1 of 2

রাজা কঙ্ক

রাজা কঙ্ক

বাই রোড গাড়িটাকে পাঠিয়েছিলাম আগের দিন চম্পকনগরে। ট্রেন থেকে সেখানে নেমেই গাড়ি হাঁকিয়ে যাব বন্ধুদের বিবরে–এই ছিল আমার প্ল্যান।

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়বার মিনিট কয়েক আগেই আমার কামরায় এসে উঠল সাতজন আরোহী। পাঁচজন আবার সিগারেটখোর। এতটা পথ এদের সঙ্গে যেতে হবে ভেবে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। স্টেটসম্যান আর ব্র্যাডশ নিয়ে চলে এলাম পাশের কামরায়।

আমাকে দেখেই খুবই বিরক্ত হল যে মেয়েটি তার বয়স পঁচিশও নয়। ভারী মিষ্টি মুখখানা। পানপাতার মতো গড়ন। চোখ-মুখ-নাক নিখুঁত। ঢলঢলে চোখে মাদকতা বা সেক্স যাই বলুন না কেন আছে। কামরায় একমাত্র আরোহী সে। তাই আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফিসফিস করে কী যেন বলল ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটিকে।

বুঝলাম আমার সম্বন্ধে লাগানো হল। ভদ্রলোক মেয়েটির স্বামী নিশ্চয়। ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। আমার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখলেন। সন্তুষ্ট হলেন এবং মৃদু হেসে বোধহয় অভয় দিলেন স্ত্রীকে। শুনে মেয়েটিও হাসল আমার দিকে চেয়ে। ছোট্ট কামরায় ঘণ্টাকয়েক আমার সঙ্গে তালা চাবি দিয়ে রাখলেও যেন তার আর কোনও ভয় নেই।

ভদ্রলোক বললেন, রাগ কোরো না মণি কেমন? চলি, নইলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করব।

জানলা থেকে রুমাল নেড়ে বিদায় জানাল মেয়েটি এবং লুকিয়েচুরিয়ে আঙুলের ডগায় অধর ছুঁইয়ে কয়েকটা তোফা চুম্বনও নিক্ষেপ করল স্বামীর পানে।

গার্ড হুইশল দিয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে।

ঠিক এই সময়ে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ছুটতে ছুটতে এল একটা লোক।

লোকজন হইচই করে উঠল তার দুঃসাহস দেখে। কিন্তু কোনওদিকে না চেয়ে ফুটবোর্ডে লাফিয়ে উঠেই দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে এসে পড়ল আগন্তুক।

আমার সঙ্গিনী অন্যমনস্ক ছিল। আচমকা ওইভাবে একজনকে কামরায় ঢুকতে দেখেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে ধপ করে বসে পড়ল বেঞ্চিতে।

আমি ভীতু নই। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগেই এভাবে কামরায় ছিটকে আসা মোটেই স্বাভাবিক নয়। বদ মতলব না থাকলে সচরাচর….

লোকটার চেহারা দেখে কিন্তু সেরকম কিছু মনে হয় না। ঠিক যেন পাকা মাকাল ফলটি। যেমন টুসটুসে রং–টুসকি দিলেই যেন ফেটে পড়ে–তেমনি ফিটফাট সাজগোজ। যে লোক এ রকম তেড়েমেড়ে ছুটন্ত ট্রেনে লাফিয়ে ওঠে, তার চেহারা আর পোশাক আর একটু নিরেশ হলে যেন মানাত। চেহারা দেখলে মনে হয় বুঝি পারস্যের খানবাহাদুর কিম্বা আরব দেশের তৈল সম্রাট। লাল-লাল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, টানা-টানা চোখ, চোখাচোখা নাক। আর পোশাক? র‍্যানকিন-হার্মান গোলাম মহম্মদরাও বুঝি অমন কাট-ছাঁট রপ্ত করতে পারেনি এখনও। যেমন দামি কাপড় তেমনি বাহারি স্যুট। অমন সুন্দর টাইও বড় একটা দেখা যায় না। জোডিয়াক তো নয়ই বিলিতি নিশ্চয়ই।

দেখেই আমার কিন্তু খটকা লাগল। হ্যান্ডসাম ফিগার, চোস্ত পোশাক-আশাক, মুখটাও কেমন জানি চেনা-জানা। চেনা লোকের ফটোগ্রাফ অনেক দিন পর দেখলে যেমন চিনেও চিনে ওঠা যায় ণা এ যেন তেমনি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় দেখেছি নবরূপী কার্তিক মহাশয়কে।

সঙ্গিনী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখি অবস্থা তার শোচনীয়। দু-চোখ কোটর থেকে খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে–আতঙ্ক মূর্ত হয়েছে বিস্ফারিত চোখের তারায়। ফরসা রং ফ্যাকাশে হলে বিশ্রী লাগে–মেয়েটিকেও বিশ্রী লাগছে মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে যাওয়ার দরুন। বেঞ্চির ওদিকে বসে সুদর্শন আগন্তুক–এদিকে বসে সুন্দরী সঙ্গিনী। আগন্তুক চেয়ে আছে জানলা দিয়ে বাইরে, সঙ্গিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আগন্তুকের দিকে। ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে রয়েছে ইঞ্চি কয়েক দূরে। মেয়েটির ইচ্ছে ব্যাগটাকে কাছে টেনে আনে কিন্তু ভয়ের চোটে হাত বাড়াতেও পারছে না। থরথর করে আঙুল কাঁপছে, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। অবশেষে আঙুল দিয়ে পৌঁছল ব্যাগের হাতলে এবং কোলের ওপর উঠে এল হলুদ থলে।

এতক্ষণে চারচোখে মিলন হল আমার সঙ্গে মেয়েটির। আমি ওর নার্ভাসনেস দেখে না বলেও পারলাম না ব্যাপার কী? শরীর খারাপ নাকি? জানলা খুলে দেব?

জবাব না দিয়ে ভীরু চোখে মেয়েটি কেবল চেয়ে রইল। কথা বলার মতো সাহসও তার নেই বুঝে আমি অভয় চোখে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আমার চোখের মধ্যে তাকিয়ে আড়চোখে বারবার ইশারা করতে লাগল আগন্তুকের পানে। চোখের ইশারায় সে যেন বলতে চায়, লোকটাকে দেখেছেন? সুবিধের নয়।

আমি ওর সভয় চাহনির জবাব দিলাম অভয় হাসি হেসে–ঠিক যেভাবে হেসেছিল তার স্বামী আমার সম্বন্ধে তার ভয় কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে। ইঙ্গিতে বললাম–ভয় কী? আমি তো রয়েছি। যুবতীদের দেখলেই যুবকদের প্রাণে বীররসের সঞ্চার ঘটে। আমিই বা বাদ যাই কেন?

ঠিক এই সময়ে আগন্তুক চাইল আমাদের পানে। পর্যায়ক্রমে চোখ বুলিয়ে নিল আমার আর সঙ্গিনীর থেকে মাথা পর্যন্ত। সে চোখে জিজ্ঞাসা নেই, ঔৎসুক্য নেই, ঔদাসীন্যও নেই। পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত হতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফের চেয়ে রইল জানলা দিয়ে বাইরের দিকে।

কামরার মধ্যে আর কোনও কথা নেই। মেয়েটি এই নৈঃশব্দ্য সইতে পারল না যেন। সর্বশক্তি কেন্দ্রীভূত করল সুচারু রসনায়–বললে ফিসফিস করে, শুনেছেন?

কী?

এই ট্রেনে সে চলেছে?

কে?

সে আবার কে…একা!

কে? কার কথা বলছেন?

রাজা কঙ্ক।

আগন্তুকের পানে চেয়েই শেষ কথাটা বলল মেয়েটি। অর্থাৎ রাজা কঙ্ক তার দৃষ্টিপথেই আবির্ভূত হয়েছে। বেঞ্চের অপর প্রান্তেই উপবিষ্ট রয়েছে।

সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ভয়াবহ ওই নামের মর্যাদা থেকে আমি রেহাই পাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আগন্তুক কিন্তু ঘাড় হেঁট করে বসেই রয়েছে। মুখটা ঈষৎ ফেরানো–যেন আমরা দেখেও চিনতে না পারি। প্রতিবাদের সুরে বললাম, রাজা কঙ্কর কিন্তু বিশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডর হুকুম হয়েছে গতকাল–পলাতক থাকা অবস্থাতেই। সুতরাং পলাতক রাজা কঙ্ক খামোকা লোকের সামনে এসে নতুন ঝামেলায় জড়াতে যাবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা খবরের কাগজওয়ালারা পর্যন্ত জেনে গিয়েছে রাজা কঙ্ক ছুটি উপভোগ করতে গিয়েছে লঙ্কার সমুদ্রতীরে–পাকিস্তান থেকে লম্বা দেওয়ার পর থেকে ইন্ডিয়ার মাটি তার কাছে এখন বিষবৎ। সুতরাং–

রাজা কঙ্ক এই ট্রেনেই রয়েছে, বলল মেয়েটি। একটু জোর গলাতেই বলল যাতে গলাটা আগন্তুকের কান পর্যন্ত পৌঁছয়। আমার হাজব্যান্ড ডেপুটি জেল-সুপার। স্টেশনেও শুনলাম পুলিশ তাকে খুঁজছে।

কিন্তু খুঁজবে কেন?

টিকিট কাউন্টারে তাকে দেখা গেছে বলে। চম্পকনগরের টিকিট কেটেছে রাজা কঙ্ক।

সেখানেই তার কলারটা চেপে ধরা হল না কেন?

অদৃশ্য হয়ে গেল বলে। টিকিট কালেক্টর তার টিকিও দেখতে পেল না। তাই সবাই ভাবলে নিশ্চয় এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে এসেছে রাজা কঙ্ক। জানেন তো এই ট্রেনের দশ মিনিট পরেই আছে এক্সপ্রেস।

তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। এক্সপ্রেসেই পুলিশ তাকে হাতকড়া লাগাবে।

লাস্ট মোমেন্টে নিশ্চয় এক্সপ্রেস থেকে লাফিয়ে এই ট্রেনে উঠে পড়েছে রাসকেল।

বেশ তো রাসকেলকে এই ট্রেনেই ধরা যাবেখন।

ধরবে? রাজা কঙ্ককে ধরবে?

চম্পকনগরেই সে ধরা পড়বে।

ইহজীবনে আর ধরা পড়বে না। রাজা কঙ্ককে ধরা যায় না। ঠিক পালাবে।

তাহলে পালাক। যাত্রা তার শুভ হোক।

তার আগে কী সর্বনাশটা করবে ভেবেছেন?

কী সর্বনাশ?

চুপ মেরে গেল ভয়াতুরা সঙ্গিনী। নীরবে আঁকড়ে ধরল ভ্যানিটিব্যাগ। বললাম, অত ঘাবড়ালে চলে কি? রাজা কঙ্ক ট্রেনে উঠেছে মেনে নিয়েও বলব সে বোকা নয়। খামোকা নতুন ফ্যাসাদ ডাকতে যাবে না।

আমার কথায় বিশ্বাস হল না মেয়েটির। ভয়ও কমল না।

কি আর করা যায়? আমি খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে রাজা কঙ্কর বিচারকাহিনি পড়তে লাগলাম। সবই অবশ্য জানা। তবুও মন্দ লাগছিল না রংচঙে উপাখ্যানটা। পড়তে-পড়তে চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। পরপর দুটো রাত কম ধকল হয়নি শরীরের ওপর। ঘুম তো পাবেই।

চমকে উঠলাম মেয়েটির চাপা আর্তনাদে। খপ করে কাগজটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ককিয়ে উঠল সে, কী সর্বনাশ! ঘুমোচ্ছেন নাকি?

না, না, ঘুমোব কেন? প্রাণপণে সজাগ থাকবার চেষ্টা করে বললাম।

এখন ঘুমোনো মানেই রাজা কঙ্ককে সুযোগ দেওয়া!

একশোবার! সায় দিলাম তৎক্ষণাৎ।

এই বলে চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলাম জানলা দিয়ে বাইরে। ঘুমোনো না পণ করলেও ঘুমকে কি ছাই আটকানো যায়। ট্রেনের টিকি-ঢিকি ছন্দ আর দুই বিনিদ্ররজনীর অবসাদ–দুয়ে মিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম পাড়িয়ে ফেলল আমাকে। চোখের সামনে থেকে মুছে গেল নিসর্গ দৃশ্য।

স্বপ্নজগতে দেখলাম রাজা কঙ্ক নামধারী সেই রহস্যাবৃত অতিমানবটিকে। দেখলাম ধনীর সিন্দুক শূন্য করে দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল টপকে দুর্গম অঞ্চলেও বিজয়কেতন উড়িয়ে ছায়ার মতো অপসৃয়মান কিংবদন্তীর নায়ক রাজা কঙ্ককে। দেখলাম দরিদ্রের বন্ধু এবং শোষকের শত্রু রাজা কঙ্কর পাঁকের মতো পিচ্ছিল দেহরেখা, অশরীরীর মতো যে ধরাছোঁয়ার বাইরে, ঈগলের মতো যে দুরন্ত দুঃসাহসী দেখলাম সেই অমিতশক্তিধর অসামান্য পুরুষটিকে। সেইসঙ্গে দেখলাম আর একটি চরিত্রকে যে রাজা কঙ্কর নাম নিয়েও রাজা কঙ্ক নয়। দেখলাম ছায়ার মতো শরীর নিয়ে অকস্মাৎ লাফিয়ে ঢুকল কামরার মধ্যে, হনুমানের লঙ্কাদাহনের সময়ে শরীর বিবর্ধনের মতো ক্রমশ ফুলে উঠল তার ছায়াময় কায়া এবং চেপে বসল আমার বুকের ওপর। তার সাঁড়াশীর মতো শক্ত আঙুলের নিষ্পেষণে চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল আমার, রুদ্ধ হয়ে এল নিশ্বাস। দমবন্ধ হয়ে মরতে বসেও রক্তজমা চোখে দেখলাম বেঞ্চিতে শুয়ে হাত-পা খেচছে ভয়কাতুরে মেয়েটা।

বাধা দিতে চেষ্টা করলাম না…শক্তিও ছিল না…রগ দপদপ করছে অক্সিজেনের অভাবে…বড়জোর আর একটা মিনিট…তারপরেই সব শেষ।

আগন্তুক তা বুঝল। আঙুল শিথিল করল বটে, বুক থেকে উঠল না। ডানহাতে একটা নাইলন দড়ি বার করল পকেট থেকে। দড়ির প্রান্তে ঢিলে ফঁস। ফঁসের মধ্যে আমার দুহাত গলিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলল নিমেষমধ্যে…মুখে রুমাল ঠেসে, দু-পা বেঁধে পোঁটলার মতো ফেলে রাখল বেঞ্চির কোণে। ধড়ফড় করল না উদ্বিগ্ন হল না। ঠান্ডা মাথায় ঝড়ের মতো হাত চালিয়ে এত সংক্ষেপে অথচ এমন পরিপাটিভাবে বাঁধল আমাকে যে বুঝলাম লাইনের লোক। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন নৈপুণ্য অর্জন করা যায় না। বাহাদুর বটে! রতনেই রতন চেনে! পুলিন্দার মতো অসহায় অবস্থায় বেঞ্চিতে শুয়ে মনে-মনে তাকে এক লক্ষবার প্রশংসা করলাম আমিরাজা কঙ্ক!

পরিস্থিতিটা হাস্যকর। আসল রাজা কঙ্ককে পিছমোড়া করে বেঁধেছে নকল রাজা কঙ্ক। শুধু তাই নয় আমার পকেট মেরে বারো হাজার টাকা সমেত নোটবইটা নিজের পকেটে চালান করেছে। রাজা কঙ্ক আনাড়ির মতোই মার খেয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়ে আছে একটা মস্ত গর্দভের মতো!

মহিলা সঙ্গিনী চোখ মুদে পড়ে আছে কাঠের মতো। আগন্তুক তার যৌবনের দিকে ফিরেও তাকাল না। মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল ভ্যানিটি ব্যাগটা। অমনি আঙুল থেকে সোনার আংটিটা খুলে বাড়িয়ে ধরল নকল মূছায় মূৰ্ছিতা সঙ্গিনী। আগন্তুক আংটি নিয়ে গিয়ে বসল কোণে। ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে কোলের ওপর ঢালল কতকগুলো জড়োয়া গয়না। উলটেপালটে দেখে হৃষ্ট হল নিশ্চয়। লুঠের মালের দাম যে সামান্য নয়, আমিও তা দূর থেকে বুঝলাম।

আগন্তুক আমাদের নিয়ে আর চিন্তিত বলে মনে হল না। সিগারেট ধরিয়ে বসে রইল চুপচাপ।

আমি রাজা কঙ্ক জুলজুল করে চেয়ে রইলাম তার পানে। পরিস্থিতি খুবই ঘোরতর। হাওড়া পুলিশ যখন আমায় দেখেছে চম্পকনগরের পুলিশকেও সজাগ করা হয়েছে। স্টেশনে নামলেই আমাকে পুলিশ ঘেরাও করবে আমি জানি। এও জানি, হাওড়া পুলিশের চাইতে বেশি বুদ্ধি ধরে না চম্পকনগরের পুলিশ। পোস্টাল আইডেনটিটি কার্ডে আমার নাম লেখা আছে অভীক সামুই। চম্পকনগরের বন্ধুবান্ধবরাও জানে অভীক সামুই আসছে তাদের বিবরে। রাজা কঙ্ককে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। রাজা কঙ্ককে সবাই চেনে তার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর ঈগল চাউনির জন্যে। সিনথেটিক পরচুলা আর কনট্যাক্ট লেন্সের দৌলতে দুটিই আমার ছদ্মবেশ। দুটিই এখন অনুপস্থিত। ছদ্মবেশহীন রাজা কঙ্ককে তাই চেনা অত সহজ নয়। অভীক সামুই লেখা পোস্টাল আইডেনটিটি কার্ডটা যেন অন্যমনস্কভাবেই দেখিয়েছিলাম হাওড়ার টিকিট কালেক্টরকে–একই কায়দায় চম্পকনগরেও চম্পট দেব আমি–এই ছিল প্ল্যান।

কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্যরকম। হাত-পা বাঁধা রাজা কঙ্ককে পুলিশ এত সহজে প্রিজন ভ্যানে তুলবে, এ যে ভাবাও যায় না। বারো হাজার টাকার কথা বাদ দিলাম–তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা নাম ঠিকানা রয়েছে নোটবইয়ের পাতায়। আমার আগামী অভিযানের প্ল্যান পর্যন্ত ছকে রেখেছি নোটবইয়ে। সুতরাং পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার চাইতেও আমার কাছে এখন বড় সমস্যা হল নোটবইটা উদ্ধার করা।

কিন্তু আগন্তুকের মতলবটা কী? লাইনের লোক বলেই কৌতূহলটা হতভম্ব করল আমাকে। আমি একলা হলে তার কোনও ঝামেলাই ছিল না। চম্পকনগরে ট্রেন দাঁড়ালেই দরজা খুলে প্যাসেঞ্জারদের ভিড়ে মিশে যাওয়া যেত। কিন্তু কামরার রয়েছে ওই মেয়েটি। সামনে কঙ্ক বসে আছে। বলেই মূছার ভান করে এলিয়ে আছে বেঞ্চির ওপর। কিন্তু চম্পকনগরে ট্রেন দাঁড়ালেই চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠবে সে। সুতরাং এখন থেকেই মেয়েটির মুখ বন্ধ করা দরকার। কিন্তু তাতো করছে না আগন্তুক। সুতরাং তার মতলবটা কী?

আগন্তুকের কিন্তু খেয়াল নেই আমাদের পানে। একদৃষ্টে চেয়ে আছে বাইরের দিকে তাল তাল ধোঁয়া উঠছে সিগারেটের প্রান্ত থেকে। একবার কেবল হাত বাড়িয়ে আমার ব্র্যাডশটা টেনে নিয়ে পাতা উলটোনো ছাড়া কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না তার হাবভাবে। আশ্চর্য ব্যাপার তো!

মেয়েটি এখনও মূছার ভাবটা টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে প্রাণপণে। একবার কেবল খুকখুক করে কেশে উঠল সিগারেটের ধোঁয়ায়, তাইতেই বোঝা গেল মূৰ্ছাটা বিলকুল নকল– আসল মোটেই নয়। শত্রুকে ঠান্ডা রাখার কৌশল।

আমার সারা গা টনটন করছে বাঁধনের জন্যে। মন কিন্তু বসে নেই…ফন্দি রচনা চলছে পুরোদমে মনের কারখানায়…।

একটার পর একটা স্টেশন টপকে ছুটে চলেছে ট্রেন।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল আগন্তুক। দুপা এগিয়ে এল আমাদের পানে। মেয়েটির দিকে চাইতেই তক্ষুনি জবাব এল সেদিক থেকে, ওগো তুমি কোথায়! চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে সত্যিকারের মূৰ্ছা।

লোকটার মতলব ধরতে পারলাম না। আমার পাশের জানলা তুলে বাইরে চেয়ে রইল। বৃষ্টি পড়ছে রিমঝিম শব্দে। যেন বিরক্ত হল তাই দেখে। সঙ্গে ছাতা নেই বলেই যেন ব্যাজার মুখে চেয়ে রইল বাইরে।

তারপর মেয়েটির ছাতা আর আমার রেনকোট নিয়ে এগোল দরজার দিকে।

দরজা খুলেই রেনকোট গায়ে চাপিয়ে নিল আগন্তুক। এক-পা নামিয়ে রাখল পাদানিতে। সর্বনাশ। চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবে নাকি? বাইরে ধোঁয়া আর বৃষ্টির মধ্যে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম আমি। উন্মাদ নাকি?

ঠিক এই সময়ে স্যাকসবি-ফার্মারের ব্রেক চেপে বসল লোহার চাকায়। গতি কমে আসছে, লোহার কাঁচকাঁচ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।

চকিতে পরিষ্কার হয়ে গেল আগন্তুকের উদ্দেশ্য। লাইন মেরামত চলছে নিশ্চয়। লোকটা তা জানে। গাড়ির গতি কমবেই। সে হেঁটে উধাও হবে জহরৎ আর নোটবই নিয়ে।

রগদুটো দপদপ করতে লাগল তার নিখুঁত প্ল্যান দেখে।

ফুটবোর্ডে দুটো পা নামিয়েছে আগন্তুক। ট্রেন আরও আস্তে চলছে। হঠাৎ জানলার সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ওভারব্রিজ।

অন্ধকার কেটে গেল সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই। লোকটাকে আর দেখলাম না।

অন্ধকারের মধ্যেই ওভারব্রিজের তলায় নেমে পড়েছে সে। চম্পকনগরও এসে গেল বলে। আর একটা ওভারব্রিজ পেরোলেই ট্রেন দাঁড়াবে চম্পকনগরে।

রেগুলেট করা মূর্ছা কাটিয়ে সটান উঠে বসল মেয়েটি। প্রথমেই শুরু হল বিলাপজহর হারানো শোকোচ্ছ্বাস। (ওগো তোমার দেওয়া নেকলেসটা..ইত্যাদি)

আমি কাতর নয়নে চাইলাম। মেয়েটি বুঝল। উঠে এসে খুলে দিল মুখের রুমাল। হাত পায়ের বাঁধনও খুলতে যাচ্ছিল আমি বাধা দিলাম।

বললাম, না-না, থাকুক। পুলিশ এসে দেখুক রাস্কেলটা কী হাল করেছে আমার!

চেন টানব?

সেটা আগেই টানা উচিত ছিল, এখন আর দরকার নেই। আমার গলা টিপে ধরার সঙ্গে সঙ্গে যদি চেনটা ধরে ঝুলে পড়তেন…

তাহলেই তো আমাকে চটকে পিণ্ডি বানাতো! আপনাকে বলিনি রাজা কঙ্ক এই ট্রেনে উঠেছে। ছবি দেখেই চিনেছি আমি।

এবার আর নিস্তার নেই–পুলিশ ধরল বলে।

কাকে? রাজা কঙ্ককে? পুলিশের..ক্ষমতা নেই। ফুটকি দেওয়ার জায়গায় উচ্চারিত শব্দটা লেখা চলে না।

ম্যাডাম, আপনি যদি ঠিক থাকেন, রাজা কঙ্ক ধরা পড়বেই। যা বলছি শুনুন। স্টেশনে ট্রেন ঢুকলেই আপনি চেঁচাতে থাকবেন। পুলিশ ছুটে আসবে। দু-চার কথায় তাদের বুঝিয়ে দেবেন রাজা কঙ্ক এসেছিল, আমার ওপর চড়াও হয়েছিল। কীভাবে পালিয়েছে ট্রেন থেকে তাও বলবেন। বলবেন, তাকে দেখতে কীরকম। খানদানি চেহারা পায়ে অ্যামবাসাডর বুট, হাতে ছাতা–আপনার গায়ে রেনকোট–

আপনার, বললে তন্বী।

আমার? না, না, ওর নিজের। আমার রেনকোট নেই।

কিন্তু আমার যেন মনে হল রেনকোট ছাড়াই ট্রেনের মধ্যে লাফিয়ে এসেছিল রাজা কঙ্ক।

ভুল দেখেছিলেন,…রেনকোট গায়ে না থাক হাতে ছিল নিশ্চয়…নয়তো কামরার মধ্যে কেউ ফেলে গিয়েছিল..রাজা কুড়িয়ে পেয়েছে। যেখান থেকেই আসুক না কেন, রেনকোটটা গায়ে চাপিয়ে সে পালিয়েছে। পয়েন্টটা দারুণ, ইমপরট্যান্ট…গায়ে চেক কাটা গ্রে রেনকোট…বলতে ভুলবেন না। গোড়াতেই আপনার হাজব্যান্ডের নামটা বলবেন। নাম শুনলেই ওরা কানখাড়া করে আপনার সব কথা গিলবে…কাজও করবে…জুয়েলগুলোও ফেরত পাবেন।

চম্পকনগর আর বেশি দূরে নেই। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখছে কারারক্ষকের যুবতী বধূ। আমি চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে তার ব্রেনের মধ্যে গেঁথে-গেঁথে বললাম :

আমার নাম অভীক সামুই। যদি দরকার মনে করেন, বলবেন আমাকে আপনি চেনেন…তাতে অনেক সময় বেঁচে যাবে…প্রিলিমিনারী এনকোয়ারি যত ঝটপট শেষ করা যায়, ততই মঙ্গল..মোদ্দা কথা হল রাজা কঙ্ককে পাকড়াও করা…আপনার জুয়েল সমেত… বুঝেছেন? অভীক সামুই আপনার স্বামীর বন্ধু।

হ্যাঁ, হ্যাঁ..অভীক সামুই।

জানলা দিয়ে হাতছানি দিতে শুরু করে দিয়েছে সুন্দরী সঙ্গিনী সেইসঙ্গে চেঁচিয়ে চলেছে তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠে। ট্রেন নিশ্চল হওয়ার আগেই পাদানিতে লাফিয়ে উঠল কয়েকজন ষণ্ডামার্কা পুরুষ। সবশেষে কামরায় উঠল আরেকটি লোক। সঙ্কট সময় এসেছে।

গলায় শির তুলে চেঁচিয়ে চলেছে মেয়েটি?

রাজা কঙ্ক…অ্যাটাক করেছিল আমাদের…আমার জড়োয়া গয়না নিয়ে পালিয়েছে..আমার নাম মিসেস আচারী..আমার হাজব্যান্ড ডেপুটি জেল সুপার…এই তো আমার ভাই এসে গেছে…আশু… আশু…রাজা কঙ্ক আমার সর্বনাশ করে গেছে রে..ওরে আমার কী হবে রে…তোর জামাইবাবু শুনলে কী ভাববে রে…

প্ল্যাটফর্ম থেকে দিদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আশু নামধারী ভাইটি কামরায় পা দিয়েছিল।

স্মার্ট চেহারার একজন সুদর্শন কিশোর। মিসেস আচারী তাকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠল হাউহাউ করে।

তারপর বললে ফোঁপাতে-ফোঁপাতে, রাজা কঙ্ক.এই ভদ্রলোকের টুটি টিপে ধরেছিল ..উনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন…মিস্টার সামুই, অভীক সামুই, আমার হাজব্যান্ডের ফ্রেন্ড।

কিন্তু রাজা কঙ্ক এখন কোথায়?

ওভারব্রীজের তলায় ট্রেন আসতেই লাফিয়ে পড়ল বাইরে।

আপনি ঠিক দেখেছিলেন তো? রাজা কঙ্কই তো?

হ্যাঁ…হ্যাঁ…হ্যাঁ…দেখেই চিনেছি। হাওড়াতে। তাকে দেখা গেছে বুকিং অফিসের সামনে..হাতে ছাতা, পায়ে অ্যামবাসাডর বুট–

একসকুসিভ সু, পুলিশ অফিসার আমার জুতো দেখিয়ে বলল, এইরকম?

না, না, যা বলছি শুনুন, আমবাসাডর বুট, চেককাটা গ্রে রেনকোট।

কিন্তু, মাথা চুলকে বলল পুলিশ অফিসার, টেলিগ্রামে তো রেনকোটের কথা লেখা ছিল । ছাই রঙের কোটপ্যান্টের কথা লেখা ছিল শুধু।

ঠিক বলেছেন অ্যাশ কালারের সুট, সোল্লাসে বললে মিসেস আচারী। এতক্ষণে নিশ্বাস নিলাম আমি। এই না হলে বান্ধবী…চরম বিপদেও কী রকম বাঁচিয়ে দিল আমাকে।

কথা শুনতে-শুনতে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল পুলিশ অফিসার। আমি অবশ্য তার আগেই ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে ফেলেছিলাম। বন্ধনমুক্ত হয়েও যেন কাহিল হয়ে পড়েছি, এমনিভাবে চিঁ চিঁ স্বরে বললাম?

রাজা কঙ্ক…রাজা কঙ্ক…মনে কোনও সন্দেহ করবেন না… এখনও দৌড়োলে তাকে ধরা যাবে।

এমনভাবে বললাম যেন ধুকছি। রাজা কঙ্ক আমাকে চোরের মার মেরেছে। প্রাণটা কেবল রেখে গেছে।

আমার রক্তমাখা ঠোঁটের দিকে সমবেদনা মিশোনো চোখে চেয়ে রইল পুলিশ অফিসার। প্রথম রাউন্ডে রেহাই পেলাম।

কামরাটা পুলিশ ইন্সপেকসন হবে বলে কেটে রাখা হল সাইডিংয়ে। বাকি ট্রেন রওনা হল গন্তব্যস্থানে। আমরা এসে বসলাম স্টেশন মাস্টারের ঘরে। কাতারে কাতারে লোক মজা দেখবার জন্যে হেঁকে ধরল আমাদের। কারো সর্বনাশ, কারো পৌষ মাস!

টনক নড়ল আমার। আর দেরি করা সমীচীন নয়। হাওড়া থেকে নতুন টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোলেই আমি গেছি! কোনও একটা অছিলা নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে আমাকে যেতেই হবে। গাড়িটা খুঁজে নিয়ে সটকান দিতে হবে এক্ষুনি!

কিন্তু তস্কর মহাপ্রভু কি সত্যিই একহাত নেবে আমার ওপর? এদিকের রাস্তাঘাট আমি চিনি না–কিন্তু সে চেনে। তাকে ধরা কি সম্ভব হবে?

আমার মন বলল, চেষ্টা করতে দোষ কী? অসম্ভবকে সম্ভব করাই তো রাজা কঙ্কর ব্রত। ঠগকে ঠকানোই তো রাজা কঙ্কর আদর্শ।

পুলিশ অফিসার তখনও রুটিনমাফিক এজাহার লিখছে দেখে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললাম আমি :

শুনছেন? রাজা কঙ্ক কিন্তু প্রতিমুহূর্তে দূরে সরে যাচ্ছে। স্টেশনের বাইরে কার পার্কে আমার গাড়ি রয়েছে। আপনি অনুমতি দিলেই গাড়ি নিয়ে তাকে ধাওয়া–

মতলবটা মন্দ নয়। হেসে বলল অফিসার। আপনি বলার আগেই দুজন এস আইকে পাঠিয়ে দিয়েছি।

তাই নাকি?

সাইকেলে করে খুঁজছে রাজা কঙ্ককে।

কোথায় খুঁজেছে?

ওভারব্রীজের ধারেকাছে। ওখানে গেলেই এক-আধটা ব্লু পাওয়া যাবেই। রাজা কঙ্কও ধরা পড়বে।

দূর মশাই, আপনার অফিসাররা খালি হাতে ফিরবে। ক্লু পাবে না।

আপনি কি জ্যোতিষী? একটু চটেছে মনে হল পুলিশ অফিসার।

ওভারব্রীজ থেকে বেরোনোর সময়ে কেউ যাতে তাকে দেখতে না পায়, সেইমতো হুঁশিয়ার থাকবে রাজা কঙ্ক। সুতরাং কোনও সাক্ষী আপনি পাবেন না। সবচাইতে কাছের রাস্তা ধরে সে–

রাস্তা তো গেছে কোহিমায়। সেখানেই ধরব তাকে।

কোহিমায় সে যাবে না।

না গেলে আশেপাশেই থাকবে। তাতে তো আমাদেরই সুবিধে।

আশপাশেই থাকবে না।

বিটে? বটে? বটে? লুকোবে কোথায়? মাটির তলায়? ঘড়ির দিকে তাকালাম।

বললাম–এই মুহূর্তে বলরামপুরে স্টেশনের আশপাশে ঘুরঘুর করছে রাজা কঙ্ক। দশটা পঞ্চাশে মানে, এখন থেকে ঠিক বাইশ মিনিট পরে কোহিমা থেকে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াবে বলরামপুরে। রাজা কঙ্ক তাতে উঠে বসবে–যাবে মহেন্দ্রনগর জাংশনে।

তাই নাকি? তাই নাকি? জানতে পারি কি তার গতিবিধির খবর আপনি জানলেন কী করে?

খুব সহজে। কম্পার্টমেন্টে বসে রাজা কঙ্ক আমার ব্র্যাডশ খুলে দেখছিল। কী দেখছিল? যেখানে সে অদৃশ্য হবে, ঠিক সেইখানে আর কোনও ট্রেন আসার সম্ভাবনা আছে কিনা–এই জন্যেই খুলেছিল ব্র্যাডশ। আমিও এই মাত্র দেখেছি ব্র্যাডশ। ওভারব্রীজের কাছেই বলরামপুর স্টেশনে দশটা পঞ্চাশে কোহিমা থেকে আসছে একটা ট্রেন।

শুনে চোয়াল ঝুলে পড়ল পুলিশ অফিসারের।

মার্ভেলাস! মিস্টার সামুই, আপনি ডিটেকটিভ হলেন না কেন? এ লাইনে এক্সপার্ট হতে পারতেন।

সেরেছে। বেশি বুদ্ধি দেখাতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরে বসেছি। পুলিশ অফিসারের চোখে বিস্ময় দেখলাম, আর দেখলাম চাপা সন্দেহ। কপাল ভালো যে রাজা কঙ্কর ফোটো সে পেয়েছে ওপরমহল থেকে, তার সঙ্গে সামনে-বসা এই রাজা কঙ্কর কোনও মিল নেই। আসল রাজা কঙ্ককে চিনতে পারল না শুধু ওই ছদ্মবেশী রাজার ছবি দেখেছিল বলেই। তা সত্ত্বেও দেখলাম বিষম ঘাবড়ে গিয়েছে, বিষম অস্থির হয়েছে, বিষম উত্তেজিত হয়েছে ভদ্রলোক।

কিছুক্ষণ আর কোনও কথা নেই। শ্বাসরোধী নীরবতা। চাপা উদ্বেগে আমি নিজেও শিউরে উঠেছিলাম কিনা বলতে পারব না। তবে হাজার হোক আমি রাজা কঙ্ক। নিমেষ মধ্যে জাগ্রত হল ইস্পাত কঠিন মনোবল।

হেসে উঠলাম। বললাম, মশাই, পকেট-বই খোয়া গেলে গর্দভের মাথাতেও বুদ্ধি খেলে। আপনার জনা দুই লোক দিতে পারেন? তিনজনে মিলে চেষ্টা করলে হয়তো তাকে ধরা যাবে–

প্লীজ, প্লীজ, মিনতি করল সুন্দরী সঙ্গিনী। মিস্টার সামুই প্র্যাকটিক্যাল কথা বলেছেন। আর দেরি করবেন না। আমার জুয়েলগুলো…

মহীয়সী বান্ধবীর একটি কথাতেই দাঁড়িপাল্লার কাটা হেলে পড়ল। ডেপুটি জেল সুপারের স্ত্রী আমাকে ডাকছে মিস্টার সামুই নামে। বড় অফিসারের বউয়ের মুখে জাল নামটা যেন নতুন মর্যাদা নতুন প্রতিষ্ঠা পেল। আর কোনও সন্দেহ থাকতে পারে কি? উঠে দাঁড়াল পুলিশ অফিসার।

চলুন মিস্টার সামুই। রাজা কঙ্ককে আপনারও দরকার, আমারও দরকার।

ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে এল বাইরে-আমার গাড়ির সামনে। আলাপ করিয়ে দিল দুজন শক্ত-সমর্থ জোয়ানের সঙ্গে বাঁটলো বটব্যাল আর তলাকান্ত তালুই। দুই চ্যালাকে নিয়ে উঠে বসলাম আমার গাড়িতে। আমি বসলাম ড্রাইভারের জায়গায়। ড্রাইভার বসল পেছনে। মিনিট খানেক পরেই স্টেশন রইল পেছনে। উড়ে গেল রাজা কঙ্ক।

সত্যি কথাই বলব মশায়, অহংকার একটু হয়েছিল বইকি। পাওয়ারফুল ইঞ্জিন তখন ফুঁসছে, পঁয়ত্রিশ হর্স পাওয়ারের ইমপোর্টেড মোরো-লিপটন বাঘের বাচ্চার মতোই ধেয়ে চলেছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। হু-হুঁ হাওয়ায় চুল উড়ছে আমার। ইঞ্জিনে যেন একটা ভোমরা গুনগুনিয়ে চলেছে–ভ্রমরগুঞ্জন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। দু-পাশের গাছগুলো সটাসট পেছিয়ে যাচ্ছে পেছনে। মুক্তি পেয়েছি ঠিকই কিন্তু এখনও কিছু কাজ বাকি। স্রেফ প্রাইভেট ব্যাপার বলতে পারেন।

সরকারি কর্মচারীদের সাহায্যেই আইনানুগভাবেই কাজটা সারব আমি। তাই তো রাজা কঙ্ক চলেছে রাজা কঙ্কর সন্ধানে সরকারিভাবে।

যাই বলুন, সরকারের সাহায্য না পেলে সেদিন আমি অত সহজে গাড়ি হাঁকতে পারতাম কি? রাস্তা তো চিনি না। কখন মোড় ঘুরতে হবে, কোন রাস্তা ছাড়তে হবে, কোন সড়কে ঢুকতে হবে–আমি জানি না। নির্ঘাত পথ হারিয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতাম। রাজা কঙ্ক পথ হারাতো, আরেক রাজা কঙ্ক সেই ফাঁকে হত পগাড়পার।

কিন্তু ওই যে বললাম, সরকার আমাকে সাহায্য করল সরকারি কর্মচারী জুগিয়ে। তলাকান্ত তালুই আর বাঁটলো বটব্যাল জীবন্ত গাইডবুক বললেই চলে।

অথচ পলাতক রাজা কঙ্কর সঙ্গে হিসেবনিকেশ মিটিয়ে নেওয়ার সময়ে বাঁটলো আর তলাকান্তকে চোখের আড়াল করতে হবে। আমার নোটবই ওদের খপ্পরে দেওয়া তো দূরের কথা নোটবইয়ের পাতাতেও যদি চোখ দিয়ে ফেলে দুই মূর্তিমান তাহলেও সর্বনাশ।

বলরামপুর পৌঁছে শুনলাম তিন মিনিট আগেই ট্রেনটা বেরিয়ে গেছে। আমার ভুল হয় না। রেনকোট পরা একটা দাড়িওয়ালা কার্তিক-কার্তিক চেহারার লোক সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে উঠেছে যাবে মহেন্দ্রনগর জাংশনে।

জীবনে প্রথম ডিটেকটিভ হল রাজা কঙ্কসফল ডিটেকটিভ শার্লক হোমস মেডেল দেওয়া উচিত আমাকে।

শুনলাম–ট্রেনটা এক্সপ্রেস। মহেন্দ্রনগর জাংশনের আগে কোথাও দাঁড়াবে না। সেখানে তাকে ধরা না গেলে সে চম্পট দেবে কলকাতার দিকে মিলিয়ে যাবে জনারণ্যে।

মহেন্দ্রনগর কদ্দূর এখান থেকে?

সাড়ে চোদ্দ মাইল।

উনিশ মিনিটে সাড়ে চোদ্দ মাইল?…ঠিক আছে–আগেই পৌঁছব।

মোটর রেসে নাম লেখালে নিশ্চয় গোল্ডকাপ পেতাম সেদিন। মোরো-লিপটন আমার হুকুমের দাস বরাবরই, কিন্তু সেদিন যেন আমার অন্তরের আকুলতাকে ও স্পর্শ করল। ওর যান্ত্রিক ব্যাকুলতা মূর্ত হল অসম্ভব গতিবেগের মধ্যে। আমার ইচ্ছাশক্তি যেন তার পঁয়ত্রিশ হর্স পাওয়ারকে উদ্দীপিত করল অলৌকিকভাবে এবং যেন সত্যি সত্যিই পঁয়ত্রিশটা ঘোড়া একযোগে পক্ষিরাজ ঘোড়ার মতোই উড়ে চলল পথের ওপর দিয়ে। শয়তান রাজা কঙ্ককে পাকড়াও করতেই হবে। রাস্কেল! স্কাউন্ডেল। চোর! কে কাকে টেক্কা দেয়, দেখা যাক এবার। আসল জেতে কি নকল জেতে–শুরু হল সেই পরীক্ষা।

ডাইনে!..বাঁয়ে…সোজা। হাঁক দিচ্ছে তলাকান্ত আর বাঁটলো।

পেছনের ধুলোর ঝড় উড়ছে। মাইল পোস্টগুলো দেখতে-দেখতে মিলিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে।

হঠাৎ একটা মোড় ঘুরে দেখলাম ধোঁয়ার মেঘ। এক্সপ্রেস ট্রেন।

আধঘণ্টা ধরে চলল দারুণ রেস। ট্রেনে-মোটরে প্রতিযোগিতা। তারপর মাত্র বিশ গজের ব্যবধানে স্টেশনে আগে পৌঁছলাম আমরা।

তিন সেকেন্ড লাগল প্ল্যাটফর্মে উঠে সেকেন্ড ক্লাস কামরার সামনে পৌঁছতে। কিন্তু সে নেই। রাজা কঙ্ক মিলিয়ে গেছে।

রেগেমেগে বললাম, কী বোকা আমি। ট্রেন থেকেই আমাকে দেখেছে গাড়ির মধ্যে। নিশ্চয় লাফিয়ে পড়েছে চলন্ত ট্রেন থেকে।

গার্ডসাহেব সায় দিলেন। প্ল্যাটফর্ম থেকে শ-দুই গজ আগে একজনকে তিনি দেখেছেন বাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে।

ওই তো। ওই যে যাচ্ছে।…লেবেল ক্রসিংয়ে।

তীরবেগে ছুটলাম। সরকারি সাগরেদ দুজনও এল পেছন-পেছন। কিন্তু তলাকান্ত দেখলাম খরগোশের মতো দৌড়োয়। আমাদের ছাড়িয়ে নকল রাজার নাগাল ধরে ফেলে আর কি। প্রমাদ গুণলাম আমি।

হাঁপাতে হাঁপাতে একটা ঘন ঝোঁপের কাছে পৌঁছে দেখি তলাকান্ত চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। পাছে আমরা খুঁজে না পাই তাই আর এগোয়নি।

ভালোই করেছেন। আন্তরিকভাবেই বললাম আমি। আপনি দাঁড়ান বাঁ-দিকে ওই ঝোঁপের আড়ালে, বাঁটলোবাবু যান ডানদিকের ঝোপে। আমি পেছন দিক থেকে তাড়া দিচ্ছি ওকে। বেরোলে আপনাদের সামনে দিয়েই বেরোবে। ও হাবিপদে পড়লে গুলি ছুঁড়ব–মাত্র একবার।

বলে ওদের দুজনকে পাঠিয়ে দিলাম ঝোঁপের মধ্যে। চোখের আড়াল হতেই আমি সোজা উঠে গেলাম এবং কাঁটাঝোঁপের ফাঁকে-ফাঁকে একটু ঘুরপথে এগোতেই দেখলাম নকল রাজা কঙ্ক আমার দিকে পেছন করে গুটি গুটি এগোচ্ছে।

লম্বা দুটো লাফ দিয়ে পড়লাম তার ঘাড়ে। হাতের রিভলভার ঘুরিয়ে সে চেয়েছিল আমাকে গুলি করতে। কিন্তু আমার যুযুৎসু তার চাইতেও বেশি চটপটে। নিমেষমধ্যে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে বসলাম বুকের ওপর।

বললাম চাপা গলায়, উজবুক কঁহাকার। আমি রাজা কঙ্ক। এক মিনিটের মধ্যে আমার নোটবই আর ভদ্রমহিলার ভ্যানিটিব্যাগ ফেরত দাও…তার বদলে পুলিশের খপ্পর থেকে তোমাকে রেহাই দেব, আর আমার দলে টেনে নেব। রাজি?

রাজি।

উঠে দাঁড়ালাম আমি। লোকটা পকেট হাতড়ে একটা ছুরি নিয়ে তেড়ে এল আমার দিকে।

গাধা কোথাকার বলে বাঁ-হাতে তার ছুরিসুদ্ধ হাতের কবজি চেপে ধরে ডানহাতে প্রচণ্ড ঘুসি ঝাড়লাম ক্যারোটিড আর্টারির ওপর। একেই বলে ক্যারোটিড হুকৃ–এক ঘুসিতেই এক লক্ষ সর্ষে ফুল দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল হতভাগ্য।

কাগজপত্র, নোটের তাড়া–সবই পেলাম আমার নোটবইয়ে। লোকটার কাগজপত্র কৌতূহল ভরে দেখতে গিয়ে একটা খানে দেখলাম নাম লেখা রয়েছে বিম্পে ফিরিঙ্গি। বোম্বাই, কলকাতা, দিল্লির তিন-তিনজন শেঠজিকে গলা কেটে খুন করে যে চম্পটি দিয়েছে! বিম্পে ফিরিঙ্গি। সোনার বিস্কুট আর হিরের বুদ্ধ কোটিপতি মালহোত্রার তোষাগার থেকে গায়েব করে যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।

বিম্পে ফিরিঙ্গি শুধু গলা কাটা খুনে নয়, ধুরন্ধর চোরও বটে। এতক্ষণে বুঝলাম, ট্রেনের কামরায় তাকে কেন অত চেনা মনে হচ্ছিল।

সময় বিশেষ নেই। দুটো একশো টাকার নোট খামের মধ্যে রেখে বাইরে লিখলাম ও

সুযোগ্য সহকারী বাঁটলো এবং তলাকান্তকে রাজা কঙ্ক

খামটা রাখলাম ঘাস জমির ওপর। মিসেস আচারীর ভ্যানিটিব্যাগটা ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। ভদ্রমহিলা অনেক উপকার করেছে আমার। তাই ব্যাগটাও রাখলাম খামের পাশে। হিরে জহরতগুলো অবশ্য আমার পকেটে রাখলাম। বিজনেস ইজ বিজনেস! তা ছাড়া যার স্বামী ওইরকম বিচ্ছিরি চাকরি করে, তাকে করুণা করা সঙ্গত নয়…!

বাকি রইল বিম্পে ফিরিঙ্গি। দেখলাম, একটু-একটু করে জ্ঞান ফিরছে তার। কী করব একে নিয়ে? পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার আমার নেই। ও কাজ যাদের তারা করুক।

সুতরাং ওর রিভলভারটা পকেটে পুরলাম। আমার রিভলভার বার করে একবার মাত্র ফায়ার করলাম শূন্যে… ।

ছুটে আসুক তলাকান্ত আর বাঁটলো..আমি আমার পথ দেখি।

উলটো দিকে দৌড়োলাম। আসবার সময়ে দেখে এসেছিলাম গাড়িতে পৌঁছনোর শর্টকাট। সেই পথেই উঠে বসলাম মোরো-লিপটনে।

চারটের সময়ে টেলিগ্রাম করে দিলাম বন্ধুদের বিশেষ কাজে এ-যাত্ৰা আর দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। দুঃখিত।

ছটার সময়ে পৌঁছলাম কলকাতায়।

পরদিন সকালবেলায় যুগান্তরে পড়লাম বিম্পে ফিরিঙ্গির ধরা পড়ার কাহিনি :

চম্পকনগরের কাছে বেশ খানিকটা প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দেওয়ার পর বিম্পে ফিরিঙ্গি কে অ্যারেস্ট করিয়েছে রাজা কঙ্ক। গলাকাটা খুনে এবং ধুরন্ধর জহর-চোর ডেপুটি জেল সুপারের গৃহিণীর জড়োয়া চুরি করে সটকান দেওয়ার তালে ছিল। রাজা কঙ্ক যে ভ্যানিটিব্যাগে জড়োয়া গয়না ছিল, সেটি ফিরিয়ে দিয়েছে এবং দুজন সরকারি গোয়েন্দার সাহায্যে নাটকীয় গ্রেপ্তার সম্ভব হয়েছে, তাদেরকে মোটা বখশিশ দিয়ে গেছে।

অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। (১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *