অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ২৫

২৫

সুরঞ্জন এসে নিজের ফোনটা হঠাৎ এগিয়ে দিলেন রুদ্রর দিকে, ‘এই নে। কথা বল।’

রুদ্র আর প্রিয়ম তখনও শোবার ঘরেই বসে ছিল। রুদ্র মনে মনে যথেষ্ট বিধ্বস্ত, ফোনে নাহুম খানের কথাগুলো শোনার পর থেকে ছটফট করছে ও, প্রিয়মের আগমনটাও যেন ঠিক করে উপভোগ করতে পারছে না। এখন বাবার দিকে তাকিয়ে ও প্রথমে বুঝতে পারল না, বলল, ‘কার সঙ্গে কথা বলব আবার?’

সুরঞ্জন চাপা গলায় বললেন, ‘কেন, ব্রিজেশ মাথুর! নিজেই তো বললি কী জানতে চাইবি। এত বছর পরে সতীশের থেকে নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলাম, ঠিক চিনতে পেরেছেন আমায়। একসময় কত এসেছেন আমাদের অফিসে! নে ধর।’

বাবা এতটা সক্রিয় হয়ে পড়বেন, রুদ্র সত্যিই ভাবেনি, ও তাড়াতাড়ি ফোনটা কানে দিল, ‘হ্যালো, নমস্কার ড মাথুর।’

ওপাশ থেকে ব্রিজেশ মাথুরের ঋজু গলা ভেসে এল, ‘নমস্কার। ড সিংহরায় আমাকে সব বললেন। নিজামুদ্দিন বেগের সেই কলাম নিয়ে বোধ হয় আপনার কিছু প্রশ্ন আছে?’

‘আপনি আমাকে তুমি করে বলুন স্যার! আমি অনেক ছোটো। আমি ড সিংহরায়ের মেয়ে রুদ্রাণী।’ রুদ্র বলল, ‘শুধু নিজামুদ্দিন বেগ নয়, তাজমহল সম্পর্কে কয়েকটা তথ্য পাচ্ছি যা সত্যি হলে সত্যিই তেজো মহালয় নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। ওই ব্যাপারেই…।’

‘বেশ। বলো।’

‘স্যার, শাজাহানের সভাসদ আবদুল হামিদ লহরী কি সত্যিই বাদশানামাতে লিখে গিয়েছেন যে, রাজা মানসিংহের প্রাসাদে শাজাহানের স্ত্রী মুমতাজকে কবরস্থ করা হয়েছিল?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।

‘কে বলছে এইসব বোগাস কথা?’ ড মাথুর সঙ্গেসঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘অরিজিন্যাল বাদশানামা কে চোখে দেখেছে যে এইসব পড়ে শোনাবে? সেটা তো রয়েছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের রয়াল লাইব্রেরিতে! ন্যাস্টালিক ক্যালিগ্রাফিতে লেখা সেটা। বাদশানামা-র অজস্র অনুবাদ হয়েছে গত কয়েকশো বছরে, একেকজন অনুবাদক অনুবাদের সময় নিজেদের কল্পিত তথ্য মিশিয়ে দিয়েছেন তার মধ্যে।’

রুদ্র আড়চোখে সুরঞ্জনের দিকে তাকাল, বলল, ‘মানে আপনি বলছেন তাজমহলের সঙ্গে রাজা মানসিংহ বা তাঁর পৌত্র জয়সিংহের কোনো সম্পর্কই নেই?’

‘কেন থাকবে না?’ ড মাথুর বললেন, ‘তখনকার অনেক ইতিহাসবিদই এই ব্যাপারে একমত যে ওই জায়গাটা ছিল জয়সিংহের। শাজাহান ওই জায়গাটা জয়সিংহের থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন, পরিবর্তে জয়সিংহকে আগ্রায় অনেকটা ভূখণ্ড দান করেছিলেন। সেখানে শাজাহান তাজমহল বানান। ব্যস এইটুকুই!’

‘মানে ওই প্রাসাদ তার আগে ছিল না?’

‘আচ্ছা, তুমি একটা কথা বলো তো, সারা ভারতের অধীশ্বর মুঘল সম্রাটের কি এতই দৈন্যদশা যে একটা পুরোনো প্রাসাদকে টেক ওভার করবেন?’ ড মাথুর রুদ্রকেই প্রশ্ন করলেন, ‘নিজামুদ্দিন লিখেছিল শুধু তাজমহল নয়, সব মুঘল আর্কিটেকচারই নাকি আসলে হিন্দু স্থাপত্য ছিল! কী হাস্যকর কথাবার্তা! তাহলে ওই সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যের সঙ্গে এগুলোর এত মিল হল কী করে?’

রুদ্র বলল, ‘চান্দেলা বংশের একজন রাজা নাকি…!’

‘চান্দেলা রাজা পরমাদ্রিদেব রাজত্ব করেছিলেন ১১৬৫ থেকে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি। তখন চান্দেলা রাজাদের ক্ষয়িষ্ণু দশা। পরমাদ্রিদেবের যে পূর্বপুরুষেরা খাজুরাহোর মন্দিরগুলো বানিয়েছিলেন তাঁদের তুলনায় পরমাদ্রিদেবের শক্তি অনেক কমে গিয়েছিল। তার ওপর তাঁর রাজত্বকালেই মহম্মদ ঘোরী ভারত আক্রমণ করেছিলেন। এইরকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে নিজের মধ্যভারতে অবস্থিত রাজধানী থেকে বহু দূরে এমন ব্যয়বহুল মন্দির বানানো সম্ভবই ছিল না পরমাদ্রিদেবের। তা ছাড়া আগ্রা অঞ্চলটাই ছিল চান্দেলা রাজত্বের বাইরে।’

রুদ্র ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই। তা ছাড়া খাজুরাহোর মন্দিরগুলোর সঙ্গে তাজমহলের তো কোনো মিলই নেই!’

‘তবে? শোন, এই সমস্ত চমকপ্রদ এবং বাজার গরম করা বিতর্ক উসকে দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাস পালটায় না, বুঝেছ?’

নাহুম খান আর ভগতবীর সিং যখন রুদ্রর ফ্ল্যাটে এলেন, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। এই অস্থিরতার মধ্যেই পূরবী সুরঞ্জনদের একরকম জোর করে রাতের খাওয়া খাইয়ে দিয়েছেন, অঘোরেশও কোনো প্রশ্ন করেননি, চুপচাপ খেয়ে নিয়েছেন, তারপর তাঁকে শুতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পাশের গেস্টরুমে। রুদ্র একবার ভেবেছিল ওঁর স্ত্রীর ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে আর করেনি।

রুদ্র প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে-না-দিতেই নাহুম খান অস্থিরভাবে বললেন, ‘অঘোরেশ ভাট কোথায়?’

রুদ্র ইশারায় ওঁকে নিয়ে গিয়ে দেখাল যে অঘোরেশ গভীর নিদ্রায় মগ্ন। নাহুম খান একটু আশ্বস্ত হয়ে বসলেন, কিন্তু কড়া নজর রাখলেন ওদিকে।

সুরঞ্জন বললেন, ‘আচ্ছা, সত্যিই কি অঘোরেশের স্ত্রী বেঁচে নেই?’

‘না, বললাম তো আপনার মেয়েকে! উনি বহু বছর আগে কাশ্মীরের দাঙ্গায় খুন হয়েছেন।’ নাহুম খান সকলের দিকে একবার তাকিয়ে অসহিষ্ণুভাবে রুদ্রকে বললেন, ‘আপনি কী বলে এরকম একটা ডেঞ্জারাস লোককে বাড়ি নিয়ে এলেন? জানেন, অপরাধীকে সাহায্য করার অপরাধে আপনি ফেঁসে যেতে পারেন? আমরা কী চাপের মধ্যে রয়েছি কোনো ধারণা আছে আপনার? আমাদের একটা হঠকারী ডিসিশন আগ্রাকেও ওই ১৯৯০ সালের কাশ্মীরে পরিণত করতে পারে। রায়টে ছারখার হয়ে যেতে পারে গোটা শহর।’

‘সে তো হবেই! তাজমহলে কিছু হলে কাশ্মীরের মতো এখানেও আগুন জ্বালাবে মুসলমানরা।’ সুরঞ্জন সায় দিয়ে বললেন, ‘আপনি দেরি করবেন না। আগে অঘোরেশের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, ও-ই পুরোটা ব্যাপারটা বলতে পারবে।’

নাহুম খান এবার সোজা হয়ে বসে সুরঞ্জনের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘কাশ্মীরে মুসলমানরা সেদিন আগুন জ্বালায়নি স্যার, জ্বালিয়েছিল পাকিস্তানপন্থী এক উগ্রপন্থী টেররিস্ট দল। টেররিস্ট, জঙ্গিদের কোনো ধর্ম হয় না! একজন হিন্দুও মানুষ মারতে পারে, আবার একদম মুসলমানও দয়ালু হতে পারে, সবই মানসিকতার ওপর নির্ভর করে, ধর্মের ওপর নয়।’

‘একদমই তাই।’ রুদ্র তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দিল, বাবা মনে হয় খেয়ালই করেননি নাহুম খানের নামটা ও বলল, ‘ওসব কথা ছাড়ুন, দেখুন মি খান, আমার মনে হয় না যে আদৌ কালকের তাজমহল ব্লাস্টটা অঘোরেশের প্ল্যান।’

এবার ভগতবীর সিং বললেন, ‘কী বলছেন, ম্যাডাম! আমরা এখন ওঁর বাড়ি থেকে আসছি। জানেন বাড়িতে কী পাওয়া গেছে?’

রুদ্র না জানার ভান করে বলল, ‘কী?’

‘দু-শোর ওপর পিস্তল আর প্রচুর গ্রেনেড।’ নাহুম খান বললেন, ‘এর পরেও আপনি বলবেন যে অঘোরেশ ভাট নির্দোষ, ওঁকে ফাঁসানো হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, বলব।’ রুদ্র জোর গলায় বলল, ‘আপনারা ওপরমহলের চাপে ঠিকমতো মাথা ঘামাতে পারছেন কি না জানি না, আমি বলব অঘোরেশ ভাটকে ফাঁসানো হচ্ছে। এটা একটা ট্র্যাপ।’

নাহুম খান বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তাহলে অঘোরেশ ভাটের বাড়িতে এত আর্মস কেন? ওঁর অ্যাকাউন্টে এত টাকা ঢুকছে কেন?’

রুদ্র বলল, ‘আমি সব বলছি। আমি অঘোরেশ ভাটের বাড়িতে গিয়ে যেটুকু জেনেছি, সেটাই আপনাদের বলছি। তারপর আপনাদের যা ভালো মনে হয় করুন।’ একঝলক দু-জনের দিকে তাকিয়ে নিল ও, ‘আমি যখন বাবার সঙ্গে ওঁর বাড়ি গিয়ে জানতে পারি উনিই সেই ব্যক্তি, যাকে আপনারা খুঁজছেন, প্রথমেই আপনাকে ফোন করে খবর দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু আপনি ফোন ধরেননি। তারপর উনি আর আমার বাবা আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি লক্ষ করি উনি ইতিহাসের মধ্যেই বুঁদ, একটু খ্যাপাটে গোছের লোক। এর মধ্যে একটা লোক যে আমাদের বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত বাইরে থেকে নজরে রাখছে বুঝতে পারি। ও যে আপনাদেরই লোক সেটা এখন বুঝছি অবশ্য। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা শব্দ হয়, আমি পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখি ওই বন্দুকসমেত বস্তাটা পড়ে আছে। আমার তখন সন্দেহ হয়।’ রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ‘আপনারা বলতে চাইছেন ওই পোস্টারের হুমকিমাফিক ওই ক-টা আর্মস দিয়ে কাল তাজমহলে ব্লাস্ট করা হবে? ওই ক-টা পিস্তল আর গ্রেনেড দিয়ে তাজমহল উড়ে যাবে?’

‘উড়ে না যাক, তাজমহল ওড়ানোর জন্য হয়তো আরও বড়ো প্ল্যান ছকে রাখা আছে, এটা আশপাশের মানুষের মধ্যে ত্রাস তৈরির জন্য ব্যবহার করা হবে।’ নাহুম খান যুক্তি দেখালেন।

‘তাই যদি হবে, অঘোরেশ ভাট, যে কিনা আপনাদের মতে এত বড়ো নাশকতার ছক কষছে, সে নিশ্চয়ই একা নয়, তার দলবল আছে। এবং তারাই আপনাদের কথা অনুযায়ী পোস্টারগুলো সেঁটেছে। তাহলে তাঁর দলবল কি এতই বোকা যে উনি ওঁর বাড়িতে আমাদের নিয়ে এসেছেন তবুও দেখিয়ে দেখিয়ে বারান্দা দিয়ে টুক করে সব আর্মস গলিয়ে ফেলে দিয়ে যাবে? আর অঘোরেশের মাথায় এত বড়ো প্ল্যান থাকলে খামোখা উনি আমার বাবাকে ডেকে সব জানাতেই-বা যাবেন কেন?’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো?’ ভগতবীর এবার বললেন।

‘আমি যেটা বলতে চাইছি, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে আপনারাও বুঝতে পারবেন। আপনাদের কি এটা মনে হচ্ছে না যে কেউ বা কারা অঘোরেশকে শিখণ্ডী হিসেবে সামনে দেখিয়ে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে? অঘোরেশ ভাটের বিরুদ্ধে সবক-টা অভিযোগই যেন ভীষণভাবে স্পষ্ট, আপনাদের দপ্তরে ফোন করে বলা হল অঘোরেশ ভাট উগ্র হিন্দুত্ববাদী, তাঁর সংগঠন তাজমহল ওড়াবে, তারপরেই অঘোরেশের অ্যাকাউন্টে আনআইডেন্টিফায়েড সোর্স থেকে প্রচুর টাকা ঢুকে গেল, তারপরেই যেন অঘোরেশকে চোখে আঙুল দেখিয়ে দেখানোর জন্যই আগ্রা শহরে পোস্টার পড়ে গেল, তারপর পুলিশ যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে জেনেও বাড়িতে আর্মসের বস্তা রাখা রইল, এই সবগুলোই কেমন সাজানো মনে হচ্ছে, না? হতে পারে অঘোরেশ ভাট মুসলিমবিদ্বেষী স্কিৎজোফ্রেনিক পেশেন্ট, কিন্তু তিনি যদি এত বড়ো ছক কষেই থাকেন, এই ভুলগুলো কেন করবেন?’ রুদ্র থামল।

‘তাহলে অঘোরেশ ভাটের অ্যাকাউন্টে অত টাকা গেল কী করে?’ নাহুম খান এবার বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

রুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ, সেটা শুনুন। আপনি আজ সকালেই আমাকে বলছিলেন না, আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রোফেসর ড নিজামুদ্দিন বেগ ওই একই বিষয়ের ওপর লিখেছিলেন, খুব ঝামেলা হয়, তারপরেই উনি নিখোঁজ হয়ে যান?’

‘হ্যাঁ। তো?’ নাহুম খান জিজ্ঞেস করলেন।

অঘোরেশ যা বলেছিলেন, সেগুলো মনে করতে করতে রুদ্র বলল, ‘অঘোরেশ আর নিজামুদ্দিন একই বিষয়ের ওপর গবেষণা করছিলেন। নিজামুদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার পরেই বিদেশ থেকে অঘোরেশের কাছে প্রোপোজাল আসে যে তাঁর গবেষণায় সাহায্য করার জন্য টাকা এবং রিসোর্স দুটোই দেওয়া হবে, উনি যেন নির্ভয়ে সত্যান্বেষণ করেন এবং তাজমহল যে সত্যিই হিন্দু মন্দির ছিল, সেটা প্রমাণ করার কাজ চালিয়ে যান। তখন অঘোরেশ রাজি হয়ে যান।’

‘না! আমি মোটেই রাজি হইনি!’ অদূরে কণ্ঠস্বর পেয়ে রুদ্র চমকে তাকাল, দেখল কখন অঘোরেশ এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার পাশে। গাঢ় চোখে দেখছেন সবাইকে।

মুহূর্তে নাহুম খান নড়েচড়ে বসতে রুদ্র চোখ দিয়ে ইশারা করে অনুরোধ করল যাতে প্রথমেই তিনি হম্বিতম্বি না করে বসেন।

কিন্তু না, নাহুম খান সেসব কিছু করলেন না। বরং ভগতবীর সিং বললেন, ‘আপনিই ড অঘোরেশ ভাট?’

‘হ্যাঁ।’ অঘোরেশের চোখ দেখে রুদ্র ঠিক বুঝতে পারল না ভদ্রলোক এতক্ষণ সত্যিই ঘুমোচ্ছিলেন না কথোপকথনের পুরোটাই শুনেছেন।

‘ড ভাট, আমরা পুলিশ থেকে আসছি। আপনার বাড়িতেও আমরা গেছিলাম, কিন্তু আপনাকে পাইনি। বিস্তারিত পরে বলছি, আগে বলুন কারা আপনাকে এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা পাঠিয়েছিল?’

অঘোরেশ বললেন, ‘গবেষণা চালানোর জন্য টাকা পাঠায়নি, টাকা পাঠাতে চেয়েছিল।’

রুদ্র লক্ষ করল বাড়ি থেকে পুরো ব্যাপারটা বলে নিয়ে আসার পর থেকে ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে গেছেন, আগের সেই পাগলাটে ভাবটা যেন অতটা নেই।

ইনি সত্যিই স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগি? নাকি সেটা ইচ্ছাকৃত অভিনয়?

‘পুরো ব্যাপারটা একটু বিশদে বলুন।’ নাহুম খান বললেন।

অঘোরেশ সন্দিগ্ধ চোখে একবার তাকালেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘নিজামুদ্দিন আমার বন্ধু ছিল। আমাদের দু-জনের গবেষণার বিষয়টা এক হলেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম না, ও ওর মতো এগোচ্ছিল, আমি আমার মতো। তবে যেহেতু ও এখনও ইউনিভার্সিটির সঙ্গে অ্যাটাচড ছিল, ও বইপত্র, রিসোর্স অনেক বেশি পেত, আমি কোনো দরকারে ওর কাছ থেকে সেই ব্যাপারে সাহায্য নিতাম। ওর রিসার্চের অ্যাঙ্গলটা পুরো অন্যরকম ছিল। বৈদিক আমলের কিছু গাণিতিক সূত্রের মধ্যেই ও মনে করত তাজমহল যে হিন্দু মন্দির ছিল, তার প্রমাণ লুকিয়ে আছে।’

‘গাণিতিক সূত্রের মধ্যে মানে?’ প্রিয়ম এতক্ষণ চুপ করে ছিল, অঙ্কের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসল। আইটি সেক্টরে কাজ করে অ্যামেচার অঙ্ক নিয়ে কাজ করার শখ ওর এখনও পুরোমাত্রায় আছে, এখনও অবসর সময়ে অঙ্কের দুরূহ প্রবলেম নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা ওর ফেভারিট টাইম পাস।

‘আমরা কেউ কারুর কাজে নাক গলাতাম না, তাই আমি অত বিশদে বলতে পারব না।’ অঘোরেশ মাথা নাড়লেন, ‘তবে এইটুকু বলতে পারি, লুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো অঙ্কের খোঁজ ও কোথাও থেকে পেয়েছিল, যেটা দিয়ে ও ওর প্রমাণটাকে শক্তপোক্ত করার চেষ্টা করছিল। সেইজন্য এমন একজন সহকারী নিয়েছিল যে অঙ্কে খুব পটু। একদিন যেমন আমাকে বলল, বলো তো অঘোরেশ, আর্যভটের লেখা এই শ্লোকটার মানে কী?

 চতুর্ধিকম শতমষ্টগুণম দ্বসাষ্টিস্থথা সহস্রনম

 আয়ুতদ্বয় বিশকম্ভাস্যসন্ন বৃত্তপরিনাহ!’

‘কী মানে এটার?’ প্রিয়ম বলল।

‘নিজামুদ্দিন বলেছিল, এই শ্লোক বিখ্যাত প্রাচীন গণিতজ্ঞ আর্যভটের লেখা। শ্লোকটার অর্থ হল 100-র সঙ্গে 4 যোগ করো। সেটাকে 8 দিয়ে গুণ করো, তার সঙ্গে 62000 যোগ করো। ফলাফল যেটা পাবে সেটা হল 20000 ব্যাসের কোনো বৃত্তের প্রায় ঠিক পরিধি। ফলাফল আসছে 62832, তার মানে এখান থেকে আমরা পাচ্ছি,

 π = পরিধি / ব্যাস = 62832 / 20000 = 3.14

অঘোরেশ কাগজে লিখে বোঝালেন।

‘দুর্দান্ত!’ প্রিয়ম মুগ্ধ।

‘আর্যভট তো অনেক আগের মানুষ, তাই না!’ রুদ্র বলল।

‘হ্যাঁ, উনি ৪৭০ সাল নাগাদ কাশ্মীরে জন্মেছিলেন। এদিকে চান্দেলা রাজারা মধ্যভারতে রাজত্ব করেছিলেন ৯০০ থেকে ১২০০ সাল। উনি এভাবেই π -এর মান বের করেছিলেন।’ নিজামুদ্দিনের ওই সহকারী এই শ্লোকগুলোর অর্থ বের করত।’ অঘোরেশ বললেন, ‘একদিন নিজামুদ্দিন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় সর্বভারতীয় একটা সংবাদপত্রে এই নিয়ে ধারাবাহিক কলাম লিখবে, সেখানেই ও বিভিন্ন প্রামাণ্য নথি দিয়ে সাধারণ মানুষদের জানাবে যে সত্যিটা কী। সাধারণ মানুষকে এই ব্যাপারে উদবুদ্ধ করলে বিরোধী দলেরা সরকারকে চাপ দেবে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের জন্য।’

‘বৈদিক যুগে অঙ্ক ও জ্যামিতি উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার সঙ্গে তাজমহলের সম্পর্ক কিছু আছে বলে মনে হয় না।’ রুদ্র ড ব্রিজেশ মাথুরের যুক্তিগুলো মনে করতে করতে বলল।

অঘোরেশ কটমট করে রুদ্রর দিকে তাকালেন।

‘ওসব ছাড়ুন,’ নাহুম খান বললেন, ‘তারপর কী হল বলুন।’

‘প্রথমে ওই সংবাদপত্রের বিক্রি খুব বেড়ে গিয়েছিল ওই কলামের জন্য, কিন্তু চার-পাঁচটা কিস্তি লেখার পরেই খুব গণ্ডগোল শুরু হল, ওই কাগজের অফিসে এই ঐতিহাসিক গবেষণাকে সাম্প্রদায়িক উসকানি হিসেবে ধরে নিয়ে ভাঙচুর চালানো হল, নিজামুদ্দিনের বাড়িতেও হামলা হল। ওই কাগজের এডিটর তখন নিজামুদ্দিনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে ওর কলামটা অসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ করে দিলেন। নিজামুদ্দিন খুব ভেঙে পড়ল, নিজের রিসার্চওয়ার্ক এইভাবে মাঝপথে প্রকাশিত হওয়া বন্ধ হয়ে গেলে ভেঙ্গে পড়াটাই স্বাভাবিক। তখন একদিন ও আমাকে ডাকল।’ অঘোরেশ বললেন, ‘বলল আমি যেন নিজের গবেষণা না থামাই, কোনো বিদেশি জার্নালে যেন আমার রিসার্চ পাঠাই, তাহলে এই গণ্ডগোলের সম্মুখীন হতে হবে না।’

‘নিজামুদ্দিন নিজেই কেন ওই বিদেশি জার্নালে লিখলেন না? দেশের কাগজে গণ্ডগোল হওয়ার সঙ্গে বিদেশের জার্নালে না লেখার তো কোনো সম্পর্ক নেই?’ প্রিয়ম বলল।

অঘোরেশ মাথা নাড়লেন, ‘আমিও সেটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন ও বলল, ও এখন কিছুদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চায়, তাজমহল যে সত্যিই শিব মন্দির ছিল, সেই ব্যাপারে অমোঘ এবং শেষ তদন্তের জন্য ও এখন কিছুদিন লেখালেখি করবে না।’

রুদ্র বলল, ‘ওঁর গবেষণার তথ্যগুলো উনি তার মানে আপনাকে দিয়েছিলেন লেখার জন্য?’

‘না।’ অঘোরেশ মাথা নাড়লেন, ‘দেবে বলেছিল, কিন্তু তার আগেই তো ও কর্পূরের মতো উবে গেল। ওর নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পরেই বিদেশি এক সংস্থা থেকে আমাকে ফোন করে। তারা জানায়, ওরাই নাকি নিজামুদ্দিনের রিসার্চটা ফান্ডিং করছিল, সেটা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা আমার কাজে ফান্ডিং করতে চায়। তখনই আমি আমার ব্যাঙ্ক ডিটেইলস আর অ্যাকাউন্ট নম্বরটা ইমেলে ওদের পাঠাই।’

‘আপনার সন্দেহ হল না যে একটা বিদেশি সংস্থা কেন আমাদের দেশের একটা হিস্টোরিকাল রিসার্চ ফান্ডিং করবে?’ ভগতবীর বললেন।

‘না, সন্দেহ হবে কেন? অঘোরেশ বললেন, ‘অনেক বেসরকারি বিদেশি সংস্থা আমাদের দেশের রিসার্চ ফান্ডিং করে, সরকার আর ক-টা গবেষণাকে স্পনসর করে?’

সুরঞ্জন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এটা অঘোরেশ ঠিকই বলছেন। সরকারি সহায়তা পাওয়া অত সহজ নয়।

‘বেশ। তারপর?’ ভগতবীর বললেন।

অঘোরেশ ক্লান্ত চোখে তাকালেন, ‘তারপর আমি আর কিছু জানি না।’

‘অঘোরেশজি, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’ রুদ্র বলল।

অঘোরেশ কিছু বললেন না, শুধু চোখ তুলে রুদ্রর দিকে তাকালেন।

‘আপনার কাছে আবদুল হামিদ লহরীর লেখা যে বাদশাহনামাটা আছে, সেটা অরিজিন্যাল। সেটা আপনি কোথায় পেলেন?’

অঘোরেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নিজামুদ্দিন দিয়েছিল।’

‘চারশো বছরের একটা ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি নিজামুদ্দিন পেলেন কী করে? আপনি জিজ্ঞেস করেননি?’

‘না। তখন অলরেডি ওর বাড়ির সামনে খুব গণ্ডগোল হচ্ছিল, অত জিজ্ঞেস করার সময় ছিল না। আমি ভেবেছিলাম বিদেশের ওই সংস্থাই ওকে দিয়েছে।’ অঘোরেশ মিনমিন করে বললেন।

এবার নাহুম খান একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আরে ওইসব হিস্ট্রি-ফিস্ট্রি এখন ছাড়ুন, আপনি আগে বলুন আপনার দলে আর কে কে আছে?’

‘এক মিনিট মি খান!’ রুদ্র বাধা দিল, ‘আমার মনে হয় আর একটু অপেক্ষা করলে আপনি আপনার এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’ ও ঘুরে তাকাল অঘোরেশের দিকে, ‘আপনি একজন প্রফেসর ছিলেন, একটা অ্যান্টিক পাণ্ডুলিপি নিজামুদ্দিনকে কে কোথা থেকে কীভাবে এনে দিল আপনার কৌতূহল হয়নি? শুধু এই পাণ্ডুলিপিটা আপনার কাছে রয়েছে এই অপরাধেই তো পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে!’

অঘোরেশ আমতা আমতা করে বললেন, ‘নিজামুদ্দিন বলেছিল পরে আমাকে সব বলবে, সেদিন তাড়াহুড়ো করে আমাকে ওটা দিয়ে দেয়। তারপর দিন থেকেই তো ও নিখোঁজ।’

‘তখনই আপনি তাহলে পুলিশের কাছে গেলেন না কেন?’ রুদ্র বলল।

অঘোরেশ বললেন, ‘আমি তখন … মানে …আমার রিসার্চ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে…!’

‘আপনাকে আমি সন্ধেবেলাতেই বললাম আঙ্কল, আপনি যদি এখনও মিথ্যে কথা বলে যান, বা কিছু লুকিয়ে রাখেন, নিজের চেয়ে বড়ো আর কারুর ক্ষতি করবেন না।’ রুদ্র সুরঞ্জনের ট্যাবটা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিল, তারপর ইন্টারনেট খুলে বলল, ‘১৭৯৯ সালে আওধের নবাব বাদশাহনামার এই অরিজিন্যাল পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে, তারপর থেকে ওটা উইন্ডসর ক্যাসলে ব্রিটিশ রাজপরিবারের রয়াল লাইব্রেরিতেই রাখা ছিল।’

রুদ্র ট্যাবে একটা নিউজের পেজ খুলে এগিয়ে দিল, ‘দু-মাস আগে ওটা ওখান থেকে চুরি গেছে।’

.

বাইরে কুচকুচে কালো আকাশ, তার মাঝে ঝিকমিক করে জ্বলা তারাগুলো যেন ঝড়ের গতিতে চলে যাচ্ছিল পেছনে। প্রথমে শুয়ে শুয়ে দেখতে বেশ লাগছিল, এভাবে চুপচাপ নিরন্তর আকাশ অনেকদিন দেখেনি, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা হাওয়া আর একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে উজ্জয়িনী কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়ালই করেনি।

সামান্য ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে যেতেই ও উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়েছে, এতক্ষণ একভাবে এইটুকু সিটে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকার জন্যই বোধ হয়। একটু সময় নিয়ে জড়তাটা কাটাল ও, তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল।

সামনে ড্রাইভারের পাশেই ওর ভালোবাসার মানুষ, যে আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আইনত ওর স্বামী হতে চলেছে, বসে আছে। উজ্জয়িনী কিছুক্ষণ উশখুশ করল, তারপর বাঁ-হাতের তর্জনী দিয়ে ওর মাথায় টোকা দিল।

‘উঁ?’ পেছনদিকে অর্ধেক ঘাড় ঘুরিয়ে ও বলল।

‘আর কতক্ষণ?’ উজ্জয়িনী বেজার মুখে জিজ্ঞেস করল।

‘প্রায় এসে গেছি জয়ী!’ ও সামান্য হাসল, ‘তুমি একটু রেস্ট নিয়ে নাও না!’

উজ্জয়িনী মুখে আর কিছু বলল না। আর কত রেস্ট নেবে ও? রেস্ট নিতে নিতে তো গা, হাত, পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাচ্ছে।

হাইওয়ের বুক চিরে সাঁ সাঁ করে ছুটছে ওদের গাড়ি। চোখের পলক ফেলার আগে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক লাইটপোস্ট।

উজ্জয়িনী একটা নিশ্বাস ফেলল। আবছা অন্ধকারে কবজি উলটে সময় দেখে ভাবল এতক্ষণে বাবা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে এসেছেন। ড্রাইভারটাও বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে দিয়েছে। বাবা কি বিশাল চেঁচামেচি করছেন? নাকি গুম হয়ে বসে আছেন?

আর মা?

ও একবার ভাবল, কী এমন ক্ষতি হত, একবার যদি বাবাকে জানিয়ে দিত যে, ‘বাবা, আমি একজনকে ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা কোরো না।’

কিন্তু না। ওর সেটা পছন্দ নয়। ক্ষণিকের দুর্বলতায় উজ্জয়িনী যদি কাউকে ফোন করে ফেলে? তাই গাড়িতে ওঠার পরেই ও ফোনটা নিয়ে নিয়েছে।

ঠিক আছে! আর তো মাত্র একটা রাতের ব্যাপার! কাল সকালেই উজ্জয়িনী সাবালিকা হয়ে যাচ্ছে, তারপর বিয়েটা সেরে নিলেই শুরু হবে ওর নতুন জীবন।

নিজের মনকে নিজেই বুঝতে পারছে না এখন উজ্জয়িনী, বাবা-মা-র কাছে এমনকী শিলং-এ থাকার সময়েও বাবা-মা-র সাহচর্যের কথা ভাবলেই ওর মনে রাগ হত, জেগে উঠত অপার বিরক্তি। কিন্তু ওর সঙ্গে চলে আসার পর থেকে যেন বাবা-মা-র জন্য মনটা কেমন করছে।

মনে হচ্ছে এতটা বাড়াবাড়ি বোধ হয় না করলেও হত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *