অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১

এক মাস পর …

২৪ জানুয়ারি, ২০১৮

একটা নাতিদীর্ঘ অফিশিয়াল চিঠি, যার ছত্রে ছত্রে বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং তথ্য তুলে বক্তব্য পেশ, সবশেষে অভিযোগ এবং অনুসিদ্ধান্ত।

রুদ্রাণীর অত কিছু চোখে পড়ল না, শুধু চিঠির একদম নীচে মোটা হরফে লেখা বাক্যটাই ওর মাথায় বনবন করে ঘুরতে লাগল।

You are hereby temporarily suspended from duties and ordered to submit your explanation within 3 days from the receipt of this letter, pending investigation against the alleged corruption. Your ongoing suspension will be kept under review.

কপালের দু-পাশের রগ দুটো দপদপ করছিল, রুদ্রাণী প্রাণপণে সেই জায়গা দুটো টিপে ধরে চোখটা বন্ধ করল।

কেবিনের কাচের জানলার ওপাশে রক্তিম হয়ে ওঠা সূর্য তখন তার অস্তগামী ম্রিয়মাণ আভা মলিনাকারে বিতরণ করে চলেছে। দূরের মসজিদ থেকে গোধূলি সন্ধ্যার ‘আল্লা হো আকবর’ আজান ভেসে আসছে ধীর লয়ে।

সেই আজানের করুণ সুর যেন এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে রুদ্রকেও।

এই শহরের বেশিরভাগ অংশই এই অত্যাধুনিক একবিংশ শতকেও যেন সেই মুঘল আমলেই পড়ে রয়েছে। রাস্তাঘাটের গজিয়ে ওঠা সুপারমার্কেট, শপিং মলের মাঝেও কোথায় যেন মধ্যযুগের একটা সূক্ষ্ম সুতো গোটা শহরটাকে বেঁধে রেখেছে।

ঘরের পুরোনা ঘড়িটায় ঢং ঢং করে ছ-টা বাজল। সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ বলে সাবস্টাফটা চা-বিস্কুট নিয়ে পর্দা সরিয়ে কেবিনে ঢুকল, ‘ম্যাডামজি, চায়ে।’

রুদ্র ক্লান্ত চোখে তখনও চিঠিটায় চোখ বোলাচ্ছিল, আলতোভাবে পেন বোলাচ্ছিল বাক্যগুলোর ওপর।

চিঠিটা এসেছে দিল্লির হেড অফিস থেকে, তারিখ আজকের। হিসেবমতো দিল্লি থেকে এখানে স্পিড পোস্টে আসতে কমপক্ষে একদিন লাগার কথা, কিন্তু গুরুত্ব অনুধাবন করে হেড অফিসের সাবস্টাফকে দিয়ে হাতে হাতে পাঠানো হয়েছে এই চিঠি।

যে ঘটনার জন্য রুদ্রর বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছে, তা গতকালের। একদিনের মধ্যেই হেড অফিস ব্যাপারটা ট্র্যাক করে রুদ্রর এগেইনস্টে ইনভেস্টিগেশনও চালু করে দিল?

এত তৎপর কবে থেকে হল হায়ার ম্যানেজমেন্ট?

রুদ্র একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে কম্পিউটারে সেই কাস্টমারের অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস খুলল। সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্ট। গড় ব্যালেন্স থাকে হাজার তিরিশেক মতো।

কাস্টমারের পেশা?

রুদ্র চোখ সরু করে খুঁজতে লাগল ব্যাঙ্কের ডেটাবেসে, হাজার হাজার তথ্য কিলবিল করছে সেখানে।

ভদ্রলোকের বয়স আটান্ন, বাড়ি দয়ালবাগ। পেশা অধ্যাপনা। কোন কলেজে?

নাহ! সেটা লেখা নেই।

রুদ্র গভীরভাবে গত তিনদিনের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে হওয়া সমস্ত ট্রানজ্যাকশন খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। সাধারণত বাইরে থেকে কোনো টাকা এলে যে পাঠাচ্ছে, তার নাম দেওয়া থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে গত দু-দিনের ট্রানজ্যাকশনের ডিটেইলসে প্রেরকের কোনো তথ্য নেই। কিছু অর্থহীন অক্ষর রয়েছে, বিদেশের বেনামি অ্যাকাউন্ট থেকে নানা সোর্স পালটে টাকা পাঠালে যেমন হয়।

সুরেশ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এবার ইতস্তত করতে শুরু করল। ম্যাডামকে বলে না গেলে চা টেবিলে থেকে থেকেই ঠান্ডা জল হয়ে যাবে।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে আবার মিনমিন করল, ‘ম্যাডামজি, আপকি চায়ে।’

রুদ্র চমকে উঠে একহাতে চায়ের কাপটা সুরেশের হাত থেকে নিল, অন্য হাতে গোটা ট্রানজ্যাকশন স্টেটমেন্টটা প্রিন্ট করতে দিয়ে হিন্দিতে বলল, ‘সুরেশ, অমিতকে একবার ডেকে দাও তো!’

মিনিট দুয়েক পরে অমিত পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল। কাস্টমার ডিলিং চারটের পরই শেষ, এখন ব্যাঙ্কের ইন্টারনাল কাজের সময়। সারাদিনের কাজের শেষে অমিতের চোখ-মুখ বিধ্বস্ত, চুল উশকোখুশকো, ইন করা শার্ট এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়েছে, ‘বলুন, ম্যাডাম।’

রুদ্র ইঙ্গিতে অমিতকে বসতে বলে চিঠিটা ওর দিকে এগিয়ে দিল। এই ব্রাঞ্চে রুদ্র ম্যানেজার হয়ে এসেছে প্রায় বছরখানেক, ছোটো ব্রাঞ্চ হলেও বিজনেস এখানে বেশ ভালো। চারজন ক্লার্ক আর একজন অফিসার নিয়ে রুদ্রর সংসার। বাড়ি থেকে এতদূরে এসে একটা গোটা ব্রাঞ্চের হাল ধরা খুব সহজ কথা নয়, যদি না অমিতের মতো তরুণ দক্ষ একজন অফিসারকে রুদ্র জুনিয়র হিসেবে পেত। এখানকার কোন বিজনেসম্যান কতটা বিশ্বাসী, কাকে লোন দিলে সেটা নন পারফর্মিং অ্যাসেট অর্থাৎ অনাদায়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, কোথায় ক্যাম্পেন করলে টার্গেট অ্যাচিভ করা যাবে চটজলদি, সবেতেই অমিত প্রকৃত পরামর্শদাতার কাজ করে থাকে।

অমিত পড়তে পড়তে চমকে উঠল, ‘সাসপেনশন অর্ডার! আপনার?’ পুরোটা পড়ে ওর চোখ প্রায় কপালে উঠে গেছে, ‘এসব কী, ম্যাডাম! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

রুদ্র অলসভাবে ঘাড়ের পেছনে হাত দুটো রেখে চেয়ারে এলিয়ে দিল গোটা শরীরটা, ‘পরশু রাত থেকে এই ব্রাঞ্চের একটা সেভিংস অ্যাকাউন্টে অজানা কোনো সোর্স থেকে মোট দেড় কোটি টাকা ঢুকেছে। একবারে নয়, খেপে খেপে। প্রায় তিনশোটা ট্রানজ্যাকশন। ঢুকেছে গতকাল ভোর পর্যন্ত। সোর্সও স্পষ্ট নয়।’ প্রিন্ট আউটটা ও সামনের দিকে এগিয়ে দিল।

অমিত স্টেটমেন্টটা দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলল, ‘এত টাকা!’

‘ইয়েস!’ রুদ্র চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল, ‘হেড অফিসের বক্তব্য, কেন আমি ইমিডিয়েটলি ভিডিল্যান্সে জানাইনি।’

‘কিন্তু একটা ব্রাঞ্চে কয়েক হাজার অ্যাকাউন্ট। কোন অ্যাকাউন্টে কখন কী টাকা ঢুকছে, সেটা ব্রাঞ্চ হেড কী করে জানবে?’ অমিতের গলায় বিস্ময়।

‘অমিত! আর দু-তিন বছরের মধ্যে তুমিও ব্রাঞ্চ হেড হবে, এইরকম প্রশ্ন তোমার থেকে এক্সপেক্টেড নয়।’ রুদ্রর গলায় এই অবস্থাতেও মৃদু তিরস্কার ঝরে পড়ল, ‘প্রতিদিন সন্ধেবেলায় সব ব্রাঞ্চে একটা এক্সেপশন রিপোর্ট জেনারেট করতে হয়। এইরকম কোনো সন্দেহজনক অ্যাক্টিভিটি হলে সেই রিপোর্টেই সেটা ধরা পড়ে।’

‘তা, কালকের রিপোর্টটাতে এটা ছিল না, ম্যাডাম?’

রুদ্র একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি তো কাল ছুটি নিয়েছিলে, ব্রাঞ্চে চাপ ছিল। তারপর একটা লোনের ইনস্পেকশনে চলে গিয়েছিলাম বিকেলে দেরি হয়েছিল, ওখান থেকে বাড়ি চলে গেছিলাম। রিপোর্ট বের করার কথা মনে ছিল না।’

অমিত বলল, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে-খবর হেড অফিসে পৌঁছোল কীভাবে? মানে, এগুলো তো যখন ব্রাঞ্চে অডিট করতে আসে, তখন ধরা পড়ে।’

‘সেটাই আমিও ভাবছি।’ রুদ্র বলল।

‘দাঁড়ান, আপনি প্রথমেই টেনশন করবেন না। দিল্লিতে হেড অফিসে আমার কিছু চেনাজানা আছে, আমি তাদের আগে ফোন করে দেখি কিছু জানা যায় কি না।’ অমিত ওর মোবাইলে খুটখাট করতে লাগল।

টেনশনের আর কী, রুদ্র মনে মনে ভাবল। ওর ভাগ্যটাই এই! যখনই কোনো আনন্দের সম্ভাব্য মুহূর্ত এগিয়ে আসতে থাকে, ঠিক সেই সময় পরিষ্কার নির্মেঘ আকাশে অনাহূত ঝঞ্ঝার মতো দেখা দেয় কালো কালবৈশাখী। যদিও নিয়তিতে ওর বিশ্বাস নেই বিন্দুমাত্র, তবু প্রতিবার ওর সঙ্গেই এমন হয় কেন?

আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে ভেবেছিল। বাড়িতে গিয়ে ঘরদোর গোছানোর আছে। আগ্রা শহরে ও ট্রান্সফার হয়ে এসেছে প্রায় বছর ঘুরতে চলল। এই প্রথম বাবা মা ওর কাছে আসছেন। কাল সকাল বেলায় আগ্রা পৌঁছোবেন ওঁরা। এই সপ্তাহে প্রজাতন্ত্র দিবস আর শনি রবিবারের সঙ্গে এদিক-ওদিক ছুটি নিয়ে বেশ এক সপ্তাহের ছুটি প্ল্যান করে রেখেছিল রুদ্র।

আর আজ এত বড়ো বিপর্যয়!

অমিত দু-তিনজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলল। কথোপকথনের সঙ্গে সঙ্গে ওর কপালের ভাঁজ দুটো আরও চওড়া হচ্ছিল। অবশেষে ফোন রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, এটা নাকি আগ্রা পুলিশ কমিশনারেটের অফিস থেকে ফোন যাওয়ার পর হেড অফিস ট্রেস করেছে।’

‘পুলিশ কমিশনারেট? কেন?’ রুদ্র কথাটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলেন দু-জন সাফারি পরা ভদ্রলোক, ‘আগ্রা পুলিশ থেকে আসছি। আপনিই ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তো?’

রুদ্র মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিল, তারপর মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, ‘হ্যাঁ, আসুন।’

আড়চোখে ও সেই কাস্টমারের নামটা একবার দেখে নিল।

অঘোরেশ ভাট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *