককথায় বেরিয়ে এলাম। তারপর ইসলাম ধর্ম নিলাম, ফারহিনকে বিয়ে করলাম।’

প্রিয়ম বলল, ‘বলেন কী! আপনিই তো দেখছি এই যুগের শাজাহান!’ উচ্ছ্বসিত প্রিয়ম রুদ্রর দিকে তাকাল, ভাবল রুদ্রও বুঝি অভিভূত।

কিন্তু কোথায় কী, রুদ্র আবার সেই ড বেগের সাততলা তাজমহলের ডায়াগ্রামটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, জুম করে দেখছে বিভিন্ন কোণ থেকে।

প্রিয়ম বলল, ‘শুনলে মি খানের কথা?’

রুদ্র অন্যমনস্কভাবে একবার শুধু মাথা নাড়ল।

নাহুম খান হাসলেন, ‘সে-ই বটে! শুধু মুমতাজ চলে যাওয়ার পর আমি তাজমহল তো দূর, একটা কুঁড়েঘরও বানাতে পারলাম না, পুলিশ কোয়ার্টারেই মাথা গুঁজে রয়ে গেলাম, এই যা পার্থক্য!’

‘মুমতাজ চলে যাওয়ার পর মানে?’ প্রিয়মের কপাল কুঁচকে গেল।

‘অত কাণ্ড করে বিয়ে করলাম, বিয়ের দেড় বছরে মাথায় ওর ক্যান্সার ধরা পড়ল, সময়ই দিল না! জীবন বড়ো অদ্ভুত।’ নাহুম খান খুব সহজভাবে কথাগুলো বললেন।

প্রিয়ম চুপ করে গেল। কোন কথা বলতে পারল না।

‘আপনি বলুন কী বলছিলেন।’ নাহুম খান সোজা হয়ে বসলেন, ‘তা, নাগনাথেশ্বর শিবমন্দিরের সেই শিবলিঙ্গ কোথায় গেল, তা নিয়ে কিছু লেখেননি ড বেগ?’

প্রিয়ম মনোনিবেশ করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, ইয়ে মানে, ড বেগ লিখেছেন শাজাহান কোথাও সেটাকে চিরদিনের জন্য বন্দি করে দিয়েছেন।’

নাহুম খান ভ্রূ কুঁচকে চুপ করে গেলেন, আর তাঁর ফোনটাও সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল।

ফোনটা রেখে বললেন, ‘নাগেশ সিং-এর কাছে আবার ফোন এসেছিল। উনি আগ্রা আসছেন।’

.

কবীর হনহন করে মেহতাববাগে যমুনা নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছিল। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি, উত্তেজনায় ওর শরীরের স্নায়ুগুলো যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একবার ভাবল, নাগেশ সিং-এর ওই পেছনপাকা মেয়েটা কী করছে গিয়ে দেখবে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই ও সেই ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে একটা গাছের তলায় স্থির হয়ে বসল।

দূরের তাজমহলকে দেখতে দেখতে ভাবল

দূরের তাজমহলকে দেখতে দেখতে ভাবল আর কয়েক ঘণ্টা পরে ওর জীবনটা বদলে যাবে। মাথা ঠান্ডা রেখে পুরো পরিকল্পনাটা ও ঝালিয়ে নিতে লাগল।

সত্যিই, লখনৌ থেকে যেদিন দিল্লি এসেছিল, ও কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিল যে এতরকম উথালপাতালে ভরতি হয়ে উঠবে ওর জীবন? পড়াশুনোয় ও আহামরি কিছু ছিল না, শুধুমাত্র অঙ্কতেই ওর মাথাটা যা খেলত, তাও সেই মাথা কাজে লাগিয়ে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার দিকে ওর কোনোকালেই মতি ছিল না। সিলেবাসের বাইরের জেটিল গাণিতিক প্রবলেম নিয়ে মেতে থাকত। বিশ্বের তাবড় তাবড় ধাঁধা যা চার-পাঁচশো বছরেও কেউ সমাধান বের করতে পারেনি, তাই নিয়েই ও বুঁদ হয়ে থাকত।

কিন্তু চিরকালই অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে বদমায়েশি বুদ্ধিও ওর মাথায় খেলত ভালো। প্রফেসর বেগের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করার পর ছোটোবেলার বন্ধু প্রকাশকে দিয়ে ও এটা ওটা আনাত।

প্রকাশ হল লখনৌ মিউজিয়ামের স্টোরকিপার, ছোটোখাটো জিনিস সরিয়ে দেশ বা বিদেশের অ্যান্টিক ব্যবসায়ীদের কাছে বেচা হল ওর পার্ট-টাইম রোজগার। দু-একবার ধরা যে পড়েনি তা নয়, প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে।

এইভাবেই প্রফেসর বেগকে ও এনে দিয়েছে বটেশ্বর শিলালিপির কপি থেকে শুরু করে আর অনেক কিছু। প্রফেসর বুঝতেন সবই, কিন্তু নিজের গবেষণার নেশায় এই খুচরো অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু প্রকাশ মনে হয় ইদানীং আরও বড়ো কোনো দাঁও মারার ধান্দায় ছিল, দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক স্মাগলারদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ক্রমশই দৃঢ় হচ্ছিল।

যেদিন প্রকাশের মুখ থেকে শুনে এসে ও বিদেশের কোনো মিউজিয়াম থেকে সরানো বাদশাহনামার কথা বলল, তখন প্রফেসর বেগ ওর ওপর বিশাল খাপ্পা হয়ে গিয়েছিলেন, এমনকী পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ওর সঙ্গে প্রফেসরের দূরত্ব বাড়ার শুরু।

সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতল ওই ওয়াসিম আর সাহেবের দল।

একটা নিশ্বাস ফেলল ও, সরু চোখে একটা ভাঙা পাঁচিলের ওপারে মেহতাববাগের দিকে তাকাল। প্রফেসর বেগের কাছে থাকা শেষ মুদ্রাটা কিছুতেই পাওয়া গেল না। না পাওয়া যাক, কবীর নিজেই সেই হারিয়ে যাওয়া রাস্তা বের করবে। একবার তো দেখেও ছিল একঝলক, ওর স্মৃতিশক্তি মারাত্মক, ছবির মতো মনে আছে।

ওই সাহেবরা ওকে লক্ষ লক্ষ ডলার দেবে, এর মধ্যেই ওর লখনৌয়ের মাটির বাড়ি আর টিনের চাল ভেঙে ইমারত উঠছে।

পরিবর্তে ওরা চাইছে শুধু সেই আটশো বছরের পুরোনো সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ, যা দিয়ে ওরা প্রবেশ করতে পারবে তাজমহলের একদম গভীরে।

কিন্তু তারপর? প্রবেশ করে কী করবে ওরা? এই একটা প্রশ্নে এসে কস্তুরীর মতো ও-ও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে।

এই যে গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি আর আগ্রায় সবার অলক্ষ্যে ওরা একটা জাল বিস্তার করে চলেছে, সেই নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্যটা কী?

আগ্রা কর্পোরেশন থেকে ওকে মেহতাববাগের পাশের এই পরিত্যক্ত জঙ্গল পরিষ্কার করার একশো দিনের কাজের শ্রমিকদের সুপারভাইজার করে পাঠানো থেকে নাগেশ সিং-এর মেয়েকে কিডন্যাপ করা, সবই হয়ে চলেছে ওদের নির্দেশে, এতটাই ক্ষমতার পরিধি ওদের।

অথচ আজও ওয়াসিম ছাড়া তেমন কাউকেই কবীর তেমন চিনল না। তাও ওয়াসিম নেহাতই এজেন্ট, সেটা বোঝাই যায়।

যাই হোক, ওর নিজের টাকা পাওয়া নিয়ে কথা। ও চাদরটাকে ভালো করে গায়ে জড়াল, এবার ভোর হবে ধীরে ধীরে। অনেক অঙ্ক, অনেক ম্যাপিং করে ও মোটামুটি নিশ্চিত এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই সুড়ঙ্গ। ইতিমধ্যেই একশো দিনের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের দিয়ে পুরো জায়গাটা খুঁড়ে ফেলেছে। তাতে বেরিয়েছে প্রায় বারো তেরোটা সুড়ঙ্গের মুখ। তাতে ও আশ্চর্য হয়নি। তাজমহলের ঠিক এই পারে অজস্র সুড়ঙ্গ খুঁড়ে যে শত্রুপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার যে কৌশল করা হয়েছে, সেটা ও আগেই বুঝেছিল। প্রতিটা সুড়ঙ্গকে চিহ্নিত করার কাজও শেষ।

কিন্তু এই সুড়ঙ্গগুলোর প্রায় সবকটাই মাঝপথে গিয়ে নদীগর্ভে শেষ হয়ে গেছে।

শেষ হয়নি শুধু একটা, সেই সুড়ঙ্গটা নদী পেরিয়ে পৌঁছেছে তাজমহলের মাটির তলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *