২৮
‘হ্যাঁ, ঔরঙ্গজেবের চিঠি দুটো আমি দেখেছি। একটা অত বড়ো স্থাপত্য প্রতি বছর মেরামতির প্রয়োজন তো হতেই পারে।’ ড মাথুর ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর দিলেন।
রুদ্র ভিতরের ঘরে এসে ফোনে কথা বলছিল, ‘কিন্তু স্যার, ওই বটেশ্বর শিলালিপি?’
‘বটেশ্বর শিলালিপি থেকে এটা কোনো- ভাবেই প্রমাণ হয় না যে ওই দুটোই ইতমদ-উদ-দৌলার কবর আর তাজমহল। দ্যাখো রুদ্রাণী, তোমাকে একটা কথা বলি। আজ যেখানে তাজমহল, এক হাজার বছর আগে সেখানে হয়তো ছিল কোনো উপাসনাগৃহ, তারও কয়েক লক্ষ বছর আগে সেখানে হয়তো চরে বেড়াত ডাইনোসরের দল। তাতে কিছু যায় আসে কি?’
রুদ্র মাথা নাড়ল। ভদ্রলোক ঠিকই বলছেন। ফোনটা রাখার আগে মৃদুকণ্ঠে ও বলল, ‘আমি মাঝে মাঝে আপনাকে বিরক্ত করতে পারি স্যার! প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
ঘড়িতে রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। বাইরে গোটা আগ্রা শহর ঘুমোচ্ছে, তবু রুদ্রর এই ছোটো ফ্ল্যাটে আজ এতগুলো মানুষ জেগে বসে আছে। একটু আগেই ভগতবীর সিং অঘোরেশকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে তিনজন কনস্টেবল অপেক্ষা করছিল, তারাও সঙ্গে গেল। অঘোরেশের সেই ঝোলা ইতিমধ্যেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
রুদ্রর কেমন যেন মনে হচ্ছিল, অঘোরেশের ওপর আবার হামলা হতে পারে। কেউ বা কারা অজানা কোনো স্বার্থের কারণে অঘোরেশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। তাই অঘোরেশের নিরাপত্তার জন্য পুলিশি পাহারার থেকে ভালো আর কিছুই হয় না।
পূরবী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, মাঝে এসে একটা বড়ো ফ্লাস্কে কফি করে রেখে গেলেন।
মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও পুলিশের সামনে মা আর কিছু বলতে পারছেন না, রুদ্র দিব্যি বুঝতে পারছিল। ও ডাইনিং রুমে এসে বসল।
নাহুম খান বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু তাজমহল শাজাহান বানিয়েছিলেন না সাড়ে আটশো বছর আগের সেই হিন্দু রাজা, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার কনসার্ন হল কাল সকাল বেলা তাজমহলের সিকিউরিটি এনশিয়োর করা। আর আমি সেটাই করব। পুরো তাজমহলের চারপাশ টাইট সিকিউরিটিতে মুড়ে ফেলব, যাতে একটা মাছিও না গলতে পারে, অঘোরেশের দলবল তো কোন ছার! এমনিতেই এখনও অবধি গুল মহম্মদের খুনের ব্যাপারে আমরা কিছু ক্লু পাইনি, এম এল এ ওয়াইসির দল খচে আছে, কাল যদি পোস্টারের কথা সত্যি হয়, আর দেখতে হবে না। তার ওপর দেখলেন তো, একটু আগেই ফোন এল, দিল্লির সাংসদ নাগেশ সিং-এর মেয়ে কিডন্যাপড, র্যানসমের জন্য রিজেন্ট সিনেমার সামনে যেতে হবে কাল। শালা…!’ নাহুম খানকে উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল, ‘দুনিয়ার সব ক্রিমিনালই কি হঠাৎ আগ্রায় এসে হাজির হয়েছে? আমার পেছনে বাঁশ দিতে?’
‘নাগেশ সিং কে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘রুলিং পার্টির এম পি, তার ওপর দিল্লির বিরাট বিজনেসম্যান। জয়পুরের রয়াল ফ্যামিলির ছেলে, রিসেন্টলি শান্তিচুক্তির ওপর অনেক কাজ করছেন, সাতাশ তারিখ আগ্রায় শান্তি সম্মেলন আছে দেখেননি? উনিই তো প্রধান আয়োজক।’
‘ওহ! হ্যাঁ হ্যাঁ।’ রুদ্র বলল। গত কয়েকদিন ধরে অফিস আসা যাওয়ার পথে দেখেছে বটে মস্ত মস্ত হোর্ডিং, অনেকগুলো দেশের নেতা আসছেন। ‘কী হবে যেন ওই সম্মেলনে?’
নাহুম খান উত্তর দিলেন, ‘অনেক জোড়া প্রতিবেশী দেশ, যারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধকলহ করেই চলেছে, তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি করানো হবে। নাগেশ সিং-এর প্রধান উদ্দেশ্য বেআইনি অস্ত্র পাচারকে নিয়ন্ত্রণ করা। এতগুলো দেশের মধ্যে ঝামেলা মিটে গেলে সেটা অনেকটাই কন্ট্রোল করা যাবে বলে আশা করা যায়।’
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে কী যেন ভাবছিল, ‘একটা কথা। আপনারা যখন সন্ধেবেলা অঘোরেশের বাড়িতে গেলেন, তখন কী দেখলেন? জিনিসপত্র সব পরিপাটি?’
‘পুরো বাড়িটাই তো অগোছালো।’ নাহুম খান হাত নাড়লেন, ‘ঢুকে আর্মসের বস্তাটা পাওয়ার পরেই আপনি ফোন করলেন। সেটা সিজ করে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’
রুদ্র বলল, ‘দেখুন, আপনারা পুলিশের লোক। দু-জনেই এফিশিয়েন্ট অফিসার, সেখানে আমি একজন সাধারণ মানুষ, অফিসের তালেগোলে এবং বাবার পুরোনো বন্ধুত্বের সূত্রে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছি মাত্র। কিন্তু আমার যে ক-টা ব্যাপার নজরে পড়েছে, সেগুলো আপনাদের বলছি। তারপর আপনারা ডিসিশন নিন।’
‘সাধারণ মানুষ বলবেন না। জার্মানির চ্যান্সেলরের সঙ্গে ছবি তো আপনার এমনি এমনি নেই ম্যাডাম!’ ভগতবীর সিং হাসলেন।
‘ওসব ছাড়ুন। পুরো ব্যাপারটা আমি একবার সাজিয়ে নিচ্ছি, কেমন?’ রুদ্র টেবিলে রাখা লেটারপ্যাড থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে নিল, তাতে খসখস করে লিখতে লাগল,
১। অঘোরেশ ভাট আর নিজামুদ্দিন বেগ, দু-জনেই ইতিহাসের প্রফেসর, দু-জনের গবেষণার বিষয়ই ছিল এক- তাজমহল আদলে ১১৫৫ সালে বানানো এক হিন্দু শিব মন্দির। কে বানিয়েছিলেন? না, চান্দেলা বংশের রাজা পরমাদ্রিদেব। অঘোরেশ নিজে ব্যক্তিগত কারণে প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী, সম্ভবত স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগি, বহু বছর আগে মৃত স্ত্রীকে এখনও জীবিত মনে করেন। কতটা সত্যি বলছেন, কতটা মিথ্যা, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
২। নিজামুদ্দিন বেগের কিছু অজানা সোর্স ছিল, যেখান থেকে উনি বিভিন্ন পুরোনো পুথিপত্র, শিলালিপি-টিপি পেতেন, যার অনেকগুলোই অসৎ উপায়ে। এক মাস আগে নিজামুদ্দিন সর্বভারতীয় এক সংবাদপত্রে তাঁর গবেষণার তথ্য তুলে ধরতে থাকেন এই আশায় যে তা পড়ে জনসাধারণের মধ্যে কৌতূহল জেগে উঠবে, ভারত সরকারকে এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাপ দেবে, কিন্তু ফল হয় ঠিক উলটো। মানুষের মধ্যে তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়, সংবাদপত্রের এডিটর বাধ্য হয়ে মাঝপথে নিজামুদ্দিনের ধারাবাহিক কলাম বন্ধ করে দেন।
৩। হতাশ নিজামুদ্দিন তখন অঘোরেশকে বলেন দু-জনের রিসার্চ একসঙ্গে মিশিয়ে বিদেশি কোনো জার্নালে পাঠাতে, তা ছাড়া বিদেশি যে সংস্থা নিজামুদ্দিনের রিসার্চ ফান্ডিং করছে, তাদের সঙ্গে অঘোরেশের যোগাযোগ করিয়ে দেন।
এই পর্যন্ত লিখে রুদ্র থামল, ‘অঘোরেশ কিন্তু এই ব্যাপারে তেমন কোনো ডিটেইলস আমাদের এখনও বলেননি।’
নাহুম খান মনোযোগ দিয়ে রুদ্রর লেখা দেখছিলেন, বললেন, ‘আপনি আগে পুরোটা লিখুন, যেমন লিখছিলেন?’
রুদ্র আবার লিখতে লাগল,
৪। অঘোরেশকে নিজামুদ্দিন লন্ডনের উইন্ডসর ক্যাসলের রয়াল লাইব্রেরি থেকে খোয়া যাওয়া শাজাহানের বাদশাহনামা-র অরিজিন্যাল পাণ্ডুলিপিটা রাখতে দেন। আর অদ্ভুতভাবে ঠিক তার পরেই নিজামুদ্দিন বেগ নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
৫। অঘোরেশকে বলা হয় লখনৌ আসতে, লখনৌয়ের নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে অঘোরেশ হাতে পান লখনৌ মিউজিয়ামে রাখা বটেশ্বর শিলালিপির কিছু ফোটোগ্রাফ, যাতে বলা আছে ১১৫৫ সালে সম্রাট পরমাদ্রিদেবের নির্মাণ করা দুটি মন্দিরের কথা।
৬। ইতিমধ্যে অঘোরেশ ভাটের অ্যাকাউন্টে দেড় কোটি টাকা অজানা কোনো সোর্স থেকে ঢোকে, যেটা ব্যাখ্যা অঘোরেশ এখনও দিতে পারেননি।
৭। ২৪ জানুয়ারি পুলিশের দপ্তরে কোনো এক উড়ো ফোন যায়, অঘোরেশ এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, এবং অত বিপুল টাকা বিদেশি সোর্স থেকে নিয়ে সে নাকি তাজমহল ওড়ানোর প্ল্যান করছে।
৮। এদিকে সারা আগ্রা শহরে ২৫ জানুয়ারি সকালে একটা পোস্টার ছেয়ে যায়, যাতে বলা আছে কেউ বা কারা ২৬ জানুয়ারি সকাল বেলা প্রমাণ করে দেবে যে সত্যিই তাজমহল ছিল এক হিন্দু মন্দির।
৯। ওইদিনই ভোরে মুসলিমপন্থী এক বিধায়কের ঘনিষ্ঠ নেতা খুন হয়। সেই নেতা নিজামুদ্দিন বেগের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল দলবল নিয়ে।
১০। ২৫ জানুয়ারি রাতে অঘোরেশের বাড়িতে এক বস্তা আর্মস পাওয়া যায়, যাতে রয়েছে কয়েকশো কাট্টা পিস্তল আর বেশ কিছু গ্রেনেড।
এই পর্যন্ত লিখে রুদ্র থামল। বলল, ‘মোটামুটি এই হল পুরো ঘটনাপঞ্জি।’
‘না। আরও আছে।’ প্রিয়ম বলল।
প্রিয়ম যে এতক্ষণ জেগে ছিল রুদ্র তা খেয়ালই করেনি। টানা এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছে, ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু না, ওদিকে সুরঞ্জন সোফায় বসে মৃদু স্বরে নাক ডাকছেন, কিন্তু প্রিয়ম মোবাইলে মগ্ন।
রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘আর কী?’
প্রিয়ম বলল, ‘দিল্লির সাংসদ নাগেশ সিংহের মেয়েকে ২৫ জানুয়ারি দুপুরে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’ মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই ও বলল।
রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘আরে না না, ওটার সঙ্গে এই ঘটনার কী সম্পর্ক? শুধু দিল্লি কেন, ওরকম তো ভারতের কত জায়গাতেই ঘটছে, তার সঙ্গে এই ঘটনার তো কোনো যোগসূত্র নেই।’
‘থাকতেই পারে যোগসূত্র।’ প্রিয়ম বলল, ‘দ্যাখো ইন্টারনেট কী বলছে। শাজাহান যে রাজা জয়সিংহের প্রাসাদ অধিগ্রহণ করে তাজমহলে পরিণত করেছিলেন বলে অঘোরেশ ক্রমাগত দাবি করে চলেছিলেন, সেই জয়সিংহের বংশধর হলেন এই নাগেশ সিং।’
‘এটা কাকতালীয় ব্যাপার, প্রিয়ম!’ রুদ্র কিন্তু কিন্তু করে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নাহুম খান বললেন, ‘নাগেশ সিংহের ওই সম্মেলনের অতিথিরাও কালই তাজমহলে আসবেন।’
‘না, আরও একটা লিঙ্ক আছে।’ প্রিয়ম বলল, ‘ড নিজামুদ্দিন বেগের কলাম নিয়ে যখন ক্যাবিনেটে ঝড় উঠেছিল, তখন এই নাগেশ সিংহই প্রকাশ্যে নিজামুদ্দিনকে সমর্থন করেছিলেন, মিডিয়ায় বলেছিলেন সরকারের উচিত অবিলম্বে তদন্ত শুরু করা। এই নিয়ে পার্টি ওঁকে পরে তিরস্কারও করে।’
‘অদ্ভুত!’ রুদ্র নিজের মনেই বলল, ‘এমন কি হতে পারে যে কেউ ইচ্ছে করে অঘোরেশকে ফাঁসানোর প্ল্যান করছে?’
‘কেন? অঘোরেশকে ফাঁসিয়ে কার কী লাভ?’ নাহুম খান বললেন, ‘বলছি আচ্ছা করে ধোলাই দিই…!’
‘লাভ এটাই যে অঘোরেশের দিকে পুলিশের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া।’ রুদ্র বিড়বিড় করল।