৩৫
প্রফেসর উত্তর দেওয়ার আগেই দূর থেকে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে আসার শব্দ হল। ঝোপ, গাছপালা এড়িয়ে কেউ ছুটে আসছে এদিকে। নাহুম খান ভেতরে যাওয়ার আগে ওদের কাছে দু-জন কনস্টেবল বসিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। তারা তাদের ঢাউস বন্দুক তাক করল সঙ্গেসঙ্গে। এ ছাড়াও জঙ্গলে ঢোকার মুখেও পুলিশের প্রচুর গাড়ি রয়েছে। রুদ্র আর প্রিয়ম অলসভাবে বসে ছিল অঘোরেশ আর নিজামুদ্দিন বেগের পাশে, ওরাও সতর্কভাবে উঠে দাঁড়াল।
‘আমার মনে হয় কবীরের দলকে পুলিশ তাড়া করেছে, তাড়া খেয়ে এই বাইরের দিকে ছুটে আসছে।’ প্রিয়ম বলল।
‘আমার তা মনে হয় না।’ রুদ্র বলল, ‘বাইরে যে পুলিশ থাকবেই সেটা ওরা নিশ্চয়ই জানে।’
রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই নাহুম খানকে দেখতে পাওয়া গেল, সঙ্গে আরও তিন-চারজন পুলিশকে নিয়ে দ্রুত পায়ে আসছেন, শুকনো পাতার ওপর দিয়ে শব্দটা একটু বেশিই হচ্ছিল। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘পাখি উড়ে গেছে। কবীর বা ওর দল কেউ নেই।’
‘সেটাই এক্সপেক্টেড। ওদিকে কি শুধুই জঙ্গল?’ রুদ্র বলল।
‘নদীর একদম পাড়ে একটা বাঁশের ঘর রয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে রিসেন্ট বানানো হয়েছে। ঘরটা ফাঁকা, তবে।’ নাহুম খান হাতটা তুলে একটা গোলাপি রঙের ওড়না দেখালেন, ‘এই ওড়নাটা পড়ে ছিল। মি সিং বলছেন এটা ওঁর মেয়ে উজ্জয়িনীর।’
নাগেশ সিং এতক্ষণে এসে পৌঁছেছেন, ‘আগেরবার শিলং-এ যাওয়ার সময় এইটাই আমি ওর জন্য কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমি শিয়োর এটা ওরই।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন দুঁদে রাজনৈতিক নেতা, ‘পুলিশ টাকা নিতে আসা ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করেছে তার ওপর এখানেও ওরা নেই। ওকে মেরে ফেলেছে তার মানে।’ কান্নার দমকে ফুলে উঠতে লাগল তাঁর অত বড়ো শরীর।
‘দাঁড়ান মি সিং, এখনই অত ভেঙে পড়বেন না।’ রুদ্র বলল, ‘আপনি যদি একবারও পুলিশকে আগে থেকে নিজামুদ্দিন বেগের সঙ্গে অোপনার কানেকশনটা বলতেন, জিনিসটা এত জটিল হত না। আমার মনে হচ্ছে, পুলিশ আসছে খবর পেয়ে ওরা পালিয়েছে, সঙ্গে উজ্জয়িনীকেও নিয়ে গেছে।’
‘সারা আগ্রা ট্র্যাফিককে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। আগ্রা থেকে যেকোনো দিকে ওরা বেরোতে গেলেই ধরা পড়বে। কবীরের মেসের সামনেও নজরদারি রয়েছে।’ নাহুম খান বললেন, ‘এখন আগ্রার গলিঘুঁজিতে লুকিয়ে থাকলে একটু সময় লাগবে, কিন্তু ধরা পড়বেই।’
‘এখনও কবীর বা কবীরের ওপরওলার মোটিভটা আমি বুঝতে পারলাম না। কী চায় এরা?’ রুদ্র বিড়বিড় করল, তারপর নাহুম খানের দিকে তাকাল, ‘এখন তাহলে কী করবেন?’
‘পুরো জঙ্গলটায় পুলিশ প্রোটেকশন দিয়ে দিয়েছি। আমাকে এখন হেড কোয়ার্টার যেতে হবে, দিল্লি পুলিশ থেকে লোক আসছে। ওরা এলে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে আসা বাচ্চাটা জেরায় কী বলেছে জানতে পারলে কিছুটা আইডিয়া করতে পারব।’ নাহুম খান বললেন, ‘চলুন, আর দেরি করবেন না।’
রুদ্র বাধা দিতে চেষ্টা করল, ‘আমরা কয়েকজন একটু থাকি না। আপনার পুলিশরা তো রয়েইছে পাহারাতে। প্রফেসর বেগ তাঁর রিসার্চের ব্যাপারে বলছেন, যদি কিছুটা দিশা পাওয়া যায়…!’
নাহুম খান ওকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলেন, ‘না না, তা হয় নাকি! এই জায়গাটা এখন পুরো প্রোটেক্টেড থাকবে। বড়োকর্তারা এসে আপনাদের দেখতে পেলে আমি ফেঁসে যাব। আর তা ছাড়া…।’ অঘোরেশ আর ড বেগের দিকে ইশারা করলেন নাহুম খান, ‘এঁদেরকে ফেলে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। হঠাৎ অ্যাটাক হলে কী করব তখন?’
রুদ্র মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করে চুপ করে গেল। এই লোকটার সব ভালো, শুধু মাঝে মাঝেই কর্তব্যপরায়ণ ভাবটা এমন প্রবল হয়ে ওঠে, যে সেটা আদতে ক্ষতির কারণ হয়, সেটা উনি বুঝতে পারুন আর না পারুন। হতাশ মুখে ও উঠে দাঁড়াল।
ওরা সবাই এগোতে উদ্যত হলেও প্রফেসর বেগ একচুল নড়লেন না, ঠায় বসে রইলেন।
‘কী হল, উঠুন স্যার। দেরি করবেন না।’ নাহুম খান তাড়া দিলেন।
‘আমি যাব না।’ আস্তে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রফেসর বেগ।
নাহুম খান বললেন, ‘এ কী! যাবেন না মানে, সে বললে হয় নাকি! আপনাদের দু-জনকে প্রোটেশন তো…।’
‘অঘোরেশ যদি চায়, ওকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আমি তো আমার প্রোটেকশন আপনাদের কাছে চাইনি, আর আমি কিডন্যাপডও হইনি, কোনো অপরাধও করিনি, কাজেই একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি যেতে বাধ্য নই।’ প্রফেসর সাফ জানালেন।
নাহুম খান এবার তেড়িয়া হয়ে উঠলেন, ‘আরে স্যার, এখন এসব ছেলেমানুষি করবেন না। এটা এখন পুলিশের আন্ডারে, আপনাকে থাকতে দেওয়া যাবে না, উঠুন।’
প্রফেসর বেগ এবার নাগেশ সিং-এর দিকে তাকালেন, ‘তুমি কমিশনার বা মিনিস্টার কাউকে একটা ফোন করো তো!’
নাগেশ সিং নাহুম খানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলেন, ‘ছাড়ুন। উনি একটু জেদি ধরনের। এতদিনের গবেষণা তো, থাকতে চাইছেন মানে নিশ্চয়ই কোনো ক্লু পেয়েছেন, কী দরকার প্রোটোকলের ঝামেলায় গিয়ে …।’
নাহুম খান রেগে গিয়ে নীচুস্বরে একটা গালাগাল দিলেন, ‘শালা, এইজন্য বলে ইতিহাসের লোক আর পাগল, এদেরকে এড়িয়ে চলা উচিত। কোনো বাস্তববুদ্ধি নেই, সবসময় কাজে বাগড়া দেয়।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এস আই-কে নির্দেশ দিলেন তিনি, ‘আস্তিক, তুমি চলে যাও, গিয়ে সব ইনফর্ম করো। আর দিল্লি থেকে লোক এলে বা অন্য কোনো খবর পেলেই আমাকে ফোন করবে।’
‘ওমা আপনিও যাবেন না?’ রুদ্র বলল।
নাহুম খান একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ওর দিকে।
নাগেশ সিংও থাকলেন না, চলে গেলেন এস আই আস্তিকের সঙ্গে। ওঁর এখন মেয়ের চিন্তাই সবচেয়ে আগে, আর সেটাই স্বাভাবিক।
একটা কনস্টেবল এসে নাহুম খানকে স্যালুট করল, ‘স্যার, এই যে ম্যাপটা!’
নাহুম খান হাত বাড়িয়ে নিলেন কাগজটা।
‘কীসের ম্যাপ?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘গোটা এরিয়াটায় কতগুলো সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে, আর তাদের পজিশনগুলো দেখে একটা ম্যাপ করতে বলে এলাম, সেটাই নিয়ে এসেছে।’ নাহুম খান কাগজটা মেলে ধরলেন সামনে।
‘কালো রঙের পঞ্চভুজগুলো এক একটা সুড়ঙ্গের মুখ স্যার!’ কনস্টেবলটা বলল।
‘তার মানে মোট তেরোটা সুড়ঙ্গ!’ রুদ্র বিড়বিড় করল, ‘এর মধ্যে বারোটা নকল, কিন্তু তাদের প্রবেশপথ একরকম, ভুল করে ঢুকে পড়লেই বিপদ। দু-পাশের ওই গোলগুলো কী?’
‘ওই দুটো গোল বেদি, এখন আর বোঝা যায় না, ভেঙেচুরে গেছে। শাজাহানের সময়েরই হবে।’
রুদ্র আর সময় নষ্ট করল না, হাতে কতটা সময় আছে সেটা অজানা, ও তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গে ফিরে এল, ‘ড বেগ, যে মুদ্রার জন্য আপনার বাড়িতে এখনও হামলা চলছে, তাতে কি এমন শ্লোক লেখা আছে? মুদ্রাটা কোথায়?’
‘বড়োদিনের দিন রাতে আমার বাড়িতে ওরা প্রচণ্ড হামলা করে, অবশ্য তার কয়েকদিন আগে থেকেই উৎপাত চলছিল বলে আমি সতর্কই ছিলাম। রাতের অন্ধকারে নাগেশ সিং-এর লোকের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওর দিল্লির বাড়িতে। ও সাংসদ মানুষ, ওর বাড়িতে সিকিউরিটি থাকে, চট করে কেউ হামলা করতে পারবে না। আর মুদ্রার লেখাটা স্ক্যান করে প্রিন্ট কপি নিয়ে রেখেছিলাম আমার কাছে।’ প্রফেসর বেগ তাঁর লম্বা কুর্তার পকেট থেকে আর একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন, ‘এই শিলালিপিগুলো বটেশ্বর শিলালিপি পরবর্তী ইনস্ক্রিপশন হিসেবেই আমার মনে হয়েছে।’
রুদ্র নাহুম খানের দিকে তাকিয়ে আড়চোখে হাসল। নাগেশ সিং লোকটা শুধু ধুরন্ধর নন, মিথ্যুকও বটে। সকালেই বললেন শিলালিপিটা কোথায় উনি জানেন না, অথচ সেটা ওঁর দিল্লির বাড়িতেই রয়েছে।
নাহুম খান সংক্ষেপে বললেন, ‘ওর বারোটা বাজাব দাঁড়ান না!’
রুদ্র আর সেই নিয়ে কথা বাড়াল না, ‘এই লেখাটাই তার মানে কবীর খুঁজছিল, কিন্তু পায়নি?’
‘কবীর আগের শ্লোকগুলো ডিকোড করে এই তেরোটা সুড়ঙ্গের পয়েন্ট পেয়েছে। তারপরেই আমি লিপিটা লুকিয়ে ফেলি। চান্দেলা রাজারা ছিলেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান, তেজোমহালয় শিবমন্দির বার বার মুসলিম আক্রমণে পর্যুদস্ত হওয়ায় তাঁরা এটাকে পরে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ঠিক উলটোদিকে এতগুলো সুড়ঙ্গ ছিল শুধুমাত্র শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে, যাতে তারা যদি কোনোভাবে সুড়ঙ্গের সন্ধানও পায়, ভুল পথে ঢুকে নদীগর্ভে শ্বাসরুদ্ধ হয়েই যেন মারা যায়। হয়তো মাঝপথে মুখবন্ধ সুড়ঙ্গগুলোর মধ্যে পাহারাদার রক্ষীরাও থাকত। এই এতগুলো সুড়ঙ্গের মাঝে একমাত্র যে সুড়ঙ্গ প্রাসাদে পৌঁছোচ্ছে, সেখান দিয়ে হয়তো আসা-যাওয়া করত কোনো গুপ্তচর কিংবা বিপদের সময় রাজা সেখান দিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারতেন। এখন কবীর যে এমন হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তার কারণ এটা নয় যে ও এটা আগে দেখেনি। এটা ওকে আমি দেখিয়েছিলাম, ও অর্থ বের করতে পারেনি তখন।’ প্রফেসর বেগ থামলেন।
‘আপনি আর ডিকোডের চেষ্টাও করেননি?’ প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল।
‘সেইজন্যই আসলে আমার একটু সময়ের দরকার হয়েছিল। একে তখন এত উৎপাত চলছিল বাড়িতে, তার ওপর কবীরও চলে গিয়েছিল, আমি নিরাপদে একা থেকে ভাবতে চাইছিলাম।’
‘যারা এসেছিল তারা কী চেয়েছিল আপনার কাছে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘সেটা আমার কাছে আজও পরিষ্কার নয়। দিল্লির একটা লোক দু-জন বিদেশিকে নিয়ে এসেছিল। অবিশ্বাস্য অঙ্কের একটা টাকার অফার করে বলেছিল ওই আসল সুড়ঙ্গের মুখের হদিশ ওদের চাই।’ ড বেগ বললেন।
‘কেন? সেই সুড়ঙ্গ নিয়ে ওরা কী করবে?’ নাহুম খান বললেন, ‘যদি ভেতরে শিবলিঙ্গ বা ওই জাতীয় কিছু থেকেও থাকে, আগেভাগে গিয়ে ধ্বংস করে দেবে?’
‘সেটা আমি জানি না। আমি সোজা বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কবীর দেখছি টোপটা গিলে নিয়েছিল।’ মাথা দোলালেন ড বেগ, ‘কিন্তু মুশকিলটা হল এই মুদ্রায় শুধুই ছবি বা চিহ্ন নেই, পেছনের দিকে একটা শ্লোকও রয়েছে।’
প্রফেসর বেগ কাগজটা এগিয়ে দিলে ওরা সেটাকে ভালো করে দেখতে পেল। একটা গোল চাকতির ওপর কিছু ছবি আঁকা, নীচে গোল চাকতিরই ওপর কিছু লাইন লেখা।
‘উপর নীচের ছবিদুটো মুদ্রার দু’পিঠের ছবি।’ প্রফেসর বেগ বললেন।
এতৎ সিদ্ধান্তম পরমারদি প্রধী পুজাকর
উপনিষ্ক্রমণ মহালয় অক্ষয়পুরুহুত দ্বন্দ্বমণ্ডলম কপাটসন্ধিকর্ণ!
‘অদ্ভুত বলছেন কেন?’ রুদ্র বলল।
‘কারণ মুদ্রা আর কোনো শিলালিপিতেই ছিল না। আর এর অর্থও খুব আশ্চর্যজনক।’ প্রফেসর বেগকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
‘কেন?’
‘লক্ষ করে দ্যাখো, মুদ্রাটায় একদম কেন্দ্রে রাজার ছবি, তাঁর দু-পাশে পাঁচজন করে মোট দশজন রানি।’ প্রফেসর বেগ হাত দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, ‘রাজার ছবির ওপরে মহাদেবের ত্রিশূল দিয়ে রাজার ক্ষমতা বোঝানো হয়েছে। আবার মুদ্রার ওপরদিকে ন-টা প্রকোষ্ঠ। তাঁর মানে দাঁড়ায়, রাজার দশজন রানি, কিন্তু ন-টা প্রকোষ্ঠ অর্থাৎ ঘর। নীচে লেখা
এতৎ সিদ্ধান্তম
অর্থাৎ, ‘রাজার এ কেমন নীতি?’
‘মানে দশটা রানির জন্য ন-টা ঘর?’ রুদ্রকে চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল, ‘এই সাংসারিক কথার মধ্যে কী অঙ্ক লুকিয়ে থাকতে পারে?’
‘জানি না!’ প্রফেসর বেগ হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, ‘সবচেয়ে বড়ো কথা কোন রাজার কথা বলা হয়েছে সেটাও স্পষ্ট নয়।’
‘তার পরের তিনটে শব্দ দেখুন, পরমারদি প্রধী পূজাকর। এর মানে কী?’ রুদ্র খুঁটিয়ে দেখছিল কাগজটা।
‘পূজাকর মানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আর প্রধী মানে হল জ্ঞানী ব্যক্তি। তাহলে মানে দাঁড়াচ্ছে মহান জ্ঞানী পরমারদির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হল। পরমারদি বলতে যদি চান্দেলা রাজা পরমাদ্রিদেব বোঝায়, তবে পুরোটার মানে দাঁড়াচ্ছে, রাজার দশজন রানি, কিন্তু তাদোর জন্য ন-টি ঘর। এ কেমন নীতি? পরমাদ্রিদেবের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।’
‘দুটো লাইন একে অন্যের উলটো মনে হচ্ছে না? এই রাজার নীতির সমালোচনা করা হচ্ছে, পরক্ষণেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে।’ রুদ্র বলল।
‘একদমই তাই।’ প্রফেসর বেগ বললেন, ‘কবীরের এইসব ব্যাপারে খুব ভালো মাথা খেলত, ও-ও বের করতে পারেনি।’
‘তার পরের লাইন হল …’ প্রিয়ম জোরে জোরে পড়ল,
‘উপনিষ্ক্রমণ মহালয় অক্ষয়পুরুহুত দ্বন্দ্বমণ্ডলম কপাটসন্ধিকর্ণ!’
‘অক্ষয়পুরুহুত … কোনো অক্ষয় নামের পুরোহিতের কথা বলা হয়েছে। হয়তো চান্দেলা রাজাদের কোনো পুরোহিতই অঙ্ক-টঙ্ক করতেন।’ নাহুম খান একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে পা নাচাতে নাচাতে বললেন।
‘অক্ষয় পুরোহিত?’ প্রফেসর বেগ অস্ফুটে বললেন।
অঘোরেশ এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এখন বললেন, ‘অক্ষয়পুরুহুত তো শিবের একটা নাম, আমাদের কাশ্মীরে অক্ষয়পুরুহুত শিবমন্দির আছে।’
প্রফেসর বেগ বিস্ময়ে লাইনটা আরেকবার পড়লেন, ‘উপনিষ্ক্রমণ মহালয় অক্ষয়পুরুহুত … মহালয় মানে মন্দির আর অক্ষয়পুরুহুত মানে শিব হলে শিবমন্দির। উপনিষ্ক্রমণ মানে কী বোঝাচ্ছে?’
‘নিষ্ক্রমণ মানে তো কোনো কিছু নির্গত হওয়া, যেমন গ্যাস নিষ্ক্রমণ হয়। নির্গত হয় কোনো রাস্তা দিয়ে, সঙ্গে ”উপ” মানে ছোটো কিছু… যেমন নদীর সঙ্গে এসে মেশা ছোটো নদীকে বলে উপনদী। তার মানে নির্গত হওয়ার রাস্তার চেয়েও নিকৃষ্ট কোনো রাস্তা…!’ প্রিয়ম নিজের মনেই বকে যাচ্ছিল।
‘সুড়ঙ্গ!’ রুদ্র ওকে বাধা দিল, ‘শিবমন্দিরের সুড়ঙ্গ!’
‘তার মানে পুরোটা দাঁড়াল, রাজার দশজন রানি, কিন্তু তাদের ন-টি ঘর। এ কেমন নীতি? পরমাদ্রিদেবের প্রতি শ্রদ্ধা। শিবমন্দিরের সুড়ঙ্গ।’ নাহুম খান পুরোটা বলেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ কীরকম হেঁয়ালি মশাই? তাও যদি গুপ্তধন-টুপ্তধন থাকত!’