1 of 2

স্তব্ধ অট্টহাসি

স্তব্ধ অট্টহাসি

অট্টহাসি বটে একখানা। ঘর বুঝি ফেটে গেল। কড়িকাঠ কেঁপে উঠল। চারদিকের দেওয়ালে ফাট ধরল।

ভুরু কুঁচকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। ভেবেছিল, ওই একখানা তেজালো হাসি হেসেই ক্ষ্যামা দেবে আগন্তুক।

কিন্তু তা তো হল না। অট্টহাসি যে ক্রনিক হয়ে গেল। একটা থামতে না থামতেই শুরু হয় আর-একটা। ঘর গমগম করছে। আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অট্টহাসি আর থামছে না। থামানো যাচ্ছে না। চেষ্টা করছে আগন্তুক। চোখে জল এসে গেছে। রুমাল বের করে চোখ মুছছে, মুখ চাপা দিচ্ছে, পেট খামচে ধরছে কিন্তু তেড়েমেড়ে অট্টহাসি বেরিয়ে আসছে মুখগহ্বর দিয়ে।

আর, তারপরেই শুরু হল হেঁচকি। প্রবল হেঁচকি। আগন্তুকের অতবড় কলেবরটাকে ভেতর থেকে মুহুর্মুহুঃ কঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে পাকস্থলীর তড়কা।

এরকম কাণ্ড ইন্দ্রনাথ রুদ্রর ঘরে কখনও ঘটেনি। রহস্য আর ষড়যন্ত্রে হাবুডুবু খেয়ে যারা আসে, তারা একেবারে মিইয়ে থাকে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আধমরা হয়ে থাকে।

ইন্দ্রনাথ তাদের চাঙা করে। তাদের জটিল সংকট থেকে কুটিল কাঁটা খুঁজে বের করে দেয়। তারা তখন হেসে বাড়ি ফিরে যায়।

কিন্তু এরকম অট্টহাসি তো হাসে না। বিশেষ করে কী ফ্যাসাদে ফেঁসেছে তা ব্যক্ত করার পূর্বমুহূর্তেই এবম্বিধ অট্টহাস্যের উদ্রেক ঘটে না। এভাবে হেঁচকিও তোলে না।

ইন্দ্রনাথ বুঝল, লোকটা হেঁচকিকে আর কন্ট্রোল করতে পারছে না। হেঁচকিই এখন তার প্রভু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দম আটকে আসছে, চোখ ঠেলে-ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গোটা অন্ননালিটা যেন পটাং করে ছিঁড়ে যেতে চাইছে।

হেঁচকির হাতে মক্কেলকে ছেড়ে দিয়ে পাশের ঘরে গেল ইন্দ্রনাথ। ফিরে এল একটা সাদা রঙের ট্যাবলেট নিয়ে। আর এক গেলাস জল।

বললে, খেয়ে নিন। স্প্যাজম কমবে। হেঁচকি পালাবে। মক্কেলের তখন কথা বলার অবস্থা নেই। এক হাতে জলের গেলাস, আর এক হাতে সাদা বড়ি নিয়ে দুটোই তুলল মুখের কাছে। একটা হেঁচকি যেই উঠেছে আর সময় না দিয়ে তক্ষুনি বড়ির পেছনে খানিকটা জল দিয়ে পেটে চালান করে দিল মহাকায় মানুষটা।

এরপরেও উঠেছিল খান তিনেক হেঁচকি। তারপর চম্পট দিল একেবারেই। ঘর এখন নিস্তব্ধ। অট্টহাসিও যে স্তব্ধ।

ইন্দ্রনাথ বললে, যে বড়িটা আপনাকে দিলাম তা বারালগন। দুটো বড়ি পকেটে সবসময়ে রাখবেন। বেমক্কা হেঁচকিকে শায়েস্তা করতে পারবেন।

লোকটা তখন টানা লম্বা নিশ্বেস নিচ্ছে। ফুসফুসকে ঠান্ডা করে তুলছে। কথা বলতে চাইছে না। হেঁচকির ভয়ে। ফের যদি তেড়ে আসে।

ইন্দ্রনাথ তাই একাই কথা বলে গেল।

মামুলি হেঁচকি এটা নয়। তাই বারালগন দিলাম। নইলে দিতাম ঠান্ডা জল অথবা গরম কফি। নাছোড়বান্দা এ হেঁচকি ওঠে ক্রনিক নার্ভের ইরিটেশন অথবা ইনফ্লেমেশন ঘটলে। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ইমোশন্যাল শক–সেই থেকেই হেঁচকি-রূপী সাইকোসোম্যাটিক রিঅ্যাকশন। বুঝছেন?

মক্কেল ঘাড় হেলিয়ে জানাল, সে বুঝতে পারছে।

ইন্দ্রনাথ বললে, আপনার তো দেখছি, মানসিক চিকিৎসার দরকার।

মক্কেল জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে সায় দিল এই প্রস্তাবে।

ইন্দ্রনাথ তখন নস্যির ডিবে বের করল। মুডে থাকলে খুব কায়দা করে নস্যি নেওয়া ওর অভ্যেস। আগে টানত কাচি সিগারেট তারপর হল চুরুট, পাইপ কামড়েও স্টাইল মেরেছে অনেক। এখন সব ছেড়ে দিয়ে চালাচ্ছে শুধু তামাকচূর্ণ মস্তিষ্ককে ঝাঁকুনি মেরে মেরে অ্যাকটিভ রাখার জন্যে। কিন্তু নস্যি যখন নেয়, তখন মনে হয় যেন একটা মস্ত শিল্পকর্ম করছে।

আগন্তুক খাবি খাওয়ার ভঙ্গিমায় নাকমুখ দিয়ে অক্সিজেন টানতে-টানতে দুর্লভ এই দৃশ্য অবলোকন করে গেল। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। একটু কাষ্ঠ হাসি হাসল–এবার আর অট্টহাসি নয়।

বললে, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার মানসিক চিকিৎসার দরকার। কারণ আমি পাগল।

ইন্দ্রনাথ সিনেমা-নায়কের ঢঙে অপাঙ্গে তাকিয়ে নিয়ে নস্যির কৌটো পকেটে রাখল। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললে, নিজেকে যে পাগল বলে, সে পাগল নয়।

মক্কেল বললে, কিন্তু আমি পাগল। দাগি পাগল।

মানে?

আমি পাগলা গারদে ছিলাম।

ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মওকা বুঝে একটা গেরস্ত টিকটিকি টিকটিক করে উঠে বোধহয় সর্বজ্ঞ ভূশণ্ডী কাকের মতো বলে উঠল–ঠিক, ঠিক, ঠিক! মক্কেল নির্ঘাত পাগল।

ইন্দ্রনাথের চাহনি এখন সূচ্যগ্র হয়েছে। ছুঁচের ডগার মতো সরু ওই চাহনির মধ্যেই নিহিত রয়েছে ঈগল চোখের ক্ষমতা। অনেকদূর থেকে অনেক কিছু দেখলেই ঈগল ঠিক আসল জায়গাটাকে বিবর্ধিত আকারে দেখতে পায়। ঈশ্বরের কৃপায় শুধু ঈগলই এই ক্ষমতা পায়নি–পেয়েছে নিশ্চয় ইন্দ্রনাথ রুদ্রও। নইলে হাজার গোলমালের স্তূপের মধ্যে থেকে সঠিক গোলমালটা ও টক করে চিনে নেয় কী করে? তারপরেই নির্মূল করে আসল কারণটাকে সঙ্কটের সমাধান ঘটে। মক্কেলের মুখে হাসি ফোটে। ইন্দ্রনাথের পকেটে টাকা আসে।

হ্যাঁ, এটা ওর প্রফেশন। ও বলে। অ্যামেচার ডিটেকটিভদের অস্তিত্ব শুধু গল্পের বইতেই। আসল ডিটেকটিভকে খাটতে হয়। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুধু বুদ্ধির খেল দেখালেই হয় না। সেই সঙ্গে চাই দক্ষিণা, যে যা দিতে পারে।

আগন্তুকের মুখের দিকে এহেন ঈগল চাহনি নিক্ষেপ করে ইন্দ্রনাথ কী সিদ্ধান্তে এল, সেটা মুখের পরতে প্রকাশ পেল না। চোখদুটো শুধু অনুকম্পায় নরম হয়ে এল। কণ্ঠে শোনা গেল তারই অনুরণন।

বললে, পাগলা গারদে ছিলেন?

মক্কেল বললে, হ্যাঁ।

আমাকে দেখে অমন হাসতে গেলেন কেন?

ঠিক তার মতো দেখতে আপনাকে। চমকে উঠেছিলাম, তারপরেই মনে পড়ে গেল, আমি তো পাগল। তাই–

হাসি পেল। হাসির রাজা অট্টহাসি, চমৎকার হাসি, এমন হাসি কজন হাসতে পারে বলুন। এমন হেঁচকিও কেউ তুলতে পারে না।–কোন পাগলা গারদে ছিলেন?

নয়নতারা মেন্টাল নার্সিংহোম।

সেটা কোথায়?

পুরুলিয়ায়। রিলিজ সার্টিফিকেট কবে পেয়েছেন?

সে অনেক বছর আগে।

কত বছর আগে?

কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে বছরের হিসেব করতে লাগল মক্কেল। সেই অবসরে তাকে খুঁটিয়ে দেখে নিল ইন্দ্রনাথ।

হেঁচকির ঢেউ যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ মানুষটাকে মনে হয়েছিল বড্ড অসহায়। নিজের দেহমন্দিরকে যে পুরুষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, নিজেকে সে নিতান্ত অপদার্থও মনে করে। তাকে দেখলে তখন মায়া হয়, হাসিও পায়।

কিন্তু এখন সে ভাব তিরোহিত হয়েছে তার চোখমুখ থেকে। হাবভাবে ফুটে উঠেছে সুগভীর আত্মপ্রত্যয়।

উচ্চতায় সে নাতিদীর্ঘ। প্রস্থে কিন্তু বিপুল। তার বিশাল কঁধ, বিরাট বুক এক লহমাতেই জানিয়ে দেয় শরীরের আসুরিক শক্তির অস্তিত্ব। মুখমণ্ডলও চৌকো। চোয়ালের হাড় বেশ চওড়া আর মোটা। কঠিন মনোবল ফুটে উঠেছে ঠেলে বেরিয়ে আসা চিবুকেও। ভুরু লোমশ। নাক পাতলা আর রীতিমতো ধারাল। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ। চওড়া, চ্যাপটা, স্থূলমুখে ঠিক যেন দু-টুকরো সরোবর ভেসে রয়েছে। ভাবমগ্ন, ধ্যানগম্ভীর, স্বপ্নিল সেই চাহনি যার ওপর পড়ে তাকে টলিয়ে দেয়।

আর এই চাহনি দেখে টলেছিল বলেই ইন্দ্রনাথ তার পরিচয় না নিয়েই তাকে আসন গ্রহণ করতে বলেছিল। পরক্ষণেই শুরু হয়েছিল তুমুল অট্টহাসি আর প্রবল হেঁচকি।

এখন সে তার আশ্চর্য চাহনি কড়িকাঠের দিকে মেলে রয়েছে। ভাবছে।

ভাবনা শেষ হল। চোখ নামিয়ে ধীর গম্ভীর গলায় সে বললে, চব্বিশ বছর আগে।

গলার আর বলার ব্যক্তিত্ব মন ছুঁয়ে গেল ইন্দ্রনাথের। নির্নিমেষে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ব্যক্তিত্বের এহেন চকিত পরিবর্তন মানসিক অস্বাভাবিকতার পরিচায়ক নয় কি?

স্বর মাধুর্য বজায় রাখল ইন্দ্রনাথ। বললে, চব্বিশ বছর আগে? তখন আপনার বয়স কত ছিল?

চার।

ইন্দ্রনাথের চোখের পলক পড়ল না কয়েক সেকেন্ড।

চার বছর বয়েসে মেন্টাল নার্সিং হোমে ছিলেন?

সরোবর চাহনিতে এতটুকু কাঁপন না জাগিয়ে সে বললে, এই ধাঁধার জবাবটাই আপনার কাছে পেতে এসেছি। সত্যিই কি আমি চার বছর বয়েসে পাগল ছিলাম?

এখন জেনে কী লাভ?

এর ওপরেই নির্ভর করছে আমার বিয়ে–

ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ইন্দ্রনাথ বললে, বলুন আপনার কাহিনি।

বিচিত্র সেই কাহিনি আগন্তুকের জবানিতেই শোনা যাক।

.

আমার নাম সত্য বসু। আমার বাবার নাম সুপ্রিয় বসু। মায়ের নাম সাধনা বসু। স দিয়েই তিনজনের নামের শুরু। তিন-এর এই অভিশাপ আমার গোটা জীবনে জড়িয়ে রয়েছে।

খুব ছোটবেলার স্মৃতি নেই বললেই চলে। যা আছে তা বড় আবছা। কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। তা থেকে উদ্ধার করা যায় না। আমি অন্তত পারিনি।

দু-একটা পাতলা ছবি মাঝে-মাঝে মনের কোণে উঁকি দেয়। একটা ছবি ভাবতে খুব ভালো লাগে। এ ছবিতে আছে অনেক জল। আমার চারপাশে। মাথার ওপর নীল আকাশ। আকাশ আর জল এক হয়ে গেছে।

আর একটা ছবি মনে পড়লেই গা হিম হয়ে আসে। কেন, তা বলতে পারব না। একটা মুখ…যেন ধোঁয়া দিয়ে গড়া কটমট করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে..নৃশংস চাহনি…এর বেশি কিছু মনে নেই।

তারপর যা বেশি করে মনে পড়ে, তা নার্সিং হোমের আদুরে মায়ের ছবি। আমাকে খুব ভালোবাসত। আমার সঙ্গে কত খেলা করত। কত হাসত। পাহাড়ে আর বনে বেড়াতে নিয়ে যেত।

আদুরে মায়ের কাছে শুনেছিলাম…আর একটু বড় হয়ে শুনেছিলাম আমার বাবা আর মা আগে আসত আমাকে দেখতে। মাস ছয়েক পরে আর আসেনি। এলেও দূর থেকে আমাকে দেখত। কাছে আসত না। আমি না কি বাবাকে দেখলেই ডুকরে কেঁদে উঠতাম। ভয় পেতাম।

তারপরের ছবিগুলো খুব স্পষ্ট। তখন তো আমি বড় হয়ে গেছি। নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়েছি। আমার বাবা আর মা আমাকে নিতে আসেনি বলে মানুষ হচ্ছি আদুরে মায়ের কাছে। নার্সিং হোমের কাছেই থাকত আমার এই মা। নিজেদের বাড়ি। বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। তিনি দেহ রাখার পর আদুরে মা একা থাকত। বিয়ে করেনি। আমিই তার সব। তার চোখের মণি।

আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, বড় করেছে, এই আদুরে মা। আদুরে মা বলে ডাকতে নিজেই শিখিয়েছিল। বলত, তোকে আদর দিয়ে বাঁদর করব। একটা বাঁদর পোষার শখ আমার অনেক দিনের। তুই আমার সেই বাঁদর।

রঘুনাথপুরে এখন মস্ত মানসিক চিকিৎসালয় তৈরি হচ্ছে। যখন তৈরি হয়ে যাবে, তখন পুব ভারতে এইটাই হবে সবচেয়ে বড় পাগলা গারদ। রাঁচি ম্লান হয়ে যাবে। পুরুলিয়ার গৌরব বাড়বে। এর পেছনে রয়েছে দিল্লির ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ।

কিন্তু মূল আইডিয়াটা এসেছে নয়নতারা মেন্টাল নার্সিং হোম থেকে। পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোগ। সরকারি গ্রান্ট একটা পেত। আজও পায়। পাবেও। বিরাট সরকারি হাসপাতালের পাশেই থাকবে ছোট্ট সুন্দর, একান্ত ঘরোয়া এই বেসরকারি হাসপাতাল।

এই হাসপাতালকে আমি ভালোবাসি, এখানেই ফিরে এসেছিল আমার মানসিক ভারসাম্য। বছর দুই ছিলাম সেখানে। বছরখানেক ধরে চিকিৎসার টাকা পাঠিয়ে দিত বাবা। তারপর তাও বন্ধ হয়ে গেল। গ্রান্ট ছিল বলেই হাসপাতাল আমাকে দূর করে দেয়নি। দেবেই বা কোথায়। অনাথ আশ্রম ছাড়া আমার যাওয়ার আর জায়গা ছিল না। আদুরে মা তা হতে দেয়নি। হাসপাতাল যখন রিলিজ সার্টিফিকেট দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল, আদুরে মা আমাকে তুলল নিজের বাড়িতে।

যখন স্কুলে পড়ছি, তখন প্রথম জানলাম, আদুরে মা আমার সত্যিকারের মা নয়। ন্যাশনাল ট্যালেন্ট স্কলারশিপের একটা পরীক্ষা দিতে হয়েছিল আমাকে। ফর্মে বাবা আর মায়ের নামের জায়গায় ব্র্যাকেট দিয়ে আদুরে মা লিখেছিল একটাই নাম–সুলোচনা দেবী। বাবার নাম ছিল না।

সেই দিন রাতে খাটে শুয়ে আদুরে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, মা, আমার বাবার নাম লিখলে না কেন?

আদুরে মা প্রথমে কিছুই বলতে চায়নি। কিন্তু আমি বড্ড জেদী ছেলেবেলা থেকেই,। অনেক রাত পর্যন্ত ঘ্যানর-ঘ্যানর করে গেছিলাম।

বলেছিলাম, বলতেই হবে তোমাকে। নইলে ঘুমোতে দেব না।

আদুরে মায়ের তখন হাই উঠছিল। সারাদিন ডিউটি দিয়েছে নয়নতারা-য়। রাত্রে না ঘুমোলে পরের দিন ডিউটি দেবে কী করে। ভুলে গেছি, আদুরে মা ছিল নয়নতারা-র নার্স।

শেষকালে রেগেমেগে মা বলেছিল, সত্যিই বাঁদর হয়েছিস তুই। যা শুনে কোনও লাভ নেই, তা যখন শুনতেই চাস, তাহলে শোন।

সেই রাতে সেই প্রথম জানলাম, যার ঔরসে, যার গর্ভে এই ধরায় আমি আবির্ভূত হয়েছি, তাদের নাম যথাক্রমে সুপ্রিয় আর সাধনা। দুজনের কেউই আমার আর খোঁজ খবর নেয় না। আদৌ তারা বেঁচে আছে কি না, সেটাও কারও জানা নেই।

জানলাম আরও একটা খবর। যা জানবার পর থেকেই আমার মাথায় পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার বাবা আর মা আমার মাথা খারাপ বলেই নার্সিং হোমে রেখে গেছিল। কিন্তু মাস ছয় কাটবার পর থেকেই ডাক্তারদের মনে ধোঁকা লাগে। সেরকম অ্যাবনরম্যালিটি না কি আমার মধ্যে ছিল না। আর পাঁচটা সুস্থ খোকাখুকুর মতো আমিও সুস্থ। একথা বলবার সময় যখন এল, তখন থেকেই হাসপাতালে আসা বন্ধ করেছিল আমরা বাবা আর মা।

আদুরে মা আমার বুকেপিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, সতু, ডাক্তারদের সঙ্গে আমিও একমত। গোড়া থেকেই আমার জিম্মায় তুই ছিলি। প্রথম-প্রথম তুই মাঝে-মাঝে সিঁটিয়ে যেতিস। কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করবার ক্ষমতা ওইটুকু বয়েসে থাকে না। মনের কথা যদি বুঝতেই না পারি, তাহলে আমি মা হয়েছি কেন। এটুকু বুঝেছিলাম, তোর ভেতরে কোথায় একটা আতঙ্ক রয়েছে। আস্তে-আস্তে তা মনের মধ্যেই চাপা পড়ে গেল। তখন তো আর তোকে নার্সিংহোমে রেখে দেওয়ার দরকার হল না। আমিই ডাক্তারদের বলে কয়ে তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেখে দিলাম আমার কাছে। শুধু অবাক হয়েছি তোর ওই চামার বাবা আর মায়ের কথা ভেবে। কীরকম লোক তারা? সুস্থ সন্তানকে পাগলা গারদে ফেলে রেখে চলে গেল?

বাকি রাতটা আমি ঘুমোতে পারিনি। আমার বয়স তখন ষোল। মায়ের সঙ্গে নয়নতারায় যেতাম। একাও যেতাম। আমায় কেউ আটকাত না। বরং দুদিন না গেলেই জিগ্যেস করত শরীর খারাপ হয়েছে কি না। সব্বাই ভালোবাসত। এখনও বাসে। এই ধরনের নার্সিংহোম থেকে যারা ভালো হয়ে বেরিয়ে যায়, সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে মিশে যায় তাদের আরও বেশি ভালোবাসে নার্সিংহোমের সবাই। আমি ছিলাম ওদের গর্ব। মাঝে-মাঝে আমি ওদের গ্রুপ স্টাডি অ্যাটেন্ড করতাম। ডাক্তারদের কাজ সহজ করে দিতাম। ভি আই পি-রা হাসপাতাল দেখতে এলে আমাকে তাদের সামনে যেতে হত। আমি ছিলাম নয়নতারা-র গর্ব। এখন আরও বেশি।

আর এই সবের ফলেই হাসপাতালের সব জায়গায় যেতে পারতাম, সবকিছু দেখতে পারতাম। বিশেষ করে আমার আদুরে মা যখন ওখানকার নামী নার্স।

দিনকয়েক নজর রাখলাম অফিস ঘরের ওপর। রোজ গিয়ে বসে থাকতাম। কোন আলমারিতে কী ফাইল আছে, সব দেখতাম। রুগিদের কেস-হিস্ট্রি থাকত আলাদা-আলাদা ফাইলে। প্রত্যেক মানসিক রুগির আলাদা ফাইল। মূল্যবান ডকুমেন্ট। অনেক সময়ে আদালত পর্যন্ত যখন কোনও ব্যাপার গড়ায়, তখন হাকিম দেখতে চান হাসপাতালের রেকর্ড। এরকম অনেকবার ঘটেছে বলে আমি সব জানতাম।

সম্পত্তি হাতানোর মতলবেই বিশেষ করে এটা ঘটে। আসল উত্তরাধিকারকে পাগল সাজিয়ে রাখা হয়। পাগলামি এমনিই একটা ব্যায়রাম যা যন্ত্রে ধরা পড়ে না। ভালোমনের ডাক্তার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলেন হাকিম তা বিশ্বাস করে।

আমি তো বাবার ওয়ারিশ। তাহলে বাবা আমাকে পাগল সাজিয়ে হাসপাতালে রেখে উধাও হয়ে গেল কেন?

তক্কেতক্কে রইলাম। একদিন সুযোগ বুঝে ফাঁকা অফিসঘরে ঢুকে বিশেষ একটা আলমারি খুললাম। সেখানে থাকে পুরোনো রুগিদের ফাইল। আমার ফাইল বের করলাম। রিলিজ সার্টিফিকেটের কপি দেখলাম। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে ঘোষণা করেছেন।

এর নীচে রয়েছে অনেক রিপোর্ট। কীভাবে চিকিৎসা হয়েছে। কে-কে করেছে। ইত্যাদি।

সবার নীচে রয়েছে আসল কাগজগুলো। যেগুলো আমি খুঁজছিলাম।

আমার বার্থ সার্টিফিকেট আর নয়নতারা-য় ভরতি করানোর জন্যে একজন ডাক্তারের সার্টিফিকেট।

এইটাই নিয়ম। রুগির ঠিকুজিকোষ্ঠী জানাতে হয়, যাকে ভরতি করা হচ্ছে–সে পাগল কি না, তা সার্টিফাই করে দিতে হয় একজন ডাক্তারকে।

আমাকে সার্টিফাই করেছিলেন ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েক। ঠিকানাটা টুকে নিলাম। পুরুলিয়া টাউনের জেনারেল ফিজিসিয়ান।

বার্থ সার্টিফিকেটের কপি করে নিলাম, জন্মেছিলাম দিল্লিতে। বাবার আর মায়ের ঠিকানাও রয়েছে দিল্লির।

অ্যাপ্লিকেশন ফর্মে ছবি লাগানো ছিল আমার। ছিঁড়ে নিলাম। এ ফাইল নয়নতারা আর কোনওদিন দেখবে না।

তারপর বারো বছর ধরে আমার বাবা মা আর ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েককে খুঁজছি। প্রথমে তোলপাড় করেছিলাম পুরুলিয়া টাউন। ডাঃ নায়েকের চেম্বারের ঠিকানায় চলে গেছিলাম। কিন্তু তাকে পাইনি। অনেক বছর আগে তিনি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। যেখানে ডাক্তারখানা ছিল, সেই ঘরে এখন স্টেশনারি দোকান হয়েছে। দোকানি পুরুলিয়ার পুরোনো বাসিন্দা। ডাঃ নায়েককে চিনতেন। তিনিই বললেন, ডাক্তারবাবু তো এখানে ভাড়া থাকতেন। পুরো বাড়িটাই ভাড়া নিয়েছিলেন। তারপর একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেল। উনি বউ ফেলে বিবাগী হয়ে গেলেন। আর তাকে দেখিনি। সে আজ চুয়ান্ন বছর আগের কথা।

আমি জিগ্যেস করেছিলাম, বিচ্ছিরি ব্যাপারটা কী?

দোকানি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, সে খবরে তোমার দরকার কী? এক ফোঁটা ছেলে! ভাগো।

বাস্তবিকই, ষোলো বছরের একটা ছেলের কাছে সেই কেলেঙ্কারি কাহিনি বলা যায় না। ঘটনাটা তখন না জানলেও পরে জেনেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা উদ্ধার করতে সময় লেগেছিল প্রায় চারবছর। আমি সেই ষোলো বছর বয়েসেই বুঝতে পেরেছিলাম বাবা, মা আর ডাক্তারবাবুর হদিশ পেতে হলে আমাকে গোটা ভারত টহল দিতে হতে পারে। তাই ভেবেচিন্তে ট্রাভেলিং সেলসম্যানের চাকরি নিয়েছিলাম আঠারো বছর বয়সেই। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই রোজগারের ধান্দা শুরু করে দিয়েছিলাম। আদুরে মা আমাকে আটকাতে পারেনি। আর লেখাপড়াও করাতে পারেনি। শুয়োরের গোঁ চেপেছিল মাথায়। কেন এই শাস্তি দিয়ে গেছিল আমার বাবা, মা আর ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েক–আমাকে তা জানতেই হবে।

স্বাস্থ্য মজবুত বলে চাকরিও জুটে গেল সহজে। ফেরিওলার কাজে কোয়ালিফিকেশন দরকার হয় না। শরীরটা পেটাই হলেই চলে যায়।

যে নামী কোম্পানির চাকরি জুটিয়েছিলাম, তার সেলসম্যানদের খাতির অনেক মনোহারি দোকানদারদের কাছে। পুরুলিয়া জেলায় একটা নতুন প্রোডাক্ট-এর ক্যাম্পেন করার জন্যে প্রথমেই এলাম সেই দোকানির কাছে যিনি আমাকে ষোলো বছর বয়েসে হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন গোঁফদাড়ি ওঠেনি বলে। বিশ বছরের সত্য বসুকে প্রথমে চিনতে পারেননি। আমার চুলের ডগা থেকে বুটের ডগা পর্যন্ত তখন গ্ল্যামার ঝলমল করছে। চোখেমুখে বুকনির ফুলঝুরি ছুটছে। নামী কোম্পানির দামি স্ট্যাম্প আমার চলনে বলনে।

দু-দিনেই দোকানির মন জয় করলাম। তাকে কিছু বিশেষ সুবিধে পাইয়ে দিলাম। গোটা পুরুলিয়া টাউনে স্পেশ্যাল ডিসকাউন্ট শুধু তিনিই পাবেন। তার দুটো শোকেস কোম্পানির তরফ থেকে হাজার টাকায় ভাড়া নিলাম–শুধু কোম্পানির জিনিস দিয়ে শোকেস দুটো সাজানোর জন্যে। ওষুধ ধরে গেল। চার বছর আগে এই ভদ্রলোকই আমার কাছে যা চেপে গেছিলেন, এখন তা রসিয়ে-রসিয়ে বলে গেলেন।

ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েক মন্দ ডাক্তার ছিলেন না। কিন্তু তার দাম্পত্য জীবন খুব মধুর হয়নি। তার সুন্দরী স্ত্রী-কে তিনি সুখে রাখতে পারেননি। দোষটা তার নিজের। বাড়িওলার বউয়ের কেন ছেলেপুলে হচ্ছে না, তার চিকিৎসা করতে গিয়ে সেই মহিলার সঙ্গে পরকীয়া প্রেম শুরু করে দেন। বউটিকে বাঁজা ভাবা হয়েছিল। আসলে বাড়িওলারই শুক্রকীটের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না। ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েক সেটা হাতেকলমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন বাঁজা বউয়ের গর্ভে ছেলে এনে দিয়ে।

এসব ব্যাপার চাপা থাকে না। জানাজানি হতেই টি-টি পড়ে যায়। তার স্ত্রী আক্ষরিকভাবেই ঝটা মেরে ডাক্তারবাবুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। ডাক্তারখানা তুলে দেন। একমাত্র মেয়েকে দার্জিলিং অঞ্চলের এক কনভেন্ট স্কুলে পাঠিয়ে দেন।

ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েক আর ফিরে আসেননি। এলে দোকানদার তা জানতে পারতেন। কেন, পাড়ার লোক তাকে ঠেঙাত। ঠেঙাত বাড়িওলার গুন্ডাও। ইনি বড় ভয়ানক লোক। বিষ্ণুপদ নায়েকের ছেলেকে তিনি নিজের ছেলে বলে মেনে নিতে চাননি। বউকেও দূর করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। সে ভদ্রমহিলা এখন বলতে গেলে ঝিগিরি করে বাপের বাড়িতে দাদাদের সংসারে। আমি কিন্তু হাল ছাড়লাম না। দোতলা বাড়িটার একতলায় মনিহারি দোকান। দোতলায় দুটো ঘর। একটায় থাকেন ডাঃ বিষ্ণুপদ নায়েকের স্ত্রী-আর-একটা ঘর বন্ধ থাকে। ওঁর মেয়ে কনভেন্ট থেকে এলে দিন কয়েক সেখানে থেকে যায়।

আমি একদিন স্যুটেড বুটেড অবস্থায় গট গটিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। মাসিমা, মাসিমা বলে ডাকতে ডাকতে সোজা ঢুকলাম তার ঘরে। ফেরিওয়ালারা কথা দিয়ে মানুষ কেনে–জিনিস বেচে। এই বিদ্যে আমিও শিখে গেছিলাম। ডাঃ নায়েকের স্ত্রীকেও জয় করতে বেশি সময় লাগেনি। সরলভাবেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম। আমি সেলসম্যান। কনজিউমার ডিভিশনের কিছু প্রসাধন দ্রব্য ঘরে-ঘরে ইনট্রোডিউস করতে হবে। ওঁর সাহায্য চাই।

সাহায্য পেয়েছিলাম। আলাপও জমে গেছিল। সাহস করে শুধু ডাঃ নায়েকের প্রসঙ্গটা তুলতে পারিনি। ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ফ্যামিলি ফটোগ্রাফেও ডাক্তারবাবুর কোনও ছবি দেখিনি। ওঁর মেয়ের অনেক ছবি আছে। বেশ চটপটে চৌকস এক কিশোরী।

এই কিশোরীর সঙ্গেও আলাপ হল একদিন। স্কুলের পাট চুকিয়ে তখন সে বাড়ি চলে এসেছে। কলকাতায় যাবে। হস্টেলে থেকে কী সব পড়াশুনো করবে প্ল্যান করছে। মেয়েটি মায়ের মতোই সুন্দরী। কনভেন্টের শিক্ষা আর অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাওয়ায় বেঁকা ভোজালি বললেই চলে। দু-দিকে কাটে। বেস কথা বললেই ভোজালি চালায়।

এরপর অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর গেছে। আমি আঠার মতো লেগে আছি নায়েক পরিবারের মা আর মেয়ের পেছনে। বিষ্ণুপদর ঠিকানা আমাকে বের করতেই হবে। একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, আমি কতখানি পাগল ছিলাম, আর আমার বাবা-মা এখন কোথায়।

সুযোগ একদিন পেলাম।

মাসছয়েক আগের কথা। খুব বৃষ্টি পড়ছিল। পুরুলিয়া ভিজিটে গিয়ে নির্দিষ্ট হোটলে উঠেছি। সকালবেলা আদুরে মায়ের কাছে গিয়ে আদর খেয়ে এসেছি। মা এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। একা বাড়িতে থাকে। হাসপাতাল থেকে পেনশন পায়, জমানো টাকার সুদ খায়, আমিও টাকা পাঠাই। আমি গেলেই ঘ্যানর-ঘ্যানর করে, এবারে একটা বিয়ে কর সতু। আমি বলি, পাগলের কখনও বিয়ে হয়? মা বলে, কে তোকে পাগল বলেছে? আমি বলি, বিষ্ণুপদ নায়েক। তাকে আমি চাই।

আদুরে মা সব জানত। মায়ের কাছে কিছুই গোপন করিনি। সেই বৃষ্টির দিনে রঘুনাথপুর থেকে ফিরে এসে ভাবলাম যাই মাসিমার সঙ্গে একটু গল্প করে আসি। কমলার খবরটাও নেওয়া যাক।

কমলা তার নাম। ডাক্তার নায়েকের মেয়ের নাম।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালাম। শুনলাম, মায়ের সঙ্গে মেয়ের কথা চলছে। দুজনেই খুব উত্তেজিত। এত জোরে কথা বলছে যে মাঝের চাতালে দাঁড়িয়ে শোনা যাচ্ছে।

মেয়ে বলছে, আবার এসেছিল?

মা বলছে, হ্যাঁ।

মেয়ে–টাকা চাইতে?

মা–হ্যাঁ।

মেয়ে–দিয়েছ?

মা–না।

মেয়ে–ইস, আমার সঙ্গে যেদিন দেখা হবে—

মা–মুখ ঘুরিয়ে থাকবি।

মেয়ে–কেন?

মা–-ওর টাকাতেই তো এতগুলো বছর বসে খাচ্ছি, বাড়িভাড়া দিচ্ছি তোর লেখাপড়া হচ্ছে–

মেয়ে–ভাগ্যিস জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে নিজের অ্যাকাউন্টে রেখেছিলে।

মা–ওই উড়নচণ্ডের ভয়েই করতে হয়েছিল। কিন্তু কী অবস্থাই দাঁড়িয়েছে…খেতে পাচ্ছে না …শরীর ভেঙে পড়েছে…।

মেয়ে–মদ তো ছাড়েনি।

মা–ছাড়তেও পারবে না।

মেয়ে–এখন কোথায়?

মা–সুকুজ হোটেলে।

মেয়ে–বোম্বাইয়ের কাজ?

মা–-ছেড়ে দিয়েছে। কলকাতায় কী যেন করছে।

মেয়ে–যাচ্ছি আমি সুকুজ হোটেলে।

মা–-কমলা!

আমি আর দাঁড়াইনি। তরতরিয়ে নেমে এসেছিলাম নীচে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। রাত হয়েছে। উলটো দিকের বাড়ির বারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে গা ঢেকে।

মিনিট দশেক পরেই দেখলাম কমলা নেমে এল রাস্তায়। মুখ থমথম করছে। এখন ওর বয়স তেইশ কি চব্বিশ। অপরূপা। সালোয়ার কামিজের দৌলতে ভোজালি চেহারা আরও ধারাল হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় মনে হয়েছিল, ভোজালিতে যেন নতুন শান পড়েছে।

আমি ওর পেছন-পেছন গেছিলাম। সুকুজ হোটেল পুরুলিয়ার খুব বাজে হোটেল। যত নীচুস্তরের লোকের আস্তানা। এখানে কমলার মতো মেয়ের আসা উচিত হয়নি।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হবে। মেয়ে-বাপে কথা ফুরোলেই আমি ঢুকব।

কিন্তু কমলা বেরিয়ে এল পাঁচ মিনিটেই। মুখে হতাশা। বুঝলাম বাপের দেখা পায়নি।

ও চলে যেতেই আমি ঢুকলাম। ম্যানেজার সামনেই বসে। আমার মতো চকচকে চেহারার লোক এ হোটেলে আসে না। তাই সে অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি যে সেলসম্যান, সেটা আঁচ করতে পেরেছিল। হাতের ব্যাগ দেখেই বুঝে নেয়। তাই আমি মুখ খোলবার আগেই বলেছিল, ঘর চাই?

চাই। হোটেল প্যারি আমার ভালো লাগছে না।

ওখানেই আছেন এখন?

হ্যাঁ। এখানে ঘর পেলেই চলে আসব।

কিন্তু কাল সকালের আগে তো পাবেন না।

খালি হবে তখন?

হ্যাঁ। ননম্বরের লোক কলকাতার ট্রেন ধরবেন।

বোর্ডে চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রত্যেক ঘরের চাবি ঝোলে সেই বোর্ডে। ঘরে লোক থাকলে, তার নাম লেখা কার্ড থাকে–তখন আর চাবি থাকে না।

ননম্বর ঘরের চাবি নেই। কার্ড আছে। কার্ডে লেখা রয়েছে, যাকে খুঁজতে এসেছি তার নাম। ডাঃ বি নায়েক।

বুক ধড়াস করে উঠেছিল নামটা দেখেই।

সহজভাবে জিগ্যেস করেছিলাম, ঘরটা এখন দেখে যেতে পারি?

কিন্তু উনি তো চাবি দিয়ে বেরিয়েছেন।

তাহলে একটু ঘুরে আসি।

আসুন। নটা নাগাদ আসবেন।

নটার সময়ে বোর্ডাররা খেতে বসে। বিষ্ণুপদও ওই সময়ে খাবেন। তারপর ওপরে উঠবেন। আমি তাকে চিনি না। এই প্রথম দেখব। তাই নটার আগেই হাজির হলাম হোটেলে। এক কাপ চা খেলাম। আরও আধঘণ্টা বসবার পর এক ছোকরা এসে বললে, চলুন ননম্বর ঘর দেখে যাবেন।

তিনতলায় লম্বা করিডরের দু-ধারে খুপরি ঘর। ননম্বরের দরজা ভেজানো। ছোকরা বাইরে থেকে হেঁকে বললে, আসব?

ভারি গলা ভেসে এল ভেতর থেকে, এসো।

ছোকরা দরজাটা দু-হাট করে খুলে রেখে ঢুকে গেল ভেতরে। টেবিল থেকে খালি গেলাস, চায়ের কাপ নিতে নিতে বিষ্ণুপদকে জিগ্যেস করলে, কিছু লাগবে?

না। কে রে বাইরে?

উনি ঘর দেখছেন। আপনি চলে গেলে কাল আসবেন।

আমি কিন্তু ঘর দেখছিলাম না। আমার মনের ক্যামেরায় বিষ্ণুপদর ফটো তুলে নিচ্ছিলাম। রোগা লিকলিকে মাঝবয়সি লোকটাকে দেখে রাগতে পারিনি–অনুকম্পা হচ্ছিল। দু-চোখ ছলছল করছে–ঘোলাটে–মদের ক্রিয়া। পুষ্টির অভাব গোটা শরীরে। গালের হাড় উঁচু, চোয়ালের হাড় খোঁচা হয়ে বেরিয়ে–চামড়া দিয়ে মোড়া একটা কঙ্কাল। গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে খাটের ওপর, চব্বিশ বছর আগে এই লোকটাই আমাকে পাগল সাজিয়ে নয়নতারায় ঢুকিয়েছিল।

চলে এলাম। ম্যানেজারকে বলে এলাম, কাল সকালেই আসছি। ঘর পছন্দ হয়েছে।

কলকাতার ট্রেন ছাড়ে খুব ভোরে। আমি পাঁচটার আগেই আমার সামান্য জিনিসপত্র সাইকেল রিক্সায় চাপিয়ে হাজির হলাম সুকুজ হোটেলের সামনে। একটু পরেই কলকাতার যাত্রী বেরিয়ে এলেন বাইরে। বিষ্ণুপদ নায়েক।

আমি তার পেছন নিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়, দেখে গেছিলাম ১০০ নম্বর সার্পেন্টাইন লেনে তাঁর আস্তানা। এ ঠিকানায় আগে পেল্লায় বস্তি ছিল। চারদিকে উঁচু-উঁচু পাকা বাড়ি। মধ্য কলকাতায় এত বড় বস্তি কি চিরকাল বস্তি হয়ে থাকতে পারে? তাই খানিকটা অঞ্চলে বদখৎ টাইপের কয়েকটা নতুন বাড়ি উঠেছে। সরু তিনতলা বাড়িটার তিনতলায় থাকেন বিষ্ণুপদ।

এসব আমি পরের দিন জেনেছিলাম। সকালেই বাড়িওলার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি থাকেন দোতলায়। জিগ্যেস করেছিলাম, ঘর খালি আছে কি না।

লোকটা লোফার টাইপের। চোয়াড়ে চেহারা, কথাবার্তায় ইতোরামি। খোঁচা দাড়ির জন্য আরও জঘন্য লাগছিল। চোখ লাল, মাথায় কঁকড়া চুল। বিশাল বপু। দেখলেই গুন্ডা বলে মনে হয়। এরাই এখন কলকাতার চটজলদি বাড়িওলা। ওদের সমীহ করে চলতেই হয়।

সেলামি দিতে হবে। কর্কশ গলাকে একটুও নরম করবার চেষ্টা করেনি ইতোর লোকটা।

কত?

দশ হাজার।

ভাড়া?

দুশো। লাইট ফ্যানের চার্জ আলাদা।

কোন ঘর?

একতলায় মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট আছে। ওয়ানরুম ফ্ল্যাট, অ্যাটাচড বাথ। দুটোই খালি।

তিনতলায় নেই?

না।

আর কথা বাড়াইনি। তিনতলায় ঘর তো একখানা। চিলেকোঠার ঘর। বিষ্ণুপদ তাহলে ওইখানেই থাকেন।

.

সঙ্গে হাজার টাকা ছিল। অ্যাডভান্স করে দিলাম। একতলার দক্ষিণের ফ্ল্যাট নেব বলে দিলাম। হাওয়া পাওয়া যাবে। বলে গেলাম কাল-পরশুর মধ্যেই চলে আসছি।

কলকাতায় যেখানে ছিলাম, সেখানকার আস্তানায় রইল সব জিনিস। সামান্য কিছু মালপত্র নিয়ে দু-দিন পরে চলে এলাম মুচিপাড়ার বাড়িতে। সকালবেলা গেছিলাম। নহাজার দুশো টাকা ইতোর বাড়িওলার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের দখল নিলাম। তারপর ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কাজকর্ম শেষ করে, ফরডাইস লেনের হোটেলে একপেট খেয়ে ঢুকলাম নতুন আস্তানায়।

দরজা খুলে ঢুকে ঘুরে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, চোখ পড়ল সামনের ফ্ল্যাটের দরজায়। সে দরজায় এখন আর তালা নেই। ভেজানো রয়েছে। ভেতরে আলো জ্বলছে। তাই দেখা যাচ্ছে, দুই পাল্লার ফাঁকে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্পষ্ট বুঝলাম, নিজেকে আড়ালে রেখে সে আমাকে দেখছে।

আমার আর দরজা বন্ধ করা হল না। সামনের ফ্ল্যাটে তাহলে নতুন ভাড়াটে এসেছে। আমাকে দেখার তার যখন এত কৌতূহল, তাকে দেখার কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসল। তাই দুই কপাটে দু-হাত রেখে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

নতুন ভাড়াটে যখন দেখল আমিও তাকে দেখছি, মানে দেখবার চেষ্টা করছি, তখন তো আর দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দেওয়া যায় না। দরজা খুলেই তাকে বেরিয়ে আসতে হল।

ভোজালি হেসে সে বললে, চিনতে পারছেন?

কমলা! এখানে?

আমি থ হয়ে গেছিলাম। মুখ দিয়ে কথা বেরোয়নি।

কমলা বললে, ভেতরে আসতে আজ্ঞা হোক।

যন্ত্রচালিতের মতো তার ঘরে বসলাম।

ঘরের একখানামাত্র চেয়ারে আমাকে ইঙ্গিতে বসতে বলে কমলা গিয়ে বসল নোংরা সরু খাটে।

বললে বাঁকা সুরে, আপনি আমার বাবার পেছনে লেগেছেন কেন?

আরও শোচনীয় হল আমার অবস্থা।

কমলা বললে, নিজেকে বড় ধড়িবাজ মনে করেন আপনি। তাই না? আপনি আমার বাবার পিছু নিয়েছিলেন, আর আমি পিছু নিয়েছিলাম আপনার।

আ…আমার!

আজ্ঞে। সুকুজ হোটেল থেকে ফিরেই একটা সাবান কিনতে গেছিলাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে।

আমি চেয়ে রইলাম। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হল সেই মনিহারি দোকানটার নাম, যার দোতলায় থাকে কমলা আর তার মা। দোকানিরও নামও লক্ষ্মী।

লক্ষ্মীদার মুখেই শুনলাম, আপনি একটু আগেই ওপরে গেছিলেন, নেমে এসে বারান্দার তলায় দাঁড়িয়েছিলেন, আমার পেছন-পেছন গেছিলেন। লক্ষ্মীদা মন্তব্য করে বলেছিল, আপনি নাকি আমার সঙ্গে ভাব করতে চাইছেন। আমি কিন্তু বুঝেছিলাম, আপনার মতলব তা নয়। কী করে বুঝলাম জানেন?

আমি শুধু চেয়েই রইলাম।

কমলা বলে গেল, দেড়তলার চাতালে অনেক জল আর কাদা মাখা জুতোর ছাপ ছিল। ওখানে কেউ দাঁড়িয়েছিল। দেড়তলা থেকে দোতলায় আর ওঠেনি। ফের কাদামাখা জুতোর ছাপ এঁকে নেমে গেছে সিঁড়ি দিয়ে। কেন সে ওখানে দাঁড়িয়েছিল? কারণ, সে আড়ি পেতে শুনছিল আমার সঙ্গে মায়ের কথা। শোনবার পর সে আমার পিছু নিয়ে গেছিল সুকুজ হোটেলে। কেন গেছিল? এটা জানার জন্যে তক্ষুনি আমি ফিরে গেলাম সুকুজ হোটেলে। দেখলাম হোটেলে বসে আপনি চা খাচ্ছেন। দেখলাম, একটু পরে ওপরে উঠে গেলেন। নেমে এসে ম্যানেজারকে বললেন, কাল ননম্বর খালি হচ্ছে ভোরে–আমি আসছি আটটায়। ননম্বরে আমার বাবা উঠেছে, সে খবর আমি নিয়েই গেছিলাম। বাবা ভোরে চলে যাচ্ছে জেনে ঠিক করলাম, বাবার পেছনই নেব আপনাকে পরে এক হাত নেব। ভোর পাঁচটায় সুকুজ হোটেলের সামনে পৌঁছে দেখলাম, আপনি ফলো করছেন বাবাকে। এলেন এখানে। এখন দেখছি আমার আগেই ঘর নিয়েও ফেলেছেন। কে আপনি? পুলিশ?

না। এতক্ষণে কথা বলার মতো মনের অবস্থা ফিরে পেলাম। বললাম, আমি এক পাগল।

সব কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল কমলা।

আমি বললাম, আপনার বাবার পেছন নিয়েছি শুধু এই কারণেই। আমি জানতে চাই, কেন উনি চার বছরের একটা সুস্থ বাচ্চাকে পাগল বলে সার্টিফাই করেছিলেন?

আর জানতে চান আপনার বাবা আর মায়ের ঠিকানা? জানতে চান, কেন তারা আপনাকে পাগলাগারদে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেলেন? কমলার চোখ আর গলা দুটোই এখন নরম হয়ে এসেছে।

যদি তারা বেঁচে থাকে, বললাম আমি।

কমলা কিছুক্ষণ কথা বলল না। মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে বললে, আমাদের দুজনকেই বোকা বানিয়ে গেল বাবা।

কেন?

কাল রাতেই তিন তলার ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

সেকী!

বাড়িওলাকে সেলামি আর ভাড়ার টাকা দিয়ে আলগোছে জিগ্যেস করেছিলাম ছাদের ঘরে যিনি থাকেন, তিনি বেশ আছেন। ছাদ পাচ্ছেন, হাওয়া পাচ্ছেন। বাড়িওলা বললে–এখন আর নেই। কাল রাতেই চলে গেল। আমি চমকে উঠেও সামলে নিয়ে বললাম–তাহলে ওই ঘরটাই দিন না। বাড়িওলা বললেনা, না। ও ঘরে খুব জানাশুনা ছাড়া কাউকে থাকতে দিই না আমি।

আমি বললাম, আপনার বাবাকে তাহলে বাড়িওলা ভালো করেই চেনেন?

তাই তো মনে হল।

তাহলে, বলে আমার চোখ রাখলাম কমলার চোখের ওপর। চোখে-চোখে বাকি কথা হয়ে গেল।

সেই থেকে আমরা দুজনে পালা করে বাড়িওলার পেছনে লেগে রয়েছি। লোফারটার নাম বাচ্চু সেন। ছেলেপুলে কেউ নেই। বাচ্চুবাবুর চেহারা যতখানি কর্কশ, ওর স্ত্রীর চেহারা ততখানি মোলায়েম। টিপিক্যাল বাংলার বধূর মতো যে ধরনের বন্ধুদের কথা শৈলজানন্দ শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসে পড়েছি। ফরসা, গোলগাল মুখ, কপালে আর সিঁথিতে সিঁদুর, চওড়া লালপেড়ে শাড়ি ছাড়া বাহারি শাড়ি কোনওদিন পরতে দেখিনি। চোখে বা মুখে বা কথায় উগ্রতার লেশ মাত্র নেই। হাসিখুশিও নয়। গোটা মুখখানায় যেন বিষাদ লেগে রয়েছে। চাহনির মধ্যেও বিষাদের ছোঁয়া রয়েছে। বিষাদ রোগে ভুগছে নিশ্চয়। নয়নতারায় এরকম পেসেন্ট অনেক দেখেছি।

বাচ্চু সেন বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোয় না। একটা ঠিকে ঝি দুবেলা এসে বাজার হাট, রেশন ধরা, দুধ এনে দেওয়া, ঘর মোছা এইসব করে দেয়। বাচ্চুর বউকে কোনওদিন দোতলা থেকে একতলাতেও নামতে দেখিনি।

আমার আর কমলার মধ্যে চুক্তি হয়েছিল, আমি যখন সারাদিন কাজে থাকব, কমলা তখন নীচের ঘাঁটি আগলাবে। আমি ফিরে এলে ওর ছুটি। তখন করিডোরে চোখ রাখব আমি। এ কাজটা আমি করতাম কমলার ঘরে বসেই। উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের আলাদা রাখা যায় না।

কিন্তু এটা সহ্য হয়নি বাচ্চু সেনের। একদিন সন্ধ্যায় দরজা খোলা রেখে আমি বসে রয়েছি কমলার ঘরে, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনলাম। ভারী আওয়াজ। নির্ঘাত বাচ্চু নামছে। সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই চেয়ে রইলাম দরজার দিকে। বাচ্চু বেরিয়ে গেলেই ওর পেছন নেব–এইটাই ছিল আমাদের প্ল্যান।

ও বাড়িতে ঠাঁই নেওয়ার ষষ্ঠ দিনের ঘটনা এটা।

বাচ্চু সেন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। রক্তচক্ষু মেলে দেখল আমাকে আর কমলাকে। পায়ের আওয়াজ শুনেই আঁচ করেছিলাম। মদে চুর-চুর হয়ে আছে। এখন ঘামে ভেজা মুখ আর লাল চোখ দেখে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। গায়ে একটা হাতকাটা গেঞ্জি। চেককাটা লুঙ্গিতে মাংসের ঝোল পড়েছিল বোধহয় দাগ ধরেছে।

বিষাক্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাচ্চু জঘন্য গলায় বললে, এটা প্রেমপট্টি নয়।

নিমেষে ঝলসে উঠল ভোজালি। কমলার স্বভাব-তীব্র চোখে যেন আগুন ঠিকরে গেল, কী বললেন?

যা বলবার তা বলে দিলাম, বাচ্চুর গলাতে ভয়ঙ্করের সঙ্কেত, একলা মেয়েছেলেকে থাকতে দিয়েছি দুর্নাম কুড়োনোর জন্যে নয়। এ পাড়ার একটা সুনাম আছে।

নিজের চরকায় তেল দিন, কঠিন গলায় বলে কমলা। পেশায় আমি সাংবাদিক, আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি। যখন খুশি ঘরে থাকব, যখন খুশি বেরোয়, যার সঙ্গে খুশি কথা বলব। আপনি বাড়িওলার মতো থাকবেন, গার্জেনগিরি করতে আসবেন না।

কটমট করে চেয়ে রইল বাচ্চু সেন। মেয়েদের মুখে এরকম চঁচাছোলা কথা বোধহয় কখনও শোনেনি। হিংস্রতা প্রকট হল দাঁতে দাঁত চেপে ধরার মধ্যে।

মাতালকে বিশ্বাস নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সহজ গলায় বললাম, বাচ্চুবাবু, আপনি ঘরে যান। এটা অবাধ মেলামেশার যুগ। এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই। আপনি কিছু ভাববেন না। আমাদের নিয়ে আপনাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। যান, যান।

বাচ্চু যত বড় লোফারই হোক আমার পেটাই চেহারা দেখেই বুঝেছিল, তর্জন-গর্জন করলে ফল হবে না। তাই আর একবার কমলার দিকে রক্তচক্ষু হেনে উঠে গেল ওপরে।

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম কমলাকে, এ রকম মেজাজ আর দেখাবেন না, আমাদের কৌশলে ঠান্ডা মাথায় কাজ উদ্ধার করতে হবে। হারামজাদা যখন বাড়ি থেকে বেরোয় না, তখন আমি ওর বাড়ি ঢুকব–আজ, রাতেই।

মানে?

করিডরটা গিয়ে শেষ হয়েছে সরু উঠোনে–দুপাশে আমাদের বাথরুম। তার ঠিক ওপরেই সরু বারান্দাটা বাচ্চু সেনের। পাইপ বেয়ে উঠে যাওয়াটা এমন কিছু নয়। কেউ দেখতেও পাবে

পেয়ারা গাছটার জন্যে। আজকের এই মাথা গরমের পর গিন্নির কাছে নিশ্চয় খানিকটা লম্ফজ করবে বাচ্চু রাস্কেল। কী বলে, তা শুনতে চাই।

তখন সাতটা বাজে। বাচ্চুর শোওয়ার ঘরে সবুজ আলো জ্বলে রাত দশটা নাগাদ। হাতে তখনও তিনঘণ্টা ছিল। আমি খেয়ে এলাম ফরডাইস লেনে। তারপর গেল কমলা। বাচ্চু ওপর থেকে আর নামেনি। দশটা নাগাদ রান্নাঘর আর খাওয়ার ঘরের আলো নিভে গেল। আমি পেছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শোওয়ার ঘরে সবুজ আলো জ্বলে উঠতেই বৃষ্টির জলের মোটা পাইপ ধরে উঠে এলাম দোতলায় বারান্দায়। শোওয়ার ঘরের একটা জানলা এই বারান্দায় দিকে। খোলা রয়েছে। তাই পাইপ বেয়ে আর একটু উঠে তিনতলার ছাদের আলসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। কান রইল জানলার দিকে। শুনলাম স্বামী-স্ত্রীর কথা।

বাচ্চুর বউ বলছে, আজকালকার মেয়েরা মেলামেশা করে, নিজেদের বাঁচিয়েও চলে। তোমার নাক গলানো ঠিক হয়নি।

তুমি থামো, গরগর করে ওঠে বাচ্চু, এত বড় স্পর্ধা..চোখ রাঙায়…চুলের মুঠি ধরে… ছোঁড়াটাও কম নয়।

ওকেই আমার ভয়।

কীসের ভয়? বাচ্চু সেন কাউকে ভয় পায় না।

তুমি কিছু বোঝোনি?

কী..কী…বুঝবটা কী?

নতুন ভাড়াটে এলে কত কথাই তো জিগ্যেস করো–একে তো জিগ্যেস করলে না?

অ্যাশ কোম্পানির সেলসম্যান। ঠিকই বলেছে। কার্ড তো দেখিয়েছে।

তাতেই সব জানা হয়ে গেল? আবার কী জানব?

ওর বাবা কে, মা কে এইসব।

জেনে আমার লাভ? টাকার দরকার টাকা পেয়েছি।

ওগো তুমি কি অন্ধ?

মানে?

ওর চাহনি দেখেছ?

চাউনি…চাউনি নিয়ে কি ধুয়ে খাব?

সেই চাউনি…ঠিক তার মতো..ও সে-ই।

কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ। তারপর চাপা গলায় বললে বাচ্চু, ঠিক বলছ?

বাচ্চুর বউ এমনিতে খুব আস্তে কথা বলে। সব সময়ে যেন মুষড়ে আছে। এখন একটু কান্নার ছোঁয়া লাগল গলার সুরে। হা…হা…মায়ের মন সেই সর্বনাশের পর থেকে…

আবার সেই কথা! সর্বনাশ হতই।

তাই বলে ওইভাবে।

আঃ!

বাচ্চুর বউ আর একটা কথাও বলল না। ঘরের আলো নিভে গেল। একটু পরেই বাচ্চুর নাকডাকার শব্দ পেলাম।

পাইপ বেয়ে নেমে এলাম। কমলাকে বললাম যা শুনেছি।

পরের দিন সন্ধ্যায় বাচ্চু বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আমি তখন বাড়ি ছিলাম না। কমলা ওর পিছু নিয়েছিল। কিন্তু সুরী লেনের মোড় পর্যন্ত। স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বাড়ির সামনে কোলে-দের গ্যারেজে ঢুকেছিল বাচ্চু। বুলেট মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

কমলা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছিল ফ্ল্যাটে। আমি তখন সবে ফিরেছি। বাচ্চু ফিরে এল গভীর রাতে।

.

তারপরের দিন তিনতলায় এল নতুন ভাড়াটে।

রিক্সা থেকে যখন নামছে, তখন দেখেছিলাম তাকে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। চুলদাড়িতে সাদা চুল অনেক। দাড়িও রবিঠাকুরের দাড়ির মতো বুক পর্যন্ত ঝুলছে। চুল সাধু সন্ন্যাসির মতো। জট পাকিয়ে গেছে। লম্বা আর নোংরা। খুব রোগা। পোশাক কিম্ভুত। পুরো হাতা ফতুয়া। কালো রঙের। পাজামাও কালো রঙের। পিঠে একটা পুঁটলি। হাতে বাঁশের লাঠি। চোখে কালো চশমা।

জানলা দিয়ে দেখলাম, রিক্সাওলা তাকে হাত ধরে নামিয়ে দিল। অতি কষ্টে সে নীচে নামল। লাঠি সামনে বাড়িয়ে ঠুকে-ঠুকে দরজার দিকে এগোল–রিক্সাওলা তার হাত ধরে নিয়ে গেল করিডর দিয়ে, সিঁড়ির ওপর দিয়ে, দোতলায় চাতাল পেরিয়ে, তিনতলার। একটু পরেই শুনলাম, বাচ্চু ওঘর থেকে বেরিয়ে ভারী পায়ে উঠে গেল ওপরে।

রিক্সাওলা নেমে আসতেই করিডরে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলাম, কে রে? অন্ধ নাকি?

সে বললে, হ্যাঁ।

পরের দিন থেকে সে রোজ নেমে আসত লাঠি ঠুকে-ঠুকে, সার্পেন্টাইন লেন আর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের বাড়িগুলোর দেওয়াল ঘেঁষে চলে যেত শিয়ালদা স্টেশনে। ফিরত রাত্রে। পেছন পেছন গিয়ে দেখেছি মেন স্টেশনের সামনে ইসকনের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছে। মুখে একটাই একঘেয়ে বুকনি : বুড়ো অন্ধকে দশটা পয়সা দিয়ে যাও বাবা। কাতারে কাতারে লোক যে অঞ্চলে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত যাতায়াত করছে, সেখানে অন্ধ ভিখিরি একজনই। রোজগার ভালোই চলছিল।

আমি নিজেও একদিন দশ পয়সা ফেলে দিলাম কেঁচড়ে। জিগ্যেস করলাম, নাম কী তোমার?

সাধুচরণ।

রাত নটা নাগাদ ফিরত সাধুচরণ। সারাদিন থাকত শিয়ালদা স্টেশনের আশেপাশে। খেয়ে নিত কোর্টের সামনের ফুটপাতের দোকানে। ও অঞ্চলের সব্বাই ওকে চিনে গেল ছমাসে। ছমাস আমি তাকে চোখে-চোখে রেখেছি। তিনতলায় সে উঠে গেলে দেখেছি, ছাদের ঘরে পরদার ফাঁকে আলো জ্বলছে। আলো যখন নিভে যেত, আমি পাইপ বেয়ে পেয়ারা গাছের আড়াল রেখে উঠে যেতাম দোতলায়, কখনও তিনতলায়। ছাদেও উঠেছি। কিন্তু সাধুচরণের ঘর বন্ধ থাকত, জানলায় পরদা ঝুলত, ঘর অন্ধকার; কিচ্ছু দেখতে পেতাম না।

বাচ্চু আর বউয়ের কথাবার্তা শুনে খটকা লেগেছিল একদিন। যেদিন সাধুচরণ ভাড়াটে হয়ে এল সেই দিন।

রাতে উঠেছিলাম পাইপ বেয়ে। শুনেছিলাম ওর বউ বলছে, নতুন ভাড়াটে আনলে, দেখেশুনে এনেছ তো?

হ্যাঁ-হ্যাঁ। অন্ধ বলেই তো আনলাম। তোমার ছাদে উঠতে অসুবিধে হবে না।

কাপড় মেলতে বাচ্চুর বউ রোজ সকালে উঠত ছাদে। বিষ্ণুপদ যখন থাকতেন, তখনও নিশ্চয় উঠত।

ছমাস ধরে আড়ি পেতেও কিন্তু বাচ্চু আর ওর বউয়ের মুখে আমাকে নিয়ে আর একটা কথাও শুনিনি, নির্জনে স্বামী-স্ত্রীরা প্রাণ খুলেই তো কথা বলে। বাচ্চু অতীতকে যেন কবর দিয়ে রাখতে চায়। বউ তা জানে। ভয়ে কথা বলে না।

বাচ্চু কিন্তু সেই রাতের পর থেকে আমার দিকে যখন তাকায়, তখন ওর চোখে দেখি অদ্ভুত এক চাহনি। কী যেন খুঁজছে আমার চোখ-মুখের মধ্যে। একদিন সটান জিগ্যেস করেছিল, আপনার পুরো নাম কী বলুন তো? কার্ডে তো লেখা আছে এস বোস।

আমি গলা ছেড়ে অট্টহাসি হেসেছিলাম। বলেছিলাম, সত্য বোস।

তারপরেই উঠেছিল হেঁচকি। উপুড় হয়ে খাটে শুয়েও হেঁচকি থামাতে পারিনি। বাচ্চু কিন্তু আর আমার কাছে ঘেঁষেনি ঝি-কে দিয়ে পাঠিয়ে দিত ভাড়ার রসিদ ঝি-এর হাতেই দিতাম টাকা।

ছমাস পরে মেট্রো রেলের খাদে পাওয়া গেল সাধুচরণের মৃতদেহ।

.

খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল। মেট্রো রেলের মুণ্ডপাত করেছিল সাংবাদিক। রাত নামলে যখন লোডশেডিং হয়, তখন খুঁড়ে ফেলে রাখা এই মৃত্যুকূপগুলো আরও কতজনের প্রাণ নেবে, এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের পিণ্ডি চটকেই হাত ধুয়ে ফেলেছিল জার্নালিস্ট। সাধুচরণের নাম ঠিকানাটা অবশ্য ছাপিয়ে দিয়েছিল। ফতুয়ার পকেটে পাওয়া গেছিল ভাড়ার রসিদ। তাতেই লেখা ছিল নামধাম।

পুলিশও এসেছিল। বাচ্চুর সঙ্গে নামকাওয়াস্তে দেখা করে, তদন্ত সেরে চলে গেছিল। আমার ঘরে যখন এসেছিল, আমি শুধু বলেছিলাম, তিনতলায় থাকত জানি, শিয়ালদায় ভিক্ষে করত। মেট্রো রেলের ওদিকে মরতে গেছিল কেন?

মরতে! ভিক্ষের লোভ বড় লোভ। বলে চলে গেছিল পুলিশ।

সাধুচরণকে পাওয়া গেছিল বৌবাজার আর চিত্তরঞ্জন এভিনুর চৌমাথায়–পাতালে।

সেই রাতে খাটে শুয়ে বাচ্চুর বউও জিগ্যেস করেছিল একই কথা, আহারে। অতদূরে গেল কেন?

একই জবাব দিয়েছিল বাচ্চু, মরতে।

.

তারপরের দিন সকাল বেলা সার্ট প্যান্ট পরে করিডর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল বাচ্চু। এটা ওর বাইরে বেরোনোর পোশাক। ছমাসে এই প্রথম বাইরে যাচ্ছে। এরকম কুয়োর ব্যাঙ জীবনে দেখিনি।

ও বেরিয়ে যেতেই কমলা এল আমার ঘরে। আমরা এখন পরস্পরকে তুমি বলে সম্বোধন করি। নাম ধরে ডাকি। মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে। আমার জীবনে যে লোকটা সর্বনাশ ঘটিয়েছে, তার মেয়ে সে। তবুও ভালো লাগে। বাপের রক্ত ধমনীতে নিয়েও কমলা অন্য জাতের মানুষ।

যা বলছিলাম। হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢুকে কমলা বললে, যাও-যাও! নিশ্চয় মোটর সাইকেল বের করতে যাচ্ছে। সেদিনও এই ড্রেস করে বেরিয়েছিল।

আমাকে আর কিছু বলতে হয়নি। বেরোবার জন্যে আমিও জামাকাপড় পরে নিয়েছিলাম। সেলসম্যানের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম রাস্তায়। দেখলাম, মোড় ঘুরে সুরী লেনে ঢুকছে বাচ্চু। ও গেল গ্যারেজে। অনেকদূর থেকে দেখলাম, বুলেট আর স্টার্ট নিচ্ছে না। ছমাস ফেলে রেখে দিলে এত সহজে স্টার্ট নেয় না। বেশ ভোগাবে। মিস্ত্রি প্লাগ সাফ করতে বসে গেল। আমি চলে গেলাম ট্রাম রাস্তায়। হাসপাতাল থেকে ট্যাক্সি বেরোচ্ছিল। মিটার ডাউন করে ঢুকলাম সুরী লেনে। ইঞ্জিন বন্ধ করিয়ে বসে রইলাম ভেতরে।

প্রায় আধঘণ্টা পরে মাথায় হেলমেট এঁটে, শাঁখারিতলা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাচ্চু আর বুলেট। পেছনে আমার ট্যাক্সি।

ডায়মন্ডহারবার যাওয়ার পথে আজকাল বেশ কয়েকটা হলিডে হোম হয়েছে। কলকাতার কালো টাকার বাবুরা এখানে এসে সারাদিন পরের বাড়ির মেয়ে-বউ নিয়ে ফুর্তি করে। সন্ধ্যায় কলকাতা ফেরে। কেউ-কেউ রাতেও ফুর্তি চালায়।

এরই পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে অনেক ভেতরে। বড় রাস্তা থেকে ভেতরের সেই অঞ্চলের সৌন্দর্য টের পাওয়া যায় না। এককালে নিশ্চয় কোনও জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল। টলটলে জলের ঝিল আর দীঘি, ফুলে ভরা বাগান, বড়-বড় গাছ। পুরো জায়গাটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সে যে কত বিঘের জমি, সে আন্দাজ করবার মতো অবস্থা আমার ছিল না। পাঁচিলের ওপর দিয়ে শুধু একটা বাড়ির ওপর দিক দেখেছিলাম। অনেকদূরে রয়েছে। রোদ্দুরে ঝকঝক করছে। আলট্রামডার্ন ডিজাইনের প্রাসাদ নয়। আগের যুগের সুন্দর স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন। বড়-বড় থাম। ব্রিটিশ আমলের খিলেন। যেন কোনও রাজারাজড়ার বাড়ি।

লোহার গেটের সামনে বুলেট পৌঁছতেই স্টিল প্লেটের গায়ে একটা খুপরি খুলে একজন তাকিয়েছিল। তারপরেই খুলে গেল গেট, ঢুকে গেল বাইক।

ট্যাক্সি ছাড়লাম না। পানের দোকানে বসে গল্প শুরু করলাম। এ বাড়ির মালিকের নাম দয়ালশঙ্কর শেঠ। মারোয়াড়ি নয়। বাঙালি শেঠ। বহু বছর আগে এই বাড়ি আর বাগান কিনে নিয়েছে। আগের মালিক রেস খেলেই ফতুর হয়েছিল। এখনকার মালিক বাড়ি থেকেই বেরোয় না। একটা বিরাট গাড়ি আছে। বিলিতি গাড়ি। কালেভদ্রে তাতে চেপে এদিক-ওদিক ঘুরে আসে। ছেলেপুলে নেই। বউ বড় খিটখিটে। চাকর-দারোয়ান মালি-ঝি আউটহাউসে থাকে। উলটোদিকের পাঁচিলের ধারের দোতলা বাড়িটায় থাকে লিকলিকে একটা লোক খুব বদমেজাজি। কারও সঙ্গে মেশে না। নিজের বাড়ির চারদিকে জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। মালিকে ঘেঁষতে দেয় না। গভীর রাতে সেখানে হাসি আর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কখনও মেয়েছেলের কখনও ব্যাটাছেলের। লোকটার চরিত্র ভালো নয়। জ্যান্ত পিশাচ। মুখ দেখলেই বোঝা যায়।

ঠিক এই সময়ে বুলেট-এর বিকট আওয়াজ শুনলাম। হেলমেটধারী বাচ্চু বেরিয়ে এল দু চাকায় চেপে। ট্যাক্সির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে চেয়ে দেখল সেদিকে। ভাগ্যিস আমি দূরে পানের দোকানে বসেছিলাম আমাকে দেখবার আগেই উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম দোকানের পেছনে। বুলেট বেরিয়ে গেল সামনে দিয়ে। ট্যাক্সি নিয়ে পেছন-পেছন আমি ফিরে এলাম মুচিপাড়ায়।

কমলা বসেছিল আমার জন্যে। সব শুনল। বললে, বুনো হাঁসের পেছনে আর কদ্দিন দৌড়োব, সত্য?

আমি বললাম, কী করতে চাও?

ও বললে, বিয়ে।

আমাকে?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমি সত্যিই পাগল ছিলাম কি না, সেটা না জেনে তো বিয়ে করব না।

সেটা জানবার ভার দাও যোগ্য লোককে। ছমাসেও আমরা যা পারিনি–ছদিনে তা জানা যেতে পারে।

গোয়েন্দার কথা বলছ?

হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথ রুদ্র তার নাম।

.

ইন্দ্র বললে, এখান থেকে মুচিপাড়া বেশি দূরে নয়। আপনি কমলাকে নিয়ে আসুন।

সত্য বললে, সে সুভাষ সরোবরে বসে আছে। আপনার বাড়ির সামনেই।

নিয়ে আসুন।

মিনিট কয়েক পরেই কমলাকে নিয়ে ফিরে এল সত্য। একবিন্দুও রং চড়ায়নি সে কমলার চেহারার বর্ণনায়। সত্যিই চাবুক চেহারা। তীব্র চাহনি। সালোয়ার কামিজের আড়ালে বাঁকা ভোজালিই বটে।

হাত তুলে সে বললে ইন্দ্রকে, আমি আপনার গুণমুগ্ধ।

বেগুন মুগ্ধ, বলে হাল্কা হেসে দুজনকে সোফায় বসাল ইন্দ্র। কোনও বাগাড়ম্বর করল না। কমলাকে বললে, সত্য বসুর উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। আপনারটা নয়।

আমার উদ্দেশ্য?

হ্যাঁ।

খুব সোজা।

না। খুব বেঁকা।

মানে? আপনি জানতে চান, আপনার বাবা অত টাকা কোত্থেকে পেয়েছিলেন?

যেন অদৃশ্য চাবুকের আঘাতে বিবর্ণ হয়ে গেল কমলা।

ইন্দ্র বললে, কত টাকা ছিল জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে?

পাঁচ লাখ।

পুরুলিয়ায় একজন ছাপোষা ডাক্তার এত টাকা হঠাৎ পেল কোত্থেকে? এইটাই আপনার কৌতূহল। পাপের টাকার সুদে মা-মেয়ের এতদিন চলছে কি না–এইটাই আপনি জানতে চান।

হ্যাঁ।

পুরো ব্যাপারটায় টাকার খেলা চলছে। টাকার খুব গন্ধ পাচ্ছি। দেখা যাক কী করতে পারি।

পরপর কয়েকটা ফোন করে গেল ইন্দ্রনাথ।

প্রথম ফোনটা ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এক চাই অফিসারকে। একশ নম্বর সার্পেন্টইন লেনের বাচ্চু সেন কত বছর আগে জমি কিনেছিলেন? বাড়ি কি কনট্রাক্টর তৈরি করেছিল? কত টাকা লেগেছিল। আন্দাজি হিসেব পেলেই চলবে। অসম্ভব? অসম্ভবকে সম্ভব করাই কর্পোরেশনের কাজ। টাকায় সব হয়। খবর নিতে হবে বাচ্চু সেনকে না জানিয়ে।

দ্বিতীয় ফোনটা চব্বিশ পরগণার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে। তিনি তরুণ আই এ এস অফিসার। ইন্দ্রনাথ তাকে দাবড়ি দিয়ে বলে গেল, দয়ালশঙ্কর শেষ কত বছর আগে জায়গা জমি কিনেছিলেন? কার কাছ থেকে কত টাকায় কিনেছিলেন? আগে কোথায় থাকতেন? এ খবরও নিতে হবে দয়ালশঙ্করকে না জানিয়ে।

তৃতীয় ফোনটা দিল্লির প্রেমচাঁদ ডিটেকটিভ এজেন্সিকে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমচাঁদ মালহোত্রা ইন্দ্রনাথকে তোয়াজ করতে পারলে যেন বাঁচে। ইন্দ্রনাথ তাকে তুই তোকারি করে বলে গেল, আজ থেকে আটাশ বছর আগে একটা বার্থ সার্টিফিকেট দিল্লি থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। সুপ্রিয় আর সাধনা বসু ছেলে সত্য বসুর নামে এই সার্টিফিকেট নিয়েছিল। বাবা আর মায়ের বর্তমান ঠিকানা বের করা যাবে?

.

সাত দিন পরে। সন্ধে হয়েছে। দয়ালশঙ্কর শেঠ-এর বাড়ির একতলায় বিশাল বসবার ঘরে ঢুকলেন ডি এম কালিপ্রসাদ সিংহ। সঙ্গে রয়েছে ইন্দ্রনাথ।

কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকলেন দয়ালশঙ্কর শেঠ, বয়স প্রায় ষাট। ধবধবে সাদা গায়ের রং। দীর্ঘ, সৌম্য আকৃতি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। গায়ে কেমব্রিকের পাঞ্জাবি। ফরসা রং ফুটে বেরোচ্ছে কেমব্রিক যুঁড়ে।

রাগে কাঁপছেন দয়ালশঙ্কর। বললেন, এ সব কী হচ্ছে এ বাড়িতে? সার্চ ওয়ারেন্ট আছে আপনার?

এস পি এসে সেটা দেখাবেন। উনি এখন আপনার ডান হাতকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। বললেন মিঃ সিংহ।

আমার ডান হাত?

বসুন বসুন, দাঁড়িয়ে কি কথা হয়? অনেক কথা আছে। হ্যাঁ আপনার ডান হাত–সচ্চিদানন্দ ঘোড়ই। তার জঙ্গলঘেরা বাড়িতে এখন সার্চ চলছে। অন্ধ ভিখিরি সাধুচরণকে ট্রেস করা হচ্ছে। চিনতে পেরেছেন তাহলে? সাধুচরণ! মেট্রো রেলের পাতাল কুপে পড়ে যে মারা গেছে।

দয়ালশঙ্করের ফরসা মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে গেছিল। আস্তে-আস্তে উনি বসে পড়লেন একটা সোফায়।

বসলেন ডি এম–তার পাশে। ইন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে রইল সামনে। চোখে যেন কমল হিরে জ্বলছে।

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকল সত্য আর কমলা।

ইন্দ্র বললে, আপনারা দুজনেই ওপরে যান মিসেস শেঠকে নিয়ে আসুন। যদি না আসতে চান–পরিচয় দেবেন নিজেদের–তাহলেই আসবেন।

দয়ালশঙ্কর রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। সত্যকে টেনে নিয়ে কমলা চলে গেল ওপরে। একটু পরেই হাত ধরে নিয়ে এল এক প্রৌঢ়াকে। মুখ তার এমনিতেই সাদা, বোধহয় অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন বলে আরও সাদা মনে হচ্ছে। বিবর্ণতা বেড়ে গেছে বিষম ভয়ে। কঁপছেন। কমলা তাকে ধরে বসিয়ে দিল দয়ালশঙ্করের পাশে। ইন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েই রইল। এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। দুজনের দিকে।

বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভারিক্কি চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। শ্যামবর্ণ। চোখে চশমা। রোদে পোড়া মুখ। একটু বিরক্ত।

ডি এম উঠে দাঁড়ালেন, আসুন স্যার। দয়ালশঙ্করকে দেখিয়ে বললেন, এঁকে চিনতে পারছেন?

দয়ালশঙ্করের সামনে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, না চেনার কী আছে। অতবড় উকিল আন্দামানে আর তো কেউ ছিল না।

ডি এম বললেন, আপনি বসুন। মিঃ শেঠ উঁকিলি ব্যবসা ছেড়ে দিলেন কেন?

সেটা নিয়ে জল্পনাকল্পনা আমরাও করেছি। ওঁর বন্ধু সাত্যকি সাহা ছিলেন মস্ত বড় টিম্বার মার্চেন্ট। কাটা গুঁড়ি চাপা পড়ে একই সময়ে মারা গেলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কোথায় যে চলে গেলেন শেঠ মশাই–

কার ছেলে?

আশ্চর্য কথা। কার আবার? সাত্যকি সাহার।

স্যার, রাগ করবেন না। রাজনীতি করার দৌলতে আপনি আন্দামানের অনেকের হাঁড়ির খবর রাখেন বলেই আপনাকে বিরক্ত করছি। সেই ছেলের বয়স তখন কত ছিল?

একটু ভাবলেন ভদ্রলোক। ঘড়ি দেখলেন, নেক্সট ফ্লাইটেই আমাকে দিল্লি যেতে হবে। ছেলেটার বয়স…তা তিন বা চার বছর তো হবেই।

আপনি দেখেছিলেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

এই ছবির মতো তাকে দেখতে ছিল কি? বলে ডি এম যে ফটো এগিয়ে দিলেন, সেটা নয়নতারা-র ফাইল থেকে খুলে এনেছিল সত্য বসু।

একবার দেখেই ভদ্রলোক বললেন, মনে তো হচ্ছে তারই। অনেক বছর আগে দেখা তো। কেন বলুন তো?

স্যার, এই ছেলেটাকে পাগল সাজিয়ে পুরুলিয়ায় নয়নতারা মেন্টাল নার্সিং হোমে রাখা হয়েছিল।

অ্যাবসার্ড! এ ছেলে কক্ষনও পাগল ছিল না।

হাসপাতালও সেই রায় দিয়েছে। এই সেই ছেলে, সত্যকে দেখিয়ে বললেন ডি এম। ছবির সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন?

চোখ, সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলেন শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক, এবার মনে পড়েছে। ছেলেটার আশ্চর্য চোখ নিয়ে আমরা কত কথাই বলতাম সাত্যকি সাহাকে। এ সেই চোখ। এতবড় হয়েছে! এই ছেলেকে পাগল সাজানো হয়েছিল! কে সাজিয়ে ছিল? ইনি? দয়ালশঙ্করকে দেখিয়ে যেন ফেটে পড়লেন রাজনীতিবিদ। ওঁর সঙ্গেই তো ছেলে এসেছিল আন্দামান ছেড়ে।

মূলে ছিলেন ইনিই। তবে নার্সিংহোমে সত্য বসুর বাবা আর মা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের এই ছবি। দুটো পাশপোর্ট ফটো এগিয়ে দিলেন ডি এম, দিল্লি থেকে ইস্যু করা বার্থ সার্টিফিকেটে লাগানো ছিল ফটো দুটো।

কার বার্থ সার্টিফিকেট?

সাত্যকি সাহার এই ছেলের।

ওর জন্ম তো আন্দামানে। বাবা আর মা তো–

মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাত্যকি সাহা। দিল্লিতে জাল বার্থ সার্টিফিকেটের ফলাও ব্যাবসার খবর আপনি তো রাখেনই–

জঘন্য কাণ্ড চলছে।

চবিশ বছর আগেও ছিল এই জালিদের কারবার। এই ছেলের বাবা আর মা বলে পরিচয় দিয়েছিল এই দুজন। ছবি দেখলেন–এবার স্বচক্ষে দেখুন।

চোখের ইঙ্গিত করলেন ডি এম। সত্য বেরিয়ে গেল। সঙ্গে করে নিয়ে এল বাচ্চু সেন আর তার স্ত্রী-কে।

ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন রাজনীতিবিদ, আশ্চর্য! ক্রিমিন্যাল আপনারা। সাত্যকি সাহার ছেলেকে নাম ভাড়িয়ে নিজের ছেলে বলে চালিয়েছিলেন? পাগলাগারদে রেখেছিলেন? হোয়াই? আই ওয়ান্ট টু নো, হোয়াই?

এই প্রথম কথা বললেন দয়ালশঙ্কর। এখন তার গলা শক্ত।

ভুল করছেন সকলেই। সাত্যকির ছেলে রোগে ভুগে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছে বাইশ বছর আগে। ডেথ সার্টিফিকেট আছে।

থতিয়ে গেলেন রাজনীতিবিদ। চাইলেন ডি এম এর দিকে। ডি এম চাইলেন ইন্দ্রনাথের দিকে।

ইন্দ্রনাথ বললেন রুদ্রকণ্ঠে, মানুষ যখন ইতোর হয়, লোভী হয় তখন সে পশুরও অধম। বাচ্চু সেনের স্ত্রী আমাদের কাছে সব বলেছেন। ওঁর মুখেই শুনুন।

স্বামীর দিকে না চেয়ে বলে গেল তার স্ত্রী কলের পুতুলের মতো, পাপ আর পারা কখনও চাপা থাকে না। ফুটে বেরোবেই। আমি কত বারণ করেছিলাম। হোক সে জন্ম রুগ্ন–তবুও তো আমার ছেলে। তাকে দেওয়া হল দয়ালশঙ্কর শেঠকে আর এই ছেলেটাকে সত্যকে দেখিয়ে নিয়ে এসে সুপ্রিয় বসু আর সাধনা বসুর নাম দিয়ে জাল বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে ছেলেটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল পাগলাগারদে। ভগবান আছেন।

কেন? ইন্দ্রর প্রশ্ন।

কেন আবার। আমার ছেলে ছিল জন্ম রুগ্ন–সে তো মারা যেতই। কিন্তু লোকে জানত, মারা গেল সাত্যকি সাহার ছেলে। বন্ধু দয়ালশঙ্করকে দিয়ে তিনি উইল করেছিলেন তাদের অবর্তমানে ছেলের আর সম্পত্তির ভার দয়ালশঙ্করের। বিরাট সম্পত্তি হাতিয়ে নিলেন আসল মালিককে পাগল সাজিয়ে।

কেন? একই ভাবে ফের প্রশ্ন করে ইন্দ্রনাথ।

টাকা…টাকার জন্যে। প্রত্যেকের পাঁচ লাখ। আমার ছেলে হাতছাড়া করার জন্যে…সেই ছেলেকে পাগল বলে সার্টিফাই করার জন্যে…

কে সার্টিফাই করেছিল? বিষ্ণুপদ নায়েক?

হ্যাঁ।

সে এখন কোথায়?

কিছুদিন ছিল আমাদের বাড়িতে। মাসছয়েক আগে চলে গেল।

ইন্দ্র বললে, সে চলে যায়নি। এখানে আসত। বাড়ির আউট হাউসে থাকত। মদ খেত, মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করত। এখান থেকে গেল বাচ্চু সেনের বাড়িতে ভাড়াটে সেজে টাকা দোহন করার মতলবে। ভিখিরি সেজে বেরোতো। তাকে সরিয়েছে এই দয়ালশঙ্কর শেঠ আর বাচ্চু সেন– মেট্রো রেলের গর্তে লাশ ফেলে দিয়েছে। সাত্যকি সাহা আর তার বউকেও কাটা গাছ চাপা দিয়ে মেরেছে এই দয়ালশঙ্কর শেঠ। সম্পত্তি হাতিয়েছে। আসল উত্তরাধিকারী এই সত্য বসুকে পাগলাগারদে রেখেছিল বাচ্চু সেন আর তার স্ত্রী দিল্লিতে জাল বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে। বাচ্চু সেনের স্ত্রী কিন্তু ছেলেটির চোখ মনে রেখেছিল–মেয়েদের এ ক্ষমতা থাকে। সে চোখ এই সত্য বসুর বিয়ে করতে চায় কমলাকে আপনাদের কারও আপত্তি আছে?

না। সম্মতি শোনা গেল একাধিক গলায়।

শক্তগলায় বললেন শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক, কিন্তু একটা শর্তে। হানিমুন হবে আন্দামানে।

হেঁচকি তুলে সত্য বললে, আপনার খরচে!

* দ্বীপবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত (শারদীয় সংখ্যা, ১৪০০)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *