মই
রবিনবাবুর বয়স ষাটের অধিক। খুব ফরসা। ঢ্যাঙা। খাড়াই নাক। চওড়া কপাল। চোখ দুটি কিন্তু এখনও উজ্জ্বল। মাথার সব চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। নাকের নিচে দুপাশে পাকানো একজোড়া গোঁফ আছে সাদা। এমনকি ভুরুর চুল পর্যন্ত সাদা। পরনে গিলেহাতা আদ্দির পাঞ্জাবি এবং পায়জামা। হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি। রবিনবাবু একা আসেননি। গিন্নিকে এনেছেন। রবিনবাবুর তুলনায় তিনি অল্পবয়স্কা। সিঁদুর দিতে দিতে মাথার দিকের চুল প্রায় উঠে গিয়েছে। ইনিও খুব ফরসা। সাদাপেড়ে সাদা সিল্কের শাড়ি দিয়ে সর্বাঙ্গ মুড়ে বস্তার মতো বসে আছেন। স্থূলাঙ্গী। সে তুলনায় রবিনবাবু বেশ ছিপছিপে।
ছড়ির রূপো-হাতলে হাত বুলোত বুলোতে রবিনবাবু বললেন, ইন্দ্রনাথবাবু, এই হল ব্যাপার। জানলার নিচে শুধু মইটা পাওয়া গিয়েছে।
গালের ব্রন খুঁটতে-খুঁটতে ইন্দ্রনাথ বললে, কীসের মই?
কাঠের।
আঙুলের ছাপ?
একদম নেই।
সেইসঙ্গে খোকাও নেই, পাশ থেকে ডুকরে কেঁদে-ওঠা স্বরে বললেন রবিনবাবুর গিন্নি। ইন্দ্ৰনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন দেখে আসি।
.
রাসবিহারী এভিনর ওপরে বাগানওলা বাড়ি যে কজনের আছে, নিঃসন্দেহে তারা বিত্তবান। রবিনবাবুও এই মুষ্টিমেয়দের মধ্যে পড়েন। চা-বাগান আছে, কয়লার খনি আছে। সুতরাং লক্ষ্মীর পায়ে শেকল পরিয়ে রেখেছেন সিন্দুকের মধ্যে। দোতলার বিরাট চওড়া বারান্দায় দাঁড়ালে বড় রাস্তা দেখা যায় আউট হাউসের মধ্যবর্তী গেটের মধ্যে দিয়ে! আউট হাউসে এইমাত্র ঘুরে এসেছে ইন্দ্রনাথ। জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন কিছু জানা যায়নি। এস্টেটের কর্মচারী, দারোয়ান, চাকর সে রাতে ঘর ছেড়ে বেরোয়নি তুমুল বৃষ্টির জন্যে। তাই দেখেনি কাউকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেঁট হয়ে মইটার দিকে তাকিয়েছিল ইন্দ্রনাথ। পুলিশ বিশেষজ্ঞরা ওই মই খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু কিডন্যাপার অতিশয় ধুরন্ধর। আঙুলের ছাপ রেখে যায়নি, কোথাও কোনও সূত্র ফেলে যায়নি। শুধু ওই মইটা ছাড়া।
বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে হেঁট হয়ে মই নিরীক্ষণ করতে করতে ইন্দ্রনাথ বললে, মৃগ, এরকম মই তো ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে বিস্তর পাওয়া যায়, তাই না?
হ্যাঁ। ঘরাঞ্চি ঠিক নয়, বাঁশের মইও নয়। প্যাকিং কাঠ কেটে তৈরি।
মইয়ের ওপরের ধাপটা ঈষৎ চওড়া। অন্যান্য ধাপের মতো সরু নয়। কাঠটাও অন্যরকম। সাদাটে। গোটা মইটা কিন্তু নীলচে কাঠের তৈরি।
ইন্দ্রনাথ চেয়েছিল ওই ওপরের ধাপের দিকেই। চেয়ে থাকতে থাকতেই বললে মৃদু কণ্ঠে, মৃগ, ধাপটার গায়ে কতকগুলো ফুটো রয়েছে।
পেরেকের ফুটো, বললাম আমি। প্যাকিং কেস ভাঙা কাঠে অমন থাকে।
ফুটোর মধ্যে মরচে নেই।
তার মানে বাক্সটা রোদে জলে বেশিদিন থাকেনি, বললাম আমি।
কাঠটার রং এদেশি কাঠের মতো নয়।
কারণ ওটা বিদেশি কাঠ। বিলিতি পাইন। কাঠের শুয়ে দেখছিস না কত মিহি। রঙটাও সাদা। সাহেবদের দেশের কাঠ তো।
সদ্য কেনা মই। কিডন্যাপিংয়ের জন্যেই যদি কেনা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দোকান থেকে কেনা?
তার কোনও মানে নেই, বললাম আমি। কিডন্যাপার যদি বালিগঞ্জ অঞ্চলের মানুষ হয়, তাহলে এপাড়া থেকেই কিনতে পারে।
এদিকে এরকম দোকান আছে?
আছে। কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলেও আছে। নিউমার্কেটের পেছনে ওদের বড় ঘাঁটি।
আর কোনও কথা বলল না ইন্দ্রনাথ। প্রখর হল চক্ষু। হাত বাড়িয়ে মইটা টেনে আনল বারান্দার ওপর।
কী দেখছিস? শুধোই আমি।
নিরুত্তরে ওপর ধাপটার দিকে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। অনেকক্ষণ পরে সঙ্কুচিত চোখে বললে আস্তে-আস্তে, কাঠটা র্যাদা দিয়ে চাচা হয়েছে দেখছি।
তা তো হবেই, দুই ভুরু কাছাকাছি এনে বন্ধুবরের দৃষ্টিরেখা অনুসরণ করলাম, ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না অ্যাঁদা দিয়ে কাঠ চাঁচা নিয়ে মন্তব্য করা হল কেন।
ইন্দ্র বললে, বাঁদা জোরে চাপার দরুন মাঝে-মাঝে কাঠের গায়ে বসে গিয়ে আটকে গিয়েছে। যেখানে-যেখানে এইভাবে আটকেছে, সেই-সেই জায়গায় তাকালেই বুঝবি, বাঁদাটা ভাঙা।
র্যাদা ভাঙা!
হ্যাঁ, ফলাটার মাঝখানে সামান্য ভাঙা ফাঁক আছে। সেই ফাঁকা জায়গায় কাঠ কাটেনি– উঁচু হয়ে রয়েছে।
ভারি আবিষ্কার করলি! বললাম তাচ্ছিল্যের সুরে, তোর আগেই ফোরেনসিক এক্সপার্টরা ও জিনিস দেখেছে। তারা নিশ্চয় ঘাস কাটেন না।
না, না, ঘাস কাটবেন কেন।–এমনি বললাম। নন্দনের হদিশ কি আর ওই ভাঙা ব্ল্যাদা থেকে বেরোবে।তাই মাথা ঘামাননি।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠস্বর শুনলাম পেছনে, ইন্দ্রনাথবাবু, তাহলে কি খোকাকে পাওয়া যাবে না?
রবিনবাবুর স্ত্রী। নন্দনের গর্ভধারিণী। নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে।
ইন্দ্রনাথ বললে, দেখুন আমার যথাসাধ্য আমি করব। তার আগে বাড়ির সবাইকে দেখতে চাই।
কুন্দনকে ডাকব?
ডাকুন।
আয়নার মতো চকচকে মার্বেল মেঝের ওপর শুভ্র নগ্ন পা ফেলে একজন সুদর্শন তরুণ এসে দাঁড়াল সামনে। বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি নয়। সুকুমার মুখশ্রী। গড়ুর নাসিকা। সুদীর্ঘ চোখ। কৃষ্ণকালো মণিকায় সুগভীর ব্যঞ্জনা। দীর্ঘদেহী কন্দর্পকান্তি এই তরুণ যে শিল্পচেতনায় উদ্বুদ্ধ তার প্রমাণ ওই চোখে। বেশভূষা সাদাসিধে। খদ্দরের ঢিলেহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি। এই হল রবিনবাবুর প্রথমপক্ষের সন্তান। মাত্র এক বছরের শিশুকে আয়ার হাতে সঁপে দিয়ে তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন কর্কট রোগের আক্রমণে।
অপরিসীম মাতৃস্নেহ দিয়ে শিশু কুন্দনকে কৈশোরের সিংহদ্বারে নিয়ে এসেছিলেন এই আয়া। নাম সুচরিতা। কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করেছিলেন রবিনবাবু আয়াকে স্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত করে। কুন্দনের বয়স তখন পনেরো। নন্দন এল বছর ঘুরতেই। সমান স্নেহ দিয়ে নন্দন আর কুন্দনকে সিঞ্চিত করে চললেন সুচরিতা। গর্ভধারিনী নন বলেই বরং কুন্দনের প্রতি তাঁর স্নেহ বর্ষিত হল একটু অধিক পরিমাণেই।
পাঁচ বছরের সেই নন্দনই দুদিন আগে নিখোঁজ হয়েছে। তার মায়ের ঘর থেকে। মই বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠেছে কিডন্যাপার। সুচরিতাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। নন্দনকে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে বৃষ্টিঝরা অমানিশায়।
রেখে গিয়েছে শুধু একটি চিঠি। কয়েক লাইনের বাংলা চিঠি। তাতে লেখা?
অ্যানথ্রপলজিস্ট স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন ফিংগ্রারপ্রিন্টের প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছিলেন ভারতবর্ষে। ড্যাকটিলোগ্রাফি আজকে একটা মস্ত বিজ্ঞান। কিন্তু ওপথে আমাদের ধরা যাবে না। আঙুলের ছাপ রইল না কোথাও। নন্দনকে ফিরিয়ে দেব শুধু টাকার বিনিময়ে। দশ লাখ কি খুব বেশি হল? কালো টাকার পাহাড় জমিয়েছেন মনে নেই?
বৈভব যদি অধিক প্রিয় হয়, নন্দনের লাশ ফেরত দিয়ে যাব। আর যদি তা না চান তো বাগানের রাধাচূড়ায় একটা সাদা কাপড় ঝুলিয়ে রাখবেন সামনের পূর্ণিমায়। টাকা সংগ্রহ করব পরে। আমরা বিজ্ঞান-জানা তরুণ দল। গোয়েন্দাও বটে। থানা পুলিশ করলে টের পাব পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। লাশ পাবেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে।
ইন্দ্রনাথ তাই প্রথমে জিগ্যেস করেছিল, এই চিঠি পাওয়ার পরেও থানা পুলিশ করলেন? আপনার সাহস তো কম নয়?
রবিনবাবু শুকনো হেসে বলেছিলেন, প্রশংসাটা সুচরিতার প্রাপ্য। আমার চেয়ে ওর মনের জোর বেশি। এই দেখুন না, পুলিশ প্রকারান্তরে আমাকে দশ লাখ টাকা দিতে বলায় সুচরিতাই টেনে এনেছে আপনার কাছে।
সেই সুচরিতা আর কুন্দন দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে। ধাত্রীজননীর গা-ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে কুন্দন, যেন মহীরুহের পাশে লতাটি।
চোখ মুছে সুচরিতা বললেন, এই আমার বড় ছেলে কুন্দন। বড় ভালো ছেলে। স্কুলে কখনও সেকেন্ড হয়নি। এখন ঢুকেছে আর্ট কলেজে।
ইন্দ্ৰনাথ শুধু বললে, দেখেই বুঝেছিলাম।
কুন্দন মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেটি প্রকৃত শিল্পী। অন্তর্জগত নিয়েই তন্ময়।
সুচরিতা গর্বিত সুরে বললেন, ওর স্টুডিও দেখলে আপনার তাক লেগে যাবে। একাই একশো। কখনও কুমোর, কখনও পটুয়া, কখনও ছুতোর। সবরকম হাতের কাজের ব্যবস্থা আছে। একতলায়।
একতলায়?
হ্যাঁ, ওইখানেই ওর স্টুডিও। ছেলের আমার বন্ধু টন্ধু তেমন নেই। দিন রাত ওই স্টুডিওতেই মাটি ডলছে নয় তো তুলি চালাচ্ছে, অথবা ব্ল্যাদা ঘষছে।
র্যাঁদা শব্দটা শুনেই আপনা হতে আমার চোখ নেমে এল পায়ের কাছে রাখা মইয়ের দিকে।
ইন্দ্রনাথ হেসে বললে, তা হলে তো স্টুডিওটা একবার দেখে আসতে হয়।
মৃদু আপত্তির সুরে কুন্দন বললে, বড় নোংরা সেখানে–।
হোক। তবুও স্টুডিও তো।–তোমার আপত্তি না থাকলে–
না, না, আপত্তি কীসের! আসুন।
নিখোঁজ নন্দনের তদন্তে এসে শিল্পী কুন্দনের শিল্পপ্রতিভা নিয়ে ইন্দ্রনাথের হঠাৎ আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেনি। র্যাদা শব্দটি ওর মনেও সাড়া ফেলেছে নিশ্চয়।
একতলায় পশ্চিমদিকের একটি বড় ঘর। জানালার পাশেই রাধাচূড়া। ঘরের এক দেওয়ালে আলমারি ঠাসা বই। টেবিলের ওপর হ্যান্ডব্যাগের খোপে কমপ্লিট ডু-ইট-ইওরসেল ম্যানুয়েল। আর একদিকের দেওয়ালে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন সাইজের তুলি, রঙের শিশি, ছুতোরের যন্ত্রপাতি। আরেক দেওয়ালের গায়ে কাঠ আর মাটির স্তূপ। ঘরের মাঝখানে ইজেল আর কুমোরের চাকা, ছুতোরের বেঞ্চি, আর একটা অর্ধসমাপ্ত মৃন্ময় মূর্তি।
বিমুগ্ধ বিস্ময়ে চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে বললে ইন্দ্রনাথ, বাঃ! কুন্দনের দেখছি বহুমুখী প্রতিভা।
পুত্রগর্বে গর্বির্তা সুচরিতা বলে উঠলেন, কাঠের চেয়ারবেঞ্চি আর মাটির মূর্তি বানিয়ে ও কী করে জানেন?
কী?
বিক্রি করে। সেই টাকা অন্ধদের স্কুলে দান করে।
এবার আমিও বিস্মিত হলাম। এ যে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। বাপ কালো টাকার হিমালয় রচনা করেছেন–ছেলে প্রায়শ্চিত্ত করছে নিজের গতর দিয়ে।
কুন্দন মাথা হেঁট করে বললে, মা তুমি থামো।
সস্নেহে কুন্দনকে ধমকে উঠলেন সুচরিতা, তুই থাম।
স্মিতমুখে মা ছেলের কথা শুনতে-শুনতে যন্ত্রপাতির তাকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ। আমার চোখ নিমেষে অনুসরণ করল ওকে। সর্বাগ্রে একটি ব্ল্যাদা তুলে নিয়ে উলটেপালটে দেখল ইন্দ্রনাথ। সব শেষের রাদাটির ফলার পানে অনিমেষে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর গেল বিপরীত দিকের দেওয়ালে। সেখানে কাঠের স্তূপ আর মাটির গাদা। শিকারি কুকুর যেমন গন্ধ শুঁকে-কে খরগোসের কান টেনে বার করে, বন্ধুবরও সন্ধানী চোখে তাকিয়ে কাঠের গাদা থেকে টেনে তুলল এক টুকরো কাঠ। বিলিতি পাইন কাঠ। কাঠটার গায়ে কতকগুলো পেরেকের ফুটো। ফুটোগুলো যে প্যাটার্নে রয়েছে, সেই একই প্যাটার্নে পেরেকের ফুটো একটু আগেই আমি দেখে এসেছি দোতলায় রাখা কাঠের মইতে। ওপরের ধাপের কাঠটা কেটে নেওয়া হয়েছে এই কাঠ থেকেই।
চোখ তুলল ইন্দ্রনাথ। ধীরে-ধীরে পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল মুখ। বললে মৃদু কঠিন কণ্ঠে, ছিঃ কুন্দন! সম্পত্তির লোভটাই বড় হল! কোথায় রেখেছ নন্দনকে?
কুন্দন যে গুডি টাইপের গুড বয় নয়, তার প্রমাণ পেলাম পরক্ষণেই। আস্ত একটা ভিজে বেড়াল। এতক্ষণ মাথা হেঁট করে থাকা শান্ত মানুষটাই নিমেষে যেন জ্বলে উঠল। ইন্দ্রনাথের মৃদু কঠিন কণ্ঠের তীব্র শ্লেষ যেন সেই, দেশলাইয়ের আগুন। ছুঁয়ে গেল বারুদের স্তূপ। ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো টান-টান চেহারায় কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পরেই ঘৃণাকুটিল কণ্ঠে শুধু বললে, আপনি… আপনি।
বলেই লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল যন্ত্রপাতির দেওয়ালের সামনে, খপ করে তুলে নিল একটা তুরপুন এবং ছোরার মতো উঁচিয়ে তেড়ে এল ইন্দ্রনাথের পানে।
চকিতের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল ইন্দ্রনাথের দেহ। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে কুন্দনকে জাপটে ধরলেন সুচরিতা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললেন, কুন্দন! কুন্দন!
মা! হাঁফাচ্ছে কুন্দন, তুমি ছাড়ো—
কুন্দন! শেষে তুই!
মা!
কুন্দন! বলতে-বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন সুচরিতা।
পাথর হয়ে গেল কুন্দন। শিথিল হাত থেকে খসে পড়ল তুরপুন।
মা…আমি….আমি!
নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন সুচরিতা।
ঝড়ের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল কুন্দন। যাওয়ার সময়ে বিষদৃষ্টি হেনে গেল ইন্দ্রনাথের পানে।
চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন সুচরিতা।
কাছে গিয়ে নিবিড় কণ্ঠে বললে ইন্দ্রনাথ, রবিনবাবু উইল করে ফেলেছেন নিশ্চয়?
ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন সুচরিতা।
কাকে কত দিয়েছেন?
অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বললেন সুচরিতা, দশ আনা ছআনা। মা নেই বলে দশ আনা কুন্দনকে। তাতেও ও খুশি নয়। ছআনার লোভে ছোট ভাইকে–বলতে-বলতে চোখ থেকে আঁচল নামিয়ে বললেন, খোকাকে পাব তো?
নিশ্চয় পাবেন। আপনিই তাকে ফিরিয়ে আনবেন।
আমি! আমি কী করে জানব–!
জানেন বইকি সুচরিতা দেবী, অদ্ভুত স্বরে বললে ইন্দ্রনাথ।
কী বলছেন–?
স্ক্রু-প্যাঁচালো চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ। তারপর খপ করে ছুতোরের টেবিল থেকে পেনসিল তুলে নিয়ে খসখস করে লিখল সাদা দেওয়ালে..
দু-টুকরো স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল সুচরিতার গোলগাল ফরসা মুখের অক্ষিগহ্বরে।
.
ইন্দ্রনাথ কী লিখল দেওয়ালে?
।মাতৃস্নেহের চরম পরীক্ষা এসেছিল ধাত্রী জননীর জীবনে–উইল লেখবার সময়ে। নাড়ী ছেঁড়া ধনকে সব পাইয়ে দেওয়ার অভিলাষে ছোট্ট একটি চক্রান্ত করেছিলেন সুচরিতা। রবিনবাবুর মন যাতে প্রথম পুত্রের ওপর বিষিয়ে যায়, তাই লোক লাগিয়ে নন্দনকে কিডন্যাপ করিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্যে। ক্লোরোফর্মে বেহুশ হয়ে শুয়েছিলেন নিজে নিজে। ভাড়াটে কিডন্যাপার আঙুলের ছাপ কোথাও রাখেনি–কিন্তু মইটি রেখে গিয়েছে। মই মেরামতের টুকরো কাঠটিও রেখে দেওয়া হয়েছিল কুন্দনের স্টুডিওতে–ওরই র্যাদা দিয়ে চাচা হয়েছিল মইয়ের কাঠ। স্বামীকে সুচরিতাই জোর করে পাঠিয়েছিলেন থানায়। থানা আমোল না দেওয়ায় ইন্দ্রনাথের কাছে। সূত্র প্রমাণগুলো রহস্যসন্ধানীর চোখে ধরা পড়লেই ভাড়াটে কিডন্যাপারকে দিয়ে ফিরিয়ে আনত নন্দনকে।
কিন্তু ইন্দ্রনাথের খটকা লাগল ছেলের লাশ দেখবার ঝুঁকি নিয়েও থানা পুলিশ ডিটেকটিভদের শরণাপন্ন হওয়ার আগ্রহ দেখে। আগ্রহটা একা সুচরিতারই। মায়ের জাত তো এরকম হয় না।
তাই দেওয়ালে লিখল ইন্দ্রনাথ–পেটের বাচ্চা আর সতীন কাটা কখনও সমান হয়?
* দক্ষিণী বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত। (শারদীয় সংখ্যা, ১৯৭৭)