অঘোরে ঘুমিয়ে শিব – ১৬

১৬

বেলফাস্ট থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে দিল্লির ফ্লাইট। কস্তুরীকে নিয়ে নাগেশ বিজনেশ ক্লাসে বসেছিলেন। খাতায় কলমে কস্তুরী ওঁর এই টুরের সেক্রেটারি হলেও মূলত সঙ্গদান ছাড়া কিছুই তেমন ও করেনি। এখন নাগেশ মুখে মুখে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন, সেটাই ও ল্যাপটপে টাইপ করছিল। প্লেন এখনও ছাড়েনি।

চিঠি ড্রাফট শেষ হলে কস্তুরী উচ্ছলভাবে বাইরে তাকিয়েই দূরের প্লেনগুলোর ওঠানামা দেখতে পেল। ওর অভিমান অনেকক্ষণ আগে কেটে গেছে। আসলে ওর মনটা অনেকটা আকাশের মতো, এই মেঘ, পরক্ষণেই বৃষ্টি।

নাগেশ কস্তুরীর উচ্ছল তাকিয়ে থাকা দেখছিলেন। ওর এই ছেলেমানুষি স্বভাবের জন্যই নাগেশের একঘেয়েমি আসে না।

এই যদি সুজাতা হত! সামান্য মনোমালিন্য নিয়ে অনায়াসে কুড়িদিন কাটিয়ে দিত, মনে মনে ভাবলেন নাগেশ। অভিমানেরও একটা সীমা থাকে, সেই সীমারেখা পার করলে আর ভালো লাগে না, তখন সেটা শুধুই বিরক্তি উৎপাদন করে।

কস্তুরী নাগেশের মনের কথা বুঝতে পারল কি না কে জানে, জানলার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল, ‘আপনি কিন্তু আমাকে এখনও বললেন না!’

‘কী বলব আবার?’ নাগেশ ভ্রূ কুঁচকোলেন। যতই স্বাভাবিক থাকুন, ভেতরে ভেতরে তিনি আসলে অস্থির হয়ে পড়ছেন। মেয়েটা কতদিন পর বাড়িতে আসছে, দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

আলগোছে ঘড়ি দেখলেন একবার, এতক্ষণে দিল্লিতে নেমে যাওয়ার কথা। দীনেশকে বলা আছে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ওকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসতে। আগামীকালের পার্টির ব্যাপারে আয়োজন তো করাই আছে। ভাবলে অদ্ভুত লাগে, এই সেদিন নার্সিং হোম থেকে পুঁটুলি করে নিয়ে এলেন ওইটুকু উজ্জয়িনীকে, ছাব্বিশে জানুয়ারির দিন জন্মেছিল মেয়ে, এর মধ্যেই এত বড়ো হয়ে গেল?

নাগেশ মনে মনে ঠিক করলেন, কালকের জন্মদিনের পার্টিতে কোনো খামতি রাখবেন না, সবাইকে নিমন্ত্রণ ইতিমধ্যেই করা হয়ে গেছে, শুধু উজ্জয়িনীই যা জানে না, ওর জন্য ওটা সারপ্রাইজই থাকবে। এইজন্যই তো অত বড়ো সম্মেলনটা প্রতিরক্ষা সচিবের অনুরোধেও ছাব্বিশ তারিখ করেননি, কালকের দিনটা শুধুই মেয়েটার জন্য।

মাঝে মাঝে নিজের বাচ্চা মেয়েটার জন্য বড়ো কষ্ট হয় নাগেশের। ছোটো থেকে কখনো মেয়েটা একটা সুস্থ বাড়ির পরিবেশ তো পেলই না, উলটে সঙ্গে অল্পবয়সে অতিরিক্ত ম্যাচিয়োরিটির বোঝা টানতে টানতে বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। প্রথম যখন নাগেশ আর সুজাতা বুঝেছিলেন উজ্জয়িনী আর পাঁচটা শিশুর মতো নয়, উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। উজ্জয়িনী তিন বছরেই দুরূহ পাটিগণিতের অঙ্ক করতে শুরু করেছিল। তারপর মেয়ে প্রডিজি শুনে সাময়িক গর্ব হলেও এখন সেটাকে বরং অভিশাপ মনে হয় নাগেশের। মনে হয়, এর চেয়ে সাধারণ মেধাসম্পন্ন বাচ্চা হলেও ওর শৈশবটা অনেক আনন্দের হত। তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এল ওর সেই হ্যালুসিনেশনের অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন।

মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাননি নাগেশ। চেয়েছিলেন দিল্লিতেই পড়ুক। কিন্তু তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই উজ্জয়িনীর সতেরো আঠারো বছরের মতো মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সে নিজেই বলল, বাড়িতে থেকে পড়তে সে চায় না। এমনকী, বাবা মা ওর ওখানে ঘন ঘন যাক, সেটাও ও চায় না। মনে পড়লেই বুকটা মুচড়ে ওঠে নাগেশের।

ব্যবসায়ী হিসেবে, রাজনীতিক হিসেবে তিনি সফল হলেও, সত্যিই একজন স্বামী হিসেবে, পিতা হিসেবে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ!

কস্তুরী এবার ঠেলা দিল, ‘বলুন না প্লিজ, এই কনফারেন্সটা কীসের ওপর? অ্যান্টিটেররিজম? কারা আসবে?’

নাগেশ বর্তমানে ফিরে এলেন। প্লেন টেক অফ করে ফেলেছে। গোত্তা খেয়ে ধীরে ধীরে উঠছে ওপরের দিকে। চাপা একটা নিশ্বাস ফেলে মনটা অন্যদিকে ঘোরালেন, ‘তুমি কি জানো সারা পৃথিবীতে শুধু অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধের পেছনে এক বছরে খরচ হয় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি?’

কস্তুরী মন দিয়ে শুনছিল, ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন মানে কত টাকা হচ্ছে?’

‘এক ট্রিলিয়ন মানে এক লাখ কোটি। এক ট্রিলিয়ন ডলার মানে প্রায় পঁয়ষট্টি লাখ কোটি টাকা। এবার হিসেব করে নাও।’

কস্তুরী চমকে উঠল।

‘নিউক্লিয়ার বা রাসায়নিক মারণাস্ত্র তো ছেড়েই দাও, শুধু সাধারণ আর্মসেই আমেরিকা প্রায় আশি বিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতি বছর। আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, ইজরায়েল, চীন, এইসব দেশগুলো সবচেয়ে বেশি আর্মস তৈরি করে, সাপ্লাই করে। এই এত এত টাকা যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গরিবদের উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত, কত ভালো হত বলো তো!’

কস্তুরী চুপ করে শুনছিল।

নাগেশ বললেন, ‘তার ওপর গোটা বিশ্বে অস্ত্র ব্যাবসাটা সাংঘাতিকভাবে ইরেগুলেটেড, মানে বেশিরভাগ দেশের সরকার এমন সব প্রাইভেট কোম্পানির কাছ থেকে অস্ত্র কেনে, যাদের কাছে টাকাটাই সব, অনেক সময় তাদের বৈধতাও থাকে না। সরকার দেখেও চুপ করে থাকে।’

কস্তুরী বলল, ‘নিজেদের ডিফেন্স শক্তিশালী করতে গেলে দেশগুলোকে অস্ত্র তো কিনতেই হবে, আর যেসব ফ্যাক্টরি অস্ত্র তৈরি করে, তাদের থেকেই তো কিনবে। এতে অসুবিধার কী আছে?’

‘অসুবিধার নেই?’ এয়ারহোস্টেসের হাত থেকে কফির কাপ নিয়ে নাগেশ বললেন, ‘যে কারখানা আজ টাকার বিনিময়ে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে কোনো দেশের সরকারের হাতে, তার যদি কোনো দেশাত্মবোধ না থাকে, কাল সেই কারখানাই তো অস্ত্র তুলে দেবে জঙ্গিদের হাতে, উগ্রপন্থীদের হাতে, টাকার বিনিময়ে। তখন? সারা পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাবে এভাবে!’

‘ঠিক! এটা ভেবে দেখিনি!’ কস্তুরী মাথা নাড়ল।

‘ইন ফ্যাক্ট, সেটাই হচ্ছে। অনেক বেআইনি অস্ত্র পাচারকারী সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যারা একইসঙ্গে দু-পক্ষকেই অস্ত্র জোগান দিয়ে যাচ্ছে, দু-পক্ষ থেকেই তারা মোটা টাকা কামাচ্ছে, এদিকে দু-পক্ষেরই শয়ে শয়ে লোক মরছে।’ নাগেশ দম নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামলেন, ‘বছর কুড়ি আগে আফ্রিকার দুটো গরিব দেশ, ইথিয়োপিয়া আর এরিট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ লেগেছিল, দুটো দেশই পাশাপাশি, প্রচুর অস্ত্রপাচারকারী দুটো দেশকেই হাজার হাজার আর্মস সাপ্লাই করে গেছে, দুটো দেশেরই কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, হাজার হাজার লোক মারা গেছে। এদিকে রাতারাতি ওইসব আর্মস সাপ্লায়াররা কোটিপতি হয়ে গেছে। কেন, অপারেশন নো লিভিং থিং-এর নাম শোনোনি?’

কস্তুরী মনে করতে করতে বলল, ‘ওই একানব্বই সালের লাইবেরিয়া আর সিয়েরা লিওনের যুদ্ধটা, না?’

নাগেশ সায় দিলেন, ‘হ্যাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটা। রাতারাতি শহরগুলোকে ধ্বংসাবশেষ বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার বাচ্চা ছেলের হাতে ভয়ংকর সব বন্দুক দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের চামড়া ফুটো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ড্রাগ, তারা যাকে পেরেছিল, তাকে মেরে ফেলেছিল, বাড়ি গাড়ি সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মেয়েরা এক রাতে রেপড হয়েছিল। নৃশংসতার চূড়ান্ত। আর এই পুরো নারকীয় ঘটনায় মদত দিয়েছিল অস্ত্রব্যাবসা। তাদের জন্যই এত সুলভ হয়েছিল অস্ত্র।’

‘ইস!’ কস্তুরী শিউরে উঠল।

‘সারা বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ দুর্নীতির জন্য দায়ী হচ্ছে এই বেআইনি অস্ত্রব্যাবসা। অথচ সব দেশের সরকারই এটা নিয়ে চরম উদাসীন। তারা খালি বছরে একবার করে কোনো ভালো জায়গায় নিউক্লিয়ার ওয়েপন নিয়ে চুক্তি করে, সমাবেশ করে, টাকার শ্রাদ্ধ হয়, এদিকে পেছন দিয়ে যে এত লক্ষ লক্ষ আর্মস এইভাবে ক্ষতি করছে, সেদিকে কারুর হুঁশ নেই।’ নাগেশ তেতো গলায় কথাগুলো বললেন, ‘আর নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে যুদ্ধ লাগে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, আর সেখানে আর্মস ট্রেড ফুলেফেঁপে ওঠে, রক্তের বন্যা বয়ে যায়। তাই আমরা ঠিক করেছি, সমস্যাটাকে তাড়াতে গেলে আগে শিকড়টাকে ওপড়ানোর চেষ্টা করব। তাই আমরা পার্লামেন্টের কিছু সদস্য বিদেশি একটা সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে এই মিটটার আয়োজন করেছি। বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আমাদের সাপোর্ট করছে। এমনকী রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বুঝতে পেরেছ?’

‘সবই বুঝলাম। কিন্তু এটাই বুঝলাম না যে কারা এতে যোগ দিতে আসছে।’ কস্তুরী মুখ ভারী করল।

নাগেশ বললেন, ‘আমরা খেয়াল করে দেখেছি, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেই এইধরনের সংঘর্ষ বাধে সবচেয়ে বেশি। তাই সেইরকম এক জোড়া করে প্রতিবেশী দেশ, যারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত, তাদের বিদেশ সচিবকে এই মিটে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের তিক্ততা, দলাদলি ভুলে মিটমাট করে নিতে পারে, আর এটা শুধু তাদের স্বার্থেই নয়, দেশের টাকা এবং নাগরিক হত্যার স্বার্থে। আমরা প্রায় কুড়ি জোড়া দেশকে ইনভাইট করেছিলাম, তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত আসার জন্য সম্মতি জানিয়েছে বারো জোড়া দেশ। সাতাশ তারিখ মিটটা হওয়ার কথা, সেইদিন এক জোড়া করে দেশ, যাদের আমরা পিস কাপল, মানে শান্তির জুটি বলছি, তারা নিজেদের মধ্যে একটা করে চুক্তি করবে যে সেদিনের পর থেকে কোনোরকম যুদ্ধ, ঝগড়ায় তারা আর লিপ্ত হবে না। উদবোধন করবেন স্বয়ং আমাদের বিদেশমন্ত্রী। ভি ভি আই পি সম্মেলন। নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হবে পুরো জায়গাটা।’

‘পাকিস্তানও আসছে?’ কস্তুরী জিজ্ঞাসা করল।

‘আসছে।’ নাগেশ বললেন, ‘এতে দুনিয়া জুড়ে পুরো বেআইনি আর্মস ব্যাবসাতেই একটা বড়োসড়ো ধাক্কা আসবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ভারত যে শুধু এই মিটটা হোস্ট করছে তাই নয়, এই মিটটার ফলে যে শান্তির বাণী দেওয়া হবে, তাতে ভারত যে কত বড়ো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, তা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল লেখা থাকবে।’ বলতে বলতে নাগেশের গলার স্বর আবেগে কেঁপে উঠল। সাংসদ হওয়ার পর থেকেই নিজ উদ্যোগে শান্তিমূলক নানা কাজকর্মে নাগেশ সংসদে নজর কেড়েছেন, আগের বছরেও নারীপাচার নিয়ে এমনই একটা সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে আয়তনে এবং ওজনে এবারেরটার তুলনাই চলে না।

‘কোথায় হবে এটা, সেটাই এখনও বললে না! প্রগতি ময়দানে? কস্তুরী বলল।

‘নাহ!’ নাগেশ সিটটাকে পেছনদিকে হেলিয়ে দিলেন, বাইরে এখন শুধুই মেঘ, বললেন, ‘ঐতিহাসিক চুক্তি, তাই ঐতিহাসিক জায়গায় আয়োজন করেছি। আগ্রায়।’

‘আগ্রার কোথায়?’ কস্তুরী জানতে চাইল।

‘একটা অডিটোরিয়ামে। তার আগের দিক সন্ধ্যাবেলা অতিথিদের তাজমহল ঘুরিয়ে দেখানো হবে, সেটায় অবশ্য আমি যাব না, বাড়িতে পার্টি থাকবে।’ নাগেশ উঠে দাঁড়ালেন। একটু বাথরুমে যাবেন।

নাগেশ সিং বাথরুমের দিকে এগোনোমাত্র কস্তুরী নিজের ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ খুলল। এখন এয়ারলাইনসগুলো আকাশেও ওয়াইফাই দিচ্ছে। ঝড়ের গতিতে ও কাউকে কিছু একটা টাইপ করতে লাগল।

টাইপ করতে করতে ওর মুখে ফুটে উঠল অদ্ভুত একটা হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *