১০
ভোরের দিকে হঠাৎ মোবাইলের আওয়াজে রুদ্রর ঘুমটা ভেঙে গেল। এমনিতে রাতে শোয়ার আগে রুদ্র নিয়ম করে কিছুক্ষণ প্রিয়মের সঙ্গে কথা বলে। ওর এখানে রাত এগারোটা হলে লন্ডনে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। প্রিয়ম তখন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার বাসে থাকে। প্রিয়মের সঙ্গে কথা হয়ে গেলে রুদ্র ফোনটাকে সাইলেন্ট করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কাল সন্ধে থেকে যে ঝড়ঝাপটা ওর ওপরে আকস্মিক শুরু হয়েছে, ফোনটাকে সাইলেন্ট করার কথা মনেই ছিল না। তা ছাড়া কাল রাতে প্রিয়মকে ফোন করেও কিছুতেই লাইন পায়নি।
তার ওপর, দমদম থেকে প্লেনে ওঠার আগে মা একবার ফোন করেছিলেন। সেও প্রায় ঘণ্টাখানেক হতে চলল। তখন প্রায় রাত হলে কী হবে, মায়ের গলার আওয়াজেই ও বুঝতে পারছিল মা কতটা আনন্দে রয়েছেন এতদিন পরে ওকে দেখবেন বলে। চেষ্টা করেও তাই এত বড়ো দুঃসংবাদটা ও আর তখন বলতে পারেনি। টুকটাক কথা বলে আবার শুয়ে পড়েছিল।
ফলত, এখন রিং-এর আওয়াজে ও ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। বিছানার পাশেই রাখা ছোটো টেবিল থেকে ঘুমচোখে ফোনটা নিয়ে কানে দিল, ‘হ্যালো!’
টেবিলের অ্যালার্ম ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা।
ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি গলা ভেসে এল, ‘আপনার দেওয়া সমস্ত ডকুমেন্ট খুঁটিয়ে দেখলাম, কিন্তু যে ঠিকানা আপনাদের ব্যাঙ্কে দেওয়া আছে, সেই ঠিকানায় অঘোরেশ ভাট নামে এখন কেউ থাকেন না।’
রুদ্র চোখটা ডলে ঘুমটা জোর করে তাড়াবার চেষ্টা করল, উঠতে চাওয়া হাইটাকে চাপতে চাপতে বলল, ‘ইনস্পেকটর খান! এত সকালে! কী ব্যাপার!’
নাহুম খান বলে চললেন, ‘ভদ্রলোক আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন, বছর পাঁচেক ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, পরে নিজের বাড়িতে উঠে যান। এর বেশি বাড়িওয়ালাও কিছু বলতে পারল না।’
রুদ্র বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল মনে মনে, আবার একটা হাই তুলে বলল, ‘দেখুন আমি আমাদের কাছে যা যা ছিল সবই আপনাকে দিয়েছি। পেশা প্রফেসর লেখা চিল। আপাতত এখানকার সব কলেজগুলো দেখতে পারতেন তো!’
‘দেখেছি। কলেজ নয়, ভদ্রলোক আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে চাকরিটাও হঠাৎ ছেড়ে দেন।’
রুদ্র চুপ করে রইল এবার। ও একে মরছে নিজের জ্বালায়, বাবা মা আজ আসছেন, তাঁদের নিয়ে ঘুরতে বেরোবে, না, যুক্তি সাজিয়ে অফিসের চিঠির উত্তর দেবে সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। তার ওপর পুলিশ কীভাবে একটা লোককে ট্রেস করবে তা নিয়ে ওকে ভোররাতে ফোন করছে কেন সেটা ওর বোধগম্য হল না।
নাহুম খান আবার বললেন, ‘তবে আরেকটা ক্লু পেয়েছি, সেইজন্যই আপনাকে ফোন করা।’
রুদ্র কিছু না বলে চুপ করে রইল।
‘আপনার কাছে ব্রাঞ্চের চাবি আছে নিশ্চয়ই?’
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকোল, সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে পড়ল, কাল অমিতকে ব্রাঞ্চের চাবিটা হ্যান্ডওভার করে দিয়ে আসতে ও একদম ভুলে গেছে, নিয়মমতো সাসপেনশনে থাকা ম্যানেজার চাবি নিজের হেফাজতে রাখতে পারে না।
ও বলল, ‘হ্যাঁ, আছে। কাল দিয়ে আসতে ভুলে গেছি। কিন্তু চাবি দিয়ে কী হবে? আমি সাসপেনশনে আছি, গিয়ে এভাবে একা ব্রাঞ্চ খুলতে পারি না এখন।’
‘আপনি পুলিশ অর্ডারে করবেন।’ নাহুম খান বললেন, ‘আপনার বাড়ির ঠিকানাটা বলুন, আমরা তুলে নিচ্ছি আপনাকে। টেনশন করবেন না, আমরা সিভিল ড্রেসেই যাচ্ছি, এই ধরুন আটটার মধ্যে। আসলে ব্যাপারটা এতটাই ক্রিটিক্যাল আর আর্জেন্ট…!’
ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রুদ্রর কপালটা দপদপ করছিল, বিরসকণ্ঠে ও বলল, ‘কিন্তু আমি তো বেরিয়ে যাব স্টেশনে, আমার বাবা মা আসছেন আজ, রিসিভ করতে যেতে হবে।’
ওপাশে রুদ্রর কথাটা আদৌ পাত্তা দেওয়া হল কি না কে জানে, কেজো গলায় শোনা গেল, ‘কোনো কাস্টমার ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি কিনলে বা তৈরি করলে সেটার কিছু ডিটেইলস তো ব্যাঙ্কের কাছে থাকে?’
এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে রুদ্র খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, থাকে তো অবশ্যই। কত টাকা লোন, কতগুলো কিস্তিতে শোধ হবে, সব ডিটেইলসই থাকে।’
‘আর?’ নাহুম খানের গলাটা যেন উদগ্রীব শোনাল, ‘আর কী থাকে?’
রুদ্র কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘বাড়ির লোন হলে সেক্ষেত্রে সেই বাড়ির দলিল ব্যাঙ্কের কাছে জমা থাকে যতদিন না পুরো টাকা শোধ হয়।’
‘আর লোনটা শোধ হয়ে গেলে ওই দলিল আর ব্যাঙ্কের কাছে থাকে না?’
‘না, তখন কাস্টমারের দলিলের অরিজিন্যালটা ফেরত দিয়ে দিতে হয়। তবে, কপি থাকে ব্যাঙ্কের কাছে।’
নাহুম খান বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ব্যাপারটাই জানতে চাইছিলাম। আপনি অঘোরেশ ভাটের যে ডকুমেন্টগুলো আমাকে দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা বহু পুরোনো লোনের ফাইল আছে, যাতে লেখা আছে ভদ্রলোক প্রায় কুড়ি বছর আগে আপনাদের ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি তৈরির জন্য লোন নিয়েছিলেন। সেই লোন যদিও চুকেবুকে গেছে, কিন্তু সেই বাড়ির দলিলের ফটোকপি যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে তো সেখানে ওই নতুন বাড়ির ঠিকানাটা থাকবে, তাই না?
.
নাহুম খান সাড়ে আটটা নাগাদ এলেন। সঙ্গে কালকের ভদ্রলোক নেই, শুধু আরেকজন অপেক্ষাকৃত তরুণ অফিসার, তাঁর মাথায় পাগড়ি, এই কুয়াশাঘেরা সকালেও চোখে কালো সানগ্লাস। নাহুম খান আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির অফিসার ভগতবীর সিং। আজই এসেছেন দিল্লি থেকে।’
ভগতবীর সিং হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য, হেসে বললেন, ‘আপনার ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্ট আছে ম্যাডাম। কলেজে পড়ার সময় টিউশনির টাকা জমাতাম ওটায়।’
রুদ্র হাসল, বলল, ‘আপনারা একটু বসুন, আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।’
নাহুম খানকে দেখেই বোঝা যায়, সারারাত তিনি ঘুমোননি, চুল উশকোখুশকো, চোখ লালচে হয়ে রয়েছে, ক্লান্তির ছাপ সারা দেহে স্পষ্ট, ‘হ্যাঁ, শিয়োর। আমরা ওয়েট করছি।’
রুদ্র ভেতরের ঘরে রেডি হচ্ছিল। আজকের কুয়াশা দেখে মনে হচ্ছে কনকনে হাওয়া চালাবে সারাদিন, লন্ডন থেকে কেনা লেদারের জ্যাকেটটা গায়ে চাপাল ও। প্রথমে ভেবেছিল একাই ওঁদের সঙ্গে গিয়ে ব্যাঙ্ক খুলে ওই দলিল বের করবে, তারপর মত পালটাল। সাসপেনশনে থাকার সময় এভাবে একা যাওয়াটা কেউ জানতে পারলে ও আরও বেশি ফেঁসে যেতে পারে। কাউকে না জানিয়ে কেন ও এভাবে গিয়ে ব্যাঙ্ক খুলেছে, সে-ব্যাপারে ওকে আবার শো-কজ করা হতে পারে। কী দরকার এর মধ্যে আবার জটিলতা বাড়িয়ে? তা ছাড়া একটা মর্টগেজ থাকা দলিল ছিল সেটা, লিখিত নথি ছাড়া তার কপি এভাবে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াও যায় না, সেক্ষেত্রেও ওর অনুপস্থিতিতে অমিতের পারমিশন দরকার। তাই ও অমিতকে ফোন করে ব্যাঙ্কের সামনে অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছে আগেই।
ওর মনটা এমনিতেও ভালো লাগছিল না। কাল দুপুরে পর থেকে প্রিয়মের সঙ্গে কথা হয়নি। গতকাল রাতেও ফোনে পায়নি, এখনও কিছুক্ষণ অন্তরই চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু কিছুতেই কানেক্ট হচ্ছে না। একেই হাজার হাজার মাইল দূরে থাকে ওর বরটা, তার ওপর ফোনে না পেলে চিন্তা হয় না? স্কাইপ, ফেসবুকের মতো সবরকম সোশ্যাল মিডিয়াতেও চেষ্টা করেছে, কোথাওই প্রিয়ম উপস্থিত নেই। শরীর-টরীর খারাপ হল নাকি? দেখবে একবার ওর অফিসে ফোন করে? পরক্ষণেই মনে পড়ল এখন তো ওখানে গভীর রাত। বিকেলের দিকে অফিসে একবার ফোন করতে হবে।
আজ এত বেলাতেও কুয়াশা বেশ ঘন হয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে, এখানে বেশিরভাগ দোকানই এখনও তেমনভাবে খোলেনি। বালুগঞ্জ বাজার পেরিয়ে ওদের গাড়ি সদরবাজারে পড়তেই সিগনালে আটকে গেল। তখনই রুদ্রর চোখে পড়ল রাস্তার পাশের ফুটপাথের রেলিং-এ সার দিয়ে আটকানো রয়েছে শয়ে শয়ে পোস্টার। কী লেখা আছে, এতদূর থেকে সেটা চোখে না পড়লেও মোটা কালির ছাপা বলে পোস্টারগুলোকে একটু অন্যরকম লাগছে। হাওয়ায় সেগুলো পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে।
রুদ্র লক্ষ করল, পথচলতি মানুষ ধীরে ধীরে আগ্রহী হচ্ছে, দু-একজন দাঁড়াচ্ছে, লেখাটা পড়ছে, আবার নিজেদের মধ্যে সামান্য আলোচনাও করছে।
রুদ্র ঝুঁকে দেখতে গেল কিন্তু সিগনাল সবুজ হতে ওদের গাড়িটা চলতে শুরু করল।
নাহুম খান বললেন, ‘আপনি কি একাই থাকেন? বাড়ি কোথায় আপনার?’
‘হ্যাঁ।’ রুদ্র বলল, ‘কলকাতায় বাড়ি। এখন এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছি।’
‘বাঙালি? আপনার পরিবারে কেউ নেই?’
‘কেন থাকবে না?’ রুদ্র বিরক্ত চোখে নাহুম খানের দিকে তাকাল, ‘স্বামী, বাবা, মা সবাই আছেন। বাবা মা কলকাতাতেই থাকেন, আজ আসছেন আমার কাছে কিছুদিন থাকবেন বলে। আর আমার হাজব্যান্ড অফিসের কাজে ইংল্যান্ডে থাকেন।’
‘আপনার ড্রয়িং রুমে একটা ছবি দেখলাম, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সঙ্গে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। ওটা কী ব্যাপারে?
রুদ্র এবার মনে মনে বেশ রেগে গেল। নাহুম খান আর ওর সহকর্মী আসার পর ওঁরা কিছুসময় বাইরের ঘরে বসে ছিলেন, তখন রুদ্র তৈরি হচ্ছিল ভেতরে। ওই সময়েই তার মানে পুরো ঘরটা খুঁটিয়ে দেখেছে লোকটা।
একে রুদ্রর মন ভালো নেই, তার ওপর এর প্রশ্নের যেন তুবড়ি ছুটছে সারাক্ষণ।
পুলিশকে সহযোগিতা করা মানে কি নিজের কাজ, কর্তব্য সব কিছু বিসর্জন দেওয়া? আজ বাবা মা আসছেন কত আনন্দ নিয়ে, রুদ্রর অফিসের ঝামেলা, প্রিয়মকে ফোনে পাচ্ছে না, আর সেখানে সব ছেড়েছুড়ে ও এখন পুলিশের গাড়িতে করে ব্যাঙ্কে চলেছে।
ও সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল। জার্মানির সেই ব্যাপারটা নিয়ে ওখানে খুব হইহই হলেও এখানে তেমন কেউ জানে না। *তাতে একদিকে রুদ্রর সুবিধাই হয়েছিল। কীভাবে অ্যাডলফ হিটলারের ইউজেনিক্সকে নতুন করে প্রয়োগ করার মারণ ছক কষা হয়েছিল, কীভাবে ও ছুটিতে প্রিয়মের কাছে গিয়ে সেটা মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল, সেসব নিজে মুখে বলতে হলেই ও কেমন গুটিয়ে যায়, কী বলবে বুঝতে পারে না।
একটু শুনেই নাহুম খানের চোখ-মুখ বেশ পালটে গেল, ‘বলেন কী! আপনি একা এতসব কাণ্ড করেছিলেন?’
রুদ্র ব্যাজার মুখে বলল, ‘ধুর, আমি একা কেন করতে যাব! ইন ফ্যাক্ট, আমি কিছুই করিনি, জার্মান পুলিশই যা করার করেছিল, সঙ্গে আমার হাজব্যান্ডও ছিলেন।’ দ্রুত প্রসঙ্গ পালটাল ও, ‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?’
‘হ্যাঁ, বলুন?’ নাহুম ড্রাইভারকে সামনের বাঁ-দিকের রাস্তাটা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন।
‘একটা লোকের অ্যাকাউন্টে অনেকটা টাকা ঢুকেছে। তাই নিয়ে আপনাদের মতো পুলিশের অফিসাররা এতটা উদবিগ্ন কেন?’ ভগতবীরের দিকে নির্দেশ করল ও, ‘উনি ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির লোক বললেন। আপনিও তো স্পেশাল সেলের অফিসার। এটা তো ইনকাম ট্যাক্সের দেখার কথা, তাই না!’ রুদ্র প্রশ্নটা না করে পারল না।
নাহুম খান এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘ম্যাডাম, আসলে কী বলব আপনাকে, আপনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন, তা ছাড়া আপনি জার্মানিতে এত বড়ো একটা অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে বলছি, আমাদের কাছে হেডকোয়ার্টারে গতকাল একটা ফোন আসে। বিদেশি কোনো ক্রিপ্টেড সার্ভারের মাধ্যমে স্পুফ করে ফোনটা করা হয়েছিল, তাই লোকেশনটা এখনও ট্র্যাক করা যায়নি। সেখানেই বলা হয় যে অঘোরেশ ভাট বলে একটা লোক খুব বড়ো একটা হামলার ছক কষছে। সেই ব্যাপারেই আপনাদের ব্যাঙ্কে বড়ো অঙ্কের একটা টাকা জমা পড়েছে। আর কারণটাও খুব অদ্ভুত এবং স্পর্শকাতর।’
নিজে থেকে কারণটা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি না রুদ্র বুঝতে পারল না, কিছু না বলে ও চেয়ে রইল নাহুম খানের দিকে।
নাহুম খান একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘কাল রাত থেকে গোটা শহর শুধু নয়, পুরো আগ্রা জেলার ছোটো বড়ো রাস্তার আশেপাশে একটা পোস্টার পড়েছে। কারা যে রাতারাতি এত হাজার হাজার পোস্টার সাঁটাল সেটাই বের করার চেষ্টা চলছে। জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে আস্তে আস্তে।’
রুদ্র চট করে পেছনে ফেলে আসা পোস্টারগুলোর দিকে তাকাল, ওগুলোর কথাই কি বলছেন এই অফিসার?
নাহুম খান বললেন, ‘তার মধ্যে আমাদের কাছে এই ক্রিপ্টেড ফোন। মনে হচ্ছে অঘোরেশ ভাট গোপন কোনো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যারা মনে করে তাজমহল মুঘল আমলে বানানোই নয়, ওটা তারও আগের এক হিন্দু শিব মন্দির ছিল, শাজাহান সেটাকেই মুমতাজের কবরখানায় পরিণত করেছেন।’
রুদ্র চমকে উঠল, এই একই কথা কাল ও কাগজেও পড়েছে। কী যেন নাম সেই নিখোঁজ অধ্যাপকের?
নাহুম খান বললেন, ‘অনেকবার এই নিয়ে আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাছে পিটিশন জমা পড়েছে, জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। আগ্রারই এক ইতিহাসবিদ এইসব করেছিলেন। তাজমহলের গর্ভগৃহে যেখানে মুমতাজ আর শাজাহানের কবর রয়েছে, তারও নীচে নাকি এখনও সেই শিবলিঙ্গ পোঁতা আছে।’
‘এটা কি সত্যি?’ রুদ্র অবাক হয়ে গেল।
‘দেখুন, সেটা তো বলতে পারব না।’ নাহুম খান কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘সেটা ইতিহাসবিদদের কাজ, আমাদের নয়। কিন্তু আমাদের কনসার্ন হল, সরকারের তরফে অনুসন্ধানের ব্যাপারে কোনো পাত্তা দেওয়া হয়নি বলে ওই সংগঠন এখন তাজমহলে কোনোরকম নাশকতামূলক হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে তাজমহল ধ্বংস হয়ে গেলে মাটির নীচে শিবলিঙ্গ খোঁজা যায়।’
‘এটা ওই ফোনেই আপনাদের বলা হয়েছে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘না।’ নাহুম খান মাথা নাড়লেন দু-পাশে, ‘ফোনে শুধু বলা হয়েছে অঘোরেশ ভাট নামে একজনের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল তাজমহল যে আসলে শিবমন্দির ছিল, সেটা প্রমাণ করার জন্য ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে সেখানে খুব বড়ো কোনো হামলা চালাবে। আর ওই পোস্টারগুলোতেও সেটাই লেখা আছে, শুধু নাম-ধাম কিচ্ছু নেই। আমাদের মনে হচ্ছে এর পেছনে মদত দিচ্ছে বিদেশি কোনো চক্র, তারাই এতে টাকা জোগাচ্ছে।’
‘প্রজাতন্ত্র দিবস তো কালকেই!’ রুদ্র বলল, ‘মানে হাতে আর চব্বিশ ঘণ্টাও সময় নেই!’
‘সেইজন্যই তো আমাদের পুরো হেডকোয়ার্টারের সকলের ঘুম উড়ে গেছে। দিল্লির এন আই এ অবধি পৌঁছে গেছে ব্যাপারটা, যে করে হোক, এটা আমাদের রুখতেই হবে। আরেকটা বাবরি মসজিদ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।’ নাহুম খান পাশে বসে থাকা ভগতবীর সিংকে দেখিয়ে বললেন, ‘সিংজিকে পাঠানো হয়েছে আমাদের সঙ্গে তদন্তে থাকার জন্য, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঁর কাছে প্রোগ্রেস চেয়ে ফোন আসছে। বুঝতেই পারছেন, কী চাপ। তার ওপর এই অঘোরেশ ভাট আগে আগ্রা ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াতেন। এক মাস আগে ওই যে ইতিহাসবিদ আগে পিটিশন করেছিলেন, সেই নিজামুদ্দিন বেগ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান, এখনও তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
হ্যাঁ, নিজামুদ্দিন বেগ! রুদ্র বলল, ‘কালই কাগজে পড়ছিলাম, ওঁর বাড়িতে এখনও নাকি হামলা চলছে!’
‘হ্যাঁ, জানি। আমার এক কলিগ ওই কেসটার তদন্ত করছেন। উনিও তার আগে অনেকগুলো কলাম লিখেছিলেন যে, গত তিনশো বছর ধরে তাজমহল সম্পর্কে সব ইতিহাসই মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করা হয়েছে সত্যিটাকে, ভারত সরকারের উচিত অনুসন্ধান করে সত্যিটা দেশবাসীকে জানানো। ওইসব লেখার পর খুব গণ্ডগোল হয়, ওঁর বাড়িতেও বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন কাগজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লেখা বন্ধ করে দেন। তারপরেই উনি আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান। একাই থাকতেন, পাড়াপ্রতিবেশী বা সহকর্মীদের থেকেও কোনো কিছু ক্লু পাওয়া যায়নি। কোনো অ্যাক্সিডেন্টও হয়নি, সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রোগ্রেস নেই সেই তদন্তে, তার মধ্যে আবার এই নতুন উপদ্রব।’ নাহুম খানের ফোনটা আচমকা বেজে উঠল, ফোনটা রিসিভ করে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ হুঁ-হাঁ করে কেটে দিলেন, ভগতবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানটোলায় একটা খুন হয়েছে।’
ভগতবীর আগ্রারই ছেলে, কিন্তু জায়গাটা চিনতে পারলেন না, ‘মানটোলা কোথায়? কে খুন হয়েছে?’
নাহুম থমথমে মুখে বললেন, ‘মানটোলা আগ্রা ফোর্টের কাছে, মুসলমিপ্রধান অঞ্চল। সাউথ আগ্রা নির্বাচন কেন্দ্রের আওতায় পড়ে। যে খুন হয়েছে সে ওখানকার বিধায়ক মুজাফফর খান ওয়াইসির ডান হাত।’ কথাটা বলে মাথাটা দু-দিক থেকে চেপে ধরলেন উনি, ‘উহ, মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব।’
‘মুজাফফর খান ওয়াইসি মানে সেই পাগল নেতা? যে হিন্দু হটাও স্লোগান তুলেছিল কয়েকদিন আগে?’ রুদ্র বলল। মনে পড়ল তখন ও সবে আগ্রায় এসেছে, রাস্তাঘাট জ্যাম করে মানুষকে চরম ঝামেলায় ফেলে মিছিল চলছিল ওদের।
‘কয়েকদিন মানে, ভোটের আগে। ওই করেই তো মানটোলার পুরো মুসলিম ভোটটা আদায় করল। ভুলভাল বকে কিন্তু ওর ইনফ্লুয়েন্স মারাত্মক, ওর একটা কথায় হাজার হাজার মুসলমান এককাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওর বাবা ছিলেন আগের বিধায়ক, তিনি ভালো ছিলেন, এইরকম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলতেন না। ছেলে এসেই এইসব শুরু করেছে।’ নাহুম খান শঙ্কিত গলায় বলছিলেন, ‘যে খুন হয়েছে তার নাম গুল মহম্মদ, সে মুজাফফর খান ওয়াইসির একদম খাস পেয়ারের লোক ছিল। আজ ভোরে নাকি বাড়ি থেকে সবে বেরিয়েছিল, গুলিতে একদম ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।’
‘অদ্ভুত!’ রুদ্র মুখ দিয়ে বিস্ময়বোধক একটা শব্দ করল, ‘একদিকে মুসলিমবিদ্বেষী পোস্টার পড়ছে শহরে, ইতিহাসবিদ নিরুদ্দেশ হচ্ছে, অন্যদিকে কট্টর মুসলিম নেতা খুন হচ্ছে, কেউ আবার পুলিশে উড়ো ফোন করছে যারা চায় না যে তাজমহল হিন্দু মন্দির ছিল এটা প্রমাণ হোক!’
‘তবেই ভাবুন আমাদের অবস্থা,’ নাহুম খান বললেন।
‘কিন্তু কারা এটা ফোন করে পুলিশকে জানাল? কেনই-বা জানাল?’ রুদ্র বলল, ‘জানানোর পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে, অঘোরেশের ওই সংগঠনের প্ল্যান বানচাল করা, মানে অঘোরেশ ভাটের কোনো শত্রু যে বা যারা চায় না তাজমহল হিন্দু মন্দির এটা প্রমাণ হোক!’
‘এটা কীরকম কথা বললেন ম্যাডাম!’ নাহুম খান এবার কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলেন, ‘আমি মুসলমান বলে বলছি না, তাজমহল হিন্দু মন্দির না মুঘল স্থাপত্য সেটা প্রমাণ করার জন্য সেটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে? তাজমহল ভারতবর্ষের গর্ব, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা!’
‘না না, আমি সেটা বলিনি!’ রুদ্র বলল, ‘তাজমহল একটা ঐতিহাসিক সৌধ, ধ্বংসের কথা আসছে কোত্থেকে! এ তো সেই বাবরি মসজিদের মতো কথা হয়ে গেল। আর তা ছাড়া তাজমহলে হামলা মানে আমাদের দেশের পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপরেই প্রশ্ন উঠে যাওয়া। ফোন যারা করেছে, তাদের উদ্দেশ্যটা কী, আমি সেটা বুঝতে চাইছিলাম।’
‘যাই হোক, আমাদের এখন নাওয়াখাওয়ার সময় নেই।’ নাহুম খান বললেন, ‘যদি আপনার অফিস থেকে নতুন কোনো ঠিকানা পাই, সেখানে গিয়ে যে করে হোক, ওই অঘোরেশকে আটক করতেই হবে।’
রুদ্র কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, গাড়িটা হঠাৎ বাঁ-দিকে টার্ন নিতেই শ্বেতশুভ্র তাজমহলের ঝকঝকে চূড়াটার দিকে ওর চোখ পড়ল। আগ্রায় আসার পর থেকে যতবার এর পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছে, চরম ব্যস্ততার মুহূর্তেও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছে, চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো, অথচ এখনও কী জেল্লা, কী আভিজাত্য!
রুদ্র হঠাৎ তাজমহল ছাড়া জায়গাটাকে ভাবতে চেষ্টা করল। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী, উলটোদিকে মেহতাববাগ আর আগ্রা ফোর্ট, এপাশে রানির মতো অবস্থান করছে তাজমহল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কল্পনায় তাজমহলহীন আগ্রার ছবি ও আঁকতে পারল না, শুধু মনে হল, এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া যেমন হিমালয় কল্পনা করা যায় না, তেমনই তাজমহল ছাড়া আগ্রা শহর ভাবা যায় না।
নাহুম খানের আশঙ্কা একদম অমূলক। কোনো কিছুর বিনিময়েই তাজমহলে হামলা মেনে নেওয়া যায় না। কিছুক্ষণের জন্য অফিসের ঝামেলা ও মন থেকে ঝেড়ে ফেলল।
দ্রুত গতিতে ফোনের বোতাম টিপল ও, ‘অমিত, আমরা এক্ষুনিই পৌঁছে যাচ্ছি ব্রাঞ্চে। তুমি কোথায়? শিগগিরি এসো।’
…………
* রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস নরক সংকেত দ্রষ্টব্য